বকুলতলা
২৯.
ক্ষুধার চোটে ঘুমটা পুরোপুরি হলো না তরীর। ঘড়িতে তখন ভোর পাঁচটা। বাড়ির কেউই এখনো ঘুম থেকে উঠেনি। তরী আলসেমী কাটিয়ে বিছানা ছেড়ে দাঁড়াতেই আয়নার দিকে চোখ পরলো। মুখটা তেলতেলে হয়ে আছে। চোখদুটো ফুলে একাকার। সে তো রাতে কাঁদেনি। বেশি ঘুমায়ও নি। চোখদুটো এভাবে ফুলে আছে কেন? নিজেকে দেখতে কেমন অসুস্থ, অসুস্থও লাগছে। যেন কতকাল হাসপাতালের দারে দারে দৌঁড়েছে সে! শ্যামবর্ণের চামড়া ফ্যাকাশে হয়ে শ্বেতরোগের মতো লাগছে। তরী তপ্ত নিশ্বাস ফেলে মুখটা ধুঁয়ে নিলো। ওড়না জড়িয়ে আস্তে করে ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে পরলো।
চারপাশটা এখন সুনশান নিরবতায় ঘিরে আছে। তরী পা টিপে টিপে রান্নাঘরে এগোলো। ফ্রিজ খুললো। কিন্তু ফ্রিজে খাওয়ার মতো কিছু নেই। একপাশে শুধু ভাতের বড় প্লেট আর মাছের তরকারি। এই সকাল বেলা তরীর এসব খেতে ইচ্ছে করছে না। নিজের জন্য সে ছটপট নুডলস রেঁধে নিলো। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতেই দেখা হয়ে গেল প্রণয়ের সাথে। একেবারে ফর্মাল ড্রেস-আপে ঘর থেকে বেরিয়েছে লোকটা। তরীকে দেখে একটু থমকালো যেন। তারপর মুচকি হেসে বললো, “কেমন আছেন?”
প্রণয়কে তরীর পছন্দ না। আগে থেকেই। ছোটবেলার যেটুকু স্মৃতি মনে আছে, সর্বদা গম্ভীর হয়ে থাকতো প্রণয়। তাদের সাথে মিশতো কম। কিংবা একেবারেই না। এখানে এসে যাও একটু কথা বললো, সব অতীত নিয়ে! কিন্তু এখন, এই মুহুর্তে প্রণয়ের কৃত্রিম মলিন হাসিটা তাকে দ্বিধায় ফেলে দিলো কথা বলার জন্য। অকারণেই মায়া জাগলো। আমতা আমতা স্বরে জবাব দিলো, “ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?”
—“আছি।”
—“আপনি কি কোথাও যাচ্ছেন?”
—“হ্যাঁ। হস্পিটালে ইমার্জেন্সি কাজ পরে গেছে। এক্ষুণি যেতে হবে।”
তরী হালকা মাথা কাত করে সায় দিলো। সে ভেবেছিলো প্রণয়কে নাস্তার জন্য বলবে। কম সময়ে একটুখানি চা বানিয়ে হলেও দেয়া যাবে। কিন্তু প্রণয়ের কথা শুনে মনে হচ্ছে, তার হাতে একদমই সময় নেই। খাওয়ার সময়টুকুও না। তাই এ বিষয়ে আর কিছু বললো না ও। ঠোঁটে জোড়পূর্বক হাসি টেনে চলে যেতে নিলেই প্রণয় হঠাৎ শুধালো, “আপনার চোখ ফোলা কেন তরী? সারারাত কেঁদেছেন?”
—“না। কাঁদবো কেন? এমনি ফুলে গেছে।”
প্রণয়ের বিশ্বাস হলো না একদমই। সে কেমন গভীর দৃষ্টে চেয়ে চেয়ে দেখলো সামনের মেয়েটাকে। পরখ করে নিলো বিশেষ কিছু। এরপর নিঃশব্দে শ্বাস ফেলে আবারও জিজ্ঞেস করলো, “আপনি কি আমার ওপর রেগে আছেন?”
তরী একটু করে মাথা তুললো। ক্ষণিকের জন্য। ভ্রু ক্রুটি করে বললো, “আমি কেন রেগে থাকবো?”
