#ইচ্ছের_উল্টোপিঠ
#শেষ_পর্ব
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
সময়টা প্রায় সন্ধ্যা। আকাশের রং লালাভ কালো ধারণ করেছে। একটা খোলা মাঠে হাত পা বেধে ফেলে রাখা হয়েছে মহেন্দ্রলালকে। আজ বিকেলের দিকে তার গাড়ি শুদ্ধ তাকে কিডন্যাপ করেছে জুভান।
মহেন্দ্রলালের মুখ বাঁধা থাকায় শুধু গুঙিয়ে যাচ্ছেন। বারবার চোখ রাঙিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অনলের দিকে তাকাচ্ছেন। যেনো একবার ছাড়া পেলে অনলের আর রক্ষা থাকবে না।
— “হেই, মিস্টার লাল? ”
জুভানের কণ্ঠ শুনে মহেন্দ্রলাল সামনে তাকালো। জুভান মাথা নিচু করে হাতে হকিস্টিক ঘুরাতে ঘুরাতে তার দিকে এগিয়ে আসছে। জুভানকে দেখে মহেন্দ্রলালের আত্মা শুকিয়ে খা হলো। বাবার মুখে জুভানের মারাত্মক আচরণের কথা শুনেছে সে। আর আজ! আজ না জানি কি থেকে কি করে ফেলে ওকে?
জুভান ধীরে সুস্থে হকিস্টিক নিয়ে মহেন্দ্রলালের সামনে চেয়ার টেনে বসে পড়লো। তারপর শীতল গলায় বললো,
— ” তোকে এখানে কেনো আনা হয়েছে জানিস? ”
মহেন্দ্রলালের মুখ খুলে দেওয়া হলো। সে চোখ লাল করে বললো,
— ” ওই মাইয়ার লাগি। ”
— ” না। ”
— ” তাইলে কিয়ের লাগি? ”
জুভান তীক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে বললো,
— ” আশরাফুল হককে চিনিস? পুলিশ অফিসার? ”
জুভানের ঠোঁটে হিংস্র হাসি। আশরাফুল হক এর কথা শুনে মহেন্দ্রলাল এক ঢোক গিলেন। জুভান বলে,
— ” কি? মনে পড়েছে? ”
মহেন্দ্রলাল তাড়াহুড়ো করে মাথা নাড়ালো। যার অর্থ সে চিনে না। জুভান এবার হুট করে হকিস্টিক দিয়ে মহেন্দ্রলালের পায়ে জোরে আঘাত করলো। সঙ্গেসঙ্গে মহেন্দ্রলাল ” ও আল্লাহ” বলে আর্তনাদ করে উঠলো। জুভান এবার চেয়ার থেকে উঠে এলোপাথাড়ি মহেন্দ্রলালের শরীরে হকিস্টিক দিয়ে আঘাত করতে লাগলো। আর মহেন্দ্রলাল ব্যাথায় ছটফট করতে লাগলো। জুভান একবার পায়ে আঘাত করছে ত আরেকবার হাতে। আঘাতের কারণে মহেন্দ্রলালের শরীর মুচড়ে যাচ্ছে। সে হাত জোড় করে মাফ চাইতে লাগলো জুভানের কাছে। জুভান এখন নিজের মাঝে নেই। একের পর এক আঘাত করতে লাগলো আর চিৎকার করে বললো,
— ” এই আঘাত ঐশীর থাপ্পড় দেওয়ার জন্যে। ”
হকিস্টিক দিয়ে পায়ে মেরে বললো,
— ” এই আঘাত ঐশীকে লাল মরিচ দিয়ে ভাত খাওয়ানোর জন্যে। ”
এবার মাথায় এক জোড়ে হকিস্টিক দিয়ে আঘাত করলো। ” ও আল্লাহ গো! ” মহেন্দ্রলাল এবার মাথার যন্ত্রণায় জ্ঞান হারালেন। জুভান তবুও থামলো না। একের পর এক মাথায় হকিস্টিক দিয়ে আঘাত করতে লাগলো। আর চিৎকার করে বলতে লাগলো,
— ” এই আঘাত ঐশীকে তিন তিনটা দিন পাশবিক কষ্ট দেয়ার জন্যে। ”
অতিমাত্রায় মাথায় হকিস্টিক দিয়ে আঘাত পাওয়ার পর মহেন্দ্রলালের মাথার পাশ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগলো। কিন্তু জুভান এতেও থেমে নেই। পাগলের মত আঘাত করছে মহেন্দ্রলালকে।
