হলিডে #পর্ব_৩৫_ও_৩৬

0
480

#হলিডে
#পর্ব_৩৫_ও_৩৬

#পর্ব_৩৫

নীরা ভয়ে ভয়ে ফোনস্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে। আরেকবার কি ফোন করবে সে? গত দু’সপ্তাহ ধরেই দিনের নির্দিষ্ট দুটো সময়ে সে মি. তামিমকে ফোন করে যাচ্ছে। একবারে সে অনেকবার রিং দেয়। কিন্তু তার জন্য মজার ব্যাপার হলো, মি. তামিম সেই ফোনটা রিসিভ করেন না। প্রথম দিকে নীরার খারাপ লাগলেও এখন বরং ফোনটা ধরেন না বলেই নীরার বেশি ভালো লাগে। ফোন রিসিভ করে যদি নীরাকে জিজ্ঞেস করে, কেন ফোন করেছো? নীরা কি বলবে তখন?
নীরা আবার ফোনটা ডায়াল করলো। যখনি ফোনের কলিং টোনগুলো বাজতে থাকে, তার হাত-পা শীতল হয়ে বুকের ভেতরটা লক্ষ কোটি গুণ বেগে ধুকপুক করতে থাকে। আজ নীরাকে অবাক করে দিয়ে তামিম ফোন রিসিভ করে নিলো,
—হ্যালো…
নীরা কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।
—হ্যালো নীরা…
নীরা বিছানায় কাঁথা মুড়িয়ে শোয়া অবস্থায় ছিল। উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো।
—হুঁ…
—নীরা বলছো তো?
নীরা ফোনের এ পাশে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।
—কেন ফোন করেছো?
নীরা শুকনো একটা ঢোক গিললো। ঠিক জিজ্ঞেস করলো তো। বউ তার স্বামীকে ফোন করেছে, এতে প্রশ্নের কি আছে?
—হোয়াই হ্যাভ ইউ কল্ড মি?
—ফোন আমি করিনি। ফোন চলে গেছে এমনি এমনি।
—তার মানে তুমি বলতে চাচ্ছো, ফোনে আমার নাম্বারটা আপনাআপনিই উঠে এসে কল চলে এসেছে?
—হুঁ
—তুমি ফোন করোনি?
—না। আমি কেন শুধু শুধু আপনাকে ফোন করবো?
ফোনের এ পাশে তামিমের মাথায় যেন রক্ত চড়ে গেল। দুদিন হয়নি মুভির হিরোইন হয়েছে, এখনি এত ভাব? ফোন দেওয়া হয়নি আমাকে! এই যে আমি এতদিন ধরে ফোন কেন রিসিভ করিনি, সেটা তো কেঁদে কেটে কাতর হয়ে জিজ্ঞেস করবে। আজই বা কেন রিসিভ করলাম সেটা তো জানতে চাইবে। এই এতটা দিনে নীরার ফোনের দিকে তাকিয়ে তামিমের অভিমান গলা পর্যন্ত জমে কেমন শক্ত পাকিয়ে গেছে, নীরা কি একমুহূর্তের জন্য তা ভেবেছে?
—নীরা…
—হুঁ…
—আমি যদি এই মুহূর্তে দেশে থাকতাম না, তোমাকে গুলি করে দিতাম নাক বরাবর। বুঝলে?
—-হুঁ…..
—তোমার ফোনটাকে প্লিজ সামলাও। আর যাতে এমনি এমনি রিং না দেয়। কি এমন ফোন যে আপনা থেকে কল করে? কল কি শুধু আমাকেই দেয় নাকি দুর্নিবারকেও দেয়?
নীরা ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকালো। ছেড়ে গিয়ে দূরে থেকে এত শক্ত কথা মানুষটা বলে কি করে? এতদিন পরে কথা হচ্ছে, ফোনে চট করে একটা চুমু তো খেয়ে নিতে পারে; তা না করে বকাবকি করছে।
—নীরা, আমার কথা শুনছো তো? ফোন সা-ম-লে রাখবে।
—আচ্ছা!
—রেখে দেবো?
—হুঁ!
তামিম চুপচাপ কিছুক্ষণ ফোন ধরে থাকলো। তারপর আবার বললো,
—সত্যিই রেখে দেবো?
নীরা নিশ্চুপ।
—এই কটা দিনে ফোন করে অপেক্ষা করোনি তুমি? নাকি আমি ফোন ধরিনি বলে স্বস্তিতে ছিলে?

