নিনীকা #পর্ব_২৩_ও_২৪

0
381

#নিনীকা
#পর্ব_২৩_ও_২৪

#পর্ব_২৩

রওনক বিচ্ছিরি একটা ভাব দেখিয়ে ঘরে চলে এলো।বিছানায় শুতে শুতে অস্ফুটভাবে বিড়বিড় করতে লাগলো, কথায় কথায় ধাঁধা। কি আমার ধাঁধার সেনাপতি! একটা কিছু শুনতে চাইলেই ধাঁধা। আশ্চর্য!
নিনীকা ঘরে এলো। ল্যাপটপটা গুছিয়ে রেখে একপাশের বাতিগুলো নিভিয়ে বিছানায় বসলো দুই পা ভাঁজ করে রওনক আর তার মাঝে বেশ ফাঁকা রেখে। রওনক তব্দা মেরে কাঠ হয়ে শুয়ে আছে। নিনীকা নিজের মতো করে বলতে থাকলো আবার,
—জানেন সেই খটকা থেকে শুরু। আমার বুকের ভেতরটা সেদিন থেকে কেমন যেন করতে থাকলো। মা-বাবারা সন্তানের যে জিনিসটা সবথেকে বেশি ভালোবাসেন, তা হলো প্রতিভা। অথচ আমার বাবা-মা নয় কেন? আমি কারণ খুঁজতে থাকলাম, পেয়েও গেলাম একসময়। আমার সব ভেঙ্গে গেলো, চুরমার হয়ে গেল। আমার নিজের শরীর, প্রাণ সব প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেল। একমাত্র স্বস্তির জায়গা ছিলো পাপা।
রওনক উঠে বসলো। পানি এগিয়ে ধরলো নিনীকার সামনে। নিনীকা গ্লাসটা হাতে নিলো কিন্তু মুখে দিলো না।
—-পাপাকে জিজ্ঞেস করতেই পাপা আমায় গুছিয়ে বললেন সব। আমি সান্তনা পেলাম, যাক পাপা তো আমার! এবার আমার স্বপ্ন বদলালো। এবার দেখতে লাগলাম, আমার স্বপ্নের মানুষটা আলো হাতে দৌড়ে আসতে আসতে বলছে, চিন্তা নেই তো নিনী। আমি তোমার মা’কে খুঁজে দিবো। কিন্তু আবার একই ব্যাপার; আমার কাছে পৌঁছুবার আগে স্বপ্ন ভেঙ্গে যাচ্ছে। আমি দ্বিধায় পড়লাম আবার। পাপার উপর অগাধ আস্থা ছিল আমার, তাও ভেঙ্গে গেল। পাপা মানুষটাও আমার পাপা না। কোনো কুৎসিত নারীর কুৎসিত বিকৃত ইচ্ছার ফল আমি। আমার কোনো পিতৃপরিচয় নেই। এই এত স্বচ্ছ মানুষের যে পরিবারে আমার ঠাই হয়েছে, তার কোনো হকই নেই আমার।

