রোদ্দুরের_বৃষ্টি #পর্ব_২৮_ও_২৯

0
438

#রোদ্দুরের_বৃষ্টি
#পর্ব_২৮_ও_২৯

#পর্ব_২৮

শোয়েব চলে যাবার পর এই দু-মাসে রিমি হাঁড়ে হাঁড়ে টের পেয়েছে মিস করা কাকে বলে? বিজনেসে ঢেলে দিয়েছে নিজেকে একদম। ক্ষণিকের বিশ্রামাগারে পড়াতেও গেছে খুব স্বাভাবিকভাবে। শুধু একটা জিনিস ব্যাতিক্রম। লীনা ম্যাম রিমির সাথে কথা বলেন না। দেখা হলেও কৌশলে সেটা এড়িয়ে যান। শোয়েবের সাথে নিয়ম করে যোগাযোগ হচ্ছে। তবে ভিডিওকলে রিমি কথা বলতে পারেনা, অস্বস্তি হয় খুব। সেদিন তো ভিডিওকলে শোয়েব ভাই চুমুও খেয়ে নিলো। ছিঃ… রিমি সাথে সাথেই ফোন কেটে দিয়েছে…. ওখানে যাবার পর শোয়েব ভাই’র একটা পরিবর্তন অবশ্য হয়েছে, শোয়েব ভাই শুকিয়ে আরো লম্বা হয়ে গেছেন। আচ্ছা, দেশে ফিরলে দুজনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে হাইটটা একটু মাপতে হবে মনে করে….

রিমির ভাবনায় ছেদ পড়লো! পিয়ন চা দিয়ে গেছে।দামী সিরামিকের পরিষ্কার কাপে ধোঁয়া উঠা গরম চা। রিমি হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপটা নিলো….

রিমি এখন বসে আছে রিজওয়ান সাহেবের বাবা এডভোকেট ড. এনামুল হক সাহেবের অফিসে। এপয়েন্টমেন্ট ঠিক করা ছিল এগারোটায়। সাড়ে এগারোটা বেজে গেলেও তিনি আসেননি। রিমি মুখের কাছে নিয়ে চা-টা সামনে থেকে আবার সরিয়ে রাখলো। চায়ের গন্ধে গা গুলিয়ে আসছে।আজকাল তার শরীরটা একদম ভালো যাচ্ছেনা। বিশেষ করে, সকাল ১০টার পর থেকে শরীর খারাপটা যেন বেড়ে যায়!
রিমি আবার ঘড়ি দেখলো। এগারোটা চল্লিশ!
এনামুল সাহেব তাকে এত বসিয়ে রাখছে কেন? সে তো সব শর্ত মেনেই এসেছে? রিজওয়ানকে ফিরিয়ে দেবার সব কথাই তো শিওর! এর আগেও সে দুদিন বসে থেকে গেছে। আজ তাহলে? ইচ্ছে করে নয়তো?

-হ্যালো, রিমি আমি তোমাকে অনেক বোর করলাম।সরি মা-মণি। রিমি পেছন ঘুড়ে তাকালো।
মধ্যবয়সী সুদর্শন চেহারার হাসিখুশি ভদ্রলোক।পোশাক আশাক পরিপাটি। হাতে একগাদা বই তবে,
উকিলদের কালো লেবাস নেই বরং ঝকঝকে সাদা শার্টপ্যান্টে কেতা দুরস্ত।
বুঝাই যায় রিজওয়ান সাহেবের বাবা। চেহারায় নাইনটি পার্সেন্ট মিল।
রিমি হেসে সালাম করলো।
-আপনি খুব ব্যস্ত মানুষ, তাও আপনাকে ডিস্টার্ব করতেই তো বসে আছি। আপনি ছাড়া আর কেউ এই কাজে….
রিমি কথা শেষ করতে পারলোনা।
এনামুল সাহেব চেয়ার টেনে বসলেন। চোখ বন্ধ করে বড় করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
-খুব ব্যস্ত থাকি, লাস্ট দুটা মিটিং এ কথা রাখতে পারিনি বলে সরি। তোমার জন্য ১০মিনিট সময়, এর মধ্যে ভূমিকা ছাড়া মূল স্টোরিটা বলে ফেলবে।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন,
-ইওর টাইম স্টার্টস নাও….
রিমি থতমত খেয়ে গেল। কিভাবে বলবে? কোথা থেকে শুরু করবে… ও মাই গড্!
-কি হলো বলো? আমি তো ব্যাপারটার লিখিত ডেসক্রিপশন নিবোই। তুমি শুধু রিকল করবে। তবে মাঝখানে একটা ছোট্ট প্রশ্ন করে নিই। গাধাটা কি তোমার কথায় রাজি?
রিমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।
-ওকে ডান। তুমি বলতে থাকো, আমি প্রশ্ন না করলে থামবে না।
রিমি সামনে রাখা পানির গ্লাসে একটা চুমুক দিয়েই মুখ কুঁচকালো…. পানিটাও বিস্বাদ লাগছে… ছিঃ