—“ওইযে? আপনাকে ভালোবাসি বলেছিলাম?”
—“আপনার ইচ্ছে হয়েছে বলেছেন। আবার ইচ্ছে হলে অতীত টেনে আনবেন। এতে আমি রাগ করবো কেন? রাগ করলে কি আপনার স্বভাব পাল্টাবে?”
স্পষ্ট খোঁচা! ভেতরটা অগ্নিগি’রির দা’বানলে ঝল’সে গেল যেন। ধুকধুক শব্দের আন্দোলন থেমে গিয়ে দুঃখের আহাজারি করে উঠলো। চেঁচালো মন, মস্তিষ্ক। প্রণয় নিজেকে এতটা অসহায় বোধহয় কখনো অনুভব করেনি। সে তার অনুভূতি প্রকাশে ব্যর্থ। এই ছোট্ট মুহুর্তে দাঁড়িয়েও ব্যর্থ। করুণ নির্লিপ্ততা নিয়ে প্রণয় সুপ্ত অভিযোগ জানালো, “আমাদের কথোপকথনটা কেন ঝগড়াতেই থেমে যায় তরী? কখনো গভীর দৃষ্টিতে আমাকে তাকিয়ে দেখেছ? এক সমুদ্র ভালোবাসা না পেলেও তোমার জন্য পাওয়া আমার এক আকাশ কষ্ট ঠিকই দেখতে পেতে।”
অথচ কথাগুলো বলা হয় না। নির্জন রাস্তায় বিক্রি করা প্রশান্তিগুলো সে আজও কিনতে পারেনি। রিকশায়, গাড়িতে তার পাশের ফাঁকা জায়গাটা শূণ্য হয়েই থাকে। প্রণয়ের বুকটা এত বাজে ভাবে ভারী হয়ে আসে! তার আর কিচ্ছু ভালো লাগে না।
–
টং-এর দোকানে রেডিও চালু করে রাখা। মৃদু শব্দে একটা পুরোনো গান বাজছে। দোকানের কাঠের বেঞ্চিতে বসে থাকা কিছু যুবক সমান তালে গলা উঁচিয়ে উঁচিয়ে গাইছে গানটা। দোকানের চাচা পান খাওয়া লাল লাল ফোকলা দাঁতগুলো বের করে হাসছেন। মহানন্দে চা বানাচ্ছেন। মাঝে মাঝে যুবকদের সাথে গলা মিলিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে তাল মিলাচ্ছেন। আশপাশে কি সুখ, সুখ মনোভাব! তরীর ভালো লাগলো খুব। মন ফুরফুরে হয়ে গেল। গেট মাড়িয়ে আসতে আসতে যতটুকু শোনা যায়, কান খাড়া করে ওদের আনন্দের সুর শুনলো। এক কদম, দুই কদম, তিন কদম। আচমকা মাহাদের ত্যাড়া কথা শোনা গেল, “তোমাকে এখন ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেই তরী?”
তরী আঁত’কে উঠলো। নেত্রজোড়া বড়োসড়ো করে তাকাতেই ভড়কালো জোরেসোরে। মোটরসাইকেলে বসে নেতা নেতা ভাব নেওয়া এলোমেলো মাহাদকে হঠাৎ পরিপাটি বেশে দেখে হজম হলো না। মাহাদ অমায়িক হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গালের গুন্ডাদের মতো দাঁড়িগুলো একটু ছেটেছে। উষ্কশুষ্ক চুলগুলো সুন্দর করে একপাশে আঁচড়ানো। সাদা শার্টের বুক বরাবর একটা আইডি কার্ড ঝুলছে। তরীর চোখ সরলো না। আশ্চর্য চোখে চেয়েই শুধালো, “আপনার কি হয়েছে?”
—“আমার কি হবে?”
—“আপনাকে ঠিক লাগছে না।”
মাহাদের কপালে গুটিকয়েক ভাঁজ পরলো। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য। পরপরই মাছি তাড়ানোর মতো করে বললো, “আমাকে তোমার কখনই-বা ঠিক লাগে?”
