#হলিডে
#পর্ব_২৩_ও_২৪
#পর্ব_২৩
নীরা খুবই বিরক্ত গলায় বললো,
—একটা মানুষ একজনকে শাস্তি দিতে যাচ্ছে আর তুমি তাকে মহা উৎসাহে সাহায্য করছো? এটা কি ঠিক ?
—নীরা, তুই এমন ভাবে কথা বলছিস যেন উনার পুত্র বধুটা তুই?
নীরা শফিকের কথায় চমকে গেল।
নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
—নিজে পুত্র বধু না হলে বুঝি বলতে পারি না? উনি ভাবছেন উনার ছেলেকে মেয়েটি ফুসলে ফাসলে বিয়ে করেছে; এমনও তো হতে পারে উনার ছেলেটারই দোষ! শুধু শুধু মেয়েটাকে দৌড়ানো।
শফিক গাড়িতে বসতে বসতে বললো,
—তুই এত সিরিয়াস হয়ে গেলি যে?
নীরাও বসলো গাড়িতে।
—এমনও তো হতে পারে ভাইয়া যে, ছেলেটাই মেয়েটাকে প্রেশারে ফেলেছে। তুমি তো জানো না ভাইয়া, আজকালকার ছেলেরা তো বন্দুক আর পুলিশ নিয়ে বিয়ে করে। পুলিশের চার পাচঁটা গাড়িও রেডি রাখে এরা! বিয়ে না করলেই গাড়িতে করে ডিরেক্ট থানায়।
শফিক নীরার মাথায় টোকা দিয়ে বললো,
—তুই এত রিয়েক্ট করছিস যেন তোকে কেউ এমন করে বিয়ে করে নিয়েছে। কিরে কিছু ঘটিয়েছিস নাকি?
নীরা শফিকের কথায় আবারও চমকে উঠলো। তোতলাতে তোতলাতে বললো,
—তুমি যে মাঝে মাঝে কি বলো না ভাইয়া… পুরো ভয় পাইয়ে দাও। আমি কেন বিয়ে করবো? তোমার অতিথির গিফটের কথা বলো, কি কিনবে তাঁর জন্য?
শফিক জবাব দিলো না।
—তুমি কি তাকে দেখেছো? সে কি শাড়ি পরে? শাড়ি দিলে হবে নাকি অন্য কিছু? আচ্ছা, তাঁর কি পছন্দ?
শফিক হঠাৎ করেই বললো,
—নীরা, চল নেমে যাই। উপহার কিনতে ইচ্ছে করছে না। চল্ নেমে যাই। ভালো লাগছে না।
নীরা শফিকের হাত চেপে ধরলো,
—উপহার না কিনলে না কিনবে, চলো গাড়ি করে কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করা যাক। ফ্রিতে গাড়ি পাওয়া গেছে।
—আমার পড়াশোনা আছে। হিউজ সিলেবাস বাকি।
—ভাইয়া, একদিনে তোমার পড়াশোনা ভেসে যাবে না। একটু সময় আমরা ঘুরতেই পারি।
শফিক নিশ্চুপ হয়ে বসলো।
—ড্রাইভার সাহেব একটা গান টান কিছু বাজান তো… আমরা ভাইবোনে দু’ঘন্টা গাড়িতে করে ঘুরতে চাই। সমস্যা নেই তো?
ড্রাইভার না সূচক মাথা নাড়লো।
শফিক জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।
নীরাও বাইরে তাকালো। শফিক ভাইয়া, কি আবার মন হারাচ্ছে? কোথাও কি ভেঙ্গে পড়ছে? কোনো ভয় কি কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে তাকে?
নীরাই নিরবতা ভাঙলো।
—-তুমি কি মুকুলকে দেখতে চাও?
শফিক হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।
—ভাইয়া, তোমার কি ধারণা ভালোবাসার আসলেই কোনো শক্তি আছে? হৃদয়ের ক্ষতি করা ছাড়া আর কিছু কি ভালোবাসা দিতে পারে? আমার মনে হয় পারে না। আমাদের টাকা ছিল না, নেইও। ভালো খাবার দাবার ছিল না, এত অভাবের মাঝেও সবাই ভালো ছিলাম। কিন্তু তোমার যখন ভালোবাসাটা হলো, কি কান্ডটাই না হয়ে গেল! বর্ষা ভাবি কি আসলেই ভালোবেসেছিল তোমাকে?