অনল পাশে দাঁড়িয়ে থেকে জুভানের এমন পাগলামি দেখে দৌঁড়ে এলো। হাত দিয়ে জুভানকে আটকানোর চেষ্টা করলে জুভান এক ঝটকা দিয়ে অনলকে ধাক্কা দেয়। অনল নিজেকে সামলে বলে,
— ” শান্ত হ জুভান। ও মরে যাবে। ”
জুভান রাগে কাপতে কাপতে বললো
— ” ডু ইউ থিঙ্ক আই ফাকিং কেয়ার অ্যাবাউট ইট? ”
অনল জুভানের হাত আবারও ধরলো। বললো,
— ” ওকে এখন মেরে ফেললে আমাদের প্ল্যান ভেস্তে যাবে। শান্ত হ তুই। ,”
জুভান রাগে হকিস্টিক দূরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। তারপর মহেন্দ্রলালের রক্তাক্ত শরীরের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো।
___________________
হসপিটালের করিডোর দিয়ে অনল মহেন্দ্রলালকে মেডিকেল বেডে করে তাড়াহুড়ো করে নিয়ে আসছে। অনল চিৎকার করে ডাকছে,
— ” ডক্টর? ডক্টর? প্লিজ কাম ফাস্ট। ”
অনলের এমন পাগলের মতন চিৎকারে সবাই রোগী ফেলে অনলের দিকে তাকালো। দুজন ডাক্তার অনলের দিকে এগিয়ে এলে অনল দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বলে,
— ” ডাক্তার, ইনি রাস্তায় এমন রক্তাক্ত পড়ে ছিলেন। উনার অবস্থা আশঙ্কাজনক। প্লিজ কিছু করুন ডাক্তার। ”
ডাক্তার অবাক হয়ে তাকালেন অনলের দিকে। এমন মানবসেবা তিনি আরো কখনোই দেখেন নি সেটা হলপ করে বলতে পারেন। অতঃপর ডাক্তার তাড়াহুড়ো করে মহেন্দ্রলালকে ওটিতে প্রবেশ করালেন।
জুভান একপাশে নিজেকে আড়াল করে দাড়িয়ে সব লক্ষ করছে। একটু পর মন্ত্রী সাহেদুল হক হন্তদন্ত হয়ে হসপিটালে আসলেন। এসেই হসপিটাল মাথায় তুলে নিয়েছেন। তার একমাত্র ভাইপোর এই অবস্থা তিনি মোটেও মেনে নিতে পারছেন না। একজন সিস্টার ঔষধ এর ইঞ্জেকশন ওটিতে নিয়ে যেতে গেলে সাহেদুল হক সিস্টারকে আটকে নানা প্রশ্ন করতে লাগলেন। এরমধ্যে জুভান হাতে গ্লাভস পড়ে বিষযুক্ত ইনজেকশন সেই ট্রেতে রেখে মেডিসিনযুক্ত ইনজেকশন সরিয়ে ফেললো। কাজ শেষ হলেও তাড়াতাড়ি সেই জায়গা প্রস্থান করলো।
প্রায় আধাঘন্টা পর ওটি থেকে ডাক্তার বিমর্ষ হয়ে বের হলো। সাহেদুল হক জলদি ডাক্তারের দিকে এগিয়ে গেলো। ডাক্তার হাফ ছেড়ে বললেন,
— ” সরি, আমরা রোগীকে বাঁচাতে পারিনি। আপনারা লাশ নেওয়ার ব্যবস্থা করুন। ”
সাহেদুল হক স্থির দাড়িয়ে রইলেন ওটির সামনে। ডাক্তার নিজের কেবিনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে আরেকজন ডাক্তারকে বিড়বিড় করে বললো,
— ” বিষ কোথা থেকে আসল সেটাই ত বুজলাম না। কিন্তু মন্ত্রীকে এটা বললে আমার চাকরি যেতে পারে। মিথ্যে না বললে তো আর উপায় ছিল না। রক্ষা করো ভগবান! ”
জুভান অনলের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো। কাজ হয়ে গেছে!
