#নিনীকা
#পর্ব_৫_ও_৬
#পর্ব_৫
নিনীকা গাড়ি থেকে নামার আগে হাতঘড়িতে আবার সময়টা দেখলো। ৬টা পাঁচ। কে কে জেগে থাকতে পারে এখন? মা আর দাদীমা? মায়ের জাগবার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। রাতে তিনি স্লিপিং পিল খান।পায়ের জুতোটা খুলে নিনীকা হাতে নিয়ে নিলো। এই পেন্সিল হিলের কটকট আবার সবাইকে না জাগিয়ে দেয়। মেইন গেটটা পেরিয়ে নিনীকা জুতোজোড়া লনেই ছুঁড়ে ফেলে দিলো। দরজার চাবিটা খুলেই খুব সাবধানে ভেতরে উঁকি দিলো। না, কেউ নেই ড্রয়িংরুমে। সিঁড়ির দিকে যেতেই নিনীকা দেখলো, দাদীমার ঘরের দরজা হাট করে খোলা। দাদীমা অঘোরে ঘুমুচ্ছেন। ফ্লোরে জায়নামাজটা এখনো বিছানো। দাদীমা তাহলে ফজরের নামায পড়েই ঘুমিয়েছেন আবার। দাদীমার ঘরে সবার প্রবেশ নিষেধ, শুধু নিনীকার পাপা যেতে পারেন।কোনোকিছুর দরকার পড়লে দাদীমা দরজায় এসে ডাকেন। দাদীমার ঘরের দরজায় বড় বড় করে লিখা,
“ভেতরে প্রবেশ নিষেধ”
নিনীকা চট করে ঘরে ঢুকে গেল। জায়নামাজটা উল্টো করে বিছিয়ে দিলো। মেঝে থেকে দাদীমার চটিজুতোটা নিয়ে রাখলো দাদীমা’র মাথার কাছে।ফ্লাস্কের গরম পানিটা ঢেলে ফেলে দিলো।
নিনীকার দাদী একজন প্রচন্ড ভুতের ভয় পাওয়া মানুষ। যে কোনো সামান্য ব্যাপারকে তিনি জ্বীন-ভুত দিয়ে ব্যাখ্যা করেন এবং সবাইকে সেটা বিশ্বাসও করতে হয়। দাদীমার দলে এরকম ভুতবিশ্বাসী আরো ২জন আছে। তারা হলো নিনীকাদের বাসার বুয়া নাসিদা খালা এবং দারোয়ান সোলায়মান চাচা।নিনীকা একটা তৃপ্তির হাসি হেসে রুমে চলে এলো।এখন তার একটুও ফ্রেশ হতে ইচ্ছা করছেনা। চেঞ্জ না করেই সে বিছানায় শুয়ে পড়লো।
নিনীকার ঘুম ভাঙলো সকাল সাড়ে ন’টার দিকে।নাসিদা খালা একনাগাড়ে দরজায় নক করে যাচ্ছেন।
—ছুডু মেডাম, ও ছুডু মেডাম জলদি নিচে নামেন।জলদি আসেন। বিরাট দুইডা ঘটনা ঘটছে। ও ছুডু মেডাম…
নিনীকা বিছানা থেকে না নেমেই বললো,
—প্লিজ যাও খালা। আমি ১০মিনিট পরেই আসছি।
নিনীকা শাওয়ার নিতে ঢুকলো।
নিনীকার মা মাহবুবা চৌধুরীর মেজাজ এখন ছাপ্পান্ন।তিনি এখনো বুঝতে পারছেন না বাড়িতে এসব কি ঘটছে?
ফ্রেশ হয়ে নিনীকা টাওয়ালে চুল ঝারতে ঝারতে নিচে নামছিলো। মাহবুবা মেয়ের দিকে তাকালেন। মেয়েটা আবার শর্টস পরেছে। ফর্সা উরু দেখা যাচ্ছে। পিংক কালারের অফশোল্ডার টপের জন্য কাঁধের দিকে ব্রায়ের সবুজ ফিতা বেরিয়ে আছে। কাঁধ অবধি নেমে আসা অসমান চুলগুলো ছড়িয়ে ছিঠিয়ে আছে।কপালের দিকের চুলগুলো চুইয়ে এক-দু ফোঁটা পানিও পড়ছে। মেয়েটাকে যে কি অপূর্ব লাগছে! মাহবুবা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বাড়ি ভর্তি চাকর-বাকর। সব হা করে তাকিয়ে থাকে। অনেক নিষেধ সত্ত্বেও নিনীকা কেন এসব পোশাক পরছে? ডাক্তারি পড়ে পড়ে মেয়েটার মাথা পুরো গেছে। শরীরটাকে সে আর শরীর ভাবে না। তার কাছে এটা একটা এক্সপেরিমেন্টাল থিং মাত্র। মাহবুবা মনে মনে ভাবলেন, মেয়েকে আজ কঠিন করে কিছু কথা শোনাবেন।
নিনীকা চেয়ারে বসতে বসতেই বললো,
—গুড মর্নিং মা! পাপা ফেরেনি চাঁদপুর থেকে? নাইস শাড়ি মা, তোমায় পুরো গ্রিক দেবীর মতো লাগছে। এগেইন এ ভেরি গুড মর্নিং!
মাহবুবা হাসলেন। মেয়েটা এতো চমৎকার করে কেন কথা বলে? নিনীকার উপরে জমে থাকা তার মনের রাগটা নিমেষেই উধাও হয়ে গেছে।
—তোর পাপার আরো ৪দিন লাগবে। ফুড মিনিস্টার গিয়েছেন ওখানে, আরো তিনটা সেমিনার হবে।
নিনীকা হতাশ কণ্ঠে বললো,
—ওহ। আবার ৪দিন! মা, পাপা কেন এত ব্যস্ত থাকে?
মাহবুবা প্রসঙ্গ পাল্টালেন,
—তোর দাদীমা’র ঘরে নাকি আজও ভুত এসেছিলো!
রুটি ছিড়তে ছিড়তে চিন্তিত মুখ করে নিনীকা বললো,
—মাই গুডনেস! বলো কি? কখন?
—ফজরের পরে। তিনি নামায পড়ে শুয়েছিলেন একটু। তখনি এলো সাদা আলখেল্লা পরা। বামহাতি ভুত। ডানহাত নাকি ছিল না ভুতটার। তিনি স্পষ্ট দেখেছেন। তাঁর ঘরের বিশাল ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে গেছে।
—ও মাই গড! কি ক্ষতি করেছে?
—ফ্লাস্কটা ভেঙ্গে দিয়ে গেছে। জায়নামাজ উল্টানো।পায়ের চটি পেলেন সিথানের কাছে।
—ভুতটা কেন এসেছিলো সে ব্যাপারে কিছু বলে টলে গেছে?
—হু বলে গেছে। ২ গরু জবাই করে মিসকিন খাওয়াতে বলে গেছে। সোলায়ামান গেছে গরু কিনতে। বাদ আসর মিসকিনরা খাবে। তোর ছোটচাচা মিসকিন খুঁজতে গেছেন।
নিনীকা ভয় ভয় চেহারা করে বললো,
—আমার খুব ভয় করছে মা। যদি ভুত আমার ঘরেও ঢুকে যায় কখনো? এত বড় বাজেটের কিছু যদি আমার ঘাড়েও চাপিয়ে দেয়!
মাহবুবা নির্ভরতার ভঙ্গিতে বললেন,
—ওহো, মাই বেবী… একদম ভয় পাবি না। তোর দাদীমা দোআ পড়ে বাড়ি বন্ধ করে দিয়েছেন। ভুত ঢুকতে পারবে না আর।
—তিনি তো এর আগেও বাড়ি বন্ধ করেছিলেন।
—এবার তিনি সোনারূপার পানি ছিটাচ্ছেন।মাওলানা সাহেবকে খবর দেয়া হয়েছে। সন্ধ্যায় মাওলানা সাহেব এসে ভালো করে ব্যবস্থা করবেন।
—মা, ভুতটা কি চালাক দেখেছো? যখন যখন পাপা থাকে না তখন তখনই আসে।
—তাই নাকি? আগে তো ভেবে দেখিনি। বাই দ্য ওয়ে নিনী তুই রাতে ফিরিস নি কেন?
—আলট্রাসনোগ্রাফী ছিল ২৫টার মতো। লেইট নাইট আমায় তিনটা ওটি এসিস্ট করতে হয়েছে। তুমি তো জানোই মা, ইন্টার্ন ডক্টরদের কত খাটতে হয়! ডাক্তাররা যত দৌড়ায়, তত টাকা। সার্জন হওয়া কি অত সোজা নাকি?
