হলিডে #পর্ব_২৬_ও_২৭

0
596

#হলিডে
#পর্ব_২৬_ও_২৭

#পর্ব_২৬

নাফিসা দরজায় দাঁড়িয়ে বললো,
—আপনি কি ফ্রি আছেন চাচা? একটু কথা বলবো।
সোবহান সাহেব শোয়া ছিলেন৷ তাৎক্ষনিক উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন। সোবহান সাহেব কি বলবেন, তিনি এখন ঘুমোবেন? মেয়েটা কেন এসেছে? কি দরকারে?
নাফিসা আবারো বললো,
—ভেতরে আসবো চাচা??
সোবহান সাহেব তড়িঘড়ি করে বললেন,
—জি মা.. হ্যাঁ মা, অবশ্যই আসুন। একশোবার ভেতরে আসুন। আপনারই তো বাড়ি।
এই কথা বলে সোবহান সাহেব জিভ কাটলেন। বেশি বলে ফেলেছেন। নাফিসা নিঃশব্দে ভেতরে এলো।
সোবহান সাহেব আবার শ্বাসকষ্ট অনুভব করছেন। নীরা ইনহেলারটা যে কোথায় রেখেছে?
নাফিসা ভেতরে এসে বিছানার এক কোণে বসলো। সোবহান সাহেব দাঁড়িয়েই রইলেন।
—চাচা, আপনি যদি এভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন আমি কিন্তু স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারবো না। আমার অস্বস্তি হবে।
সোবহান সাহেব বসলেন। বুকে মৃদু মৃদু ব্যথা করছে তাঁর। নাফিসা মেয়েটা তাকে থ্রেট করতে আসেনি তো?
নাফিসা খুব নরম গলায় বললো,
—চাচা আপনি নাকি আমায় চলে যেতে বলেছেন?
সোবহান সাহেব বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লেন আবার।
—চাচা আমার একজন বন্ধু আমায় দাওয়াত করেছে, তাঁর দাওয়াতে আসাটা কি আমার অন্যায়?আপনি কেন আমাকে তাড়িয়ে দিতে চাইছেন?
সোবহান সাহেব ঘাবড়ানো গলায় বললেন,
—-মাগো আমার ছেলেটার মাথা খারাপ। সে কি বলতে কি বলে দিয়েছে আপনাকে। আমরা দরিদ্র মানুষ মা, আপনার কিভাবে যত্ন করি? আপনার এখানে থাকার সেবা যত্নই তো দিতে পারতেছি না মা। আমার ছেলের ব্রেনের ঠিক নাই, সেই জন্য আমি বলছিলাম আপনার যদি অসুবিধা হয় তাই।
নাফিসা অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো।
মানুষ তাকে কেন এত ভয় পায়? কেন স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে না?
—চাচা, আপনি বারবার আমার বন্ধুকে নিয়ে রুড কথা বলছেন। ইট হার্টস মি! আপনি আমায় তাড়িয়ে দিতেই সেবাযত্মের দোহাই দিচ্ছেন, আই নো।
নাফিসা কণ্ঠ ভারী হয়ে এসেছে।
সোবহান সাহেব বিছানায় বসলেন। মেয়েটা কি তাঁর কথায় সত্যিই কষ্ট পেয়েছে? তাঁর এভাবে বলা আসলেই ঠিক হয়নি।
—মাগো… আপনি কত বড় ঘরের মানুষ! আমরা মা সাধারণ মানুষ, রাস্তার ভিখারী। কি বলতে কি বলি! কথাবার্তার সুবুদ্ধি নাই। আপনাকে যে কিভাবে আপ্যায়ন করি?
—চাচা, আমি সহজে কারো সাথে মিশতে পারি না।কারো সাথে ফ্রেন্ডলি হতে ভালোও লাগে না।ছোটবেলা থেকে আমার বন্ধুর সংখ্যা খুব কম।
হয়তো বন্ধুদের কোনো ব্যাপারে আমি মুগ্ধ হতে পারতাম না বলেই, কেউ আমার বন্ধু হয়ে থাকেনি। কিন্তু মি. শফিককে আমার চমৎকার লেগেছে। কেন লেগেছে, তার এক্সাক্ট কারণ আমি জানি না। ইন ওয়ান সেনটেন্স, হি ইজ এ নাইস গাই। তিনি আমার বন্ধু, এটা ভাবতে আমার ভালো লাগে। সেই ভালো লাগা থেকে আমি এখানে বেড়াতে এসেছি। তারপরও আপনি যদি আমায় এলাউ না করেন, আই’ল গো হ্যাপিলি। তবে আমি যদি আমার এই বন্ধুটির বাড়ির এই চমৎকার অনুষ্ঠানে থাকতে না পারি, খুবই কষ্ট পাবো।
নাফিসা হাত জোর করে বললো,
—আমি এই বিয়েতে থাকতে চাই, এটা আপনার কাছে আমার বিনীত অনুরোধ চাচা!

সোবহান সাহেব নিশ্চুপ তাকিয়ে আছেন। অনেকবছর আগে তিনি তাঁর দাদীর মুখে ঘুমপাড়ানীর গল্পে শুনেছিলেন, এক সূঁইবিধানো রাজপুত্রের গায়ে ছিল হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ সূঁই। সূঁইয়ের ব্যাথায় অস্থির সেই রাজপুত্রের সব সূঁই খুলে মুক্ত করে দিয়েছিলো এক রাজকন্যা! এই নাফিসা মেয়েটি, সেই রাজকন্যা নয়তো? যে শফিকের ব্যাথার সমস্ত সূচ খুলে নেবে! না না, তা কেন হবে? এখানে নাফিসা রাজকন্যা হলেও শফিক তো আর রাজপুত্র নয়!
—আপনি কিছু বলছেন না তার মানে কি আমি চলে যাবো চাচা?
সোবহান সাহেব নাফিসার দেওয়া প্যাকেটটা সামনে এনে বললেন,
—এত দামী পোশাক মাগো আমি জীবনেও দেখিনি। হাতে নিয়েই চমকে গেছিলাম। কিভাবে পরবো?সামান্য বিয়ের অনুষ্ঠানে এই পোশাকের কি দরকার?
এখন মনে হচ্ছে, যে বিয়েতে আপনি অতিথি সেখানে অবশ্যই এরকম পোশাক পরা উচিত। আপনি এই বিয়ের বৌভাতের আগে যাবেন না। এই গরীবখানায় আপনার দাওয়াত।
নাফিসা উঠে দাঁড়ালো। হাসিমুখে বললো,
—ধন্যবাদ চাচা। আমি তাহলে নিচে যাচ্ছি। খুব হট্টগোল শোনা যাচ্ছে।

নাফিসা সিঁড়ির গোড়াতে যেতেই দেখলো, নীরা উপরে আসছে। সে একটি চমৎকার হলুদ শাড়ি পরেছে , কাজ করার জন্য শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে নিয়েছে। সে এক হাতে শাড়ির কুঁচি সামলে নিয়ে ধীরে ধীরে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠছে। তাকে দেখাচ্ছে নববধূর মতো। নাফিসা একথাটা ভেবেই মনে মনে হাসলো।
নীরার অন্য হাতে ছোট্ট ট্রেতে দু-কাপ চা।
—হেই নীরা আপনাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। নাইস শাড়ি… প্রিটি সাজ।
নাফিসা হাত তুলে গ্রেইস করলো নীরাকে।
—ম্যাম, শফিক ভাইয়া এসেছেন। তিনিই শাড়ি এনেছেন। ঘরোয়া করে হলেও তো গায়ে হলুদ! তাই হলুদ শাড়ি।
নাফিসা সেটা শুনেও কিছু বললো না।
নীরার ট্রের দিকে ইশারা করে বললো,
—একটা চা নিই?
—অবশ্যই, আমি আপনাকেই চা দিতে যাচ্ছিলাম। তখন বাবার ঘরে ছিলেন, তাই দু-কাপ চা।
নাফিসা চায়ের কাপ হাতে সিঁড়ির গোড়াতে বসলো,
—অন্য চা টা এখন আপনি নিন নীরা। বসুন না।
নীরা আস্তে করে ট্রেটা ফ্লোরে রাখলো। চায়ের কাপ হাতে নাফিসার পাশাপাশি বসলো।
—এত ক্রাউড নিচে! কি হচ্ছে?
—রনি ভাই’র মেডিকেল কলেজের বন্ধু বান্ধবরা এসেছে হলুদ মাখাতে। এসে দেখছে, হলুদ ডায়রিয়া করতে করতে বর হলুদ হয়ে পড়েছে। তবে মূল ফাংশান এখনো শুরু হয়নি। তামিম সাহেবের মা হলুদের স্টেজ ফেজ বাঁধিয়ে হুলস্থূল। তিনি বারবার রনি ভাইকে ওয়ার্ন করছেন, নো মোর টয়লেট।
নীরা শব্দ করে হেসে উঠলো।
নাফিসা মুগ্ধ হয়ে বললো,
—আপনার হাসি এত মিষ্টি। সাউন্ডস মিউজিক্যাল। আমি এরকম কাউকে হাসতে দেখিনি।
নীরা লজ্জিত ভঙ্গিতে চায়ে চুমুক দিলো।
—ম্যাম, আপনি যদি কিছু মনে না করেন একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
নাফিসা হেসে বললো,
—আপনি কি জিজ্ঞেস করবেন তা আমি জানি মিস নীরা।
নীরা অবাক হয়ে তাকালো।
—আমি অনেক কিছুই আগে থেকে বলে দিতে পারি। মি. তামিম আপনাকে বলে নি?
তামিমের কথা আসতেই নীরা কেঁপে উঠলো একটু। তার হাতের চায়ের কাপ থেকে চা ছলকে পরে গেল।
সে প্রসঙ্গ বদলাতে বললো,
—বলুন তো, আমি কি জানতে চাই?
—এই যেমন, আপনি এখন জানতে চাইছেন আমি মি. শফিকের ইনভাইটেশনে ইউ এস এ থেকে চলে এলাম কিন্তু এখানে এসে তাঁর সাথে দেখা করবার কোনো তাড়া কেন নেই আমার? এই যে মি. শফিক এসেছেন এতক্ষণ, আমরা দু-জন এখনো কেন মিট করলাম না, তাই না?
নীরার মুখ বিস্ময়ে হা হয়ে আছে!
নাফিসা চায়ে শব্দ করে লম্বা একটা চুমুক দিলো।
—মিস নীরা দু-জন বন্ধু তারা জানে তারা দুজনে খুব কাছাকাছি আছে। একজন আরেকজনের কথার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে, অস্তিত্ব টের পাচ্ছে। তবু সেঁধে কেউ কারো কাছে যাচ্ছে না, এটা খুবই ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। আমরা দুজনে সেটা উপভোগ করছি।
—আপনি বলতে চাইছেন, আপনার সাথে দেখা না হবার অস্থিরতাটুকু শফিক ভাইয়া’ও উপভোগ করছেন?
—ইয়েস….. বরং এমনি এমনি হুট করে যখন সামনাসামনি হবো, ইট উইল ক্রিয়েট এ ম্যাজিকেল ফিলিং। সামথিং লাইক দ্যাট হ্যাভেনলি থিং।
নীরা নাফিসার হাত থেকে খালি চায়ের কাপটা নিয়ে ট্রেতে রাখলো।
—আপনি খুব সুন্দর করে কথা বলেন ম্যাম। কত সুন্দর করে ভাবতে পারেন!
তারপর মনে মনে বললো, আরেকজন মাথাপাগলা আছে যার সবকিছু চাই; এক্ষুণি চাই, ধরে বেঁধে চাই। বুকে পিস্তল ধরেও সেটা চাই।
নাফিসা হাসলো,
—মিস নীরা রাতের মেন্যুতে কি আছে? না মানে আমি রাতে খুব লাইট কিছু খাই। বিয়ে বাড়ি তো নিশ্চয়ই রিচ আইটেম হচ্ছে?
—আপনি যেটা খাবেন বলুন, আমি দু-মিনিটেই করে দেবো ম্যাম।
—খিচুড়ি হবে, একটু পাতলা করে? আর এক গ্লাস লেমন জুস!
নীরার বুকের ভেতর ধক করে উঠলো। শফিক ভাইয়া এসেই বলেছেন, নীরা আমার জন্য একটু নরম খিচুড়ি করে দিস তো…. খুব খিচুড়ি খেতে মন চাইছে।
—মিস নীরা, চুপ করে গেলেন যে হঠাৎ?
—না আসলে, আমি খিচুড়ি করে দিচ্ছি।
নাফিসা এবারও হাসলো, সে জানে নীরার তাকে কিছু বলার আছে। নীরা নিচে গিয়ে আবার ফিরে আসবে! নাফিসা গুণতে লাগলো, থ্রি…. ….. টু……..
নাফিসার গুণা শেষ হলো না। নীরা দুটো সিঁড়ি নিচে নামলো, তারপরই ফিরে এলো।
—ম্যাম একটু কথা ছিল, বলি?
নাফিসা হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লো।
—-আমার মা মানে আমার আসল মা, বর্তমানের ইনি নন। আমরা তখন গ্রামে, বাবা গ্রাম্য বাজারে খুচরো সবজি বিক্রেতা। এসব করে টরে তো আর সংসার চলে না, তখন অবশ্য আমি জন্মাইনি। তো মা তখন কি করতেন, গ্রামের সর্দার বাড়ির বাসন-কোসন মাজতেন। তাছাড়া ধান টানের সিজনে সাহায্য করতেন। কিছুটা অভাব যদি ঘুঁচে তাতে।
আমার মায়ের নাম ছিল শিপন। সবাই মাকে ডাকতো শিপা কামলি বলে। আমি যখন হলাম, তারপর দেখলাম মা কাজে গেলে আমায়ও নিয়ে যান৷ তবে সর্দার বাড়ির ভেতরে আমাদের জায়গা হয় না। মা কাজ করতেন, খেলতে খেলতে প্রায়ই আমি ঘুমিয়ে পড়তাম। আমাকে তখন মা সর্দার বাড়ির পেছনের বারান্দায় শুইয়ে দিতেন। প্রায়ই শফিক ভাইয়া গিয়ে মায়ের সাথে রাগ করতো, বোনকে মাটিতে কেন শুইয়েছো? বোনতো কালো হয়ে যাবে! শফিক ভাইয়া আমায় কাঁধে করে তখন বাড়ি নিয়ে আসতেন। আমায় কাঁধে করে বয়ে কি যে ক্লান্ত হতেন তিনি! ঘাম পড়তো গা বেয়ে, আমি ফুঁ দিতাম তাকে। এই ক্লান্তি কি আর ফুঁ’তে কমে?
এটুকু বলে নীরা সিঁড়িতে বসে পড়লো। এখন তার ক্লান্ত লাগছে। আর বলতে পারবেনা সে।
নাফিসা বসা থেকে উঠে পড়লো। নীরার কাছাকাছি এসে বসলো,
—আপনি কি আপনার মায়ের এই কাজটাকে ছোট করে দেখে কষ্ট পাচ্ছেন? নাকি মি. শফিকের জন্য?
নীরা জবাব দিলো না।
—মিস নীরা মি. শফিক আমার বন্ধু। একজন ভালো মানুষ হিসেবে বন্ধু৷ উনার পারিবারিক সংকট, ভালো, খারাপ সবকিছুর জন্য কিন্তু নয়। আপনি আমায় কিছু বোঝাতে গিয়ে নিজে কষ্ট পাচ্ছেন বরং। আপনি কি আপনার মায়ের কাজ নিয়ে লজ্জিত বোধ করেন? নিশ্চয়ই নয়… সুতরাং আমিও আমার বন্ধুত্বে লজ্জিত নই।
—তারপরও এসব কথা আপনার জানা দরকার আমার মনে হলো।
—মিস নীরা, আমার কিচ্ছু জানার দরকার নেই।আমি যা পছন্দ করি, সেটা শুধু সেটার কারণেই। আই থিংক, আপনার মন কোনো কারণে ভীষণ বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। আপনার চিন্তা শক্তি এলোমেলো কাজ করছে, আপনার ভেতর কোনোকারণে ভেঙেচুড়ে যাচ্ছে। কিছু একটা আটকে আছে, সেটা এক্সপ্রেস করতে পারলে আপনার ভালো লাগবে।
নীরা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো, পা টলছে তার!
নাফিসা নীরার দু-কাঁধে হাত রেখে নরম দৃষ্টিতে তাকালো,
—মিস নীরা, আপনার শাড়ির মতো আরেকটা শাড়ি কি পাওয়া যাবে? আমার খুব শাড়ি পরতে ইচ্ছা করছে।
নীরা নাফিসার কথায় আবার ছোটোখাটো একটা শক খেলো৷ শফিক ভাইয়া মিস নাফিসার জন্যও এমন একটা শাড়ি এনেছেন। তবে শাড়িটা নীরার হাতে দিয়ে বলেছেন, তুলে রাখ। যখন চাইবে তখন দিস। নীরা অবাক হয়ে বলেছিল, প্রাইম মিনিস্টারের মেয়ে শাড়ি চেয়ে পরবে?
শফিক জবাবে শুধু হেসেছিল।
নীরা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।
—ওকে যান। আর তাড়াতাড়ি শাড়ীটা এনে পরিয়ে দিন আমায়। আই নিড এ ব্লাউজ অলসো! আরেকটা কথা, শফিক সাহেবের জন্য আমার একটা ছোট্ট উপহার আছে। নিয়ে যান…
—আমি দেবো?
—হুঁ, সেটাই ভালো হবে। তাকে উপহার দিতে লজ্জা লাগবে আমার।
নীরা মৃদু হেসে বললো,
—ম্যাম, আপনি শফিক ভাইয়াকে কেন এত পছন্দ করেন বলুন তো? এর কারণ কি?
—ঠিক যেই কারণে তামিম সাহেবকে আপনি এত পছন্দ করেন, ঠিক সেই কারণে।
নীরা লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো, নীরার মনের কথাটা নাফিসা ঠিক বুঝে গেছে।
সে অসহায় গলায় বললো,
—এই কারণটা তো আমি জানি না ম্যাম!
—তেমনি আমিও মি. শফিককে পছন্দ করার কারণটা জানি না, নীরা। আমার মনে হয় জানার দরকারও নেই। কেননা সম্পর্কে “পছন্দ” ব্যাপারটা নিজেই একটা বড় কারণ।

নীরা হাসলো কিন্তু তার চোখভর্তি জল ছলছল করেছে। কি যে অপূর্ব দেখাচ্ছে তাকে! এত সুন্দর চোখ কি কোনোকালেও এই পৃথিবীর কারো ছিল?

#পর্ব_২৭

নীরা ঘরটা গুছিয়ে নিয়ে আরেকবার তাকালো।টেবিল ক্লথ, বিছানার চাদর, জানালার পর্দা সব ঠিক আছে তো? এই ঘরটা সে মাথাপাগলার বাবার জন্য গুছিয়েছে। ভদ্রলোক বারবার টেবিলের কথা বলেছেন। একটা টেবিল চাই, টেবিলে বসে কি লিখালিখি করবেন? এই ছোট্ট টেবিলে হবে তো? নাকি পাশের ঘরের বড় টেবিল এনে দেবে? নীরা বিছানায় বসে টেবিলটা টেনে নিলো। বিছানা থেকে লিখা যাবে? টেবিলের সাথে কি আলাদা চেয়ার দেবে? আচ্ছা বালিশ ঠিক আছে তো? নীরা চিৎ হয়ে বালিশটা টেনে বিছানায় শুলো। উফ্ কি শান্তি, ভদ্রলোক আসার আগ পর্যন্ত একটু ঘুমিয়ে নিলে কেমন হয়? এ ঘরে তো কেউ ডাকতেও আসবে না। নীরা গায়ের উপর কম্বলটা টেনে নিলো, সারাদিনে অনেক ধকল গেছে।
নীরা চোখ বন্ধ করে দুমিনিট ও হলো না, তামিম এসে দড়াম করে বিছানায় বসলো।
—নীরা তুমি এখানে? আমি সারাবাড়ি খুঁজলাম। উফ্ সারাবাড়ি হেঁটে পা ব্যথা হয়ে গেছে, দেখি সরোতো।
নীরা কিছু না বলে একটুখানি সরলো।
তামিম কম্বল টেনে এর ভেতরে ঢুকে পড়লো।
—আরে জরুরি কথা ছিল। তখন তুমি বললে না, আমার মাকে বুঝাতে, বিয়ে ক্যানসেল করে দিতে, সেই ব্যাপারেই তো কথা বলতে তোমার ঘরে গেলাম; গিয়ে দেখি হারুন সাহেব ঘুমিয়ে আছে! উফ্ উঠে যাচ্ছো কেন? জরুরি কথা আছে বললাম না! বিয়ে বিষয়ক একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবো আজকেই।
—আমি এভাবে কম্বলের ভেতর শুয়ে আলোচনা করতে পারবো না। দমবন্ধ লাগছে আমার।
—তুমি যে কি বলো না নীরা! স্বামী স্ত্রীতে এক কম্বলের ভেতরেই তো সব জরুরি আলোচনা করবে। এই পৃথিবীতে স্বামী-স্ত্রী মিলে যত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা, আবিষ্কার আর ষড়যন্ত্র করেছে সব এই কম্বলের ভেতর! আমি তো শিওর এভাবে শুয়ে কথা বললে এটম বোম আবিষ্কার সম্ভব! এই যেমন আমার মা-বাবা আমাকে যখন আনবে বলে আলোচনা করলো, তখন ঠিক এইভাবে…..
নীরা চিৎকার দিয়ে বললো,
—স্টপ… ফিলোসফি বন্ধ! আপনার জরুরি আলাপ শেষ করুন। বাড়িতে লোকজন গমগম করছে, কেউ চলে এলে! শাড়ি টানাটানি বন্ধ, একদম বন্ধ!
—কি যে গরম লাগছে নীরা! দাঁড়াও টিশার্টটা খুলে নিই আগে। তোমার কাছে আসলেই গরম লাগে আমার। ব্যাপারটা বুঝলাম না। তুমি কি হিটার?
নীরা বিড়বিড় করে বললো, আজ এমনিতেও গরম।
তামিম কম্বলের ভেতর শুয়েই টিশার্ট খুলে মেঝেতে ছুঁড়ে মারলো।।
—নীরা ফ্যানটা ছাড়ো তো একটু!
নীরা কঠিন গলায় বললো,
—পারবো না। আমি টায়ার্ড!
তামিম নিজে উঠে গিয়েই ফ্যান ছাড়লো এবং দরজা আটকাতে গিয়ে চাপা একটা চিৎকার দিয়ে নীরার কাছে ফিরে এলো।
—নীরা, নীরা…. মা এদিকেই আসছে। এ ঘরের দিকে। দেখি সরো, ওপাশে শুতে দাও আমাকে।
নীরা তড়াক করে উঠে বসলো।
—মা মানে… আপনার মা? সেলিনা ম্যাম?
তামিম জবাব দিলো না। ততক্ষণে সে ভালো কম্বলের ভেতর শুয়ে নিয়েছে।
—তুমি আমার উপর শুয়ে পড়ো নীরা। কুইক…
—আপনি মিথ্যা বল….
নীরার কথা শেষ হলো না, সেলিনা চলে এসেছেন।
নীরা কাঠ হয়ে তামিমের উপর শুয়ে শক্ত করে কম্বল আঁকড়ে ধরলো।
সেলিনা ঘরের ভেতরে এসেই বিছানার কোণে বসলেন,
—নীরা… ও আল্লাহ! তুমি এখন শুয়ে যে? সবাই খু্জছে তোমাকে। হলুদের কুলা কোথায়? রনির পেটটা ধরেছে একটু, লাস্ট ওয়ান আওয়ারে একবারও যায়নি। আমার তো খুব টেনশন লাগছিলো। যাক বাবা এন্টিবায়োটিক কাজ করা শুরু করেছে! উফ বাবা, এখন তো তোমায় অসুস্থ মনে হচ্ছে।
—না, না.. আসলে একটু ক্লান্ত লাগছিলো তাই শুয়ে পড়লাম।
—আরে এইসব ক্লান্তি ফ্লান্তি বাদ দাও। উঠো, শরীর ঝারা দিয়ে উঠে পড়ো। তাড়াতাড়ি আসো…. খুব হই হুল্লোড় হচ্ছে নিচে। আচ্ছা, আমার গর্দভটাকে দেখাছো? তাকে তো দেখছি না কিছুক্ষণ ধরে। সে কি বাড়িতে আছে না ফকিরনীর ভিক্ষাপট্টিতে চলে গেছে কে জানে? মেয়েটা কেমন কাবু করেছে ভেবেছো? সে বিয়েবাড়ি ফেলে চলে গেছে!
নীরা প্রায় শ্বাস বন্ধ করে শুয়ে আছে।
—আপনি যান ম্যাম, আমি আসছি।
সেলিনা উঠে দাঁড়ালেন,
—নীরা আর একটা কথা, তামিমের বাবা একটু ড্রিঙ্ক করবেন রাতে। তাকে কি একটু নিরিবিলি একটা রুম দেওয়া যাবে? বুঝোই তো…
নীরা কোনোরকমে বললো,
—আপনি যান, আমি এক্ষুণি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

সেলিনার মনটা খারাপ হয়ে গেল। মেয়েটা খালি যান যান বলছে। তিনি মেয়েটার সাথে একটু দরকারি আলাপ করতে এসেছিলেন। কাল বিয়েতে তামিমের বউ আসবে, বউটাকে কিভাবে হেনস্তা করা যায় সেটা নিয়ে! অথচ মেয়েটা আরাম করে শুয়ে আছে। থাক্, সারাদিন খেটেখুটে ক্লান্ত বোধহয়!
—আর আধঘন্টা পরেই কিন্তু হলুদ শুরু হবে। স্টেজ করা শেষ৷ তুমি একটু তাড়াতাড়ি এসো মা।
সেলিনা দরজার কাছে গিয়ে আবার ফিরে এলেন।
—দেখেছো, আমার দিওয়ানা মজনু সাহেব এখানে গেঞ্জি ফেলে গেছেন। কোনো যত্ন নেই কাপড়ের। থাকবে কেন? উনার তো এখন ভিখারী পোশাক দরকার।
সেলিনা টিশার্টটা তুলে ঝেড়ে নিয়ে চলে গেলেন।

নীরা হাঁফ ছেড়ে কম্বলের ভেতর থেকে বের হতে যাবে,
হারুন প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে এসে নীরার বিছানার কাছে দাঁড়ালো।
—নীরা মা… বিরাট সর্বনাশ হয়ে গেছে, বিরাট সর্বনাশ হয়ে গেছে।
হারুনের গায়ে কাঁথা মোড়ানো। এই গরমে কাঁথা কেন? নীর বিমর্ষ গলায় বললো,
—কি হয়েছে? আপনার জ্বর এসেছে?
—না মা, জ্বর কেন আসবে? জ্বর তো আমার লাস্ট তিন বছর ধরে হয় না। গত আগস্টে পক্স হলো, তাও জ্বর হলো না।
—তাহলে আপনার বিরাট সর্বনাশটা কি?
