#হলিডে
#পর্ব_৩৯ (শেষ পর্ব)
লাবণীর চূড়ান্ত মেজাজ চটে আছে। ইতুর এরেঞ্জ করা এই বিশেষ হলিডে ট্রিপটাতে আসা একদম ভুল হয়েছে। এটা তার সাত মাসের শেষ সপ্তাহ৷ এখন সে কোনো নয়েজই শুনতে পারে না অথচ এটা ডিসেম্বরের থার্টি, তার মানে কক্সবাজার কনসার্টে কনসার্টময়! রনি অবশ্য বলেছিল, আমরা না যাই?
লাবণীই জেদ করে আসলো। বাঁ-পায়ের ব্যথাটা এখন ডান পায়েও শুরু হয়েছে। এখন বুঝো মজা।
রনি ওয়াটার ব্যাগে করে গরম পানি নিয়ে এসেছে।
—তুমি এক কাজ করো লাবণী, বিছানায় শুয়ে স্যাঁকটা নাও। আসো…
লাবণী মুখ শুকিয়ে বললো,
—আরেকটা ওয়াটার ব্যাগ লাগবে রনি। দু-পায়েই ব্যথা করছে।
—তোমাকে বলেছিলাম হেঁটো না বীচে। এত ছুটোছুটি করলে… তুমি তো আর ওদের মতো নও। এই স্টেজে কত কেয়ারফুল থাকতে হয়। তাছাড়া গতকাল থেকে তোমার একদম পানি খাওয়া হয়নি।
—খবরদার, ডাক্তারি বন্ধ৷ ডাক্তারি ফলাবে না। বিয়ের এত বছর পর বেড়াতে এসেছি, তাও আমি বীচে হাঁটবো না? দরকার হলে, আমায় কোলে করে তুমি হাঁটবে। তাও বেড়াবো আমি। বাবু হবার সময় যদি মরে টরে যাই? এমনিতেই অনেক দুঃস্বপ্ন দেখি!
রনির মন গলে গেল। সত্যিই তো মানুষটাকে নিয়ে সে এই প্রথম বেড়াতে এলো। তাও ইতু সবাইকে একসাথে করে নিয়ে ব্যবস্থা করলো বলে। একটা হুইলচেয়ার ম্যানেজ করা দরকার, লাবণীকে অন্তত তাতে বসিয়ে বীচে ঘুড়ানো যাবে! রনি হোটেল থেকে নিচে নামতেই দেখলো, নীরার ম্যানেজার বেলাল আসছে। তাঁর হাতে বিশাল স্ক্রিন।
—কি ব্যাপার বলো তো বেলাল? এত বড় স্ক্রিন যে!
—স্যার, রাতে মুভি দেখা হবে। বীচে বিশাল আয়োজন চলছে। সেলিনা ম্যাডাম বলেছেন, একটা মোবাইল সিনেমা হল হবে। সবাইকে টিকিট কিনতে হবে। আপনাদের তো দুইটা, তাই না স্যার?
—আর সিনেমা… তোমার ভাবীর পা ফুলে গেছে, হুইলচেয়ার কিনতে যাচ্ছি! তাও দিও দুইটা টিকিট, ভালো লাগলে যাবো।
—স্যার ফার্স্টক্লাস না সেকেন্ডক্লাস?
—ক্লাসও আছে নাকি?
—জি স্যার! ফার্স্টক্লাস সোফা, সেকেন্ডক্লাস মাদুর পেতে বালুতে।
—দাম?
—তিনটাকা আর একটাকা!
—ভাংতি তো নাই বেলাল।
—ভাংতি ছাড়া স্যার টিকিট পাবেন না। দুটো টিকিটে আলাদা আলাদা তিন টাকা করে দিতে হবে। সেলিনা ম্যামের কড়া অর্ডার। সলিড খুচরোতে বিল হবে।
—আচ্ছা! আমি ভাংতি খুঁজে দেখি। তুমি দুটো টিকিট বুক করে রাখো।
রনির কাছে আজ তিন টাকা ম্যানেজ করা বেশ কঠিন মনে হলো।
তামিম আবার হাত জোড় করে ছেলেকে বললো,
—বাবা, তুমি দাদুমার সাথে যাবে সোনা। ইউ আর এ গুড বয়! আমার সাত রাজার ধন এখন তাঁর দাদুমার কাছে লক্ষী হয়ে থাকবে। তাই না??
অন্তু মাথা নেড়ে বললো,
—দা..৷ দাব্বো না! দাব্বো না….
তামিমের ইচ্ছে করলো। ছেলেকে কটাস করে একটা চড় দিয়ে দেয়। এই ছেলে হবার পর থেকে তামিমের জীবন তামা তামা। এই হলিডে ট্রিপে এসে অবধি সে ছেলেকে কোল ছাড়া করতে পারছে না। নীরার সাথে কিছুতেই একা হতে পারছে না। এই ছেলেটা কেন হলো?
তামিম মায়ের কাছে গিয়ে কাতর নয়নে তাকালো৷ মা’কে ভুলিয়ে ভালিয়ে অন্তুকে গছাতে পারলে, তারপর সে নীরাকে নিয়ে ফুড়ুৎ হবে।
সেলিনা রোদ চশমা পরে আধশোয়া হয়ে ডাব খাচ্ছেন।
তামিমকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন।
—দুর হ.. ছেলে নিয়ে এক্ষুণি দুর হ! কোনো ঘ্যানঘ্যান চলবে না। আমি একটা পিওর হলিডেতে এসেছি।
তামিম অনুনয়ের গলায় বললো,
—মা, অন্তু তোমার কাছে আসবে বলে কাঁদছে। মা… প্লিজ…
সেলিনা অন্তুকে ডাকলেন,
—বলোতো দাদাই, তুমি এখন কার সাথে থাকবে?
অন্তু মহানন্দে বললো,
—বাব্বা.. বাব্বা…..
তামিম রেগে গেল।
—শালা, মারবো এক চড়! বাবা বাবা। যা দাদুর কাছে যা।
—খবরদার তামিম ওকে একদম ধমকাবি না। দাদুই সারাবছর তোদের পায় না। তুই থাকিস মিশনে, তোর বউ থাকে শুটিংয়ে। এই হলিডেতে তোরা দুজন দাদাইকে সময় দিবি। শুধু দাদাইকে। যা এখন। তোর বউ কই?
তামিম বিরক্ত মুখ করে উঠে দাঁড়ালো। অন্তু শক্ত করে তামিমের কলার ধরে আছে। তামিম বিড়বিড় করে বললো,
—কেন যে হলিরে বাবা?
অন্তু হাসলো।
—বাব্বা। বাব্বা!
নীরা এদিকেই আসছে।
—তুমি কি অন্তুকে বকেছো আবার?
—আশ্চর্য! বকবো কেন?
—অন্তু মুখ ফুলিয়ে কেন তাহলে?
—কোথায় মুখ ফুলিয়ে? এই তো হাসছে।
—তুমি ওকে মায়ের কাছে গছিয়ে দেবার ধান্দা করোনি তো?
তামিম করুণ চেহারা করে জিভ কাটলো।
—আমার বাবা আজ সারাদিন আমার কোলে বসে থাকবে। তাই না বাবা?
—শোনো, আমরা না ওদিকে ঝাউবনটায় যাবো। তুমি অন্তুকে কাঁধে নিয়ে নাও। আর এই নাও আমার ব্যাগটাও নাও। পানির বোতল নিয়েছো তো? এটা না, বাবুরটা!
নীরা আরো দুটো ব্যাগ তামিমের গলায় ঝুলিয়ে দিলো।
—-কাঁধে তুলো অন্তুকে!
—নীরা ব্যাগ আর নেই? মাত্র ছয়টা ব্যাগ নিয়ে আমার কেমন খালি খালি লাগছে নিজেকে।
—তুমি কি আমার সাথে ফাজলামো করছো?
—কি যে বলোনা তুমি! এক কাজ করো, তুমি আমার পিঠে উঠে পড়ো। পিঠটা তো খালিই! খালি পিঠে হাঁটা কি ঠিক হবে?
নীরা চোখ রাঙিয়ে তামিমের দিকে তাকালো।
—অন্তুসোনা, তুমি বাবার চুলে শক্ত করে ধরে বসো! শোনো, সামনের মাসে আমার লং টাইম আউটডোর আছে। আমি তোমাদের আজ ভালোকিছু ছবি তুলবো। অন্তু যখন তোমায় মিস করবে, তখন দেখবে।
তামিম একহাজার মাইল লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। পারিবারিকভাবে বিয়ের অনুষ্ঠানের পর কিছু বুঝবার আগেই অন্তুটা হয়ে গেল। এই ছেলে হবার পর থেকে তামিমকে নীরা যেন দেখেই না। আর অন্তুটাও কিছুতেই তামিমকে নীরার কাছে ঘেঁষতে দেয় না। এমনকি রাতে অন্তু ঘুমিয়ে পড়লেও তামিম নীরার কাছে শুতে গেলেই উঠে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে চিৎকার। কতরাতে তো এমন হয়েছে মা পর্যন্ত জেগে উঠে এসে বলেছে,
—কিরে, তুই কি বউমার কাছে শুতে গেছিলি?
লজ্জায় তামিমের মরে যেতে হয়েছে তখন! এমন হাড়বজ্জাত ছেলেকে তামিম ছাড়বে না। কিছুতেই না। ছেলের হানিমুনে যাবার দিন সকালে সে হার্ট এটাকের নাটক করবে। হুহহহহহ…..
—কি ব্যাপার বলোতো তোমার? এমন কাঁদো কাঁদো মুখ করে কি ভাবছো বলোতো? একটু হাসো। ছবিগুলো তো ভালো আসছে না। অন্তু বাবা, বাবার কানদুটোতে ধরো তো… গুড!
তামিম সবগুলো দাঁত বের করে হাসার ভঙ্গি করলো। এই নীরাটা এত পাষাণ কি করে হতে পারলো? একটু তো লুকিয়ে টুকিয়ে তামিমকে আদর করে নিলে পারে। না, তা না! সারাক্ষণ অন্তু বাবা, অন্তু বাবা! তামিম ভেবে পায় না, বাচ্চা হবার মতো একটা ভয়াবহ ব্যাপার কি করে স্বামী স্ত্রীর বিবাহিত জীবনে ঢুকে গেল?
পারভীন আরা মহাবিপদে পড়েছেন। তার প্রস্রাবের সমস্যা দেখা দিয়েছে। একটু পরপরই বেগ হয়ে দু-এক ফোঁটা প্রস্রাব হচ্ছে। এই দু-একফোঁটার যন্ত্রণায়ই তাকে বারবার হোটেলে ছুটতে হচ্ছে। কিন্তু বীচ থেকে হোটেলে যাবার পথ তার কাছে বারবার গুলিয়ে যাচ্ছে। বীচে যে যার মতো ঘুরছে, তার খবর নেবার কেউ নেই। সোবহান সাহেব মদ খেয়ে মনের আনন্দে বালুতে গড়াগড়ি খাচ্ছেন।
পারভীন আরা একবার গিয়ে বললেন,
—ওগো চলো, হোটেলে চলো প্রস্রাব করবো।
—হোটেলে যাবার কি দরকার? এইখানে পানিতে নেমে করে ফেলো। কেউ বুঝবে না। এমনিতেই সমুদ্রের সব পানি নোনতা! ব্যস, তোমার নোনতা পানি এর স্বাদ আরো বাড়িয়ে দেবে।
—ছিঃ!
সোবহান সাহেব ভ্যাকভ্যাক করে হাসলেন।
—রাতে আমরা মুভি দেখবো। ফার্স্টক্লাসের টিকেট। বেয়াইন সাহেবা সম্মান করে দিলেন। নাও রাখো।
পারভীন আরা মুখ গোমড়া করে টিকিট দুটো হাতে নিলেন।
রনি দুটো ডাব হাতে এদিকেই আসছে।
—মা নিন, ডাব খান। ডাব খেলে ভালো লাগবে।
এই সিরাপটা থেকে এক কাপ পানিতে মিশিয়ে খেয়ে নিন। রনি পকেট থেকে ঔষধ বের করে দিলো।
পারভীন আরা আশ্চর্য হয়ে গেলেন,
—তোমায় কে বললো বাবা?
—লাবণী। আপনি বারবার হোটেলে ছুটে যাচ্ছিলেন। তখনি বললো, প্রায়ই নাকি এরকম হয় আপনার। এইবার ঢাকায় গিয়ে কিছু টেস্ট করিয়ে নেবেন তো। আমি যাই মা। কিছু লাগলেই ফোন করবেন। লাবণীকে একা বসিয়ে এসেছি।
পারভীন আরার চোখ মমতায় ভিজে গেল। নিঃসন্তান তিনি অথচ এই ছেলেটা যে মাঝে মাঝে কি করে না! নিজের ছেলেই মনে হয়।
দূরে ইতু বসে বই পড়ছে। এই মেয়েটা সারাদিন কি এত পড়ে কে জানে? নিজেই হলিডের এই প্ল্যানটা করলো অথচ বেড়াতে এসে কেমন নিরুত্তাপ! পারভীন আরা চেঁচিয়ে ইতুকে ডাকলেন।
—ডাব খাবে ইতু???
ইতু হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়ালো। প্রায় দৌড়ে ছুটে এলো।
—ডাব কোথায় পেলেন? খুব তেষ্টা পেয়েছিলো!
—রনি দিলো।
—থ্যাংক্স আন্টি। কি ট্র্যাজেডি দেখেছেন আন্টি, চারিদিকে পানি অথচ তেষ্টা মেটাবার কোনো উপায় নেই। তেষ্টা পেলেই পানি খুঁজতে হচ্ছে। কি যেন একটা গান আছে না, লালন মরলো জল পিপাসায় থাকতে নদী মেঘনা…. হাতের কাছে ভরা কলস তৃষ্ণা মেটে না!
ইতু মিষ্টি করে হাসলো।
—তুমি সারাদিন কি এতো পড়ো মা?
—একটা রিসার্চ ওয়ার্ক আছে, সেটার জন্য ক্লু খুঁজতেই রেফারেন্স বইগুলো পড়তে হচ্ছে!
ইতু স্ট্রটা ফেলে দিয়ে ডাবটা উপরে তুলে মুখের উপর ধরলো। গাল আর গলা বেয়ে ডাবের পানি পড়ছে তার।
পারভীন আরা ডাবের স্ট্রটা মুখে নিলেন। তাঁর হঠাৎ করেই মনে হলো, জীবন অনেক সুন্দর। এর ভীষণ সুন্দর মানে হয়। যারা যারা জীবনের এই সুন্দর মানেটা খুঁজে পায়, তারা আসলেই ভাগ্যবান।
নাফিসা শফিককে ধমকালো এবার,
—যাও, এক্ষুণি যাও। রাণী কাঁদছে তো!
শফিকের চূড়ান্ত মেজাজ খারাপ লাগছে। এই নিয়ে সে মোট আট ধরনের আচার এনেছে। যেটাই আনছে, সেটাই রাণী থু করে ফেলে দিচ্ছে। নাফিসা তাতে বেশ মজা পাচ্ছে। সেও রাণীর সাথে সাথে বলছে, থু।
—-এবার কিন্তু আঙ্গুরের আচার আনবে।
—-আশ্চর্য! আঙ্গুরের আচার আমি কই পাবো? বীচের এত রোদে আমি আর যেতে পারবো না। আচারের দোকানদার আমায় দেখলে দাঁত বের করে হাসছে।
—হাসুক। রোদ তো… দরকার পড়লে ছাতা নিয়ে যাও! নাহলে আমার রাণী মা কাঁদবে। কি রাণী মা তুমি কাঁদবে না?
রাণী তক্ষুনি ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেললো।
শফিক হাতের বাকী আচারগুলো ছুঁড়ে ফেললো।
—সবাই কেমন সুন্দর বেড়াচ্ছে দেখো বীচে। রিতু আর দুর্নিবারকে দেখলাম ওয়াটার বাইক চড়ছে, অথচ তোমরা মা মেয়ে বসে বসে মাথা খাচ্ছো আমার! কত কষ্ট করে আমি ছুটি ম্যানেজ করেছি জানো?
—খবরদার একদম ছুটির দোহাই দেবে না। কি আমার ডাক্তাররে। উনি ছাড়া যেন এদেশের রোগীর চলছে না। যাও, আচার নিয়ে আসো।
শফিক গম্ভীরমুখ করে বললো,
—আমি পারবো না। আমি এখন বসে বসে সমুদ্রের ঢেউ দেখবো।
নাফিসা আর রাণী দুজনেই ভ্যাঁ ভ্যাঁ শব্দে চিৎকার শুরু করলো।
শফিক তাকিয়ে হেসে ফেললো। বিয়ের আগে মনে হতো, নাফিসা শফিকের জন্যই শফিককে বিয়ে করেছিলো। কিন্তু মাঝে মাঝে শফিকের মনে হয়, মূলত রাণীর জন্যই নাফিসা শফিককে ভালোবেসেছিলো বুঝি!
—কি হলো? তুমি এখনো গেলে না? দেখছো না, আমরা মা মেয়ে কাঁদছি। আমাদের চোখের জলে সমুদ্রের পানি কেমন বেড়ে যাচ্ছে। আর কিছুক্ষণ কাঁদলে জোয়ার চলে আসবে শিওর।
—আসুক জোয়ার। আমি যাবো না!
—যাবে না?
—না। আমি আর কোনো আচার আনতে পারবো না।
—পারবে না?
—না না না…..
—আমি এক্ষুণি হেলথ মিনিস্টৃতে ফোন দিচ্ছি, এক্ষুণি ওরা তোমার ডাক্তারি লাইসেন্স ক্যানসেল করে দিক। দিবো ফোন?
নাফিসা ফোন ডায়াল করলো,
—হ্যালো বাবা, তোমার স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে কি একটু পাওয়া যাবে?
শফিক উঠে দাঁড়ালো। নাফিসার কোনো বিশ্বাস নেই।
—যাচ্ছি আমি। যাচ্ছি তো বাবা৷
নাফিসা ফোন রেখে খিলখিল করে হেসে উঠলো। দুপুরের রোদ গালে পড়ে তাকে কি অপূর্ব লাগছে দেখতে! ইশ্ এই মেয়েটার হাসি এত সুন্দর কেন? একটু মুটিয়ে যাওয়ায় গালের টোলটা যেন আরও বেশি গর্ত দেখাচ্ছে! রাণী হাত তালি দিয়ে উঠলো,
—বাবা ভয় পেয়েছে, বাবা ভয় পেয়েছে… কি মজা। কি মজা! বাবা নানাভাইকে ভয় পেয়েছে।
সেলিনা একে একে সবার নাম লিস্ট করে লিখিয়ে নিচ্ছেন। ফার্স্টক্লাস আর সেকেন্ড ক্লাস আলাদা আলাদা করে। হারুন করুণ মুখ করে বসে আছে।
তার নিজের নাম ফার্স্টক্লাসে অথচ তামিম স্যারকে তিনি দিয়েছেন সেকেন্ডক্লাস। স্যারকে মাটিতে বসিয়ে সে কিভাবে সোফায় বসতে পারে? সবাই ম্যাডামের নিজের লোক। এখানে এত ফার্স্ট সেকেন্ডের কি আছে? যত্তসব।
হারুন দৃঢ় কণ্ঠে বললো,
—আমি মুভি দেখবো না ম্যাডাম। আমার টিকিট ক্যানসেল করে দিন।
—মুভি দেখবে না মানে? অবশ্যই দেখতে হবে। যারা বেড়াতে এসেছে সবাইকে মুভি দেখতে হবে। টিকিট যারা কাটবে না, তাদেরকেও বাধ্যতামূলক মুভি দেখতে হবে। তবে তারা মাদুরেও সিট পাবে না। ডিরেক্ট বালিতে বসবে। নিজের ছেলেকেই আমি ছাড় দিচ্ছি না, দেখছো না?
—এটা কি ঠিক হচ্ছে ম্যাডাম?
—আমাকে ঠিক বেঠিক শেখাচ্ছো যে? তুমি কি আমার ঠিক বেঠিকের স্যার? বলো, বলো….
—না ম্যাডাম, আমি আপনার সিংহাসন!
সেলিনা চটে গেলেন।
—কি বললে তুমি? কি বললে? সবসময় ফাজলামো!
হারুন প্রায় দৌড়ে পালিয়ে গেল।
দুর্নিবার অনুনয়ের স্বরে বললো,
—একটা বাবু কিন্তু আসলেই দরকার রিতু। আমাদের কি কথা ছিল? তোমার অনার্স শেষ হলেই আমরা বেবী প্ল্যান করবো। অনার্স শেষ করে তুমি রিসার্চে চলে গেছ অথচ এখনো বাবুকে আনার কোনো আয়োজন নেই।
—কোনো বাবুর দরকার নেই। তখন হয়তো বলেছিলাম, এখন না বলছি। আই ডোন্ট নিড এনি বেবী।
—এভাবে ছেলেমানুষী করলে হয় রিতু? আমরা বুড়ো হয়ে গেলে আমাদের কে দেখবে? তাছাড়া সবাই দেখো কেমন বাচ্চা কোলে নিয়ে আদর করছে। আমরাই শুধু…..
—আমি আপনার বাবু। নিন আমায় কোলে নিয়ে আদর করুন তো… নিন নিন।
রিতু হাত উঁচু করলো।
দুর্নিবার পাথারে করে রিতুকে কোলে নিলো।
—প্লিজ রিতু… প্লিজ… একটা বাবু! ও রিতু…..
রিতু চোখ বন্ধ করে বললো,
—-হবে না, হবে না।
ইতু পাশেই ছিল। বিরক্ত হয়ে বললো,
—উফ্ রিতু! দিয়ে দে না একটা বাচ্চা। বেচারা এত ঘ্যাঁনঘ্যাঁন করছে।
—ইয়েস ইতু…. তুমি একটু বোঝাও তো তোমার বোনকে, প্লিজ। আমি সব ম্যানেজ করবো, দরকার হলে মুভিতে কাজ করা কমিয়ে দিয়ে বাচ্চার দেখাশোনা করবো। ওকে কোনো ঝামেলা দিবো না।
—বেচারা বলছেই তো রিতু, বাচ্চা উনি দেখবেন। তো?
—বাচ্চা কি এতো সোজা নাকি? তুই বরং একটা দিয়ে দে না ইতু….. প্লিজ ডিয়ার সিস্টার, হেল্প মি৷
ইতু বিরক্ত হয়ে ওঠে গেল। এই রিতুটার মুখে কিছুই আটকায় না।
ইতু চলে যেতেই রিতু দুর্নিবারের কানে ফিসফিসিয়ে বললো,
—আমায় হোটেলে নিয়ে চলুন। এক্ষুণি।
—এক্ষুণি?
—হুঁ, এক্ষুণি মানে এক্ষুনি।
—এক্ষুণি কিভাবে যাই বলোতো? একটু আগেই মাত্র এলাম!
—না গেলে , হবেনা হবেনা, হবেনা!
রিতু লম্বা করে চুমু খেয়ে নিলো দুর্নিবারকে।
—উফ রিতু! এসব কি হচ্ছে? সবাই দেখছে। লাস্ট উইকে দুটো পিকচার লিক করে গেছে আমাদের।
—তাহলে হোটেলে চলুন!
সেলিনা হন্য হয়ে হারুনকে খুঁজছেন। ডিনারের সব এরেঞ্জমেন্টস এর দায়িত্ব তিনি কেন যে এই গাধাটাকে দিয়েছেন? আজকের ডিনারটা কত স্পেশাল অথচ দুপুর থেকেই সে হাওয়া। এত বড় বীচে এখন কোথায় পাওয়া? মাইকে একটা এনাউন্সমেন্ট করানো দরকার।
দুর্নিবারকে সামনে দেখেই ধমকালেন,
—তোমার ব্যাপারটা কি বলোতো দুর্নিবার? সারাক্ষণ বউ কোলে করে হাঁটছো! বউ তো এই পৃথিবীতে তোমার একার নয়! আরো মানুষের তো বউ আছে নাকি? গতকাল তো তোমাকে ওয়ার্ন করা হলো।
দুর্নিবার রিতুকে নামাতে চাইলো। রিতু আরো শক্ত করে দুর্নিবারের গলা জড়িয়ে ধরলো।
—নামাও ওকে, এক্ষুণি নামাও। সকাল সন্ধ্যা বউ কোলে করে হাঁটা। তোমার শ্বশুর যে দেখছে, সেই খেয়াল কি আছে? পেপারে পর্যন্ত তোমাকে বউয়ের গোলাম লিখে নিউজ হচ্ছে। ছিঃ.. এতবড় নায়ক হয়ে এমন দশা!
রিতু কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
—দেখেছো মা, নামাচ্ছেই না। আমি কোলে উঠতে না চাইলেই সে রাগ করে।
দুর্নিবার মাথা নিচু করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সেলিনা আরো রেগে গেলেন।
—নামাবে না তো? ওকে.. তুমি আর তোমার বউ অমাদের গ্রুপ থেকে বাদ। এক্ষুণি বাদ! বেলাল…….. বেলাল…….
বেলাল রেজিস্টার খাতা হাতে হাজির হলো।
—রেজিস্টার থেকে এই বাঁদর দুটোর নাম কাটো। কুইক।
বেলাল বিষন্ন গলায় বললো,
—ওহ! স্যার। আপনি আবার ম্যাডামকে কোলে নিয়েছেন? আপনার কি কোমরও একটু ব্যথা করে না? ম্যাডাম তো নিশ্চয়ই ৪৫ কেজির কম হবে না।
নিন স্যার, নাম বাতিলের পেপার। এখানে একটা সাইন দিন।
রিতু গম্ভীরমুখে বললো,
—মা, তোমাদের জামাই তো সাইন দিতে পারবে না। দেখছোই তো, তাঁর হাত বন্ধ! তাঁর বদলে আমি সাইন করে দিই?
সেলিনা ঠাস করে রিতুর গালে একটা চড় দিলেন।
—ধারি মেয়ে, কোনো লজ্জা নেই!
রিতু হেসে ফেললো। সেলিনা বেলালকে নিয়ে হারুনকে খুঁজতে চলে গেলেন।
—তুমি যে কি পাগল না রিতু! মা কি ভাবলো? শুধু শুধু থাপ্পড়টা খেলে।
রিতু আবার দুর্নিবারের গালে চুমু খেলো।
—থাপ্পড়ে ব্যথা পাই না গো হিরো সাহেব, ব্যথা তো পাই আপনার আদর না পেলে।
রিতু দুর্নিবারের ঘাড়ের দিকে আলতো করে কামড় বসিয়ে দিলো।
দুর্নিবার প্রায় দৌড়ে হোটেলের দিকে ছুটছে।
ইতু দূর থেকে ব্যাপারটা দেখে হাসলো। মানুষগুলো কি বোকা! সম্পর্ককে আঁকড়ে ধরে আনন্দে বেঁচে থাকার কি চেষ্টা! দিনশেষে সম্পর্ক বলে কি আসলেই কিছু আছে? নেই…. যা থাকে তা হলো সাকসেস। সফলতা…
ইতুর হঠাৎই মনে হলো, আজ রাতে বৃষ্টি হবে। ভীষণ বৃষ্টি।
সেলিনা ইতুর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। ইতুর কাঁধে হাত রাখলেন। ইতু চমকে কেঁপে উঠলো,
—মা, সারা কক্সবাজার ঢি ঢি পড়ে গেছে বাংলাদেশের নামকরা একজন তরুণ ক্রিকেটার এসেছেন। দেখেছো?
—হ্যাঁ। শুনেছি তো!
—সেই ক্রিকেটার আবার আমাদের মতো ফুল ফ্যামিলি নিয়ে হলিডেতে এসেছেন। উঠেছেনও আমাদের হোটেলে। একই তলায়, পাশাপাশি। কি দারুণ মিল, তাই না?
সেলিনা শুকনো একটা ঢোঁক গিললেন। ইতু কিছু ধরে ফেলেনি তো!
—আবার দেখো, সেই ক্রিকেটার আজ রাতে আমাদের সাথে ডিনারেও বসছেন। তাই না? তোমরা কি প্ল্যান করেছো বলোতো?
—তোর বাবা ও’র বাবার পরিচিত বলে এমনি ভদ্রতা করে ডেকেছেন ডিনারে।
—মা, তোমরা কি আমাকে গাধা ভাবো? আমি মাইক্রোবায়োলজির ছাত্রী। তুমি আর বাবা কি করে ভাবলে যে, সারাক্ষণ বল হাতে হা করে দৌড়াচ্ছে, এমন একটা হাঁদাকে আমি বিয়ে করবো? এই লোকটা আবার দেখলাম কঠিন বাঁ-হাতি! আমার তো ক্ষীণ সন্দেহ এই লোকটা বাঁ হাতে ভাতও খায়! ইয়াক…
—সেলিব্রিটি ক্যারেক্টার, কটাবছরের ক্যারিয়ারে খালি রেকর্ড আর রেকর্ড। লক্ষ লক্ষ মেয়ে লাইন দিয়ে আছে ওকে বিয়ে করতে। কিন্তু ওর মা তোকে ভীষণ পছন্দ করলো বলে…
—দুদিন পর আমি ইউনিভার্সিটির টিচার হবো মা, আমার কাজ হবে ছেলেমেয়েদের পড়ানো। আর ওই বলওয়ালা কি বলবে? আয় ছেলেরা, আয় মেয়েরা বল খেলিতে যাই! একটা ধেরে টাইপ লম্বা একটা লোক বল নিয়ে উরুতে ঘঁষছে, সেটা আবার বিশাল স্ক্রিনে দেখাচ্ছে, ছি ছি ছি….
সেলিনার কপাল ঘামতে লাগলো। ইতু এত কেন রেগে আছে? শেষমেশ অনমকে সে পছন্দ করবে তো?
(সমাপ্ত)