—তোর বিসিএসের পড়াশোনা? প্রিলি তো এসেই গেল।
—আমি ফাঁকে ফাঁকে পড়ে নিচ্ছি। মা, তোমার হেয়ার ড্রায়ারটা একটু আনো তো। আমারটা কাজ করছে না। চুল শুকোতে হবে। আমি এখনি বেরোবো আবার।
মাহবুবা হেয়ার ড্রায়ার আনতে চলে গেলেন।
এই সুযোগে নিনীকা টি-পটের সবটা চা বেসিনে ফেলে দিলো।
মাহবুবা হেয়ার ড্রায়ার দিতে দিতে বললেন,
—ঘরে গিয়ে শুকা। এখানে খাবারে চুলটুল পড়বে আবার।
—মা, দুপুরের মেন্যুটা কি আজকে? বড় ফুফুকে লাঞ্চে বলেছি।
—সব প্রিপারেশান মাছের। চলবে?
—চলবে মা। নাসিদা খালা তো বললো বিরাট ২টা কান্ড হয়েছে? ১টা তো ভুতের বুঝলাম, আরেকটা কি?
—খবরের কাগজে তোর ছবি বেরিয়েছে!
আগ্রহী সুরে নিনীকা বললো,
—হোয়াট? শো মি কুইকলি মা।
—এই যে…
নিনীকা ক্যাপশনে চোখ বুলালো,
“চিত্রনায়ক রওনক রাজের মা হঠাৎ অসুস্থ”
স্টাফ রিপোর্টার: সোমবার রাত ১টার দিকে চিত্রনায়ক রওনক রাজের মা রেবেকা বেগম(৪৮) হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েন। বুকে প্রচন্ড ব্যথার সাথে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। তাৎক্ষণিকভাবে তাকে রাজধানীর হেলথ কেয়ার হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মোঃ মিজানুর রহমান তাকে হাসাপাতালে ভর্তি করেন এবং জানান তাকে ১দিন নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখার পর তাঁর শারীরিক অবস্থা বুঝা যাবে। এখন কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে দেয়া হয়েছে। এসময় হাসপাতালে কর্তব্যরত আরো একজন চিকিৎসক নিনীকা চৌধুরী জানান, প্রাথমিকভাবে কোনো গুরুতর সমস্যা ধরা পড়েনি। তবে সব এখনি বলা যাচ্ছে না। রিপোর্ট হাতে পেলেই সব বলা যাবে।
তবে আশংকা করা হচ্ছে, তিনি হৃদরোগজনিত সমস্যায় ভুগছেন।
চিত্রনায়ক রওনক রাজ দেশবাসীর কাছে তাঁর মায়ের জন্য দোয়াপ্রার্থী।
নিচে নিনীকা চিত্রনায়ক রওনক রাজের মা এবং হাসপাতালের অন্যান্য ডাক্তারদের হাসোজ্জ্বল ছবি।
সংবাদটা পড়ে নিনীকা বিরক্তি ভরে বললো,
—হাউ রিডিউকুলাস! এই কয়েকঘন্টার মধ্যে দেশবাসীর কাছে দোআ চাওয়াও হয়ে গেছে? তাঁর তো কোনো সমস্যাই আমরা ডিটেক্ট করতে পারিনি। বুকে ব্যথাটা ছিল, ব্রিদিং প্রবলেম এরা কোথা থেকে লিখলো? আর তাকে তো ভর্তি করা হয়ই নি। কি হরিবল ব্যাপার দেখেছো মা?
—যা খুশি লিখুক। তোর ছবি তো ছাপা হলো নাকি?
এই তুই কি কথা বললি রে নিনী? রওনক রাজ নেক্সটে কোন মুভিটা করছে?
—আমি সেধে কথা বলিনি মা। ওসব সেলিব্রিটি পেশেন্ট মানেই বিপদ।
নিনীকা হেয়ার ড্রায়ার হাতে নিয়ে ঘরের দিকে যেতে যেতে বললো,
—আমার রুমে একটা চা পাঠাও তো মা।
নিনীকা সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে গান ধরলো,
“শ্রাবণ জলে ভিজে ভিজে..
ভালোবাসা নেবো খুঁজে…
ভালোবেসে অপরাধী হবো দুজনায়….
মাহবুবা প্রায় চিৎকার করে বললো,
—স্টপ সিংগিং!
নিনীকা মিষ্টি করে বললো,
—হার্টিলি স্যরি মা। ভুলে গেছিলাম।
মাহবুবা টি-পটটা থেকে চা ঢালতে গিয়ে দেখলেন এতে এক ফোঁটাও চা নেই। তিনি বিড়বিড় করে বললেন,
” ও মাই গড! ও মাই গড!”
#পর্ব_৬
বেরোবার আগে নিনীকা দাদীমার ঘরে উঁকি দিলো।দাদীমা সিগারেট ফুঁকছেন আয়েশ করে।
—দাদীমা একটা আর্নেস্ট রিকোয়েস্ট ছিল। শুনবে?
দাদীমা জায়গা থেকে একটুও না নড়ে বললেন,
—শুনছি বল। তুই লিপস্টিক দিয়েছিস কেন? হুকুম ভুলে গেছিস? বিয়ের আগে নো সাজগোজ। বিয়ের পরে জামাই বগলে নিয়ে ইচ্ছামত সাজবি।
নিনীকা এপ্রনের উল্টোপিঠের হাতায় লিপস্টিক মুছে নিয়ে বললো,
—বিকেলে তোমার যে মিসকিনরা খাবে, তার সাথে আমার কয়েকটা বন্ধুকেও খেতে বলি?
—কেন রে? তোর বন্ধুগুলোও মিসকিন নাকি?
—ওরা মিসকিন না দাদীমা। ওদের অবস্থা আরো খারাপ। ফকিরের কাছাকাছি। বেশিরভাগেরই মা-বাবা নেই ঢাকায়। একা থেকে পড়ছে। তুমি এলাউ করলেই বলবো।
—ক’জন?
—পারহেপস হান্ড্রেড বা হান্ড্রেড সামথিং। বলবো?
দাদীমা তাচ্ছিল্যভরে বললো,
—ডিনারে বল ওদের। নাহলে আমার মিসকিনদের ওরা আবার ডিস্টার্ব করবে।
নিনীকা আনন্দিত কণ্ঠে বললো,
—থ্যাংক ইউ মাই সুইট দাদীমা। তুমি কি একটু দরজায় আসবে? আমি তোমায় একটা চুমু খাবো।
—চুমু খেতে হবে না এখন। দেখিস না আমি বিড়ি ফুঁকছি।
নিনীকা একটা ফ্লায়িং কিস ছুঁড়ে দিয়ে বললো,
—ইউ আর দ্য বেস্ট দাদীমা ইন দিস ওয়ার্ল্ড! লাঞ্চে বড় ফুফু আসবে। আমায় ফোন করে বললো, নিনী মা নাকি ভুত দেখেছে আবার! আমি দুপুরবেলায়ই আসছি।
দাদীমা রাগান্বিত কণ্ঠে বললেন,
—ভুত দেখেছি আমি, সে আসছে কেন? বুইরা ধামরি একটা, দিনের মধ্যে ১৪বার তার বাপেরবাড়ি আসা লাগে। তার ইশকাডালি কথার আমি ধার ধারি না। এখন কি সে ভুতের মেনেজার সাজছে? আমি ভুত দেখলেই তার আসতে হবে?
নিনীকা অসহায় মুখ করে বললো,
—আমি তো না ই আসতে বললাম ফুফুকে। আমায় বলে কিনা, আমার বাপের বাড়ি; আমি একশোবার যাবো। তুই না বলার কে?
দাদীমা রাগে গজগজ করতে থাকলেন। নিনীকা গাড়ির চাবিটা নিয়ে সানন্দে বেরিয়ে এলো।
দাদীমা বড় ফুফুকে একদম সহ্য করতে পারেন না।কারণ বড় ফুফুই একমাত্র ব্যক্তি যিনি লজিক ছাড়া কোনো জিনিস সহজে বিশ্বাস করেন না। সবসময়ই রেগে থাকেন। সব বিষয়েই তিনি হাইলি কেয়ারফুল এন্ড ডিটারমাইন্ড। তবে নিনীকার ব্যাপারে তিনি একটু সফট হার্টেড এবং এ বাড়িতে নিনীকার সাথেই তাঁর ভালো সম্পর্ক।
গাড়িতে বসেই নিনীকা গান ধরলো।
“মুখ লুকিয়ে কার বুকে..