রওনক কাছে এসে গা ঘেঁষে বসলো নিনীকার। নিনীকা সরে বসলো আরেকটু। বলতে থাকলো নির্বিকারভাবে,
—আমার এত ভালোবাসার পাপাকে আমি কষ্ট দিতে পারি না। সেই রাইট নেই আমার। আমি কম্প্রোমাইজ করলাম। আমি আমার সমস্ত দায়িত্ব নিয়ে আমার মা-বাবাকে ভালোবাসতে শুরু করলাম।বিন্দুমাত্র কষ্ট যেন তাঁরা আমার কাছ থেকে না পায়। আমি পাপার পাতানো গল্প নিয়ে আমাকে আঁকড়ে ধরে তাদের বেঁচে থাকার আকুলতাকে সাপোর্ট ধরে বাঁচতে থাকলাম প্রতিটা ক্ষণ। মানুষ তার রিয়েলিটির সাথে সমঝোতা করে, আমার ক্ষেত্রে রিয়েলিটি দুরস্থান। আমি কম্প্রোমাইজ করলাম জীবনের সাথে। আমার স্বপ্ন আবার বদলালো। এবার সেই আলো হাতের মানুষটা আমায় বলতে লাগলো, ভেবো না নিনী, তোমার নিজের কেউ নেই কে বললো? আমি তোমার নিজের মানুষ খুঁজে দিবো।
রওনক এক দৃষ্টিতে নিনীকার দিকে তাকিয়ে আছে। এত শক্ত কথা এত সহজভাবে কে বলতে পারে? গলার স্বর নিনীকা আরো কোমল করে বললো,
—বুঝলেন নায়ক সাহেব, আমার যখন বিয়ে ঠিক হলো আমি ভাবলাম এবার বুঝি আমার নিজের মানুষ সত্যি এলো। কত স্বপ্ন কত আকাঙ্খা! জোছনার রাতে সে আমার সাথে সপ্তর্ষি দেখা নিয়ে ক্ষ্যাপাবে, বলবে সাত সাতটা বাবু হলে কেমন হয়? আমরা অমন সপ্তর্ষি বানিয়ে ঘুম পাড়াবো ওদের। আচ্ছা, চাঁদের উল্টোপিঠটা কেমন? এমন রূপালি নাকি নীলচে? কিন্তু কি দাঁড়ালো? স্বপ্নে আমার গুড়েবালি! সেই মানুষটা আমার নয়, অনেক বছর আগেই অন্য কারো হয়ে আছে। আমায় পছন্দ করলো তাঁর নিজের মানুষ। আমার কত বাধ্যবাধকতার বেঁচে থাকা দেখেছেন?
নিনীকা গ্লাসের পানিটা মুখে নিলো এবার। অনেক তেষ্টা পেয়েছে তার।
রওনকের নিজেকে নিনীকার কাছে খুব ক্ষুদ্র মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে। চোখের জলে ভেজা গালটা মুছতে মুছতে হাসার চেষ্টা করে নিনীকা বললো,
—-সবার জন্মের পেছনে একটা কারণ থাকে। আমি কেন জন্মেছিলাম বলুন তো? না কারো জন্যে, না কোনো বাঁধনে। শুধু স্বপ্ন দেখতে আর আলো হাতে গহীন অন্ধকারে দৌড়ে আসা মানুষটার জন্য অপেক্ষা করতেই কি আমার জন্ম? সত্যিই কি শেষ পর্যন্ত মানুষটা আমার কাছে এসে পৌঁছুতে পারবে?
রওনক চুপ হয়ে আছে। শব্দ ফুড়িয়ে গেছে আজ তার। সিনেমার নায়ক সে। এতদিন নিজের দুঃখটাকে তার সবথেকে বড় লেগেছে। নিজের দুঃখ কষ্ট লুকিয়ে মনে হয়েছে বাস্তবিকই সে নায়ক। কিন্তু নায়ক তো এখানে অন্য কেউ ‘ডক্টর নিনীকা’!
নিনীকা তার জীবনে আসার আগ অবধি তার মন খারাপ ছিল আর এখন সে নিনীকার মন খারাপের কারণ হয়ে গেছে। উফ্!

—ক’টা বাজে?
রওনক চমকে উঠলো প্রায়।
—হুহ। দুটো প্রায়… ঘুম এসেছে আপনার ডক্টর?
আড়মোড়া ভেঙ্গে শুতে শুতে নিনীকা বললো,
—ঘুম আসলেই যে শুতে হয় কে বললো আপনাকে? শুয়ে পড়লেই ঘুম আসে। আমি ঘুমের জাদু জানি। ওপাশের বাতিগুলো নেভান তো।
—জাদু মানে? সেটা কেমন?
—বলবো না। আপনি তো আমার ধাঁধার উত্তরই দিতে পারেননি।
রওনকের মাথায় হাত পড়লো আবার। এই মেয়েটা এত চমৎকার কেন? সবসময় একটা কৌতুহলের রেশ লাগিয়েই রাখে। এক্ষুণি জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খেয়ে নিলে কেমন হয়? নিমকুচি করি আপনার ধাঁধার! আপনি নিজেই আস্ত ধাঁধা একটা।
রওনক গভীর ভালোবাসায় নিনীকার কোমরের দিকে হাত রেখে কাছে টানলো।
এদিকে না ফিরেই নিনীকা বললো,
—বাহ্, হিরোর কত শক্তি! এক হাতেই টানছে আমায়। হাত সরান, আমি ঘুমোবো। পিড়িত ফিড়িত হবে না কখনো আমার সাথে।
রওনকের হাতটা প্রায় ছুঁড়েই সরিয়ে দিলো নিনীকা।
অনেক রাগ নিনীকার! এত সহজে সে ভালোবাসবে না কাউকে। মনে মনে বললো, আজ আমায় আদর করবেন তো অনেক বছর আগে কাউকে কেন ভালোবেসেছিলেন তবে? আমার কোনো আদর চাই না ডগার-অগা নায়ক।
রওনক এপাশের আলো নেভালো না। নিনীকা পাশ ফিরে শুয়ে আছে। আবছা আলোয় এপাশটা একরকম দেখাচ্ছে, ওপাশের আয়নায় মুখটা অন্যরকম দেখাচ্ছে। নিনীকার অভিমানী মুখটা খুব আদুরে লাগছে দেখতে।
পেছন থেকে নিনীকার কানের কাছে মুখটা নিয়ে রওনক বললো,
—একবার আমায় রাতের ক্লিনিকে ডাক্তাররা কিভাবে ঘুমোয় দেখতে যেতে বলেছিলেন, তা কবে নিয়ে যাবেন আমাকে?
নিনীকা জবাব দিলো না। ঘুম এসেছে তার।

