#নিনীকা
#পর্ব_১_ও_২
#পর্ব_১
আমি একবার ভাবলাম পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাই; পরে ভাবলাম না থাক! ও মুখ দেখে তো আমার এমনিতেই মন পুড়ে গেছে কতকাল আগে। এখন আবার কেন?
ইলাই প্রথম কথা বললো,
—অভিকের পাপার সাথে কথা হয়েছে তোমার? তুমি হুট করে দেখা করতে এলে যে? আমি ভাবলাম প্রেম উথলে উঠলো কিনা আবার! সব বুঝি বলে দিতে এসেছো?
আমি চুপ করেই থাকলাম।
—বাব্বা, তুমি তো পুরোই মাত করে দিয়েছো দেখছি। টপ হিরো একদম! এবার নাকি ন্যাশনাল এওয়ার্ডও পাচ্ছো! আচ্ছা, এখন নাকি তুমি অনেক বদরাগীও। মিনমিনে বিড়াল থেকে বাঘ। চারটা বডিগার্ড নিয়ে ঘুরছো। আমার বাসায় যখন আসবে বললে, অভিকের পাপা বললো, প্রেস আসতে পারে। সেজেগুজে থেকো।
ইলা হেসেই যাচ্ছে।
আমি প্রসঙ্গ পাল্টালাম।
—তোর ছেলে কোন ক্লাসে?
—-সেকেন্ড স্ট্যান্ডার্ডে উঠবে এই জানুয়ারিতে।
—বাহ্! তোর ছেলে কিন্ত তোর মুখটাই পেয়েছে। তোর জামাই এখন কেমন?
—পুরোপুরি সুস্থ। বুঝাই যায় না, ছ-মাস আগেও ও অসুস্থ ছিল। এখন তো বিজনেসও খুব রমরমা। আমি তো মাঝে মাঝে বলি, এত টাকা দিয়ে আমরা কি করবো? অভিক তো একাই। এত টাকা এই এক ছেলে তো দুবার জন্মালেও শেষ করতে পারবে না।
—আমাকে দিয়ে দে না! আমার তো টাকা নেই।
—উঁহু, ঢং! তোমার তো বিয়েই হলো না। এই যে মুভি টুভি করে টাকার পাহাড় বানালে, তা খাবে কে? বিয়েটা করছো না কেন?
—বউই পাচ্ছি না। পছন্দ করার মতো মেয়ে কি এখন আছে রে? তোর সৌন্দর্যের ছিঁটাফোটাও নেই তো।
ইলা শব্দ করে হাসলো,
—সান্তনা দিচ্ছো না সুখী করছো? সারাক্ষণ সুন্দরী সুন্দরী নায়িকা কোলে করে শ্যূটিং করছো। সারাবছর লাইম লাইটে থাকছো। যার বাসই গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডে সে কিনা সুন্দরী খুঁজে পায় না!
—তোরা দেশে থাকবি কতদিন?
—মাস দেড়েক আছি। বাব্বা, সিগারেটও ধরেছো?তারপরও ঠোঁট এত সুন্দর!
—দেশে আচমকা যে? আবার বেবি এসপেক্ট করছিস নাকি?
—কি করে বুঝলে?
—লেবু পাতা কচলাচ্ছিস দেখে আন্দাজে ঢিল ছুঁড়লাম।
আমার ফোন এলো। ফোনটা আমি মিউট করে রেখে দিলাম। ম্যানেজার এসে আমায় তাড়া দিতে থাকলো।
—স্যার বিকেল চারটায় প্রেস চলে আসবে। পোস্টার লঞ্চের ব্যাপার… আপনি না থাকলে পার্টি ঝামেলা করবে।
—ক্যানসেল করো, যেভাবে মিথ্যা বলতে হয় বলো। যেভাবে পারো স্কিপ করো।
ম্যানেজার বিরক্ত ভঙ্গিতে চলে গেল।
ইলা একটু চাপা গলায় বললো,
—তুমি কি ভালো আছো রওনক ভাই?
আমি সোফা থেকে নেমে নিচে বসলাম।
—ফ্লোরে কেন বসছো? হায় হায়! উঠো উঠো, এত বড় ফিল্মস্টার ফ্লোরে বসে আছে, একটা ছবি যদি কেউ লিক করে দেয়! সর্বনাশ!
—ইলা সেদিন তুই যদি সাহস করে চলে আসতি! কেন এলি না?
ইলা দীর্ঘশ্বাস ফেললো,
—তোমার মা’কে আমার আজীবন ভয় ছিল। কি ভীষণ জেদী উনি! শেষ অবধি যদি উনি সত্যিই তোমাকে বলা কথাটা সত্যি করে দেয়! তোমার বাবাকে তো তুমি দেখোওনি, আর মা’কে যদি হারাও। আমি তো তুচ্ছ একটা মেয়ে! আলাদা একটা মানুষের শরীর মাত্র। আর তোমার মা, তিনি তো তোমার অস্তিত্ব।
আমি টিশার্টের হাতায় চোখ মুছলাম। পাশের টেবিলে টিস্যু বক্স ছিল। ইলা ওখান থেকে টিস্যু নিয়ে আমার হাতে দিলো।
—প্লিজ তুমি যাও। যাও তো রওনক ভাই। যাও….
বলতে বলতে ইলা সজোরে কেঁদে ফেললো।
ও’র স্বামী, ও’র ছেলে দৌড়ে এলো। আমি উঠে দাঁড়িয়ে গেলাম। ইলার স্বামী ইলার কান্নায় অস্থির হয়ে পড়লো,
—ইলু ইলু কি হলো তোমার?
ইলা জোড়ে জোড়ে শ্বাস ফেলতে ফেলতে বললো,
—আমায় রুমে দিয়ে আসো অভিকের পাপা।আমার বাম-পা টা আবার ব্যথা করছে।
ইলার স্বামী আমার দিকে ক্ষমাপ্রার্থনার ভঙ্গিতে তাকালেন। যেন এত বড় ফিল্মস্টারের সামনে তার বউ কেঁদে ফেলে ফাঁসির অপরাধ করে ফেলেছে!
আমি জোর করে হাসার চেষ্টা করলাম।
—ইলার দেখছি বাম পায়ের সেই ব্যথাটা রয়ে গেছে।
আমি গাড়ির দিকে যেতে যেতে ম্যানেজারকে বললাম,
—মিটিংটা আবার রি-স্ট্যান্ড করাও। বলে দাও ঠিক চারটায়’ই পোস্টার লঞ্চ হবে। আমি থাকবো।
গাড়িতে বসে আমি আবার সিগারেট ধরালাম।ম্যানেজার বিনীত ভঙ্গিতে বললো,
—স্যার এটা কিন্তু চারনাম্বার হয়ে যাচ্ছে। প্লিজ ফেলে দিন।
আমি হু হু করে কেঁদে ফেললাম।
ইলা… আমার জীবনের সবথেকে লুকানো গল্পের নাম। আমার ছোট ফুফুর মেয়ে…
#পর্ব_২
ইলা আর আমি সমবয়সী হলেও, ইলা পড়াশোনায় আমার জুনিয়র ছিল। ইলা তখন ইন্টারমিডিয়েট দিয়েছে সবে। আমি অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে। আমরা তখন সিলেটে। আমি এম.সি কলেজে পড়ছি, চুটিয়ে মডেলিং করছি। টিভিসি করছি অল্প বিস্তর। ফিল্মের জন্য স্ট্রাগল করছি। চেহারায় আমার তখনো পুরোপুরি কৈশোর কাটেনি, ম্যাচিউরড কোনো রোল পাচ্ছি না, তাই অভিনয় করা হয়ে উঠছে না। ইলারা তখন ঢাকায়। মা অগ্রগামী স্কুলের টিচার। আপুর গ্র্যাজুয়েশন শেষ। এর মধ্যে আপুর বিয়ে ঠিক হলো। ছেলে এটোমিক এনার্জিতে চাকরি করে। ভালো পাত্র! মা হাত ছাড়া করতে চাইলেন না।
ইলার আর আমার ছোটবেলা থেকে টুকটাক যা ভালো লাগা ছিল তার আনুষ্ঠানিক রূপ পেলো আপুর বিয়েতে। বিয়ের অনুষ্ঠানে আমার দাদু বাদে সব ফুফুরা এলেন। ইলাও এলো। ইলা তখন ডগডগে কচি সুন্দরী, কোমর অবধি চুল, খাড়া নাক, ঘন ভ্রু! পুরো শরীর যেন একটা রোমান্টিক কবিতা।
হলুদের রাতে ইলা আমার ঘরে ঢুকেই বললো,
—দরজা বন্ধ করে আমায় একটু আদর করো তো, রওনক ভাই। তোমার যে আমি আছি, তাতো তুমি ভুলেই গেছ।
আমি দরজা বন্ধ করলাম।
ইলাই আমায় পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। অভিযোগের মত করে বললো,
—মডেলিং কি প্রফেশনালি নিবে রওনক ভাই?