নীরা এবারও নিশ্চুপ। কি বলবে সে? কি বলা উচিৎ তার? সে কি বলবে, প্রতিটা ক্ষণেই সে শুধু তামিমকেই ভাবে। খেতে বসলে, শুতে গেলে, শাড়ি ঠিক করতে গেলে, চুল বেণী করতে গেলে তার এই মানুষটাকেই মনে পড়ে। কান্না গলায় এসে সূচের মত বিঁধে। অথচ ফোন না ধরে এখন উল্টো রাগ দেখানো হচ্ছে? নিজে তো এই অবধি একটাও ফোন করেননি, তবে? তিনি কি জানেন নীরা যে সেকেন্ড মুভিটা সাইন করেছে, তার পুরো টাকাটা সে জমা রেখেছে তামিমের জন্যে! এই যে এখন নীরার গাল ভেসে যাচ্ছে ব্যথায়।
—কি হলো? কথা নেই কেন? ওকে ফাইন, রাখছি আমি। ফারদার যদি আমাকে ফোন করবার স্পর্ধা দেখাও, আই উইল শিওরলি কিল ইউ। আমি দুটো রিভলভার ক্যারি করি জানো তো? দু-হাতে দুটো গান নিয়ে তোমায় ঝাঁঝরা করে দেবো। আমি ফরেনে বলে খুব বিনোদনে আছো, তাই না?
নীরা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। যাবার আগে নিজে সেঁধে বললো, বারবার ফোন করবে। আমায় দেখতে চাইলে, ভিডিও কল করবো। আর এখন ফোনে গুলি করা হচ্ছে!
তামিম ধমকে উঠলো আবার।
—মনে থাকবে তো? নো ফোনকল, নো নক।
নীরা কোনোরকমে বললো,
—আচ্ছা!
—আমি পড়াশোনা করতে বললে তোমার গায়ে বাঁধে না, মর্জি হয় না। আর দুর্নিবার বললেই ফরফর করে কলেজ যাওয়া। হোয়াই? সে কি হয় তোমার? কলিজা? এত আপন তোমার ও! কই এতদিনেও তো আমার একটা কথা শুনলে না। আর ওই ব্যাটা তোমার প্রাণোনাথ বনে গেল দুদিনেই? তা হলে আমাকে ফোন কেন? প্রাণোনাথকে ফোন করো।
তামিম ফোন রেখে দিলো। নীরা ফিসফিস করে বললো, উফ! ফোন টা না ধরলেই তো ভালো ছিল। একা একাই রাগ করবে, নীরার কোনো রাগ নেই! এত মাথাপাগলা হলে সংসার কিভাবে চলবে?