একটু পর ঘুমঘুম চোখে আধো স্বরে নিনীকা বললো,
—-চেঞ্জিং রুমে আমার নীল স্যুটকেসটা আছে। ওখান থেকে আমার মোবাইলা ফোনটা একটু এনে চার্জে দিন তো, পাপা ফোন করবেন সকালে।
রওনক স্যুটকেসটা খুলেই বড়সড় একটা ধাক্কা খেলো। পুর সুটকেসটা খালি। মাঝখানে একটা সুন্দর সোনালী তারা আকৃতির ফ্রেমের সেমি মিনি সাইজের হ্যান্ড মিরর। হাতে নিতেই মনে হলো, একটা আকাশের তারা যেন। হ্যান্ড স্ট্যান্ডটায় পিংক রিবনে একটা কাগজ মুড়িয়ে বাঁধা। রওনক দ্রুত কাগজটা খুললো। তাতে সুন্দর গুটিগুটি অক্ষরে লিখা,
“জীবনের এই চমৎকার শুরুর রাতে এটা আপনার জন্য। নায়কের সবথেকে দরকারি জিনিস, আয়না। এতে যতবার আপনি মুখ দেখবেন, আমি যেখানেই থাকি না কেন আপনার মুখ দেখতে পাবো। এ আমার বিশ্বাস। এই স্টার শেইপ আয়নার একটা বিশেষত্ব হলো, আগের দিনের সম্রাটেরা যুদ্ধে যাবার আগে এমন ধরনের হাত আয়নায় নিজের মুখ দেখে বের হতেন। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, এরকম ধরনের আয়না তাদের জন্য শুভ। যুদ্ধশেষে জয়ী হবার পরও এই আয়নায় প্রথম নিজের মুখ দেখতেন। আরেকটা মজার ব্যাপার হলো… থাক্ মজার ব্যাপারটা আপনিই খুঁজে বের করুন। এই আয়নায় তাকানো আপনার জীবনের প্রতিটা মুহূর্তু হোক সেরা”
শুভরাত্রি।

বিস্ময়ে রওনকের চোখ এত বড় হয়ে আছে। নিনীকা একেবারেই তার মতো ভেবেছে। এই আয়না ঘেরা ঘরটা রওনক নিজেই ভেবেছে। নিনীকাও সেইম! আচ্ছা এই আয়নার মজার ব্যাপারটা কি? রওনক আয়নাটা হাত করে এসে নিনীকার সিথানে বসলো। তার সদ্য বিবাহিতা বউ অঘোরে ঘুমাচ্ছে। রওনক পরম ভালোবাসায় আলতো কর চুমু খেলো নিনীকার নাকটাতে। নিনীকা টেরই পেলো না, হালকা নড়ে উঠলো যেন একটু।
টেনশানে সারারাত রওনক জেগেই থাকলো ভোর হওয়া অবধি। ডক্টর নিনীকা তাকে ভালোবাসবে তো? নিনীকার ভালোবাসা তার চাই-ই-চাই। এই প্রথম ভোর হওয়া রওনকের ভীষণ ভালো লাগলো।
সকালের শুরু করলো সে পরম করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা করে। এর থেকে ভালো সকাল হতেই পারে না।