—সুযোগ পেলে তো নিবোই। তবে ফিল্মে অভিনয়টা করতে চাই মন থেকে।
—অভিনয় করতে গিয়ে আবার নায়িকাদের সাথে শুয়ে যাবে না তো?
—আমার যদি শোয়ার সাহস থাকতো, তোর সাথে সেই কবেই…
—আমার নাচ কেমন হলো? দেখি বলো তো নাচ কেমন হলো?
—জঘন্য হয়েছে। একটু পরপর তোর ওড়না সরে যাচ্ছিলো, নাভি দেখা যাচ্ছিলো। সবাই দেখলোও তো!
—ইশ, আমার বাবুটার কি হিংসে! আহালে, আহালে! আর তুমি যে মেয়েদের কোমর ধরে ধরে মডেলিং করছো, তাতে বুঝি আমার রাগ হয় না?
আচ্ছা, তোমার যদি সত্যিই কোনোদিন নাম হয়ে যায়। তখন যদি আমায় ভুলে যাও!
—চুপ করবি? তুই চাস না আমার নাম হোক?
—আমার তো তোমাকেই চাই রওনক ভাই।
সেইরাতেই আমি আর ইলা একটা অত্যন্ত কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। আমরা বিয়ে করবো। আপুর বৌভাতের দিন রাতে লুকিয়ে বিয়েটা করলামও। বিয়ের পরে বাসর কই হবে? এদিকে ইলাদের চলে যাবারও তাড়া। এক বন্ধুকে ম্যানেজ করলাম, সে হোটেলে রুম যোগাড় করে দিলো। বাসা থেকে বের হয়ে রিকশায় উঠতেই ইলা বললো,
—ভয় করছে রওনক ভাই।
—ফিরে যাবো?
—না, থাক চলো!
একটু পরেই ইলা কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো,
—যদি বাচ্চা হয়ে যায়?
এইবার আমি ভয় পেলাম। নিজের ভয় লুকিয়ে বললাম,
—কি ওষুধ টষুধ যেন আছে? খেয়ে নিবি।
ইলা আমার কানের কাছে মুখটা নিয়ে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
—যদি জ্বর টর হয়ে যায়?
—জ্বর হতে যাবে কেন?
—সোমার তো বিয়ের পরদিনই খুব জ্বর হলো।প্রথমবার এসব করলে নাকি জ্বর হয়?
—সোমাটা কে?
—ওই যে আমার নাখালপাড়ার বান্ধবীটা। গত মাসেই যার বিয়ে হলো। তারপর তো পুরো তিনদিনই গায়ে গায়ে জ্বর ছিল।
—কি আজগুবি কথা! এত জ্বরের ভয় ছিল তো বিয়ের জন্য মরে যাচ্ছিলি কেন? এত যন্ত্রণা করবি না তো!
হোটেলের সামনে গিয়ে আমি নামলাম। ইলা ঠায় বসে থাকলো,
—কিরে নামবি না?
—এক পায়ের জুতো পড়ে গেছে।
—কোথায় পড়লো?
—ওই যে, রিকশা যেখানে ঝাঁকি খেলো।
—তখন বলিসনি কেন?
—ভয় করছিলো।
—কাঁদছিস কেন? উফ! তোর জুতোর দাম কি লক্ষ টাকা নাকি?