তুমি গল্প শোনাও কাকে…”
গাড়িই একমাত্র জায়গা যেখানে সে নিশ্চিন্তে গান গাইতে পারে। নিনীকা স্পিডটা আর একটু তুলে দিলো। পাপা ঢাকায় না থাকলে তার অ্যাক্সিডেন্ট করতে খুব ইচ্ছা করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সাহসের অভাবে আর দুর্ঘটনা ঘটিয়ে উঠা হয় না। আজ একটু চেষ্টা করলে মন্দ কি?
নিনীকার দুর্ঘটনার চেষ্টা আজও সফল হলো না।
ক্লিনিকে নামার আগে নিনীকা একবার পাপাকে ফোন করলো,
—হ্যালো, পাপা! পা পা..
ফোন ধরেই নিনীকার বাবা ব্যস্তভাবে তাড়াতাড়ি বললেন,
—মাই সুইট মম আই’ল কল ইউ ব্যাক আফটার টেন মিনিটস! আই এম ইন এ হারি বেবী।
নিনীকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন রেখে দিলো। সে জানে পাপা দশমিনিট পর ফোন করবে না। আজ দুদিন পর সে পাপাকে ফোন করেছে। একমাত্র মেয়ে ফোন করলে কেউ কি এমন করতে পারে? নিনীকার কাছে বসে দুদন্ড গল্প করবার সময় কি তাঁর কোনোদিনই হবে না? সে কি এরকম পাপা কখনো চেয়েছিলো?
দুপুরে বড় ফুফু এসেই সবাইকে হামকি ধামকি শুরু করেছেন।
—টাকা কি গাছে ধরে নাকি? ভুত এলেই গরু জবাই। অবসর মানুষের শয়তানি সব আমি বুঝি! ভুতের এত মিসকিন খাওয়ানোর দরকার হলে ভুত নিজে টাকা দিয়ে খাওয়াক। মিসকিন খাওয়ানোতে ভুতের স্বার্থ কি?
দাদীমা ভীত মুখ করে ফুফুর বকুনি খাচ্ছেন।
সোলায়মান চাচা জ্ঞানী লোকের মত বললেন,
—স্বার্থ অস্বার্থ কিছু নাই গো আম্মা। না খাওয়াইলে আবার আইয়া ডর দেহাইবো। আমারে কইলো, যা সোলায়মান গরু কিন্না আন; নাইলে আগুনে সেঁকা দিমু। বিদ্যা আম্মা। কসম আম্মা।
নাসিদা খালা চোখ মুছতে মুছতে বললো,
—আম্মা, আমি পস্ট দেখলাম বাও হাত দিয়া ইশারায় আমারে ডাকলো। কইলো, বুড়ি যদি মিসকিন না খাওয়ায় তাঁর খবর আছে! এই মরা কাঠটা ছুইয়া কইতাছি আম্মা।
—চুপ কর নাসু। মরা কাঠ ছুঁয়ে বললে কি মিথ্যা সত্যি হয়ে যায় নাকি? তোদের ২জনের এই মাসের বেতন কাঁটা। নাউ গেট লস্ট!
নাসিদা খালা ধমকের মত করে বললেন,
—বেতন কাটলে কাটবেন। এই নাসিদা বেতন কাটারে ডরায় না। বেতনের আশায় কি ভুতের আদেশ শুনমু না?
সোলায়মান আর নাসিদা জানে, যে মাসে তাদের বেতন কাটার কথা বলা হয় সে মাসে তারা ডাবল বেতন পায়। আর সেই বেতন দেয় ছুডু মেডাম। তাঁর মন অতিব বিশাল, গাজীবাড়ির পুশকুনির মতো বিশাল। ছুডু মেডাম হইলেন সাক্ষাৎ দয়ার পাহাড়! তাঁর ঘর থাইকা ১০০০টাকা চুরি করলেও কোনো ধমক নাই।
নিনীকা দুপুরে এসেই বড় ফুফুকে জড়িয়ে ধরলো।
—আজ কিন্তু তুমি রাতে থেকে যাবে ফুফু। আমার সব বন্ধুরা ডিনারে আসছে। ডিনারের পর আমরা পুল সাইডে একটা গানের জলসা করবো। সেই পার্টিতে তুমি হবে দুষ্টু রাজা। বদমাইশ রাজার মতো আমাদের গান শুনে তুমি মদ খাবার ভঙ্গি করবে।পারবে না?
—বলিস কিরে! আজ তোর বন্ধুদেরও ডিনারপার্টি নাকি? ও মাই গড, তুই আর তোর দাদীমা মিলে লোক খাইয়ে খাইয়ে তো ফতুর করে ছাড়বি দেখছি।
—ফুফু ওরা এক বাজেটেই খাবে। এত টাকা টাকা করো না তো!
“যদি পাই বন্ধুর মন
টাকার দরকার কি কারণ?”
—এই কথাটা তুই এক্ষুণি বানালি, তাই না?
নিনীকা হেসে ফেললো।
—উফ ফুফু! তুমি কি ব্রিলিয়ান্ট!
—একদম কনভিন্স করার চেষ্টা করবি না আমায়।পার্টিতে থাকলেও ওসব মদ খাবার ভঙ্গি টঙ্গি আমি কিন্তু করতে পারবো না।
নিনীকা মনে মনে বললো, ফুফু আমি জানি তুমি আমার জন্য সব করতে পারো। একটা মরা তেলাপোকা দিয়ে যদি আমি গিলে ফেলতে বলি, তুমি ঠিক গিলে ফেলবে।
গানের জলসায় নিনীকার ফুফু সাজলো দুষ্ট রাজা, নাসিদা খালা সাজলো দুষ্টু রাজার পেয়াদা। নিনীকার বন্ধু রাসেল, সে মদ খাবার এক্টিংকে বাস্তব দেখানোর জন্য সত্যিকারের মদ যোগাঢ় করে নিয়ে এসেছে। ফুফুর হাতে দেয়া হয়েছে মদভর্তি গ্লাস। ফুফু সেই গ্লাস হাতে নিয়ে মদ খাবার ভঙ্গি করে করে দু-গ্লাস মদ খেয়ে নিলেন। এরপর থেকে প্রথমে শুরু হলো কঠিন বমি, রাত দেড়টা নাগাদ সাথে যোগ হলো লুজ মোশন। অবস্থা এতই খারাপ হলো যে, রাত তিনটায় উনাকে সিটি পলি ক্লিনিকে এডমিট করে স্যালাইন দিতে হলো। হাসপাতালে ভর্তি হবার পর থেকে ফুফু সবার কাছে মাফ চেয়ে বিদায় নিচ্ছেন। তাঁর ধারণা তিনি মারা যাচ্ছেন।
নিনীকার কাছে মাফ চাওয়ার সময় বললেন,
—নিনীরে তোর বিয়েটা দেখে যেতে পারলাম না।
নিনী সিরিয়াস মুখ করে বললো,
—ওহ ডিয়ার ফুফু, হাসপাতালে আমার অনেক বন্ধুরা এসেছে সাথে। একটা চয়েস করে দাও তো।এক্ষুণি বিয়ে করে ফেলবো। বিয়েটা দেখে যাও।
—যাদেরকে সাথে এনেছিস সবগুলাই তো মরাছড়া।পছন্দসই তো নেই একটাও। সবগুলাই তো বাঁদরের হাড্ডি! যে মদ এনেছিলো, সে কই? তারে একবার সামনে নিয়ে আয়। জিজ্ঞেস করতো সত্যিই মদ না জোলাপ নিয়ে এসেছিলো?
রাসেল দৃঢ় কণ্ঠে জবাব দিলো,
—১৯৮০ টাকা দিয়ে এক বোতল কিনলাম ফুফু।বললো তো পিওর ওয়াইন। কোরবান ডাকু রোজ রাতে এই মদটা পাঁচবোতল খায়।
সোলায়মান চাচার কাছে মাফ চাইবার সময় সোলায়মান চাচা বিরস মুখ করে বললেন,
—সবই ভুতের রাগ গো আম্মা। আফনে তাঁর কাছে খেমা চান। সে খেমা করলেই দাস্ত বন্ধ হইয়া যাইবো।ভুতেরে ত্যক্ত করায় এই অবস্থা হইছে আপনার।
ফুফু সাথে সাথে সোলায়মান চাচার আরও এক মাসের বেতন কেটে দিয়েছেন।
(চলবে)
#তৃধা_আনিকা