তামিম ফোন রেখে রিতুকে ডায়াল করলো,
—রিতু….
—ভালো আছিস ভাইয়া? মায়ের ফোন কেন ধরিস না বলতো?
—আর ফোন… আমি বাঁচবো কিনা দ্যাখ! এই কয়দিনে নীরার জীবন আকাশ-পাতাল বদলে গেছেরে রিতু। টিভিতে ওর এড অনএয়ার যাচ্ছে, দুর্নিবারের মতো হিরোর সাথে ব্যাক টু ব্যাক দুটো মুভি সাইন করে নিয়েছে।
—মুভি বাদ দে। তোর বউ তো ঢাকা শহরে ছেয়ে গেছে খুব। বেরোলেই বড় বড় বিলবোর্ডে ছবি দেখতে হচ্ছে! ভীষণ ব্যস্ত….
—তোর সাথে কথা হয় রিতু?
—পাওয়াই তো ভার! বাসায় ফিরে কখন কে জানে? সেদিন ফোন করলাম এসিস্ট্যান্ট রিসিভ করলো। ওই যে বেলাল বলে ছেলেটা, তাকে পি এস করে নিয়েছে। পরে অবশ্য ফোন ব্যাক করেছিল। আমি রিসিভ করিনি।
—ওও…..
—মা সেদিন গিয়েছিল তো ওবাড়িতে লাবণী ভাবীকে দেখতে। শুনে এলো, জুস কর্নার নাকি রমরমা চলছে। ওরা ভালো আছে বেশ। কিস্তিতে ফ্ল্যাট কিনবে ওরা।
—-আচ্ছা…
—-এমনভাবে কেন আচ্ছা বলছিস? মনে হচ্ছে তোর পেট ব্যথা করছে। তোদের কথা হয় না?
তামিম জবাব দিলো না।
—তুই ফোন করিস না কেন ভাইয়া? ফোন কর এক্ষুণি।
—তোকে বলেছিলাম, একটু কথা বলতে। আমি ওর সাথে রেগে আছি!
—দ্যাখ ভাইয়া তোর বউ, তোর ভালোবাসা! তুই পায়ে ধরে কাছে আনবি নাকি গুলি করে মেরে ফেলবি তুই ঠিক করবি! আমার কিই বা করার আছে? আমি ছোটো মানুষ!
—সে বদলে গেছে রিতু, ওটা আমার নীরা নয়।
—তুই বিদেশে বসে সেটা বুঝে গেলি! ও’র নাম হচ্ছে, মিডিয়াতে ভালো কাজ করছে, এটা কত বড় ব্যাপার! মনটা বড় কর ভাইয়া। এমন একটা চ্যালেঞ্জিং পেশায় ক্লিক করা মানে বুঝিস?
—আর আমার কষ্ট বুঝি কিছুই না?
—তুই ট্রেনিংটা মন দিয়ে কর ভাইয়া। কষ্ট পাচ্ছিস কেন? এত রাগ করলে হয়? সকাল বিকাল ফোন করে কাঁদে না বলে যে সে তোকে ভালোবাসে না, এমন ভাবার কোনো দরকার নেই।
—তুই তো ভালোবাসিস নি, তাই বুঝতে পারছিস না। সে কেন আমার জন্য ব্যাকুল হয় না? একটা পজিটিভ সাইনও কি সে শো করেছে? আমি দেশে যতদিন ছিলাম, গোমড়া মুখ করে কথা বলতো। আর টিভিসিতে দেখো, কি দারুণ স্মাইলিং ফেইস! হুহ….
—তুই যে হারে ব্যাকুল হয়ে আছিস ভাইয়া, ওখানে নীরাপু ব্যাকুল হলে তো সব শেষ।
—ও দুর্নিবারের কথায় ফট করে ফর্ম ফিলাপ করে নিলো! দুর্নিবার কি মন্ত্র দিলো বলতো?
—তুই এমন ভাবে বলছিস যেন দুর্নিবার একটা হ্যাংলা ছেলে!
—ফিল্মের হিরোর আর ওয়েটই বা কি বল?
—শোন ভাইয়া তোর বউ এমন আহামরি চাঁদের পরী নয় যে, দুর্নিবার ও’র প্রেমে পড়ে যাবে! একজন নামী আর্টিস্ট সে, এমবিএ কমপ্লিট করেছে। মোট ২১ টা মুভি করে নিয়েছে। প্রথম নয়টা মুভি ডিটেকটিভ সিরিজ, উইথাউট হিরোইন হিট করে গেছে। চারটা আর্টফিল্ম। দুটো মিউজিক্যাল কমার্শিয়াল একটা মুভিতেও সে হিরোইন রিপিট করেনি। বুঝতে পারছিস তো! এত কোয়ালিফাইড একটা মানুষ হুট করে তোর বউয়ের প্রেমে পড়ে যাবে না। সে যাকে ভালোবাসবে, শি উইল বি দ্য স্পেশাল। কোয়ালিটি থাকতে হবে।বুঝতে পারছিস? কিছু থাকতে হবে ভেতরে। সে একজন ভালো মানুষ বলে তোর বউকে পড়াশোনায় ইন্সপায়ার করেছে যাস্ট!
—তুই দুর্নিবারকে এত ডাই হার্ট সাপোর্ট করছিস, মনে হচ্ছে দুর্নিবার তোর ছোটবেলার বন্ধু।
—ভালো মানুষকে ভালো বলেছি, দ্যাটস অল। তোর এত গা জ্বলছে কেন? কি হিংসারে তোর ভেতর ভাইয়া!
—তুই এভাবে বদলে গেলি রিতু! তোদের কাউকে আমি ছাড়বো না। তোকে, নীরাকে, দুর্নিবারকে সবাইকে দেখে নেবো আমি। মাইন্ড ইট!
রিতু ফিসফিস করে বললো,
—দুর্নিবারকে গুলি টুলি করিস না ভাইয়া। গুলি লাগবে ও’র আর ঘায়েল হবো আমি রে…..
—কিছু বললি ফিসফিস করে?
—হুঁ, গান গাইলাম একটা। শুনবি?
“কত কি বলতে বাকী….
কতটা চলতে বাকী..
তোর চোখের চাউনিতে মন কতটা গলতে বাকী….
জানে মন…..
আচ্ছা ভাইয়া, মন গলতে বাকী নাকি বুক? লিরিক্সটা ঠিক হচ্ছে তো? দেখেছিস ভাইয়া।
পড়াশোনায় ডুবে থাকতে থাকতে ভালো গানগুলো ভালো করে শোনাই হয়নি। ইতুর খবর জানিস ভাইয়া, সে তো পড়াশোনা করে ফাটিয়ে দিচ্ছে সব।