তারপর খানিক্ষণ সময় নিয়ে তরীর মুখশ্রী আগাগোড়া দেখে নিলো। হতাশ কণ্ঠে আবার বললো, “খানা দানা কিছু খাও না? মুখের এই অবস্থা কেন? বলেছিলাম আমাকে বিয়ে করতে। করো নি। নয়তো এতদিনে একটা সুখবর পেয়ে মোটাসোটা হয়ে যেতে।”
তরী কি রেগে গেল? রেগেমেগে এখন মুখটা কি ভীষণ লাল করে ফেলবে? নাহ্! মুখটা লাল হলো না। কিন্তু ভীষণ রেগে কটমট নয়নে তাকালো মেয়েটা।
—“আপনি কি কখনো শুধরাবেন না বলে শপথ নিয়েছেন?”
—“তুমি তো আমাকে ভালোবাসো না। শুধরে কি করবো?”
—“আমি আপনাকে কখনোই ভালোবাসবো না মাহাদ। কেন বুঝেন না? এত বেহায়াপনা কেন করেন? মিনিমাম সেল্ফরেস্পেক্টটুকুও নেই?”
আরও একদফা হতাশ হয়ে ধীরে ধীরে আটকে রাখা নিশ্বাসটা একটু একটু করে ছাড়লো মাহাদ। কথাটা গায়ে লেগেছে খুব। কিন্তু প্রতিক্রিয়ার বেলায় মাহাদ নিত্যান্তই বেহায়া, আত্মসম্মানহীন। হাত বাড়িয়ে তরীর হাতটা টেনে মোটরসাইকেলের কাছে নিয়ে গেল। খুব শান্ত স্বরে বললো, “চলো, বাসায় পৌঁছে দিবো।”
—“আমি আপনার সাথে যাবো না।”
—“আমি তবুও নিয়ে যাবো।”
—“আপনি এমন অসহ্য কেন?”
—“তুমি অসহ্য চোখে দেখো বলেই হয়তো।”
—“আপনি বলেছিলেন, আমি যদি আপনাকে চলে যেতে বলি তাহলে আপনি চলে যাবেন। আর আমার সামনে আসবেন না।”
—“কিন্তু কথাটা তুমি মন থেকে বলছো না তরী। আগে বলো। তারপর চলে যাবো।”
এপর্যায়ে তরী বিস্ময়ে আর কিছু বলতে পারলো না। বিমূঢ়, ধৈর্যহারা হয়ে চুপ হয়ে গেল। মাহাদ আসলে কিসের তৈরি? কোনোভাবেই ভেঙ্গে ফেলা যায় না কেন একে? বরং তরী নিজেই ভেঙ্গে যাচ্ছে। ভেঙ্গে গুড়িয়ে নিঃশেষ হচ্ছে।
—“আকাশের দিকে তাকাও তো তরী।”
মাহাদের আদেশে ভরপুর কণ্ঠ। তরী মুখ তুলে তাকালো। দেখলো, একঝাঁক সাদা মেঘেদের। মন ভালো করা নীল, সাদা রঙদের। প্রশান্তিদের। মাহাদ প্রশ্ন করলো, “কি দেখতে পাচ্ছো?”
—“শান্তি।”
—“আমি কি দেখতে পাচ্ছি জানো?”
তরী অল্প মাথা নাড়ালো। সে জানে না। দৃষ্টি তখনো আকাশপানে কঠিনভাবে স্থির। মাহাদ বলতে রইলো, “আমি আমাদের বিচ্ছেদ দেখতে পাই তরী। তোমাকে হারিয়ে ফেলার পর আমার পরিণতি দেখতে পাই।”
হুট করেই আকাশ থেকে পাওয়া প্রশান্তি আর অনুভব করতে পারলো তরী। বিষাদে ভরে গেল ভেতরটা। কথা ঘুরাবার জন্য বললো, “আপনার গলায় এটা কিসের কার্ড?”
—“অফিস থেকে দিয়েছে।”
তরী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “অফিস মানে?”
—“খুঁজে খুঁজে একটা চাকরি নিয়েছে। সাংবাদিকতার।”
—“আপনি সাংবাদিক?”
মাহাদ তরীকে মোটরসাইকেলে বসতে ইশারা করে বললো, “আমার খবর তো কিছু রাখো না। তাই না জানাটাও স্বাভাবিক। আমার সাংবাদিকতা ভালো লাগে। ওই সাবজেক্টেই পড়ালেখা শেষ করেছি।”
___________________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা