নিনীকা #পর্ব_২১_ও_২২

0
383

#নিনীকা
#পর্ব_২১_ও_২২

#পর্ব_২১

বিয়ে শেষে ক্লাব থেকে রওনকদের বাসায় আসার সময় পাপার সাথে সাথে নিনীকাকে নামিয়ে দিতে বাড়িশুদ্ধ সবাই প্রায় চলে এলো। দাদীমা, মা, নাসিদা খালা, আরো কিছু গেস্ট। সবাই নিনীকাদের পক্ষ থেকে রওনকের একটি বোনের কথা সে শুনেছিলো, সেই বোনকেও বিয়েতে নিনীকা দেখেনি। রওনকদের নিজের লোক বলতে ইলা ছাড়া আর কেউ-ই ছিল না। বিয়ের মাঝখান থেকে ইলাও লা-পাত্তা। মানে কি?

পাপা নিজের বাড়ির মতো করে সব গুছিয়ে দিয়ে গেলেন। রওনকের অসুস্থ মা, চাকর-বাকর সব সামলাচ্ছে। এই এত সুসজ্জিত শ্বশুরবাড়িটাকে নিনীকার খুব নিষ্ঠুর মনে হলো। খুউব।
তবে রওনকদের বাড়িতে সবচেয়ে হুলূস্থুল হলো নিনীকার বাসর ঘর দেখে। ঘরটা সাজানো হয়েছে ডিফারেন্টভাবে। সিলিং থেকে ফ্লোর অবধি ঘরের ভেতরে চারদেয়ালে আয়না লাগানো হয়েছে, দরজার অংশটা ছাড়া। তার উপর লম্বা করে ডিফারেন্ট কালারের গোলাপ লাইন করে ঝুলানো। ঘরের ভেতরে বিছানা ছাড়া আর কোনো ফার্নিচার নেই।ব্যবহার করা হয়েছে মাল্টিকালার আলো। ঘরের যে প্রান্তেই কেউ দাঁড়াক না কেন তাকে ফুলগুলোর মাঝে মাঝে ভিন্ন ভিন্ন রঙে চারদিকে সেই আয়নায় দেখা যায়। বিছানাটা রাখা হয়েছে ঘরের মাঝামাঝি। বিছানায় শুলেই দেখা যাচ্ছে পুরো অন্য একটা জগৎ। দাদীমা তো ঘর দেখেই নিনীকার কানে কানে ফিসফিস করে বললেন,
—নিনী কাপড় খুলবি খুব হুঁশিয়ারে। বাতি নিভানোর পর খুলবি কিন্তু। আয়নার যেই ব্যবস্থা তোর জামাই করে রেখেছে না, তুই যেদিকেই কাপড় খুলবি ব্যাটা দেখবে। বুদ্ধি দেখেছিস! সব ব্যাটা একরকম। ভিতরে ভিতরে খালি শয়তানি। চোখ দিয়েই খাওয়ার ব্যবস্থা।
নিনীকার অবশ্যি ঘরটা ভালো লেগেছে। বেশ ভালো লেগেছে। এরকম ঘরের থিম সে কখনো ভাবেইনি। নিনীকা বরং একেকসময় একেকভাবে বসে চেক করছে তাকে কেমন দেখাচ্ছে।

রওনকের ঘরে যেতে ইচ্ছে করছে না এখন। ক্লান্ত লাগছে। একটু ছাদে গেলে কেমন হয়? রওনক ছাদের দিকেই যাচ্ছিলো, নিনীকার ফোন! ফোনটা কেটে দিয়ে রওনক ঘরে এলো। নিনীকা এর মধ্যেই শাড়ি বদলে ফেলেছে। বদলায়নি ঠিক… ব্লাউজের সাথে সেলোয়ার পরে আছে। জামা কেন পরেনি মেয়েটা?
রওনককে দেখেই ব্যস্তভাবে বললো,
—কাপড় জামা রাখবার এ ঘরে তো কিছু নেই!
রওনক বারান্দার দরজার এক পাশ দিয়ে আরেকটা সরু দরজা খুলতে খুলতে বললো,
—চেঞ্জিং রুম এটা। সব আছে এতে।
নিজেই সুটকেসটা টেনে নিয়ে যেতে যেতে নিনীকা বললো,
—আমরা কি রাতে আর খাবো না? ভাত খাওয়া হয়নি আমার! প্লেইন মাছেরঝোল দিয়ে ভাত পাওয়া যাবে?
রওনক হাসলো। নিনীকার অন্য সুটকেসটা নিজে এগিয়ে দিতে দিতে বললো,
—সোহেল এখন থেকে আপনারও ম্যানেজার, ডক্টর। যা দরকার ফোন করে দিবেন। নাম্বার আছে তো?
চেঞ্জিং রুমের দরজাটা আটকে দিতে দিতে নিনীকা বললো,
—-ম্যানেজার দরকার নেই আমার, আন্টিকে বলুন। বারো হাত কাঁকুরের তেরো হাত বিচি। যত্তসব…
রওনক আবার কপাল কুঁচকালো। বারো হাত কাঁকুর নিনীকা কাকে বলেছে? তেরো হাত বিচিটাই বা কে?
প্রায় সাথে সাথেই নিনীকা চেঞ্জিং রুমের দরজাটা আবার খুললো,
—কি ব্যাপার আপনি দরজার সামনে এরকম ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? ভেতরে আসবেন?
রওনক থতমত খেয়ে গেল। কিছু বলতে যাচ্ছিলো,
নিনীকা থামিয়ে দিয়ে বললো,
—বিয়ের মাঝখান থেকে হঠাৎ ইলা উধাও। উনি কি খেয়ে গেছিলেন? আমায় বলে যাননি কেন? একটা ফোন করে দেখুন না।
রওনক যথাসাধ্য দৃঢ় গলায় বললো,
—আমি ফোন করতে পারবো না।
নিনীকা দরজা খোলা রেখেই গুণগুণ করে গান গাইতে গাইতে কাপড় ছাড়ছে। রওনক সড়ে এলো।
এই মেয়েটা এতো অদ্ভূত কেন?

রওনক বেড়িয়ে নিচে এলো। নিনীকাদের বাড়ির লোকেরা চলে যাচ্ছে। আশ্চর্য! মেয়েটার খবরই নেই।
রওনক তাড়াহুড়োর সাথে ঘরে এলো আবার।
নিনীকা চেঞ্জ করে ফেলেছে। এত দ্রুত! মিনি সাইজের একটা আয়না সামনে নিয়ে ফ্লোরে বিছিয়ে বসে গয়না খুলতে ব্যস্ত। চুড়ি খুলতে খুলতে নিনীকা বললো,
—আপনি ফ্রেশ হবেন না নাকি শেরোয়ানি পরেই থাকবেন চিরজীবন?
বিছানার এক পাশে বসতে বসতে রওনক বললো,
—পাপারা চলে যাচ্ছেন। আপনি বাই বলবেন না?
আয়না থেকে চোখ না সরিয়েই নিনীকা বললো,
—পাপারা মানে?
—আপনাদের বাড়ির সবাই চলে যাচ্ছেন।
নিনীকা উঠে এসে রওনকের পাশে বসলো। দেয়ালের
আয়নার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললো,
—দেখুন তো, আমরা কয় জোড়া? কয়টা রওনক আর নিনীকা দেখা যাচ্ছে?
রওনক শেরোয়ানির বোতাম খুলতে খুলতে একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে বললো,
—পরে বলা যাবে তো এসব। উনাদের বাই বলে আসুন আগে।
নাকের নথ খুলতে খুলতে নিনীকা বললো,
—তাদের যদি এঘরে আসতে বলি আপনি কি কিছু মনে করবেন?
পায়ের জুতোটা খুলতে খুলতে রওনক সোহেলকে ফোন করলো,
—হ্যালো স্যার!
—তোমার ম্যামের বাড়ির লোকদের নিয়ে এসো উপরে। আর বলবে কফি দিতে এ ঘরে।
তারপর নিনীকার দিকে তাকিয়ে বললো,
—তাদের কথার মাঝে কি আমি থাকতে পারি?
নিনীকা জবাব দিলো না। সে চোখের কাজল তুলতে ব্যস্ত!

নিনীকাকে বাই বলতে এলো, নাসিদা খালা আর
পাপা। তারা আসতেই রওনক চলে যেতে চাইলো, নিনীকার পাপা প্রায় হাত ধরে আটকালেন।রওনক হাসিমুখে বললো,
—কয়েকটা ফোনকল সাড়তে হবে আমার।
পাপার দিকে না তাকিয়েই নিনীকা বললো,
—পাপা, ঘরটা ভালো সাজিয়েছে না বলো?
—-হু খুব। হিরোদের সবকিছুই আলাদা।
পাপার কাছে এসে বসতে বসতে নিনীকা বললো,
—মা, দাদীমা কোথায়? ঘরে এলোনা যে?
আশিকুল সাহেব তাড়াহুড়ো করে বললেন,
—নিচেই আছেন। আসতে চাইলেন না। মামণি আমি তোমায় সকালে ফোন করে নিবো। গুড নাইট আপাতত।
অসহায় মুখ করে নিনীকা বললো,
—আরেকটু থাকো না তোমরা, পাপা।
পাপা হেসে তাকালেন। অভিমান ভরা আকুলতায় নিনীকা তাকিয়ে বললো,
—তোমাদের সবার যাবার বড্ড তাড়াহুড়ো। শুধু আমারই কোনো তাড়া নেই। কেন পাপা?
আশিকুল সাহেব মেয়ের দুহাত এক করে চুমু খেলেন। বিড়বিড় করে বললেন,
—অনেক দোআ রইলো মামণি। করুনাময় যেন তোমায় ভীষণ সুখী করেন। আমাদের তাড়াতাড়ি ফেরা দরকার। বুঝোই তো কত কাজ!

নাসিদা খালা চুপচাপ অনবরত কেঁদে যাচ্ছেন।
নিনীকা এগিয়ে গিয়ে নাসিদা খালাকে জড়িয়ে ধরলো।
—এতো কাঁদছো কেন খালা? আমি কি মারা গেছি?
কোনোমতে স্বর টেনে বললেন,
—ঘর গুছাই দিবো কে আপনার?
—প্রতি সপ্তাহে এসে তুমি গুছিয়ে দিবে।
নিজের গয়নাগাটি সামনে বাড়িয়ে দিয়ে নিনীকা বললো,
—এর থেকে একটা পছন্দ করে নিয়ে যাও। যখনি আমার কথা মনে পড়বে, সেই গয়নাটা পরবে। দেখবে আমি তোমায় দেখতে চলে আসবো। যদি না নাও বুঝবো, তুমি আমার কথা কখনোই আর মনে করতে চাও না।
নাসিদা খালা মনে মনে বললেন, আমি আপনারে মৃত্যুর পরেও মনে করতে চাই গো আপা।
একটা চুড়ি তুলে নিয়ে নাসিদা খালা একছুটে দৌড়ে বেড়িয়ে গেলেন। ছুডু মেডাম কি যে পাগল! বিয়ের গয়না কাউরে দেয়া যায় বুঝি?

রওনক বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফোন করছিলো, আশিকুল সাহেব ডাকলেন।
—গুড নাইট তাহলে!
রওনক হাসিমুখে মাথা নাড়লো।
আশিকুল সাহেব একটু গিয়ে আবার ফিরে আসলেন। বিব্রতভাবে রওনককে বললেন,
—ক্যান আই হাগ ইউ ওয়ান্স মাই ডিয়ার সন?
রওনক নিজেই জড়িয়ে ধরলো।
কান্নায় আর্দ্র গলায় আশিকুল সাহেব বললেন,
—আমার বেঁচে থাকার সবচেয়ে সুন্দর কারণটি আমি তোমায় দিয়েছি বাবা। আমি চাইবো, তুমি তাঁর বেঁচে থাকবার সবচেয়ে সুন্দর কারণ হবে। মেয়েটির ধারালো বুদ্ধিই মেয়েটার কষ্টের ভার সবসময় বাড়িয়ে দিয়েছে। এবার যাতে সে সব সত্য আর আনন্দের মধ্য দিয়েই খুঁজে পায়।
—আমি চেষ্টা করবো পাপা।
—মেয়েটা কখনোই আমার কাছে একটু সময় ছাড়া কিছু চায়নি, বুঝলে। আমি হয়তো সেভাবে দিতে পারিনি। আজ খুব খারাপ লাগছে, জানো? আজ খুব খারাপ লাগছে।
চোখ মুছতে মুছতে আশিকুল সাহেব দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছেন। রওনকের চোখ ছলছল করছে। নিনীকার নিজের বাবাও কি আজ এমন করতেন?নিজে এসে মেয়েকে রেখে যেতেন শ্বশুরবাড়িতে? আচ্ছা, আজ রওনকের নিজের বাবা থাকলে কেমন হতো? ছেলের বাবারা বিয়ের দিন ছেলেকে কি বলে? ছেলেদের বাবারা বিয়ের দিনে কেমন হয়? বাইরের অজস্র আলোর দিকে তাকিয়ে আছে রওনক। এই এত আলো কি আসলেই অন্ধকার কাটাতে পারছে?

#পর্ব_২২

রিসিপশান পর্যন্ত রওনক কোনো কাজ রাখেনি। তার মানে হলো, এরপরের কিছুদিন সে দম ফেলতে পারবে না। দিন-রাত কাজ! এর মধ্যে কয়েকটা চ্যানেল ইন্টারভিউস চায়। ডক্টর নিনীকা যেতে চাইবে কিনা কে জানে? শাওয়ারটা শেষ করে রওনক তোয়ালে পরেই দরজা খুলে উঁকি দিলো। নিনীকা ঘরে নেই। বাহ্ রিল্যাক্সে থাকা যাবে একটু।

রেবেকা শুয়েছিলেন রুম অন্ধকার করে। নিনীকা নক করতেই দরজা খুললেন,বললেন,
—একটু পরই আমি যেতাম তোমার ঘরে। বাড়িটা সম্পূর্ণ ফাঁকা হবার অপেক্ষায় ছিলাম।
নিনীকা ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে আলোটা জ্বাললো। রেবেকার হাত ধরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় বসলো,
—-এত কেন ভয় পান আপনি? দেখলেন তো, সব ঠিকঠাক হলো। রওনক সব সামলেছে। একটা মানুষও কিচ্ছু বুঝতে পারেনি।
—ও তোমাদের বাড়ির লোকেরা করে দিলো বলে! তোমার পাপা যে কি ভালোবাসে তোমায়! আমার ধারে বসে কেঁদে গেলেন একচোট।
নিনীকা উঠে গিয়ে দেয়ালের ছবিটার দিকে তাকালো। ছোট্ট রওনক মায়ের চুলের একটা বেণী ধরে কামড়াচ্ছে।
—এই সময় রওনকের বয়স কত ছিল, আন্টি?
রেবেকা আলমারি খুলে কিছু একটা বের করছিলেন। না তাকিয়েই বললেন,
—তখন আটমাস বোধহয়। নতুন দাঁত উকি দিয়েছে, যা পায় তা-ই কামড়ায়! চুল খেয়ে ফেলারও চেষ্টা।
—-এই ছবিটার একটা কপি করে নিয়ে রাখবো কিন্তু আমার ঘরে।সমমতাময়ী মা-হাস্যজ্জ্বল সন্তান! আপনার ঘরে অন্যরকম ভালোলাগা ঘিরে আছে ছবিটার জন্য। আন্টি রওনকের বড়বেলার ছবি রাখেননি কেন?
রেবেকা নিনীকার কাছে এসে দাঁড়ালেন। আওয়াজ নিচে করে বললেন,
—বড় রওনকটা তো তোমার মা। তুমি রেখো।
নিনীকা মিষ্টি করে হাসলো।
—আপনি কত বুদ্ধি করে কথা বলেন!
—বুদ্ধি আর কই? আমার সারাদিন খুব ভয় করছিলো, যদি ও’র কোনো ফুফু এসে বাগড়া দেয় বিয়েটাতে। রিনি আসলেও ঝামেলা ছিল। রাগ করায় ভালো হয়েছে।
—রিনি আপা কি সত্যিটা জানে?
—-ও’র তো জানার দরকারও নেই, দাদু ফুফুদের সাথে সম্পর্ক রেখে ভালোই আছে। শুধু রওনকের জানার দরকার ছিল। ও’র বড় হবার দরকার ছিল। আজ আমিও মুক্তি পেলাম। তোমরা খাবে কখন মা?
—এখনি খাবো। আপনার ছেলে কখন খায়?
—রওনকের কি কিছু ঠিক আছে বলো? আমি সব রেডী করতে বলি, তুমি ডেকে আসো একবার।
নিনীকা মাথা নেড়ে হাসলো।
—ইলা হুট করে চলে গেল কেন? বাসায় এসেছিলো?
আলমারি থেকে বার করা একটা ফাইল নিনীকার হাতে দিতে দিতে রেবেকা বললেন,
—এখানে রওনকের কেনা কিছু ভালো লোকেশানের জমি আছে। তোমার কাছে রাখো, তোমার পছন্দমতো কিছু করো তাতে। ইলার শরীর খারাপ লেগেছিলো হঠাৎ করে। বুঝোই তো, বিয়ের ধকল। তোমায় বলার সুযোগ পায়নি। আমায় ফোন করে বলে গেছে। সকালেই আসবে।
নিনীকা ফাইলটা নেড়েচেড়ে দেখে বললো,
—বিয়ের উপহার? পুত্রবধুকে দিলেন বুঝি?
রেবেকা হাসলেন,
—আমি পরে এসে চেয়ে নিবো আন্টি। এখন রাখুন।
রেবেকা নিনীকার মাথায় হাত বুলালেন।
—গোসল করেছো নাকি?
—হুম। টায়ার্ড লাগছিলো খুব। মেক-আপ থেকে মুক্তি নিতেই গোসল করা।
—-তুমি কিন্তু এমনিতেই সুন্দর দেখতে। আমি কিন্তু দেখতে গিয়ে পছন্দ করে তোমায় এনেছি। যেদিন তোমার সাথে রাতে ঘুমালাম, সেদিন রাতে ভীষণ ভালো ঘুম হয়েছিলো আমার। আমি সেদিনই বুঝেছিলাম, তুমি আলাদা। অন্য সবার থেকে আলাদা।
নিনীকা লজ্জিতভাবে তাকালো। তার চোখের ভাষা বলছে, আপনারা এত একা কেন আন্টি? এত বড় হিরোর মা আপনি অথচ কেউ কি জানে ভেতরে ভেতরে কত অসহায় আপনি? একা একা কঠিন লড়াই করে যাচ্ছেন।
রেবেকা ঔষধের বক্সটা হাতে নিয়ে বললেন,
—খাবার বোধহয় দেয়া হয়ে গেছে। তুমি গিয়ে দেখো, রওনক ফ্রেশ হলো কিনা! আমি ঔষধ খেয়ে আসছি।

উঠে চলে যেতে গিয়ে নিনীকা ফিরে এসে রেবেকার পাশে বসলো। নরম স্বরে বললো,
—কোনো মা-ই তাঁর সন্তানের জন্য অশুভ নয়। মন ছোট করে কেন সব থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখেন? এই এত বড় পৃথিবীতে আমাদের নিজের বলতে তো একটা জিনিসই আছে, তা হলো মন। মনকে প্রশান্তি দেওয়া আমাদের একান্ত দায়িত্ব। রওনক আপনার মধ্য দিয়ে এসেছে বলে বাবা পায়নি, এটা না ভেবে একবার ভাবুন তো সে আপনার গর্ভে এসেছিলো বলেই এত নাম করেছে। এই শকটা হয়তো দরকার ছিল আন্টি। আর শুনুন, বিয়েতে আমরা আপনার সব কথা শুনেছি। সবাইকে বলা হয়েছে, আপনার সিভিয়ার ব্যাকপেইন। রিসাপশানে কিন্তু এসব হবে না। থাকতেই হবে আপনাকে।
নিনীকার হাতটা ধরে অনুরোধের গলায় রেবেকা বললেন,
—মা, প্লিজ। এই রিসেপশান পর্যন্ত ছেড়ে দাও আমায়। তুমি বুঝো না কেন, আমি থাকলেই ঘুরে ফিরে রওনকের বাবার কথা আসে। ওর বাবার ফ্যামিলির কথা আসে। যেটা আমার এবং রওনকের জন্য অপমানের আর যন্ত্রণার। আমি অসুস্থ, তাই নেই। এই এক অযুহাতই ভালো। সব অনুষ্ঠান মিটে যাক। তাছাড়া তোমার স্বামীর সাংবাদিকেরা সবসময় ছুতো খুঁজছে এমনিতেই।
—আমি আছি তো আন্টি! রিসেপশানের দিন রওনকের পাশে বসে সবার সব প্রশ্নের জবাব আপনি মাথা উঁচু করে দিবেন। আপনি যে জবাবটা দিতে পারবেন না সেটা আপনার হয়ে আমি দিবো। এত কেন ভয়? কিসের ভয়?
রেবেকা চুপ করে রইলেন। জবাব দিলেন না। ছেলের ক্যারিয়ারে তিনি কোনো কালো ছায়া পড়তে দিতে চান না।
—-রিমি আপাকে কি আমি ফোন করবো একবার আন্টি?
রেবেকা শান্ত গলায় বললো,
—দরকার নেই মা।
নিনীকা আর জোর করলো না। থাক্, যে ব্যথা এত বছর ধরে মানুষটা একা বইছেন, সেটা আর বাড়িয়ে কি লাভ? ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো। একজন মা ঠিক কতটুকু সন্তানের ভালো চাইলে নিজেকে সন্তানের জীবনে অশুভ ভাবেন? অথচ নিনীকার কি আশ্চর্য জীবন! তার মায়ের জন্য সে নিজেই ছিল অশুভ এবং অপ্রত্যাশিত!

রওনক খাবার টেবিলে অলরেডি ওয়েট করছে। সোহেল বললো,
—ম্যাম বিউটিশিয়ান রয়ে গেছে। আপনি খেয়ে নিলেই সে আপনাকে তৈরি করে দিয়ে যাবে। রাতের জন্য ম্যাম দুইটা গাউন ভাবা হয়েছে, ফ্লোরাল পিংক একটা আরেকটা প্লেইন গ্লোডেন। তবে গয়না খুব লাইট।
বিস্মিত হয়ে নিনীকা বললো,
—তৈরি করে দিবে মানে? এত রাতে আবার কি তৈরি?
সোহেল মাথা নিচু করে রইলো। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে নিনীকা রওনকের দিকে তাকালো। রওনক নিনীকার দৃষ্টি থেকে বাঁচতে খাওয়ায় মন দিলো।
কঠিন গলায় নিনীকা বললো,
—সোহেল, তোমার বিউটিশিয়ানকে তুমি এক্ষুণি বিদায় করো। রিসেপশানেও আমি সাজবো না।ফারদার যদি আমার সাজগোজ ড্রেসআপের ব্যাপারে কনসার্ন দেখাতে আসো, ফল খুব খারাপ হবে। আমি তোমার স্যারের মতো সং না যে ডে-নাইট আমায় মেন্যু করে কাটাতে হবে। আমি আমার মতো। খুব সাধারণ একজন।
সোহেল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো।
রেবেকা হালকা গলায় বললেন,
—তোমাদের প্রথম রাত্রি মামণি। তাই সোহেল ওভাবে প্ল্যান করেছে। আসলে আমাদের বাড়িতে তো আর কেউ নেই যে তোমায় তৈরি করে দিয়ে আসবে।
নিনীকা চুপচাপ খেয়ে উঠে গেল। তার ভালো লাগছেনা। কিচ্ছু ভালো লাগছে না।

রওনক ঘরে এসে দেখে নিনীকা ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে বিছানায়। মেয়েটা কি ল্যাপটপও নিয়ে এসেছে সাথে?
রওনককে দেখেই ল্যাপটপে চোখ রেখেই নিনীকা বললো,
—কি ব্যাপার হিরো আপনি রেডী হননি? হিরোর ফার্স্ট নাইট বলে কথা!
রওনক জবাব দিলো না। তার লজ্জা করছে, আচমকা লজ্জা করছে। সে কি ঘরে বসবে নাকি বারান্দায় বসবে? ক’টা বাজে এখন?
—কি হলো হিরোর? এভাবে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন যে?
—না মানে, ইয়ে মানে আপনি কি কাজ করছেন ডক্টর? আমি কি শুতে পারি এপাশে?
নিনীকা জবাব দিলো না। খুব মনোযোগ দিয়ে ল্যাপটপে তাকিয়ে আছে সে।
রওনক বারান্দায় চলে এলো। বারান্দায়ও ভালো লাগছে না, আলোর ঝলমলে তার চোখ জ্বালা করছে।
ল্যাপটপটা বিছানার মাঝখানে রেখে নিনীকা রওনকের কাছে এসে দাঁড়ালো বারান্দায়।
রওনকই প্রথম কথা বললো,
—কাজ শেষ ডক্টর?
—উঁহু! কাজ ছিল না তো। এমনি বসেছিলাম।
—ঘুমোবেন না?
নিনীকা জবাব দিলো না। চুপচাপ দাঁড়িয়েই রইলো। তারপর হঠাৎ যেন কথা বললো,
—জানেন, ছোটবেলা থেকেই আমি চমৎকার গান করি। কিন্তু মজার ব্যাপার কি জানেন? আমি গান গাইলেই বাসার সবাই রাগ করতো। এমনকি স্কুল ফাংশনে গান গাইলেও বাসায় খবর চলে আসতো। বকতো আমায় মা খুব করে। ঠিক তখনি প্রতিদিন আমি আমার নিজের মতো করে স্বপ্ন দেখতে লাগলাম। দেখতে লাগলাম যে, গহীন বনের গাঢ় অন্ধকার থেকে কেউ একজন আলোর মশাল হাতে দৌড়ে আমার দিকে আসছে। সে দৌড়ে আসতে আসতে চিৎকার করে বলছে, নিনী, তোমার কোনো চিন্তা নেই আমি আসছি। তোমার ভয় নেই নিনী; আমি তোমায় গান গাইবার সব সুযোগ করে দিবো। কিন্তু প্রতিবারই মানুষটা আমার কাছে পোঁছুবার আগেই আমার স্বপ্নটা ভেঙ্গে যেত।
রওনক কৌতুহলী চোখে তাকিয়ে গল্প শুনছে নিনীকার। মেয়েটার চোখের জল গাল বেয়ে মুক্তোদানার মতো পড়ছেই। জামার বুকের কাছটা ভিজে গেছে অনেকখানি।

নিনীকা বলে যেতে থাকলো।
—আমার গান গাওয়ার সাধ অপূর্ণই রয়ে গেল।
পাপা আর মায়ের উপর কঠিন অভিমান করে পড়াশোনায় মনোযোগী হলাম। এর মাঝে আমার বড়ফুফু একটা বিরাট ভুল করে বসলেন। একটা হারমোনিয়াম কিনে দিয়ে আমায় একদিন বললেন, তোর মা কেন এত নিষ্ঠুর বলতো নিনী? সে চাইলে তুই ঠিক গান গেয়ে নাম করতে পারতি। ব্যস আমার প্রথম খটকা লাগলো।
এটুকু বলে নিনীকা থামলো।
রওনক কি করবে এখন? স্বান্তনা দিবে? ডক্টর নিনীকাকে কি বাকি অংশটা বলতে বলবে? নিনীকার হাতটা কি একটু ধরবে? বলবে এসব কোনো দুঃখই না, আমি আছি তো! আপনার গল্পটা বলুন।
এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে নিনীকাকে রওনক হঠাৎ জড়িয়ে ধরতে চাইলো।
নিনীকা সরে এলো একটু। রওনক আবার স্বাভাবিকভাবে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো,
—তারপর? প্লিজ বলুন ডক্টর। তারপর…
নিনীকা জামার হাতায় মুখটা ভালো করে মুছে নিয়ে বললো,
—একটা ধাঁধার উত্তর দিন তো, তাহলেই বলবো।
রওনকের কপাল অটোমেটিক কু্ঁচকে গেল। এই মেয়েটার কথায় কথায় ধাঁধা!
—বলুন তো কোন জিনিসের ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন নাম? জিনিস কিন্তু একই। এইদেশেই একেক জায়গায় একেক নাম। ভাষার কোনো প্রভাব নয়, নামটাই আলাদা।
রওনকের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। এসবের মানে হয়?
নিনীকা হাসছে…

(চলবে)

#তৃধা_আনিকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here