নিনীকার ঘুম ভাঙলো, সকাল নটায়। জেগেই রওনককে সে প্রথম যে কথাটা বললো,
—পাপা ফোন করেছে? ফোন কই আমার? চার্জে দিয়েছেন কই?
রওনক জবাব দিলো না।এতক্ষণে তার ঘুম আসছে, সে ঘুমোবে এখন। নিনীকা চিন্তিতভাবে মোবাইল খুঁজছে।

#পর্ব_২৪

নিনীকার ফোনে একবিন্দু চার্জ নেই। নিনীকা সিমটা খুলে রওনকের মোবাইলে রিপ্লেস করে নিলো। বাহ্! জামা-কাপড়ও রেডী করা নায়কের! কমপ্লিট, আন্ডারওয়ারসহ! নায়ক বেরুবে তাহলে কোথাও। নিনীকা একটা ছোট্ট কাজ করলো এর মাঝে।
রওনকের ঘুম ভাঙলো দুপুরের দিকে। নিনীকা বেরিয়েছে এর আগেই।

রওনক ধাঁধার উত্তর পেয়ে গেছে, তার এক্ষুণি নিনীকাকে বলা চাই। কিন্তু মোবাইল কই? রওনক রেডী হতে হতে প্রায় চেঁচিয়ে সোহেলকে ডাকলো।
সোহেল হন্তদন্ত হয়ে ছু্টে এলো।
—তোমার ম্যাম কখন বেরিয়েছে? তাকে ফোন করো।আমার মোবাইল কোথায়? আর কাপড়-চোপড়ও তো সব রেডী করোনি ঠিকঠাক। কি হয়েছে বলোতো তোমার? কিছুই ঠিকঠাক পাচ্ছি না।
সোহেল বিছানার এপাশ ওপাশ খুঁজতে খুঁজতে বললো,
—স্যার ম্যাম তো ম্যাডামকে নিয়ে বেরিয়েছেন, ব্রেকফাস্টের পর। মোবাইল ফোন তো আপনার কাছেই ছিল রাতে। আমি রাখিনি। রিংও তো যাচ্ছে না। সুইচড অফ বলছে।
প্রায় আধঘন্টা তন্ন তন্ন করে খোঁজার পরও রওনকের মোবাইল পাওয়া গেল না।
—বাদ দাও সোহেল। বরং সিমটা তোলার ব্যাপারে কথা বলো।
—আপনার অনেক ভেল্যুএবল ডকুমেন্টস ছিল ওতে। যদি বাইরের কারো হাতে পড়ে!
সোহেল চিন্তিত হয়ে আছে। ঘর থেকে মোবাইল যাবে কোথায়? মোবাইল ফোনের তো আর পা নেই যে হেঁটে চলে যাবে!
রওনকের তাড়া আছে। বিকেলে প্রডিউসার ডিরেক্টরদের সাথে হালকা একটা মিটিং আছে। বিয়ের পরদিনই মোবাইল হারিয়ে গেল! এটা কি শুভ?

মিটিং শেষ হবার পরও রওনক প্রায় আধঘন্টা চুপচাপ গাড়িতে বসেছিলো। এসব কি হচ্ছে তার সাথে?
সোহেল কিছু বললেই ধমক খাচ্ছে। ভয়ে সেও কিছু জানতে চাইছে না। স্যারের হয়েছেটা কি? ফেরার পথে রওনকই নিজে থেকে বললো,
—সোহেল ঘটনাতো কিছু বুঝতে পারছি না। সকালে উঠেই মোবাইল হাওয়া। মিটিংএ রুমাল বের করতে ব্লেজারের ইনসাইড পকেটে হাত দিলাম, আন্ডারওয়ার বেরিয়ে এলো। এই দেখো, প্যান্টের পকেটে মোজা। আরেক পকেটে এক স্লাইস পাউরুটি! সব সুন্দর করে ভাঁজ করে রাখা। এসবের মানে কি?
সোহেল বিস্মিত হয়ে হা করে তাকিয়ে আছে।
—স্যার এসব কি বলছেন?
—-এই দেখো সোহেল।
সোহেল নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছে না! কেউ কি স্যারের সাথে মজা করছে? না না স্যারের সাথে কে এমন মজা করবে? ভুত বলে তাহলে সত্যিই কিছু আছে? ও মাই গড!