—ভালোবাসা না থাকলে কি বিয়ে করতো আমায়?
—বিয়ে করার জন্য ভালোবাসার দরকার হয় না ভাইয়া। এই পৃথিবীর অধিকাংশ বিয়েই কিন্তু ভালোবাসাহীন।
—কিন্তু বাকিটা? বল নীরা.. সেটা? বাকি সবটা, যেটা অনুভূতির অংশ সেটার কথা বল?
নীরা জবাব না দিয়ে কিছুক্ষণ শফিকের দিকে তাকিয়ে রইলো। সে স্পষ্ট বুঝতে পারলো এই প্রশ্নটার উত্তর শফিক জানে এবং নীরার কাছ থেকে শুনতে চায় না।
নীরা মৃদু হাসলো,
—বর্ষা ভাবী কি মুকুলকে দেখতে দেবে? সুযোগ হবে কি দেখার?
—মিস নাফিসা সব ব্যবস্থা করে দেবেন বলেছেন। আমি তাকে কোলে নিতে চাই! গায়ে মাথায় হাত বুলাতে চাই। আমি তাঁর জন্য একটা সুন্দর নাম ভেবেছি। তাকে প্রথম কোলে করে আমি এই নামে ডাকবো।
শফিকের চোখ ছলছল করছে। নীরা শফিকের থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে অন্যদিকে তাঁকালো।
—আমার কি ধারণা জানিস নীরা? মি.তামিম আমাদের সব সমস্যা সমাধান করতে এসেছেন। সৃষ্টিকর্তা পাঠিয়েছেন। শুধু একটু সময় লাগবে। ভালোবাসার জাদুকাঠী আছে তাঁর কাছে। মুকুলের কথা শোনার পর আমার মনে হয়েছে, মি.তামিমের খুব দরকার ছিল আমাদের। এই মুহূর্তেই দরকার ছিল।
নীরা প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করলো।
—আর মাত্র কয়েকটা দিন ভাইয়া, রাস্তার মোড়ে মোড়ে আমার বড় বড় বিলবোর্ড দেখবে। লাবণী ভাবীর বিয়েটা মিটে যাক; তারপর বাড়িতে বলবো সবাইকে। তোমার এই বোনকে তখন টিভিতে দেখতে হবে। এই ভাইয়া, আমার যদি টাকা হয় এমন গাড়ি কিনবো আমি একটা।
শফিক নীরার হাত ধরে বললো,
—এদিকে তাকা, শোন। একদম কথা ঘুরাবি না। পরিবারের একজনের অঘটন ঘটেছে বলে তুই নিজেকে সম্পর্ক থেকে দূরে সরিয়ে রাখবি, এটা কি ঠিক? মনের যদি সায় থাকে ইউ শুড এক্সসেপ্ট দিস! তুই যেরকম, তুই যা… সেরকম দেখে ভালোবাসাটা কিন্তু অনেক টাফ। তারপরও যদি মনে হয় এটা তোর নির্ভরতার জায়গা নয়, তখন তুই ঠিক করবি। দ্যাখ মা ছিল না বলে কেউ তোকে একদিনও জিজ্ঞেস করেনি তোর একটা ভালো জামা চাই কিনা? তোর চুলের একটা ব্যান্ড দরকার কিনা। ছোট থেকে তুই বড় হয়েছিস অন্যের সমস্যা দেখেই। তাই বলছি, নিজের কথা ভাবার সুযোগ যদি কখনো আসে, প্লিজ ভাবিস! প্লিজ… “সম্পর্ক” পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যাজিক, যা সব বদলে দিতে পারে।
নীরা হাত ছাড়িয়ে নিলো।
—তাই বলে এত কম যোগ্যতায়, এত বেশি! অবিশ্বাস্য ভাইয়া।
শফিক মিষ্টি করে হাসলো,
—নীরা এই পৃথিবীর সব অবিশ্বাস্য ব্যাপারগুলো না ভালোবাসাতেই ঘটে। ইটস এ রুল অফ ইউনিভার্স। পৃথিবীর নিয়মে পৃথিবীই ঠিক করে দিয়েছে, সব অবিশ্বাস্য ব্যাপারগুলো ভালোবাসাই ঘটাবে। এটা তাঁর কাজ।
নীরা হাসার চেষ্টা করলো, শফিক ভাইয়া তাকে দুর্বল করে দিচ্ছে। কিন্তু সে কিছুতেই দুর্বল হবে না। এই তামিম লোকটাকে তার একদম বিশ্বাস হয় না। মনে হয় মাথা পাগল।
শফিক প্রায় চিৎকার করে বললো,
—গাড়ি থামান, গাড়ি থামান ড্রাইভার সাহেব। এই নীরা উপহার পেয়ে গেছি… কি সাংঘাতিক!