-মাস দশেক আগে আমি একটা টিউশন শুরু করি, শোয়েবের সাথে পরিচয় ওখান থেকেই। তারপর একবার এক্সিডেন্টলি উনার সাথে আমার হাসপাতালে রাত কাটাতে হয়। মূল ঘটনার শুরু সেখান থেকেই। তখন আমাদের মধ্যে একটা শারীরিক সম্পর্ক হয়। তবে সে সময় আমি অচেতন এবং শোয়েব অর্ধচেতন বা মনোবৈজ্ঞানিক ভাষায় সাবকনসাশ মাইন্ডে ছিল। সে এ ব্যাপারে শিওর না হলেও খটকা ছিল। কিন্তু জ্ঞান ফেরবার পর, আমি তা টের পাই বেশ ভালোভাবেই। কিন্তু শোয়েবকে বলিনা।সেও নিশ্চিত ছিল না বলে আমাকে জিজ্ঞেসও করেনি। খটকা তো ছিলোই কিন্তু পরে সে এ বিষয়টা অন্যভাবে নিশ্চিত হয়।
রিমি একটু থামলো…
-বলতে থাকো.. ইওর টাইম ইজ রানিং…
-জি…. তারপরেই আমাদের দুজনের মধ্যে একটা মানসিক বন্ধন তৈরি হয়, বলতে পারেন অস্পষ্ট কিন্তু তীব্র টান। ব্যাপরটা শোয়েবের দিকে থেকে বেশি ছিল। আমি প্রথমে ভাবলাম হয়তো অপরাধবোধ। অথবা, সাময়িক প্রচ্ছন্ন ঘোর! যে কারণেই হোক, শোয়েব কাছে আসার চেষ্টা করতে লাগলো। আমি শূণ্য মানুষ, যা আমার সামর্থ্যের বাইরে তা এড়িয়ে যাওয়ার কাজটা আমি ভালো পারি। কিন্তু শোয়েব
আমাকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করতে শুরু করে। ইনফেক্ট আজকের আমার এই বিজনেসের সবই সে।সেদিন সকালে আমার চুলে পেঁচানো ছেড়া গামছা দেখে থার্টি পিসেস গামছা গিফট করলো আমায়।আমি সেটার বিক্রিও ওদের বাড়ি থেকে শুরু করলাম, তখন অবশ্য না জেনে…
রিমি একা একাই হাসলো।
-বেটার তুমি মেইন পয়েন্টসগুলো ডেসক্রাইব করো মামণি। ছোট ছোট নোটসগুলো ছেড়ে দাও! একটু ব্রিফ করে বলো।
এনামুল সাহেব হালকা কেশে নিলেন।
-ডিটেলে তো তুমি লিখেই এনেছো তাইনা?
-জি। মেইন পয়েন্ট হলো, সেই শারীরিক সম্পর্কই শোয়েবকে বেঁধে ফেললো, যার নাম ভালোবাসা।আমিও পরে কনফার্ম হলাম এটা ভালোবাসা, কামনা নয়। কারণ তিনি আমাকে যোগ্য আর সুখী করতে উঠেপড়ে লাগলেন। আমার সুখ তাঁর একমাত্র ডিমান্ড হয়ে গেল। ওই ব্যাপারটা তিনি তাঁর মায়ের সাথেও শেয়ার করলেন। তবে এ নিয়ে আমাদের দুজনের সরাসরি কোনদিন কোনো কথা হয়নি। প্রচন্ড জ্বরের ঘোরে আচ্ছন্ন একটা মানুষ একটা হাই স্লিপিং ডোজের ইনজেকশন দেওয়া একটা মেয়ের সাথে খুব অল্পসময়ের একটা ফিজিক্যাল রিলেশনে দায়বদ্ধ হয়ে পড়লেন। এটা ভেবে আমি তাকে কখনোই এ ব্যাপারে কিছু বলিনি। জীবনে এত দুঃখকষ্টের মাঝে আমি কাটিয়েছি যে, শোয়েব যদি এটা অস্বীকারও করতো, আমার কিছুই ফিল হতোনা। আমার এত নির্লিপ্ততায় শোয়েব আরও মুগ্ধ হলো। ভালোবাসা দ্বিগুণ থেকে শতগুণ হলো। আমিও পা মিলিয়ে ভালোবাসায় আগাতে চাইলাম। দরিদ্র জীবনের অবসানে আমি বিজনেসের লোনের চেষ্টা করলাম। রিজওয়ান সাহেবকে তখনি চিনি আমি। কিন্তু লোনের টাকাটা লোনের নাম করে আমায় দিলেন শোয়েবের মা। তাঁর ছেলের অনিচ্ছাজনিত অপরাধকে আমি খুব স্বাভাবিকভাবে ক্ষমা করে দিয়েছি, এতে তিনি ঋণ শোধ করলেন। তিনিও ধরে নিলেন তাঁর ইঞ্জিনিয়ার ছেলে দরিদ্র একটি মেয়ের সাথে একান্তে কিছু সময় কাটিয়ে সত্যিই অপরাধ করেছে। কিন্তু আমি জানি, এতে ঋণের কিছু নেই। ভালোবাসা হয়ে গেছে আমাদের। ওটা দুর্ঘটনা ছিল, যেটা অবচ্ছন্ন অনুভূতির।
-টাকার কথাটা কখন জানলে?
-বিয়ের পরে। বললেন, এটা আমার নবৌ-সালামী!
রিমি আবার থামলো।
পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে রেখে দিলো আবার। গা গুলানো ভাবটা বাড়ছেই।
-তুমি কিন্তু টাইম নষ্ট করছো। আর মাত্র এইট মিনিটস বাকি….
-জি বলছি, শোয়েব আমার বিজনেস পুরোদমে দাঁড় করিয়ে দিলো কিছু দিনেই। আমিও শ্রম দিতে লাগলাম। ও’র পরিবারের জন্য আমাকে যোগ্য করতে ও’সর্বস্ব ঢেলে দিলো। একরকম ঠিক হয়ে চলতে লাগলো সব। এর মাঝে, বিয়ে করে নিলেন আমায়।
বিয়ের পরেই তো শোয়েবের মা আমায় বলেন, তোমার বিজনেসের লোনের টাকাটা আমি তোমার মুখদেখার উপহার দিলাম। শোয়েবের বৌ তুমি.. এতো অনেক কম তোমার জন্য। নিজেকে জীবনে সবথেকে সুখী মেয়ে মনে হলো। এর মধ্যে বাঁধ সাধলো লীনা। তিনিই আমাদের স্ট্যাটাস ভিত্তিক অসমতাকে মানতে পারলেননা, পৃথিলাকে সাথে করে তিনিই পাঠান।তিনি অনেকটা চ্যালেঞ্জের মত করে আমায় লিখলেন, এই যে…..
রিমি লীনার লিখা চিঠিটা টেবিলে রাখলো।
এনামুল সাহেব চিঠিটা হাতে নিয়ে চোখ বুলালেন,
-বাহ্ চমৎকার হ্যান্ড রাইটিং, গুছানো ভাষা। দারুণ শর্ত.. আমার মনে হয়, চিঠিটা লীনার সামনে বসে পৃথিলাই লিখেছে! লীনা নিজে লিখলে, নাম সই করতো, ইনিশিয়াল থাকতো। জব করা এযুগের মেয়ে এরকম গুটিগুটি অক্ষরে নাম লিখতোনা। এই চিঠি পেয়ে কি ভাবলে?
-আমি ভাবলাম শোয়েব তো আমার সাথেই আছে।এতে যদি সব স্বাভাবিক হয়, হোক না। তাছাড়া ও ব্রিলিয়ান্ট ইঞ্জিনিয়ার! সারা বাংলাদেশ থেকে মাত্র ৫০জন এই ওয়ার্কশপটার জন্য সিলেক্টেড ছিল।অনেক বড় সুযোগ এটা, ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট ও”র বলতে পারেন। আমি বাঁধ সাধলাম না। কিন্তু লীনা এই সুযোগটাকেই ব্যবহার করলো। আর পৃথিলা তো খুবই এগ্রেসিভ….. মানে ওই যে যুদ্ধ আর প্রেমে সব খাটে, এরকম মেনে চলা মেয়ে। আমি জানতাম কিছু একটা প্ল্যান ওদের আছে, কিন্তু এরকম হবে ভাবিনি। এরকম প্রাণ সংশয় করে সেটা ভাবিনি।
শোয়েবের ফেরার কথা ছিল সাত তারিখেই। সেদিন থেকেই ওরা ডিসকান্টেক্টেড। ওদের পরিবার শোয়েবের বেঁচে থাকাকে জরুরি মনে করছে। শোয়েব না ফিরলেও চলবে ওদের জন্য। তাই পৃথির হুমকিতে এরা একদম সাইলেন্ট। তাছাড়া পৃথিলা এডুকেটেড মেয়ে, মেনেজ করে নিয়েছে সবাইকে। শোয়েবের মা বাদে সবাই আগে থেকেই পৃথিলাকে ভালোবাসতেন, এখন তাই শোয়েবের মা’ও সাইলেন্ট। তিনিও বলছেন, শোয়েবের ভালো চান। শোয়েবকে সুস্থ-জীবিত দেখতে চান। এতে করে যদি পৃথিলাকে বিয়ে করে ভালো থাকতে হয় মন্দ কিছু নেই। আমি তো কোনোকালেই তাঁদের যোগ্য ছিলাম না। এখন তারাও ভাবছে, যদি ছেলে আবেগের দায়বদ্ধতা ভুলে গিয়ে স্ট্যান্ডার্ড জীবনে ফিরে আসে ক্ষতি কি? আমার সাথে এক্সিডেন্টলি এক রাত কাটানোর মূল্য তো তারা পরিশোধ করে দিয়েছে সেই কবেই। শোয়েবের ফিরে আসবার চেষ্টায় ওদের পরিবারের কেউ আমার সাথে নেই….
-এতে যে শোয়েবের কোনো উইকনেস নেই তুমি শিওর?
-৭০% শিওর। কিন্তু আমি চাই, শোয়েব ফিরুক আমার কাছে। কারণ শোয়েবের চোখে আমি দায়ের পাশাপাশি অনুরাগও দেখেছি। সে আমাকে চায়।প্রচন্ডভাবে চায়। আমার মত মেয়ের ভালোবাসা তুচ্ছ ব্যাপার। তাই ভালোবাসার শক্তি দিয়ে নয়, লিগ্যালি আমি আগাতে চাই। এই যে আমার বিয়ের যাবতীয় পেপারস! আমি আমার স্বামীকে ফেরত চাই… আমার এই অস্বচ্ছল দুঃখপীড়িত জীবনে আলো এনেছে শোয়েব। এই ট্র্যাপটা থেকে শোয়েব মুক্তি পাক। আমি জানি, শোয়েব দমবন্ধকরা কষ্ট পাচ্ছে! আমাকে না পেলেও সে বাঁচতে পারবে কিন্তু ও’কে জোর করে কিছু চাপিয়ে দিলে ও মরে যাবে…. সত্যিই মরে যাবে…

#পর্ব_২৯

রিমি চোখ মুছলো।
এনামুল সাহেব ঝিম মেরে আছেন।
-আমার ফিস মনে আছে তো তোমার?
-আমি বরং বেশিই দিবো আপনাকে। অনেক কামাচ্ছি আমি। রিজওয়ান সাহেব আপনার পা ধরে ক্ষমা চাইবেন, আমার বোনও চাইবে। তারপর ফিরে আসবে আপনার কাছে। একমাত্র সন্তানস্নেহে কাতর আপনি কত কষ্ট পাচ্ছেন আমি তা বুঝতে পারছি।রিজওয়ান সাহেবকে টাইট দিয়ে ফেরাবার সকল পথ আমি তৈরি করছি আস্তে আস্তে….
রিমির কণ্ঠে অসীম দৃঢ়তা।
-টাকার অঙ্ক আমার ফিসবাবদ চাইনা, সেটাতো আগেই বলেছি। আমি শুধু চাই, আমার ছেলে বৌ নিয়ে অপরাধ স্বীকার করে ফিরে আসুক। বুকে থাকুক আমার। শুধু মাথা কামিয়ে দিলাম বলে আমায় ভুলে গেল? আর এই আমায় না জানিয়ে একটা বাচ্চার মাকে বিয়ে করে নিলো, তাতে কি আমার রাগ হতে পারেনা?
এনামুল সাহেবের গলা ধরে এলো।
-এ জীবনে আমি যা সব করেছি, আমার ছেলের জন্য। সৎ পথে, আবার অনেক কিছু অসৎ পথেও।হয়তো আমারই অসততার ফল, ছেলেটা এমন একটা কাজ করলো। তাও আমার ভালো লাগছে, যে তাকে ফিরে পেতে একটা ভালো কাজ আমি করতে যাচ্ছি…
-আপনি শোয়েবের ফেরাবার ব্যবস্থা করুন। আমি বাকি সব মেনেজ করে দিবো। আর হ্যাঁ শোয়েবের সাথে আমার লাস্ট কথা হয় ৬তারিখ বিকেল চারটায়। সেই পর্যন্ত সে খুব নরমাল ও ভালো ছিল…
উঠছি…..

রিমি উঠতেই এনামুল সাহেব বললেন,
-আমার ধারণা শোয়েবের মাকে পৃথিলা শোয়েবের ভালো থাকাটা যেকোনো উপায়ে এনশিওর করেছে, নাহলে তিনি কেন বদলাবেন? পৃথিলা শুধু তোমার কাছ থেকেই শোয়েবকে ডিসকানেক্ট করেছে….
-হবে হয়তো… শোয়েব যদি স্বাভাবিকভাবে পৃথিলাকে চায়, এতে আমি আপত্তি করবো না। কিন্তু ওকে কেউ জোর করবে, সেটা আমি কিছুতেই হতে দেবো না…
-তুমি কিন্তু একবারও উল্লেখ করোনি পৃথিলা তোমার বোন, ও’র সাথে তোমার রক্তের সম্পর্ক আছে। তবে গুড, একজন ক্রিমিনালকে আত্মীয় বলা ঠিক নয়।
রিমি মৃদু হেসে বললো,
-আমি কিন্তু আরেকটা চরম সত্যও আপনাকে বলিনি। বলতাম… কিন্তু আমি চাই সবার আগে শোয়েব জানুক…..
এনামুল সাহেব চোখের কোণে আসা পানিটা মুছলেন,
-রিজওয়ানের জন্মদিন গেল গত সপ্তাহে। গাধাটাকে এটা দিও। বনানীর বাড়িটা আমি ওকে….
রিমি পেপারসের ফাইলটা টেবিলেই রাখলো।
-আপনি দোয়া করে দিন শুধু, এরকম দশ বাড়ির মালিক আপনার ছেলে নিজেই হবে… মনথেকে করা বাবা মায়ের দোআ পৃথিবীর সব সন্তানের জীবনের সবথেকে বড় উপহার! এই যে আমার কিচ্ছুটি নেই, তাও একটার পর একটা বিপদে আমার পথ খুলে যাচ্ছে, তার একমাত্র কারণ আমার মায়ের দোআ।আমার জীবনের সবথেকে কঠিন চ্যালেঞ্জটা ফেইস করতে আমি ঢাকা শহরের সবথেকে বড় উকিলকে পাশে পাচ্ছি…
এনামুল সাহেব রিমির জন্য রেখে যাওয়া ঠান্ডা চায়ের কাপে চুমুক দিলেন।
-বাবা-মায়ের ভালোবাসাটা কেন সন্তানেরা বুঝেনা বলোতো?
-অনেক বাবা-মাও তো সন্তানের ভালোবাসা বুঝেনা।”সম্পর্ক অনেক দামী সম্পদ” এটা যখন কেউ বুঝে, তখন আর সমস্যা হয়না।
-তাহলে পৃথিলা সম্পর্কে তোমার বোন হয়েও কেন বুঝলোনা?
রিমি আবারও বসলো চেয়ারে……
শক্ত গলায় বললো,
-পৃথিলা আমার বোন নয়। সম্পর্ক নিয়ে আমার নিজস্ব একটা ব্যাখ্যা আছে।
-যেমন?
-যেমন হলো রক্তের সম্পর্ক বলে কিছু হয়না। আমরা কাছাকাছিভাবে বেঁচে থেকে যেটা তৈরি করি সেটা হলো সম্পর্ক! এই যেমন, এখন আপনার সাথে আমার তৈরি হচ্ছে। আরো সহজ করে দিই, ধরেন একজন মায়ের বেবি হবার পর অন্য একটা বেবির সাথে তা বদলে দেওয়া হলো, দীর্ঘদিন সে এই অন্যের বাচ্চাটিকেই নিজের সন্তান ভেবে না জেনে লালন পালন করলো। এবং কোনোদিন সে যদি নাও জানে যে, এই বাচ্চাটি অন্যের, সেই মা নিজের ভেবেই ভালোবাসবে, টেরও পাবেনা। এই যে আমরা অনেককে না জেনেই রক্ত দিই, তাতে কি সেই মানুষটা কোনো সম্পর্কের টান অনুভব করে? করে না। সেক্ষেত্রে কি দাঁড়ালো, উপস্থিতি, কমিউনিকেশন, খেয়াল, যত্ন আর অনুভব, এসব মেলালে যা তৈরি হয় সেটা সম্পর্ক!
-তার মানে কারো অনুপস্থিতি তো কোনো সম্পর্কই তৈরি করতে পারেনা! তাই না?
-একদম, পৃথিলার যদি সিমি আপার চেহারার সাথে মিল না থাকতো, আমি তো কোনোদিন খোঁজও নিতাম না। ইভেন আমার বাবা যিনি, তাকে একবার দেখেই আমার খুব আনকমফোর্টেবল লেগেছে…. মনেই হয়নি বাবা। সম্পর্ক তৈরিতে অনেক কিছুর দরকার…. দূর থেকে হুট করে এসে বললেই হলোনা, আমি তোমার অমুক, আমি তোমার তমুক। পৃথিবীতে মানুষের তৈরি করা সবথেকে আশ্চর্য জিনিসের নাম হলো, “সম্পর্ক”। “সম্পর্ক” একটা অনুভূতি, একটা দয়িত্ব, একটা ডিউটির নাম!
-তুমি তো বেশ ঝক্ঝকে ব্রেইনের মেয়ে। উইল ইউ বি মাই এসিসটেন্ট?
রিমি মিষ্টি করে হাসলো।
-শোয়েব আসুক…. আমি শুধু একজন যোগ্য প্রেমিকা হতে চাই, যে অনেক আগেই প্রেমিকের বৌয়ের রূপ ধারণ করে ফেলেছে।
রিমি চোখ মুছলো আবার। হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে রিমি উঠে দাঁড়ালো।
এনামুল সাহেবও উঠে দাঁড়ালেন। হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
-আমার নিউ ক্লায়েন্টের সাথে একটা হ্যান্ডশেক তো করতেই পারি?
রিমিও হাত বাড়িয়ে দিলো। এনামুল সাহেব আবেগাপ্লুত ধরা গলায় বললেন,
-সমুদ্রে একধরনের প্রচন্ড সাহসী মাঝিদের দল আছে বুঝলে মা, যারা প্রচন্ড ঝড়েও নৌকার হাল ধরতে পারে। একদম ভয় পায়না এরা। বরং ঝড় তাদের বেশ পছন্দের।ডুবে যাওয়া নৌকাকে ঝড়ের কবল থেকে বাঁচিয়ে ফিরতে এরা দক্ষ। এদের আনন্দ শুধু ঝর মোকাবেলায়। মরে যেতেও ভয় করে না এরা…
তুমি হলে সেরকম রিমি। জীবনসমুদ্রে তুমি অত্যন্ত সাহসী মেয়ে। এই যে শক্ত করে হাল ধরে আছো….
অল দ্য ভেরি বেস্ট মাই চাইল্ড…

রিমি বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠলো। এই লড়াইয়ে সে একদম একা…..
রিমি গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো।
হুঁ হুঁ করে কান্না পাচ্ছে তাঁর.. এই পৃথিবীতে একটা জিনিসও কি সহজভাবে তার হবেনা? এত যুদ্ধ করে কি বাঁচা যায়? শোয়েব ভাই ঠিক আছে তো? মেরে ফেলেনি তো? না, না হতেই পারেনা। তাঁর মধুর স্বপ্নটা
তো এখনও বলা হয়নি …..

রিমি গাড়ির জানালা দিয়েই বমি করে দিলো। বুকে জমে থাকা কষ্ট যেন….

(চলবে)

#তৃধা_আনিকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here