রওনক বাসায় ফিরে দেখলো নিনীকা ফেরেনি তখনো। সে নিচে ড্রয়িংরুমেই টিভি ছেড়ে সোফায়ই শুয়ে রইলো। নিনীকা ফিরলো আরও আধঘন্টা পরে। রওনক নিনীকাকে দেখে উঠে বসলো। ডক্টর নিনীকাকে চমৎকার লাগছে! বেগুণি ফ্লোরাল প্রিন্টের হোয়াইট জর্জেট শাড়ি পরেছে। সাদা আর রূপালির মিশেলে বর্ডার করা ডিপ ভায়োলেট ফুলহাতা ব্লাউজ। সাথে গলায় লকেটবিহীন লম্বা থিন একটা চেইন। খোলা এলোমেলো চুলে দু এক জায়গায় অগোছালো ক্লিপ করা। হাতে একগুচ্ছ রজনীগন্ধা।
ব্যস অপূর্ব!
—গুড ইভিনিং নায়করাজ। কখন এলেন?
—এই তো মাত্র! বাসা খালি যে?
—কই খালি? দুজন তো আছে, বাকিদের কাজ থেকে ছুটি দিয়ে দিয়েছি। এত লোকের তো কাজ নেই!
স্টিকগুলো ফ্লাওয়ার ভাসটাতে রাখতে রাখতে নিনীকা বললো,
—আপনাকে অনেক সুন্দর লাগছে দুধরাজ। নরম পাউরুটির মতো কোমল দেখাচ্ছে!
রওনক মনে মনে হাফ ছাড়লো। তার মানে এসব কাজ ডক্টর নিনীকাই করেছে।
—আমার প্যান্টের এক পকেটে পাউরুটি তাহলে আপনিই রেখেছেন?
চোখ কপালে তুলে বিশাল অবাক হবার ভঙ্গিতে কপট রাগী গলায় নিনীকা বললো,
—-প্যান্টের পকেটে পাউরুটি মানে! আমার কি মাথা খারাপ? কি বলেন এইসব?
—না ইয়ে মানে… মিটিং গিয়ে পকেটে হাত দিলাম বেরিয়ে এলো।
—কি বেরিয়ে এলো?
—না কিছু না, এমনি বললাম। সকাল থেকে কিছুই ঠিকঠাক হচ্ছে না, মোবাইলও হারিয়ে ফেললাম।
—তাই নাকি? ভুতের কান্ড হতে পারে। দাদীমার ঘরেও ভুত আসতো প্রায়ই। শুনলেন না, ওই যে বিয়ে ঠিক হবার পরও এসেছিলো তো! নাকি সেই ভুতটা বিয়ের পর বাড়ি চিনে আমার শ্বশুরবাড়ি চলে এলো!
ভয়কাতুরে মুখ করে নিনীকা চাপা স্বরে বললো,
—-ভয় করছে আমার!
রওনক সহানুভূতির সুরে বললো,
—আরে না ডক্টর। এমনি মজা করলাম। মোবাইলটাই শুধু পাচ্ছি না।
নিজের সিমকার্ড লাগানো রওনকের ফোনটা বাড়িয়ে ধরে নিনীকা বললো,
—নিন আমার ফোনটা আপাতত ব্যবহার করুন।
দাঁতে জিভ কেটে লজ্জিত হাসি হেসে রওনক বললো,
—না না দরকার নেই। এক্সট্রা তো ফোন আছে আমার ডক্টর।
নিনীকা মনে মনে বললো, ওরে আমার গাধা নায়ক এটা তোরই ফোন।
মুখে বললো,
—মজা করলেই ভালো। পিওর সায়েন্সের মানুষ হলেও ভুতে আমার খুব ভয়!
রওনক হাসিমুখে বললো,
—ধাঁধার উত্তর পেয়ে গেছি ডক্টর। উত্তরটা হলো ‘নদী’।
নিনীকা মিষ্টি করে হেসে রওনকের কাছে এসে দাঁড়ালো। রওনকের মাথার চুলটা নেড়ে দিয়ে বললো,
—উফ চুলে মাকড়সা ঝুল লেগেছিলো। এতক্ষণে ধাঁধা পারলেন?
—সকালেই পেরেছি। আসলে ফোন করে বলতে চেয়েছিলাম।
কাঁধের ব্যাগটা রেখে নিনীকা গ্লাসে পানি নিতে নিতে বললো,
—ফোন করেননি কেন তবে? আমি তো আপনার ফোন ট্রাই করলাম, অফ বললো। ও আচ্ছা হারানো নয় তাহলে চুরি গেছে কনফার্ম।
রওনক জবাব দিলো না।