—নীরা মা, আমি তো আপনার বিছানায় কাঁথা নাকে মুখে চাপিয়ে দিলাম ঘুম। এর মাঝে স্যার ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দিলেন। কাঁথার উপরে আমার গায়ে হাত দিয়ে ডাকলেন নীরা… ও নীরা, আমি মাথা বের করতেই স্যার রেগে গেলেন। আমি কোনোমতে দৌড়ে পালিয়ে এলাম।
নীরা গম্ভীর গলায় বললো,
—ভালো করেছেন। এখন গিয়ে চুপ করে বাবার ঘরে শুয়ে পড়ুন। গায়ে হলুদ শুরু হলে আমি ডাকবো আপনাকে।
হারুন ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো।
—কি হলো যান।
—ইয়ে মানে মা… স্যারের কাছে আমার লুঙ্গি রয়ে গেছে।
নীরা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো।
—আপনার লুঙ্গি স্যারের কাছে রয়ে গেছে?
—হুঁ। আসলে নীরা মা হয়েছে কি স্যার তো আমায় দেখে ভীষণ রেগে গিয়েছিলেন। আমিও সোজা উঠে বাঁচাও বাঁচাও বলে দিলাম দৌড়। দরজা খুলে বের হবার সময় স্যার আমাকে ধরতে লুঙ্গিতে ধরলেন। লুঙ্গি টান লেগে খুলে রয়ে গেছে। আল্লাহ পাকের অশেষ মেহেরবানী কাঁথা সাথে ছিল! ইজ্জত রক্ষা হয়েছে।
নীরা কঠিন একটা কথা বলতে গিয়েও নিজেকে সামলালো। নাফিসা এসেছে। আজ একে একে সবাই এ ঘরেই আসছে কেন? হুহ…
নাফিসা হাসিমুখে বললো,
—নীরা আপনাকেই খুঁজছিলাম। সেলিনা ম্যাম আপনায় নিতে পাঠিয়েছেন আমাকে। টারমারিক সিরিমনির সব প্রিপারেশন শেষ।
—আসছি আমি। এক্ষুণি এই ঘরটা গুছিয়ে আসছি।
নাফিসা শাড়িটা মেলে ধরে বললো,
—আমায় কেমন দেখাচ্ছে বলুন তো? এই সবুজ টিপ যাচ্ছে তো?
নীরা হাসলো।
—সবার থেকে মিষ্টি লাগছে আপনাকে। এক চোখে কাজল দেননি যে?
নাফিসা চোখ টিপলো,
—ওটা ইচ্ছে করেই। একজন যাতে আমার এই ভুলটা ধরিয়ে দেয়! আরে হারুন সাহেব না? আপনি এমন আপাদমস্তক কাঁথা মুড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছেন যে.. শরীর খারাপ?
হারুন জোরে জোরে মাথা নাড়লো।
—তাহলে? ওহ… কাঁথাটা বেশ সুন্দর! হাতের সেলাই না? কে করেছে? মিস নীরা আপনি?
—এটা আড়ং থেকে কেনা। ফুফু দিয়েছিলেন আমায়।
—বেঙ্গলী হেরিটেজ! আসলেই জসিম উদ্দীনের নকশী কাঁথার মাঠ! এবার স্টেটসে যাবার সময় আমিও নিয়ে যাবো এরকম একটা। দেখি তো হারুন সাহেব কাঁথাটা মেলে ধরুন তো!
নাফিসা কাঁথার কাজটা দেখতে হাত বাড়ালো।
হারুন ভুত দেখে পালাবার মতো দৌড় দিলো। মুখে বললো,
—আমার জীবন থাকতে আমি এই কাঁথা কাউকে দেবো না! দরকার হলে জীবন দেবো, তবু এই কাঁথায় কাউকে হাত দিতে দেবো না।
নাফিসা বিস্মিত হয়ে বললো,
—আশ্চর্য লোক তো, কাঁথা নিয়ে তিনি এমন রিয়েক্ট করছেন কেন? কাঁথার জন্য জীবন দেবার কি হলো?

নীরাও চিন্তিত বোধ করছে। নিচের মাথাপাগলটা একদম নড়াচড়া করছে না। কারণ কি? চাপা পড়ে মরে যায় নি তো আবার? এতক্ষণ তো নড়ছিলো, এখন? উফ্ নাফিসা যাচ্ছে না কেন?

(চলবে)

#তৃধা_আনিকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here