__________________
পরদিন সকালে জুভান আর ঐশী বাইরে বেরিয়েছে। আজ সারাদিন তারা রিকশা চড়বে আর নিজের মত করে সময় কাটাবে। জুভান সবসময়ের মত মুখে মাস্ক আর মাথায় কালো ক্যাপ পরে আছে। রিকশায় উঠে ঐশী জুভানের বাহু আকড়ে ধরে কাধে মাথা রাখলো। বললো,
— ” আমি ভাবতে পারিনি আপনি আমার কাজটা এত সহজে করে ফেলবেন। থ্যানক ইউ। ”
জুভান ঐশীর মাথায় আলতো করে চুমু দিয়ে বললো,
— ” শুধু থ্যাংক ইউ? নাকি আরো বেশি কিছু? ”
ঐশী জুভানের হাতে চাপর মেরে বললো,
— ” একদম অসভ্যতামি করবে না। ”
জুভান ইনোসেন্ট ফেস বানিয়ে ঐশীকে বললো,
— ” এই মাসুম তরুণের উপর তুমি এই অপবাদ দিলে কিভাবে? আমি আর অসভ্যতা? ভেরি ব্যাড। ”
ঐশী লাজুক হেসে জুভানের হাত আরো শক্ত করে ধরলো। মানুষটা একদম লাগামছাড়া। যা মুখে আসে তাই বলে ফেলে। কিন্তু ভালো লাগে। মানুষটা এরকমই থাকুক সবসময়। হাসিখুশি।
জুভান হুট করে বললো,
— ” কালকে তোমার কাছে সেই লকেটটা চেয়েছিলাম কেনো জানতে চেয়েছিলে না? ”
ঐশী তাকালো জুভানের দিকে। চোখ বেটে নিয়ে বললো,
— ” হ্যাঁ। কি করেছেন আপনি ওই লকেট দিয়ে? বাবার লকেট কিন্তু। সাবধানে না রাখলে? ”
জুভান এবার ফোন বের করলো। লাইভ টিভি অন করে ঐশীর দিকে এগিয়ে দিলো। ঐশী কিছুটা অবাক হয়ে ফোন হাতে নিলো। জুভান ভাবলেশহীনভাবে হাত দিয়ে চুল ঠিক করেছে। ঐশী ফোনের দিকে তাকালো। বললো,
— ” কি দেখবো? ”
— ” পাঁচ মিনিট পর একটা খবর দিবে। সেটাই দেখবে। ”
” আবারও পদত্যাগ করেছেন মন্ত্রিসভার একজন গণমান্য সদস্য। তবে সেই পদত্যাগের পিছনে রয়েছে এক কাহিনী। করুন সেই কাহিনী। আজ গণমাধ্যম একটা রেকর্ড হাতে পেয়েছে। যাতে প্রমান সহ বলা হয়েছে মন্ত্রী সাহেদুল হকের কুকীর্তি। মন্ত্রী সাহেদুল হক মেয়ে পাচার কারি এবং আরো অবৈধ ব্যাবসার সাথে জড়িত। এমনকি জানা গেছে বিশিষ্ঠ পুলিশ অফিসার আশরাফুল হকের পরিবারের মৃত্যুর পিছনে তিনি দায়ী। জনগন এতে তুমূল ভাবে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। ভাঙচুর করেছে সাহেদুল হকের বাড়ি, গাড়ি। জনগণের দাবিতে সরকার যাবতজীবন বরখাস্ত করেছেন এই কুখ্যাত মন্ত্রীকে। ”
ঐশীর চোখে পানি এসে গেছে। ওর বাবার প্রতিশোধ শেষ পর্যন্ত পূরণ হয়েছে। সবাইকে শাস্তি দিতে পেরেছে ও। সবাইকে! ঐশীর বুকের উপর থেকে প্রতিশোধের পাথর নেমে গেছে। ঐশী ছলছল চোখে তাকালো জুভানের দিকে। জুভান আঙ্গুল দিয়ে ঐশীর চোখের জল মুছে নিয়ে কপালে চুমু দিলো। ঐশী আবেশে চোখ বন্ধ করলো। জুভান মুখ তুলে বললো
— ” আজ থেকে তোমার মন খারাপের কারণ শেষ, ঐশী। আর যেনো একফোঁটা জল ওই চোখ থেকে না পড়ে। মনে থাকবে? ”
ঐশী কান্নাভেজা চোখ মুছে মাথা নাড়ালো। একটু পর ঐশী অনলকে ফোন দিয়ে এই খুশির খবর জানালো। অনল আর ঐশী দুজনেই এত হাসি হাসি কথা বলছে যেনো কতজনমের বন্ধুত্ব ওদের! জুভান মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলো ঐশীর পানে। কি অমায়িক হাসি !