তামিম ফোন কেটে দিলো। কারও খবর শুনতে তার ভালো লাগছে না। সবাই তার জন্মদিন ভুলে গেছে, এমনকি রিতুও!
লাবণীর ফোন থেকে তক্ষুনি এসএমএস এলো।
“শুভ জন্মদিন ভাইয়া”
তামিম হাসলো। শেষপর্যন্ত তিনি মনে রেখেছেন। আশ্চর্য!

ফোনের এপাশে যে লাবণী নয় নীরা, সেই কথাটা কি রিতু ছাড়া আর কেউ জানবে কোনোদিনও?

#পর্ব_৩৬

প্রাইম মিনিস্টার নাজমুল ইসলাম গম্ভীরমুখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন শফিকের দিকে। মেয়েদের সৌন্দর্যে “চোখ আটকে যাওয়া” বলে একটা ব্যাপার আছে। কিন্তু কোনো ছেলের দিকে তাকালেও যে চোখ আটকে যায়, এই জিনিসটা তিনি আজ টের পেলেন।
ছেলেটার পুরো সিভি তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছেন। এর মাঝে কারাবাসের ব্যাপারটা নাজমুল সাহেবের বেশি পছন্দ হলো। ছাত্র জীবনে তিনি যখন পার্টি করতেন, এই কারাগারে বন্দী হবার ব্যাপারটা বারবার তাকে বড় আন্দোলনে যেতে শক্তি যুগিয়েছে।

শফিক মৃদু হাসলো,
—স্যার, আপনি বলেছেন পাঁচমিনিট থেকে এক সেকেন্ড সময়ও আমায় বাড়তি দেবেন না। এখন তিন মিনিট সাত সেকেন্ড স্যার। এর মধ্যে যদি আমি আমার কথাটা না শুরু করতে পারি, তবে শেষ করতে পারবো না। প্লিজ স্যার….
নাজমুল সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, শফিকের কাছাকাছি এসে মুখোমুখি দাঁড়ালেন তিনি।
—সময়ের প্রতি খুব কনসার্ন দেখছি তুমি।
—জি স্যার, আমার জীবনে স্যার সময়ই সবকিছু। আমার জীবনের লাস্ট মোমেন্ট পর্যন্ত ফাইট করতে হবে এই সময়টাকে কাজে লাগানোর জন্য। যেমন আপনার জীবনে ক্ষমতাই সবকিছু। আবার দেখবেন কারো কারো জীবনে টাকাই সবকিছু! তেমনি….
নাজমুল সাহেব মনে মনে আনন্দ পেলেন। ছেলেটা শুরু করেছে শক্ত কথা দিয়ে কিন্তু বলছে খুব স্বাভাবিকভাবে। এই ধরনের লোকেরা মানুষ হিসেবে সৎ হয়। কারণ তোষামোদ করার গুণ তাদের থাকে না বলেই এরা অসৎ কাজে ইনভলভ হয় না।
—স্যার, আমার একটি কন্যাসন্তান আছে। তাকে আমি দেখিনি। সে অসুস্থ স্যার! কল্পনায় আমি তাকে রাণী বলে ডাকি। আদর করি। না দেখেও আমি তাঁর সুখের জন্য প্রার্থনা করি, তাঁর জীবনে কোনো অমঙ্গল যেন কখনোই না আসে, এই কামনা করি।যদিও পিতৃস্নেহ ব্যাপারটা কি এটা সঠিক আমি জানি না, তবু প্রতি মুহুর্তে মনে হয় তাঁর ভালোভাবে বেঁচে থাকা মানে আমার ভালোভাবে বেঁচে থাকা। যার নিজের মেয়ে নিয়ে সে কাতর, সে নিশ্চয়ই অন্য বাবার মেয়ের কোনো অমঙ্গলের চিন্তাও করতে পারে না;
তাই না স্যার? তারপরও যদি আপনার মনে হয়, আমি নাফিসা ম্যাডামের শুভচিন্তুক নই, তাহলে আমি ভাববো পিতৃস্নেহ ব্যাপারটা হয়তো কোনো বাবার মাঝেই নেই। নাফিসা ম্যাডাম বুদ্ধিমতী। কিছুদিন পর তিনিও আপনাকে জয়েন করবেন হয়তো। কিন্তু শুধু আমার উপর রাগ করে একজন ধারালো ব্রেইনের হবু রাজনীতিবিদকে মেন্টাল শক দেওয়া কি ঠিক হবে? তারচেয়ে বরং তিনি যখন নেত্রী হবেন, তিনি নিজেই কিন্তু উনার খারাপটা মিটিয়ে দেবেন। আর আমার স্যার খারাপ সময় দেখে অভ্যাস আছে। আমি সহ্য করতে পারি।
নাজমুল সাহেব ঘড়ি দেখলেন এবার। শফিক পাঁচমিনিটের মাঝে কথা শেষ করেছে।
—স্যার, আমি কি চলে যাবো?
—শফিক, তোমার পুরো পরিবারকে নিয়ে একদিন ডিনারে বসো আমার সাথে। আমার ভালো লাগবে। আজ আমি আসলেই খুব ব্যস্ত।
শফিক হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। । হাত বাড়িয়ে বললো,
—একটা হ্যান্ডশেক তো করতেই পারেন স্যার, দেশের একজন ছাত্র হিসেবে!

হারুন বেশ আনন্দিত বোধ করছে কিন্তু মনটা তার খানিক খারাপও সাথে সাথে। তার প্রমোশন হতে যাচ্ছে। অথচ এই খবরটা সে তামিম স্যারকে বলতে পারছে না। প্রমোশনের কথাটা প্রাইম মিনিস্টার স্যার নিজে ডেকে বলেছেন। তার মতো সামান্য এস আই প্রাইম মিনিস্টার স্যারের কাজে এসেছে, এটা অকল্পনীয়। তামিম স্যার তার নামটা বলাতে আজ এই প্রমোশন। সে অবশ্য প্রাইম মিনিস্টার স্যারকে একদিন সুযোগ করে সত্যিটা বলবে। এখন তামিম স্যারের সঙ্গে মিটমাট করাটা জরুরি। কিন্তু নীরা মায়ের সাথে রাগারাগি করে স্যার তো সবাইকে ডিসকানেক্ট করে দিয়েছেন। এই নীরা মা স্যারের সঙ্গে কবে যে করডিয়েল হবে কে জানে? হুহহহহহ……
হারুন দীর্ঘশ্বাস ফেললো, তামিম স্যারকে সে কি ভুলটাই না বুঝেছিলো। আহারে…

নাফিসার আনন্দে আকাশে উড়ে চলে যেতে ইচ্ছে করছে। সে বারবার করে জোরে চিৎকার করে বলছে, আই লাভ ইউ বাবা, আই লাভ ইউ বাবা।
এর কারণ হলো, মি. শফিকের ইউ এস এ তে আসার ব্যাপারটা বাবা সুন্দরভাবে এলাউ করেছেন। কিন্তু তার একটা বিষয় খুবই আশ্চর্য লাগছে, তা হলো, মি. শফিক এমন কি বললেন যে বাবা কনভিন্স হয়ে গেলেন সহজেই?