সিঁড়ির কাছে যেতে গিয়ে ফিরে এসে নিনীকা বললো,
—এটা কিন্তু শ্লীল ধাঁধা। এই ধাঁধাটার একটা অশ্লীল রূপও আছে, একটু এডিটিংয়ের ব্যাপার।একই জিনিসের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নাম। বলুন তো কি? দেশ কথাটা কাটলাম!
রওনক ভ্রু কুঁচকে তাকালো। রাগ উঠছে তার। সে অনেক ভেবে উত্তর বের করলো আর এখন কিনা ধাঁধা এডিট করা হচ্ছে। হুহ।
রওনকের কাছে এসে একটু গলা নামিয়ে বললো,
—এত রেগে তাকাবেন না নায়ক সাহেব। রাগের আগুনে জ্বলে যাচ্ছে আমার শরীর। এই দেখুন ফোসকা পড়ে গেছে হাতে।
রওনক মুখ ফিরিয়ে নিলো।
—আচ্ছা, উত্তর বলে দিচ্ছি। জিনিসটা হলো চুল। মাথায় থাকলে চুল, চোখের উপরে ভ্রু, চোখের পাতায় পাপড়ি, নাকের ভেতরে…
রওনক হেসে ফেললো।
—ডাক্তাররা কি এত দুষ্টুও হয় নাকি?
নিনীকা একটা চোখ মেরে বললো,
—ইয়েস হয়! আন্টিকে আমাদের বাসায় রেখে এলাম। ওখানে সবার সাথে থাকলে ভালো থাকবেন উনি। এখানে একা থাকেন সারাদিন। বুক ফেটে যে মারা যাননি, আল্লাহর কৃপা। আমার ঘরের মালিক করে দিয়ে এলাম। উনি ঠিক করেছেন আমাদের বাড়িতেই বেশি থাকবেন, দাদীমাকে ভীষণ পছন্দ হয়েছে উনার।
সিঁড়ি বেয়ে উপড়ে উঠতে উঠতে নিনীকা গান ধরলো ,
‘আমি তোর ছায়া হবো….
কিছুটা বেহায়া হবো….’

কি অপূর্ব মিষ্টি গলা! রওনক একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার নতুন বিয়ে করা বউয়ের দিকে। নিনীকার পেছন দিকের শাড়ির গুঁজাটা খুলে গেছে। মেজেন্টা পেটিকোট দেখা যাচ্ছে। সিঁড়িতেই নিনীকা শাড়ির পিনটা খুলে নিলো, আঁচল গড়াচ্ছে ফ্লোরে। হঠাৎই থামলো সে। পিছন ফিরে বললো,
—ইলাদের বাসায় গিয়েছিলাম। দুনিয়ার রান্না করে টিফিন ভর্তি করে দিয়ে দিয়েছে সাথে। কাউকে পাঠিয়ে গাড়ি থেকে আনুন তো।
রওনক ব্যস্ত ভাবে সোহেলকে ডাকলো। নিনীকার অর্ধেক খাওয়া পানির গ্লাসটার বাকি পানি খেতে খেতে বললো,
—সোহেল সামনে আমার প্রতিটা নিউ মুভি যেগুলোর কাজ শুরু হবে, সব প্রডিউসারকে ফোন করো। বলো, নিউ একজন ফিমেইল সিংগার প্লেব্যাক করবেন। এক্ষুণি মিউজিক ডিরেক্টরদের সাথে এপয়েন্টমেন্ট কনফার্ম করো তোমার ম্যামের।
সোহেল হতভম্ব হয়ে গেল।
—ম্যামের মানে? ম্যাম কি গান গাইবেন স্যার? উনি কি গান জানেন?
—গান জানে বললে ভুল হবে, গানের রাণী বলতে পারো। তোমার ম্যামকে যদি একবার রাজি করানো যায়, ফাটিয়ে দেবে যাস্ট।
—রাজি কি হবে?
—-ম্যামকে রাজি করানোর প্ল্যান করা আছে। শোনো, তুমি বলবে, তোমার ম্যামের গানের সব টাকা অরফ্যানেজের খরচে যাবে। তাতেও যদি রাজি না হয়, বলবে কিছু দরিদ্র মানুষের চিকিৎসায় দরকার। ভেতরে ভীষণ নরম একটা শিশু মন আছে উনার, ব্যস কাজ হয়ে যাবে। আর শোনো রিসেপশানে খুব অল্প সময় দিবো আমি। সব সামলাবে তুমি। আর গাড়িতে কি খাবার-দাবার আছে নাকি, এনে ডিনার সাজাতে বলো।
সোহেল সন্দেহ আর শংকা নিয়ে ফোন করতে লাগলো প্রডিউসারদের।

রিসেপশান কাটলো খুবই খারাপভাবে। নিনীকা অসুস্থ ছিল। রওনক ব্যস্ততার ফাঁকে অল্প ছিল।
রিসেপশানের পরপরই ইলারা চলে গেল।
এরপরের দিনগুলো সাদামাটা, ছক করা। রওনক গেল লম্বা আউটডোরে। শুটিং ছিল বেশ কিছুদিন।নিনীকাও ব্যস্ত ছিল ভীষণ। বাবার বাড়িতেই ছিল।
গান, ডাক্তারি সব ব্যালেন্স করতে গিয়ে হিমশিম। তবে এই সুযোগে দুজনে একটা জিনিস বুঝছে ভালো করে, তা হলো বিয়ে নামক সম্পর্কের পর দুরত্বের কষ্ট। এই ছ-সাত মাসে রওনকের সাথে নিনীকার কথা হয়েছে অল্প। দেখা দু-চার বার। কাছে আসা হলো না। যেকোনো নায়িকা রওনকের সাথে দু-বার মিটের পরই পাগলপ্রায়। নিনীকা উল্টো, বিয়ে করে দূরে ফেলে দিয়েছে। একটু ভালোবাসাপূর্ণ দৃষ্টিতে দু-দন্ড তাকায়নি। হানিমুন পর্যন্ত ক্যানসেল করেছে পড়াশোনার অজুহাতে। রওনক অনেকবার ব্রেক নেবার চেষ্টা করলেও, নানা অজুহাত আর ব্যস্ততা দেখিয়ে এড়িয়ে গেছে নিনীকা। রওনক রাগ ভাঙ্গাবার স্কোপই পায়নি। মাঝে সাঝে রওনক বাসায় এলেও নিনীকা থাকতে আসেনি এখানে। রওনক ক্লিনিকে গিয়েছিলো এর মাঝে একবার রাতে। নিনীকা সেঁধে বসলো,
—থেকে যান রাতে। চেয়ারে ঘুমোতে পারবেন তো?
—আপনি কোথায় ঘুমোন ডক্টর?
—এই তো এই পাশে ফ্লোরে বেড আছে আমার।কোটিপতি নায়ক কি আর মেঝেয় ঘুমোবে?
স্পষ্ট ফাজলামো। তাও রওনক রয়ে গেল। রওনকের নিনীকার ছোট্ট চেম্বারে চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া কাজ নেই। রাত দুটোর পর নিনীকা রুমে এসে শুয়েছিলো একটু। রওনক ভাবলো, গল্প করার সুযোগ পাওয়া গেল একটু… তা না… এর মাঝে নার্স এসে জানালো, রোগী ডাকছে। রোগীকে নিনীকা জুস খেতে বলেছিলো সন্ধ্যায় রাউন্ডে গিয়ে, এখন এসে জানতে চাইছে কিসের জুস খাওয়াবে? আমের না কমলার? নিনীকা ঠান্ডা গলায় বললো,
—-দুটোই দিতে পারে।
ওহ্ ডক্টরদের এই জীবন বুঝি! রওনক হলে তো এক ঘুষিতে নাক ফাটিয়ে দিতো। রাত তিনটার সময় জুস! জুস দিয়ে কি সেহেরি করবিরে শালা!
এই এত দুরত্বও রওনক মেনে নিয়েছে, নিনীকা প্লেব্যাক করতে রাজি হয়েছে বলে। একবার রিলিজ হোক গান, ক্লিক ক্লিক ক্লিক।

তবে এতগুলো দিন পরে আজকের দিনটা এক হবার কারণ, ইলার মেয়ে হয়েছে গত কাল সকালে। সে একটু পর পর ফোন করে বলছে, নিনীকা ও রওনককে একসাথে ভিডিও কলে দেখতে চায়। নিনীকা এড়াতে পারেনি ইলার আবদার।
রওনক সন্ধ্যায় বাসায় এলেও নিনীকা এলো রাত আটটার ও পর। ক্লান্ত চেহারা। এলোমেলো চুল। সবুজ জামার সাথে কালো ওড়না। জিন্সের সাথে পাতলা স্যান্ডেল পরনে। যেন অনিচ্ছায় ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে সে। রওনককে ভালো করে না দেখেই বললো,
—থাকবো না আমি রাতে। ডিনারও করবো না। শুধু ইলার সাথে কথা বলতেই এসেছি। অনেক কাজের প্রেসার!
রওনক মনে মনে বললো, থাকবে না মানে! থাকতে হবে। ক্লোরোফর্ম দিয়ে বেহুঁশ করে রাখবো। ঘাস কাটতে কি বিয়ে করেছি নাকি? পাক্কা ৭মাস ১৩ দিন হলো বিয়ের… এখনো ঢং! প্রেমে পড়ে গেছি ডক্টর আপনার। একবার সুযোগ দিন তো, সব ছেড়ে দিয়ে আপনার পায়ের কাছে বসে থাকবো।
মুখে বললো,
—কেউ তো থাকতে বলছে না আপনায়। কাজের চাপ তো আমারও বেশি।

ভিডিও কলে ইলা প্রথম হাই বললো নিনীকাকে। একাধারে কাঁদছে সে। নিনীকারও চোখ ভিজছে।
—তোমার মেয়ে কোথায়? আগে তো দেখাও।
রওনক সরে এলো সামনে থেকে।
ইলা মেয়েকে কোলে করে দেখিয়ে বললো,
—কেমন হয়েছে দেখতে?
চোখ বন্ধ মাথাভর্তি ঘন চুলের ফুটফুটে মেয়ে।
নিনীকা ফ্লায়িং কিস করতে করতে বললো,
—এই পৃথিবীর সেরা সুন্দরীর থেকেও ১০গুণ বেশী সুন্দরী!
ইলা কান্না কান্না গলা টেনে কোনোমতে বললো,
—এর নাম রেখেছি “নিনীকা”। ও যাতে একদম তোমার মতো হয়। তুমি কি রাগ করেছো?
নিনীকা হাসলো।
রওনক মেজাজ খারাপ করে পাশ থেকে বললো,
—আর নাম খুঁজে পাসনি নাকি? এই নামের কি দরকার?
ইলা মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বললো,
—বড় বড় মহামানুষের নামে নাম রাখলে বড় হয়ে আমার মেয়েও এমন হবে। আর তুমি এত রাগ করছো কেন রওনক ভাই? ও’টা তোমার নিনীকা। এটা আমার। আচ্ছা, তোমরা গুড নিউজ দিবে কবে বলো তো? রওনক ভাই, তোমাদের কিন্তু প্রথম ছেলেই হবে দেখো। আমি স্বপ্নে দেখেছি। আমি কিন্তু দেশে আসবো তখন।
নিনীকা একছুটে বাথরুমে চলে এলো। কান্না পাচ্ছে তার। সে কিছুতেই চায় না ইলার মেয়েটা তার মতো হোক। এত দুঃখ কষ্ট আর কোনো মেয়ের জীবনে আসুক, নিনীকা চায় না।

রওনক দীর্ঘশ্বাস ফেললো, বউ পেলাম না আবার বাচ্চা। এত বড় নায়ক সে অথচ বিয়ের এতদিনে তার বউ তাকে ধাঁধা আর ভুতের খেলা ছাড়া কিছু দেয়নি। হুহ… আজ রুমেই সিগারেট খাবে সে। যা হয় হোক!

(চলবে)

#তৃধা_আনিকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here