___________________
এতিম খানার সামনে এসে দাঁড়ালো ওদের রিক্সা। ঐশী আর জুভান নেমে এলো রিকশা থেকে। ঐশী আগে আগেই দৌড়ে গেলো ভিতরে। জুভান মুচকি হেসে মাস্ক খুলে পিছন পিছন আসতে লাগলো।
ঐশী ভিতরে প্রবেশ করতেই একঝাঁক বাচ্চারা খাতা কলম নিয়ে ওকে ঘিরে ধরলো। ঐশী খানিক অবাক হয়ে ওদের দিকে তাকালে বাচ্চারা একসাথে বলে উঠলো,
— ” আফা! অটোগ্রাফ চাই, অটোগ্রাফ চাই। ”
ঐশী মুচকি হেসে দূরে দাড়িয়ে থাকা জুভানের দিকে তাকালো। জুভান মুচকি হাসলে ঐশী লাজুক হেসে মাথা নিচু করলো। বান্দরবন থেকে আসার পথে ঐশী জুভানকে বলেছিল ওর অনেক শখ ,কেউ ওর কাছে অটোগ্রাফ নিতে আসবে। আর আজ! জুভানের জন্যে সেই ইচ্ছা পূরণ হলো। ঐশী মুচকি হেসে একে একে বাচ্চাদের অটোগ্রাফ দিতে লাগলো।
দূরে একটা হিজল ফুলের গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ঐশীকে একনজরে দেখে যাচ্ছে অনল। হ্যাঁ! অনল। ঐশীকে জুভানের সাথে হাসিখুশি দেখে অনলের বুকটা শান্ত হয়ে গেলো। অনল আঙ্গুল দিয়ে চোখের কোণার জল মুছে হাসি হাসি মুখে বললো,
— ” আমি আমার সাধ্যের বাহিরে তোমায় ভালোবেসেছিলাম ঐশী। বন্ধুর ভালোবাসাকে ভালোবাসার মত পাপ জগতে আর কিছু নেই। আমি সেই পাপ করেছি।সমাজের নিয়ম নীতি ভেঙে তোমায় ভালোবেসেছি। তুমি জুভানকে নিয়েই সুখী থাকো। আমি নাহয় তোমার একজন ভালো বন্ধু হিসেবে তোমার পাশে থাকবো। ”
সময়টা পার দ্রুত হলো। কেউ সময়ের হাল ধরতে পারলো না। সময়কে কি কখনোই ছোঁয়া যায়? যদি ছোঁয়া যেত তবে ঐশী পুনরায় সময়কে পিছিয়ে ওর বাবা মাকে বাঁচিয়ে তুলতো। জুভান, অনল, ঐশী আর বাবা মা মিলে কি সুন্দর এক সংসার হতো তাদের। কিন্তু এ তো সম্ভব না! ইশ! যদি আর একবার সুযোগ পেত সব বদলাবার। ঐশী, জুভানের মত প্রেমিক যুগলের গল্প কখনো শেষ হবার নয়। আজন্ম অমর হয়ে রয়ে যায় এই প্রেম কাহিনী।
#সমাপ্ত