শুটিং স্পটে রিতুকে দেখে নীরা বেশ অবাক হলো। তাও আবার মিসেস সেলিনা সাথে এসেছেন। মানে কি? মি. তামিম পাঠাননি তো?
সেলিনা ফিসফিসিয়ে বললেন,
—খবর জানো কিছু? তোমার এই দুর্নিবারতো রিতুর মাথা খেয়ে দিয়েছে। দুর্নিবার দুর্নিবার বলে ঘুমের মাঝে গোঙায়! সাড়ে এগারোশো মার্কসের মাঝে যে মেয়ে হাজার পঁচানব্বই পায়, সে কিনা চার মার্কস কম পেয়েছে! ভাবা যায়?
নীরাও গোমড়া মুখ করে বললো,
—আসলেই চার মার্কস।
—আরো আছে তো, ছেলেটা বলে গেল বউ মিডিয়াতে কাজ করে। এই নিয়ে তেরোজন টপ মডেল, নয়জন ছোট পর্দার নায়িকা, চারজন ফিল্মের হিরোইনের ইনফরমেশন নেওয়া শেষ। কিন্তু বউমাকে তো আর পেলাম না।
আজ সকালে তামিম ফোন করে বললো,
—মা আমার বউ মরে গেছে। দেশে এসে আবার বিয়ে করবো আমি! শোনো ছেলের কথা। মিডিয়ার মেয়ে তো, নিশ্চয়ই কোনো কাল্টি করেছে। এখন দেখো, মেয়ে আমার আবার এক হিরোর পেছনে ঘুরছে। বুঝলে ক্লাইম্যাক্স?
নীরা কিছু না বুঝেও হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।
—এই নীরা তোমার কি এখন কোনো শট টট আছে?
—জি আছে!
—বাহ্ বেশ তো, দেখে যাই তাহলে। রিতুটা গেল কই? দুর্নিবার কোথায়? তাকে খুঁজতেই গেল নাকি?
নীরা হাত বাড়িয়ে সেলিনার হাত ধরলো,
—আপনি আপনার ছেলের বউকে খুঁজছেন তো?
—হুঁ!
—আমি আপনাকে সাহায্য করছি।
—এখান থেকে বেরিয়ে প্রথম যে বিরাট বিলবোর্ডটা চোখে পড়বে, তাতে দেখবেন সবুজ শাড়ি পরা একটা মডেল এক থালা ধোঁয়া উঠা গরম ভাতে চোখ বন্ধ করে তার ঘ্রাণ নিচ্ছে, সেটাই আপনার ছেলের বউ।ওই যে পোলাওয়ের চালের যে এডভারটাইসম্যান্টটা; সেটা!
সেলিনা চোখ বড় বড় করে নীরার দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর মাথা ভোঁ ভোঁ করছে।
—আপনার ছেলের বউ একদম মারা যায়নি। সে বেঁচে আছে। ছেলের বিয়ে দেবার কোনো দরকার নেই।