—রিকশা ঘুড়াতে বলো। বাসায় যাবো, রওনক ভাই।
রিকশাচালকও হাসছে। আমি বিব্রতভাবে রিকশা ঘুড়াতে বললাম।
—একটা জুতোও সামলাতে পারিস না! আর তুই কিনা সারাজীবন আমায় সামলাবি?
ফেরার পথে আমি ইলাকে একজোড়া মোটামোটি দামের স্লিপার কিনে দিলাম। তখন আমার এত টাকা তো ছিল না। পুরো পথটা ইলা আমার কাঁধে মুখ ঘষে ঘষে কাঁদলো।
—-আমাদের যেদিন সত্যিকারের বিয়ে হবে তখন আমরা ঠিক বাসর করবো, রওনক ভাই। তুমি রাগ করো না।
—প্যাঁচপ্যাচানি বন্ধ কর তো। সত্যিকারের বিয়ে মানে! এটা কি মিথ্যামিথ্যি বিয়ে হলো নাকি?
—তুমি অনেক ভালো রওনক ভাই।
—চুপ কর, থাপ্পর খাবি। ২৭৫০ টাকা আমার গচ্চা গেল। এখন আমায় আবার সান্ত্বনা দেওয়া হচ্ছে।
ইলারা চলে গেল। আমি পড়াশোনা, থিয়েটার, আর মডেলিং নিয়ে ব্যস্ত তখন। মাস সাতেক পর ইলা ফোন করলো,
—বাসায় বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে। তুমি সব ঠিক করো। তুমি সব বলো।
—আমি বলবো মানে? আমার কি এখন বলার চান্স আছে? তুই ম্যানেজ কর।
—আমি কিচ্ছু জানি না। আমি কিছু পারবো না।তুমিই বলো। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না।
আমি মহাবিপদে পড়লাম। মা’কে বলবো? নাকি ইলাদের বাসায় বলবো? এমন অবস্থার মধ্যে আছি যে বলতেও পারছি না, সইতেও পারছি না। ইলার ফোন আর কান্নাকাটিতে অস্থির অসহায় হয়ে মায়ের কাছে গেলাম।
ম্যানেজার ডাকলো,
—স্যার, স্যার কি ঘুমিয়ে পড়েছেন? স্যার এসে গেছি, নামুন।
ম্যানেজারের ডাকে আমি সচকিত হলাম। চোখ না খুলেই বললাম,
—কটা বাজে, সোহেল?
—স্যার দুটা পয়ঁত্রিশ! আপনার ফ্রেশ হতে হবে, মেকআপ নিতে হবে। পেছনের চুল ট্রিম করতে হবে।
স্যার আপনার আজকের প্রোগ্রাম কস্টিউম হচ্ছে, নেভি ব্লু টি-শার্ট, একটা ব্ল্যাক জিন্স, সানগ্লাস।
আমার ম্যানেজারটির নাম সোহেল আলাউদ্দিন। সে খুব করিৎকর্মা ছেলে। গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করা অথচ ম্যানেজিং পাওয়ার আর বুদ্ধিতে মনে হয় পি এইচ ডি করেছে। বয়সে আমার সমান হলেও সে আমার নির্ভরযোগ্য গার্ডিয়ান।
আমি বিড়বিড় করে বললাম,
—আমি তিনটা পর্যন্ত গাড়িতেই বসবো। এরপর এসে ডাকবে। তারপর রেডী হবো। এর মধ্যে কোনো ফোন কলস আমি এটেন্ড করবো না। বি কেয়ারফুল।নাউ লিভ!
আমি আবার চোখ বন্ধ করে ভাবনায় ফিরে গেলাম।
মায়ের কাছে গিয়ে তাঁর মুখটা চেয়ে আমি বলতে পারলাম না যে, আমি আর ইলা বিয়ে করেছি। শুধু বললাম,
—মা, আমি ইলাকে পছন্দ করি, ইলাও করে। ও’র বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। মা তুমি বিয়েটা থামাও না।
মা হতবিহ্বল দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ আমায় দেখলেন,
রোবটের মতো গলায় বললেন,
—অনেক বছর আগে আমি যেই ভুলটা করেছিলাম, সেটা জেনেও তুই আমার ভুলটাই করলি?
আমি দিশেহারা হয়ে মায়ের পায়ে ধরে ফেললাম।
(চলবে)