সোবহান সাহেব অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে বললেন,
—মা বাথরুমে সাবান তোয়ালে সব দিয়েছো তো?
বড়লোক মানুষ, এরা আবার বাথরুম ব্যাপারে খুব সিরিয়াস হয়! বুঝলে মা, খাওয়া দাওয়ায় যেন কোনো ত্রুটি না হয়। তিনবেলা গরম ভাত, গরম তরকারি। আমাদের তো আর কোনো বিশেষ অতিথি নেই। আমাদের মতো গরীবের বাড়িতে থাকতে আসছেন, তুমি কিন্তু সবটা দেখো।
লাবণী খুবই মন খারাপ করা মুখ করে বললো,
—বাবা, এগুলো আমাকে কেন বলছেন বাবা? দ্বিতীয় বিয়ে বলে কি বিয়ের কনে হিসেবে আমার কোনো দাম নেই, বাবা? সারাক্ষণ আমাকে কাজই করতে হচ্ছে অথচ মাত্র দুদিন বাকী আছে বিয়ের!
নীরাকে বলুন দুটো দিন একটু সামলাতে। বিয়েটা হয়ে গেলেই আমি আবার সামলাবো সব।
সোবহান সাহেব লাবণীর কথায় বেশ লজ্জিত হয়ে পড়লেন,
—-তাই তো, তাই তো…. আমার তো একদম মনে নেই লাবণী মা। আমি নীরাকেই বলছি। এক্ষুণি বলছি। আচ্ছা তামিম সাহেব কখন আসবেন কিছু বলেছেন?
—নিজে থেকে তো কিছু বলেননি, তবে বিয়ের আগের দিন বিকেলের মাঝেই আসবেন বলেছেন।সেই হিসেবে কাল!
—তুমিও যে কি বলো না মা! বিয়েতে তোমার একমাত্র অতিথি অথচ দুদিন আগেও আসবেন না, তা কি করে হয়? দেখি, তাঁর কাছে একটা ফোন লাগিয়ে দাও; আমি বলি তাকে। বেচারা হয়তো আসতে লজ্জা পাচ্ছে।
লাবণীর ফোন করতে হলো না, মিসেস সেলিনাই ফোন করেছেন। লাবণী ফোন এগিয়ে দিলো।
ফোন ধরলেন সোবহান সাহেব।
—হ্যালো আপা, ভালো আছেন? সব খবর ভালো তো?
সেলিনা অত্যন্ত চিন্তিত গলায় বললেন,
—আর ভালো… ছেলেকে নিয়ে মহা অশান্তিতে আছি। শুনুন ভাই সাহেব তামিম তো আপনাদের ওখানে থাকতে যাচ্ছে। আমার ছেলের কেলেঙ্কারির ঘটনা তো আর জানেন না… ছেলেটা তো ভাই লুকিয়ে বিয়ে করে নিয়েছে।
—ওহ আল্লাহ বলেন কি!
—হ্যাঁ ভাই, তবে আমিও বুদ্ধি করেছি এই বিয়েতে বউটাকে দাওয়াত করে আনবো তারপর হবে খেলা। কি বলেন আপনি?
সোবহান সাহেব কিছু না বুঝেও বললেন,
—জি জি….
—ছেলে যাচ্ছে আপনার ওখানে। আপনি যে জানেন, এসব কিছু বুঝতে দিয়েন না। গোপন ব্যাপার। আপনাকে আপন মনে হলো ভাই সাহেব, তাই বললাম।
—জি আচ্ছা।
—আমি তামিমের সাথে কিছু জিনিসপত্র দিয়ে দিচ্ছি বিয়ের। একটু দেখবেন ভাই কিছু বাদ টাদ পড়লো কিনা।
—আচ্ছা দেখবো।
সোবহান সাহেব আনন্দিত হয়ে ফোন রাখলেন।
—নীরাকে ডাকো লাবণী মা। তামিম সাহেব আসছেন। তাড়াতাড়ি……
ইতু আবার বললো,
—এই পাঞ্জাবি একদম ভালো লাগছে না। আরেকটা ট্রাই করতো ভাইয়া।
রনি মাথা নাড়লো। এই নিয়ে সে কমপক্ষে বিশটা পাঞ্জাবি ট্রায়াল করেছে। একবার ইতুর পছন্দ হয় তো রিতুর পছন্দ হয় না। এদিকে দু-বোনের চাপাচাপিতে একটু রসমলাই খেয়েছিল, এখন পেটটা পাক দিচ্ছে। পাঞ্জাবির ট্রায়ালের জন্য টয়লেটে যাবার কথাও বলতে পারছে না। এই দুই টুইন সিস্টারকে নিয়ে রনি পড়েছে মহাজ্বালায়। এদের মাঝে কোনটা ইতু, কোনটা রিতু সে বারবার গুলিয়ে ফেলছে। দুজনের পরনে একই ধরনের জামা।
এবার রিতু এসে বললো,
—এটা ট্রাই করো।
রনি বিষন্ন মুখে পাঞ্জাবি হাতে নিলো। টয়লেট যাওয়া মেনডেটরি মনে হচ্ছে। দুর্গন্ধযুক্ত বাতাস নির্গমিত হচ্ছে খুব.. অঘটন না ঘটে যায় আবার।
রনি খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লো। ইতু রিতু দুজনেই দুটো পাঞ্জাবি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। রনি কি বলবে?
#পর্ব_২৪
নাফিসা চলে এসেছে। তাকে এয়ারপোর্টে কেউ রিসিভ করতে আসার কথা নয়। সে কাউকে জানিয়ে আসেনি। কিন্তু এয়ারপোর্টে এসে সে দেখলো, তাকে নিতে লোকজন চলে এসেছে। নাফিসা মন খারাপ করা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। প্রাইম মিনিস্টার বাবা হওয়ার এই এক বিড়ম্বনা! সব আগে থেকেই জেনে যায়।
নাফিসা গাড়িতে বসতে বসতে বাবাকে ফোন করলো,
—হ্যালো পাপা।
—হ্যালো মামণি, ওয়েলকাম টু হোম। তুমি কি পৌঁছে গেছ? আমি রাত দশটার মাঝেই ফিরবো। ন’টায় একটা ছোট্ট মিটিং এর শিডিউল আছে, সেটা ক্যানসেল করতে পারলে আরও আর্লি তোমায় জয়েন করবো।
—পাপা.. একটু তো থামবে! আগে আমার কথাটা তো শুনবে। আমার একটা রিকোয়েস্ট আছে, বলো তুমি রাখবে।
—তুমি রিকোয়েস্ট বলেছো তো, ধরো কনফার্ম রাখছি। একটু তাড়াতাড়ি বলো মামণি।
—বাবা, এবার আমি তোমার কাছে বেড়াতে আসিনি। রুটিন শিডিউলের বাইরে এসেছি। অল্প সময় বুঝোই তো… অন্য কারণে এসেছি। আমি যদি দুদিনের জন্য আমার এক বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে যাই, মানে ওখানেই উঠি…
নাফিসার কথা শেষ হলো না প্রাইম মিনিস্টার সাহেব ব্যস্ত হয়ে বললেন,
—মামণি,আমি সিকিউরিটির জন্য একটা টিম কনফার্ম করে দিচ্ছি। তুমি সেখানের এড্রেসটা মেসেজ করো আমার ফোনে।
—-বাবা, প্লিজ! ওটা আমার বন্ধুর বাড়ি, বিশেষ বন্ধু। প্লিজ বাবা। আমি একা যেতে চাই। নিজের মতো করে তাদের সাথে থাকতে চাই। দুটো দিন! আই এশিওর ইউ স্ট্রংলি পাপা, আমার বন্ধু আমার খুব যত্ন করবে।
প্রাইম মিনিস্টার সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। একমাত্র মেয়ে বলে অনেক সময় কঠিন কথা বলতে চেয়েও পারেন না। এরকম উল্টোপাল্টা ডিসিশন নেওয়া একদমই ঠিক না। তাঁর নিজের শরীর ইদানিং ভালো যাচ্ছে না, যেকোনো সময় কিছু না কিছু ঘটে যেতে পারে। তাঁর কিছু হওয়া মানে পার্টি নাফিসাকে নিয়ে ভাববে। যদিও সেটা আরো বেশ ক’বছর পরে ঘটবে, তাও তো মেয়েটার ইমেজ ধরে রেখে চলতে হবে। পার্টির সবাই নাফিসাকে ফিউচার লিডার করা নিয়ে কানাঘুষোও করছে।
—হ্যালো পাপা, তুমি কি শুনছো?
—মামণি তুমি আমার মেয়ে বলে সাধারণ জীবন পাবে না তা কিন্তু নয়। তাও তোমাকে জানিয়ে রাখি, সিকিউরিটি জন্য একটা টিম হিডেন হয়ে থাকবে। তোমার বন্ধুরা কেউ বুঝতে পারবে না। প্লিজ মামণি। দেখো, তোমায় না জানিয়েও আমি কাজটা করতে পারতাম…
—ওকে, তুমি ইজিলি পারমিট করছো বলে তোমার রিকোয়েস্টটাও আমি রাখলাম। লাভ ইউ পাপা।
নাফিসার ফোন রেখেই প্রাইম মিনিস্টার সাহেব চিফ সিকিউরিটি অফিসারের সাথে কথা বললেন।
নাফিসার এই বন্ধুটি সম্পর্কে ইচ এন্ড এভরি ডিটেইলস তাঁর দরকার। অপজিশানের লোকেরা ওৎ পেতে অছে। মিডিয়া যাতে কোনোভাবেই বিষয়টা কাভার করতে না পারে। খুব কেয়ারফুল থাকতে হবে।
দরজায় কেউ নক করছে। নীরা সেটা শুনেও না শোনার ভান করলো। মাথাপাগলটা চলে এসেছে নিশ্চয়! নীরা কিছুতেই দরজা খুলবে না, কিছুতেই না।নীরা ইচ্ছে করেই ভেতরের ঘরে চলে গেলো। বেশ কয়েকবার নক করার পর সোবহান সাহেব নিজে উঠে গিয়ে দরজা খুললেন৷ দরজায় অপরিচিত একটি মেয়ে। সোবহান সাহেব খুবই বিস্মিত হয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। স্লিভলেস গ্রিন ফতুয়ার সাথে জিন্স পড়া একটি ফুটফুটে দেখতে মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর চোখের কাজল লেপ্টে আছে। দীর্ঘক্ষণ কাঁদলে কাজল ছায়ার চোখ যেমন বিষন্ন লাগে, তেমন। মাথার উপরের সানগ্লাসটা পড়ে যাবো পড়ে যাবো ভাবে মাথায় চুলে আটকে আছে। এক ঠোঁটের লিপস্টিক শুকিয়ে আছে, অন্য ঠোঁটে নেই। তাঁর নাকে সাদা পাথরের নাকফুল। কানে একই পাথর আর মুক্তো পাথরের মেশানো লম্বা দুল। মুখের উপরে কয়েকগাছি এলোমেলো চুল। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, সে খুব ক্লান্ত। সে খুবই বিরক্তভাবে হাতের মোবাইলে তাকিয়ে। তাঁর কপালও কুচকে আছে। তবুও মেয়েটিকে দেখতে অপূর্ব লাগছে।
মনে হচ্ছে এরকম এলোমেলো না সাজলে তাকে ঠিক মানাতো না। তাঁর সাথে বড় একটি ট্রাভেল ব্যাগ এবং একটি হ্যান্ডব্যাগ।
মেয়েটি হেসে বললো,
—আমি মি. শফিকের বন্ধু। তাঁর ভাবীর বিয়েতে এসেছি। আমার নাম নাফিসা।
সোবহান সাহেব মনে করার চেষ্টা করলেন, নাফিসা নামে কি সিনেমার কোনো নায়িকা আছে? মেয়েটি সিনেমার নায়িকার মতো। অবশ্য আজকালকার সিনেমা তাঁর দেখা হয়না। তাঁর চিনতে পারার কথাও না ,তাহলে? নাফিসা আবারও বললো,
—মি. শফিক কি বাড়িতে নেই? আমি কি এখানে অপেক্ষা করবো চাচা?
সোবহান সাহেব আবেগাপ্লুতো হয়ে পড়লেন। এরকম সাজ পোশাকের একটি মেয়ে তাকে আন্তরিক হয়ে চাচা ডাকছে। সোবহান সাহেব অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে বললেন,
—তুমি শফিকের বন্ধু! আসো মা আসো, ভিতরে আসো। কি কান্ড দেখো! গাধাটা তো একবারও বলেনি। অহেতুক আমি তোমায় খানিকক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখলাম।
নাফিসা ভেতরে এসে সোফায় বসে পায়ের কেডস খুলতে খুলতে বললো,
—বিয়ে বাড়ির প্রথম অতিথি আমি, তাই না চাচা?
—-জি মা।
সোবহান সাহেব নিজে গিয়ে এক গ্লাস পানি নিয়ে এলেন। নীরা, লাবণী এরা গেল কই? কাউকেই তো দেখা যাচ্ছে না।
নাফিসা জুতোটা খুলে রেখে এগিয়ে এলো।
সোবহান সাহেবের হাত থেকে পানির গ্লাসটা নিতে নিতে বললো,
—খুব তৃষ্ণা পেয়েছিলো চাচা। ধন্যবাদ!
সোবহান সাহেব নাফিসার এমন ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। নাফিসা এক নিঃশ্বাসে গ্লাসের পুরো পানিটা খেয়ে নিলো।
সোবহান সাহেব আগ্রহ নিয়ে নাফিসার কর্মকান্ড দেখছেন। নাফিসা ট্রাভেল ব্যাগটা খুলে কতগুলো প্যাকেট বের করলো। তাঁর পাগলা ছেলের এমন ফিল্মস্টারের মত বান্ধবী আছে, ভাবা যায়!
—চাচা, আমি খুবই ক্ষুধার্ত। খাবার কিছু পাওয়া যাবে? আসলে ফ্লাইটে আমি কিছুই খেতে পারি না।
সোবহান সাহেব জিভ কাটলেন। উফ, মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভুলেই গিয়েছিলেন। কাকে যে ডাকবেন!
তিনি চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলেন,
—নীরা, নীরা… লাবণী মা… কোথায় তোরা?নাফিসা এসেছে, শফিকের বন্ধু।
মা তুমি কোথা থেকে যেন এসেছো?
নাফিসা একটা প্যাকেট সোবহান সাহেবের হাতে দিতে দিতে বললো,
—ইউ এস এ থেকে। এটা আপনার জন্য চাচা।
প্যাকেটটা হাতে নিয়ে সোবহান সাহেব হা করে সোফায় বসে পরলেন।
তিনি ঠিক শুনেছেন তো? নাফিসা মেয়েটা ইউ এস এ থেকে এসেছে! শফিক এই মেয়ের খোঁজ পেলো কিভাবে?
ততক্ষণে নীরা এসে দাঁড়িয়েছে। সোবহান সাহেব ইশারায় নীরাকে কিছু বললেন। নীরা হাই তুলতে তুলতে বললো,
—ইনি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে বাবা। ভাইয়া উনাকে দাওয়াত করেছেন।
তারপর নাফিসার দিকে তাকিয়ে বললো,
—আপনি আসুন আমার সাথে। আপনি নিশ্চয়ই এখন একটা হটবাথ নেবেন? আমি গরম পানি রেডী করে রেখেছি। এত অবাক হয়ে তাকাবেন না প্লিজ। ভাইয়া ফোন করে বলেছেন, যে আপনি আসছেন।
নাফিসা মিষ্টি করে হাসলো।
নীরা নাফিসার ব্যাগটা তুলতে তুলতে বললো,
—আপনি আসুন আমার সাথে। এই যে উপরের বাঁ-দিকের ঘরে আপনি থাকবেন।
নাফিসা খুব স্বাভাবিকভাবেই বললো,
—নীরা, তুমি কি আমার জন্য কিছু খাবার পাঠাবে? আই এম ভেরি হাংগ্রি। আর বিয়ের কনে কোথায়? এটা তাঁর জন্য।
সোবহান সাহেবের ঘোর কাটছে না। প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে তার বাড়িতে? তাও শফিকের জন্য? সোবহান সাহেবের শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। তিনি চোখে ঝাপসা দেখতে লাগলেন। চোখের ঝাপসায় তিনি আধো অচেতন, আধো ঘোরে চলে গেলেন। তিনি সোফায় এলিয়ে পরে চোখ বন্ধ করে ফেললেন। চোখ বন্ধ নিয়েই স্পষ্ট দেখতে পেলেন, একদল পুলিশ কোমরে দড়ি দিয়ে তাদের বাড়ির সবাইকে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে! দড়ির লাইনে প্রথমে শফিক, পরে লাবণী, পরে নীরা, পরে পারভীন আর তারপরে সোবহান সাহেব নিজে। সোবহান সাহেব হাঁটতে দেরী করছেন বলে কনস্টেবল গোছের একজন তার পাছায় বারি মারছে। বারি মেরে বলছে, তাড়াতাড়ি চল রে বুইরা। তোর ছেলের ঝাল তোকে দিয়ে মেটাবো। প্রাইম মিনিস্টারের মেয়ের লোভ…. সব বের করবো….
সোবহান সাহেব বিড়বিড় করে বললেন, হে পাক-পরওয়ারদিগার রক্ষা করো। রক্ষা করো।
তামিম ঘরে এসে দেখলো, সোবহান সাহেবের হাতে একটা প্যাকেট। তিনি প্যাকেটটা পেটের উপর চেঁপে ধরে চোখ বন্ধ করে আছেন। চোখ বন্ধ অবস্থায় তিনি অস্ফুট স্বরে কিছু বলছেন।
হারুন মুখটা এগিয়ে নিয়ে বললো,
—স্যার, বেয়াই সাহেব কি মারা যাচ্ছেন? ইয়া আল্লাহ! বেয়াই সাহেব, ও বেয়াই সাহেব..
তামিম পানির গ্লাসটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
—পানি আনুন হারুন সাহেব। উনার মনে হয় প্রেশার বেড়ে গেছে। বাড়ির কাউকেই তো দেখছি না।
হারুন অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়লো।
—স্যার, বাইরে থেকে এসে কেউ মেরে যায়নি তো? দরজা হাট করে খোলা যেভাবে।
তামিম চিৎকার করে ডাকলো,
—-নীরা…..নীরা……মিস নীরা….
নীরা ছুটে এলো, সাথে লাবণীও। হারুন কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
—নীরা মাগো, বেয়াই সাহেবকে বোধহয় বাঁচানো গেলো না আর। বাইরে থেকে ডাকাত এসে কি অবস্থা করে গেছে দেখো?
লাবণী ঘুমে ছিল। ঘুমের ঘোর তার পুরোপুরি কাটেনি। তাও সে বিস্মিত গলায় বললো,
—আপনার বেয়াইটা কে?
তামিম কথা ঘুরালো।
—উনার কি হয়েছে ভাবী?
নীরা বললো,
—বাবার অ্যাজমার ধাঁত আছে। এক্সাইটেড হলে বাবার এমন হয়। আমি স্প্রে নিয়ে আসছি।
নীরা ইনহেলারটা আনতে চলে গেল। লাবণী গরম পানির ফ্লাস্ক নিয়ে এলো।
—দু-দন্ড এ বাড়িতে শান্তিতে ঘুমানোর কোনো উপায় নেই। এই আধঘন্টার জন্য বাবা আবার কিভাবে অসুস্থ হলেন বলোতো নীরা?
নীরা ততক্ষণে সোবহান সাহেবের মুখে স্প্রে দিয়ে দিয়েছে। সোবহান সাহেব চোখ মেলেই বললেন,
—নাফিসার কাছে কে আছে?
নীরা স্বান্তনার সুরে বললো,
—মা আছে বাবা। তুমি প্লিজ কিছুক্ষণ কথা বলো না।
সোবহান সাহেব নীরার কথা শুনলেন না। তিনি তামিমের দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন,
—বাবা গো, বিরাট সর্বনাশ হয়ে গেছে। তুমি আমার পাশে একটু বসো। বাবাগো, তুমি কেমন ধরনের পুলিশ?
তামিম জবাব দেবার আগে হারুন বললো,
—ধরেন, সি আই ডি পুলিশ। পাওয়ার বেশি।
সোবহান সাহেব হারুনের জবাবে সন্তুষ্ট হলেন না। তিনি আবারও বললেন,
—বাবা, তোমার ক্ষমতা কেমন?
নীরা এবার ধমকের সুরে বললো,
—কথা বলো না বাবা। একদম না। মুখ বন্ধ।
সোবহান সাহেব তামিমের দু-হাত চেপে ধরলেন,
—প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে আমার বাড়িতে। তাকে যেভাবে পারো বিদায় করো বাবা। বাঁচাও আমাদের। সব শেষ হয়ে যাবে… বাবাগো আমি তোমার পায়ে ধরি।
সোবহান সাহেব নিচু হয়ে তামিমের পা ধরার ভঙ্গি করলেন।
তামিম এক লাফে উঠে দাঁড়ালো।
—নাফিসা কখন এসেছে নীরা? কোথায় তিনি?
নীরা তামিমের দিকে না তাকিয়েই বললো,
—একটু আগে। উপরের ঘরে আছেন।
তামিম অাশ্বস্ত করার ভঙ্গীতে বলল,
—আমি সব দেখছি আংকেল। আমি দেখছি। একদম চিন্তা করবেন না। আমার ঘর কোনদিকে নীরা?
—আপনার ঘর নেই। আপনি থাকতে পারবেন না। উপরে একটাই ঘর খালি ছিল সেটাই উনাকে দেওয়া হয়েছে।
সোবহান সাহেব নীরাকে ধমকে উঠলেন,
—খবরদার এভাবে কথা বলবি না। তামিম সাহেব দরকার পড়লে আমার ঘরে থাকবেন।
লাবণী যেন কেঁদে ফেলবে এমনভাবে বললো,
—ছিঃ নীরা! উনি আমার ভাই বলেই তো এমন করছো, তাই না? উনি আমার ঘরে থাকবেন। আসেন তামিম ভাই, আসেন… আপনার ব্যাগ আমি এক্ষুনি উপর থেকে নামিয়ে আনছি। কি হিংসা! মানুষ বদলাতে মাত্র দু মিনিট দেখলেন তো?
তামিম খুবই চিন্তিত গলায় বললো,
—আমার উপরে থাকলে বেশি সুবিধা। না মানে নাফিসা ম্যামকে হ্যান্ডেল করতে সুবিধা হতো? কি বলেন আংকেল? তাঁর গতিবিধির ওপর স্ট্রিক্ট নজরদারি দরকার।
সোবহান সাহেব সুর মেলালেন।
—তাই তো… তাই তো…. নীরা দেখ তো উপরের দখিনের ঘরটা ঠিক আছে নাকি?
নীরা লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বাবা শুধু শুধু ঘর ঘর করছেন। এই মাথাপাগলটা রাতে ঠিক নীরার ঘরেই ঘুমোবে। নীরা বিড়বিড় করে বললো, আল্লাহ সাহস দাও আমায়।
এবার হারুন মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললো,
—নীরা মা, আমি কোথায় থাকবো?
লাবণী খুবই জোর গলায় বললো,
—আপনি নীরাকে এমন মা মা করছেন কেন?
নীরা হতাশ গলায় বললো,
—উনার মৃত মায়ের চেহারা আমার মতো ভাবি তাই।
হারুন বিব্রত গলায় বললো,
—আমার মা জীবিত নীরা মা। এ কি কথা! নাউজুবল্লাহ বলুন মা।
নীরা রক্তচক্ষু করে হারুনের দিকে তাকালো। যার অর্থ, আর একটা কথা বললে আই উইল কিল ইউ।
(চলবে)
#তৃধা_আনিকা