কামাল বিব্রতভাবে বললো,
—স্যার, সেদিনের ম্যাডাম দেখা করতে এসেছেন!
দুর্নিবার মিররে তাকিয়ে টাইয়ের নট বাঁধছিলো। কামালের দিকে না তাকিয়েই বললো,
—সেই সকাল বেলার ম্যাডাম?
—জি স্যার!
দুর্নিবার ঝট করে টাই ছেড়ে দিলো।
—এখানে নিয়ে আসো।
—স্যার এখানে?
—উফফ! নিয়ে আসো, হারি আপ। বেশিক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখোনি তো? গো….
কামাল প্রায় ছুটে গেল। স্যার কেন এত অস্থির হয়ে পড়লেন কে জানে? তাও আবার স্যার তাকে নিজের মেক আপ রুমে এলাউ করছেন!
রিতু ভেতরে এসে নিজেই দরজা আটকে দিলো৷
দুর্নিবারের ভেতরে মৃদু ভুমিকম্প হয়ে গেল তখুনি।
—ভালো আছেন?
—না।
—চুটিয়ে শুটিং করছেন অথচ বলছেন ভালো নেই?
—ভালো না থাকলে যে শুটিং করা যায় না, সেটা কে বলল তোমায়?
—ওহ্! প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন। গুড…
—তুমি এখানে যে? যে আমাকে ফোন করতে চায় না, সে নিশ্চয়ই আমার সাথে দেখা করতেও আসেনি?
—একা আসিনি। মাও এসেছেন৷ নীরাপুর সাথে কথা বলছেন।
দুর্নিবার কামালকে ফোন করে নিলো,
—কামাল, আমার শটটা আমি ওয়ান আওয়ার পরে দিবো। ডিরেক্টর স্যারকে বলো, বাকি শটগুলো যাতে এখন নিয়ে নেয়। ম্যানেজ হিম।
কামাল মুখ হা করে বসে পড়লো। স্যার এই বন্ধ ঘরে এক ঘন্টা এই মেয়ের সাথে করবেনটা কি?
—আমি কিন্তু ওয়ান আওয়ার বসবো না হিরো।
—আই নো কিন্তু তোমার সাথে যে আমার দেখা হলো, এটা রিকোভার করে নরমাল অবস্থায় ফিরতে আমার ওয়ান আওয়ার তো লাগবেই।
—আমি কি ডিজাস্টার নাকি? রিকোভারের কথা কেন?
—মা এসেছেন বলেই আসা হয়েছে, তাই না?
—হুঁ! আরেকটা ব্যাপারও জানতে এলাম, আপনি কেন আমাকে ফোন করেননি?
—সেরকম কথা ছিল কি?
—হুঁ, ছিল।
—তাহলে আমার ভুল হয়ে গেছে, স্যরি।
রিতু হাসলো।
—তুমি টাইয়ের নট করতে পারো?
—হুঁ!
—আই কান্ট! উইল ইউ প্লিজ হেল্প মি?
রিতু উঠে এসে দুর্নিবারের টাইয়ে হাত বাড়ালো।
দুর্নিবার তক্ষুনি রিতুর চুলের ক্লিপটা একটানে খুলে নিয়ে বললো,
—মিস ইতু, এই ব্লু টুথ দিয়েই তো রিতু তোমাকে সব বুঝিয়ে দিচ্ছে তাই না? রিতু, শুনতে পাচ্ছো? এভাবে ইতুকে পাঠানো কি ঠিক হলো? আমি কিন্তু এর জন্য তোমায় কঠিন শাস্তি দিবো। কঠিন শাস্তি!
ইতু নার্ভাস চেহারায় তাকিয়ে আছে।
—মা পর্যন্ত বুঝতে পারেনি, আপনি কিভাবে বুঝলেন? এই তো আমার ঠোঁটের উপরে রিতুর মতো তিলটাও এঁকেছি।
দুর্নিবার হাসলো।
—তুমি যে রিতু নও আমি প্রথমেই বুঝতে পেরেছি। তুমি হয়তো খেয়াল করোনি ইতু, আমি কিন্তু একবারও রিতু বলে নাম নিইনি তোমার। শুধু এই ব্লুটুথটা খুঁজে পেতে একটু সময় লাগলো।
—এজন্যই নট বাঁধতে কাছে ডাকলেন, তাই না?
—ইয়েস!
দুর্নিবার ফ্লাস্ক থেকে কফি ঢেলে ইতুকে বাড়িয়ে দিলো।
—কিভাবে বুঝতে পারলেন বলুন তো? মাত্র একবার দেখা হয়েছে ও’র সাথে।
—কিভাবে বুঝতে পারলাম, সেটা শুধু রিতুকেই বলবো। সে কোথায়?
—সে বাসায়!
—তুমি মিথ্যে বলছো ইতু। সে এসেছে এবং আমি ড্যাম শিওর সে এখন নিচে গাড়িতে বসে। তুমি কি ওকে একটু পাঠাবে?
ইতু হাসলো।
—আপনি এত ভালো করে চিনেন রিতুকে! আমরা তো এভাবে অসংখ্যবার মা-বাবাকে পর্যন্ত বোকা বানিয়েছি।
—উঁহু ভুল বললাম, সে গাড়িতে নয় অলরেডী সে দরজায় চলে এসেছে। আমি তো ও’র ফোন ডিসকানেক্ট করেছি কয়েক মিনিট হয়ে…
দুর্নিবারের কথা শেষ হলো না। দরজায় নক।
দুর্নিবার দরজা খুললো না।
ইতু দরজা খুলে বললো,
—কি ডেঞ্জারাস হিরোরে তোর রিতু। উল্টো আমাদেরই খেলে দিলো। তুই তো খুব চিল্লালি, বোকারাম বানাবি৷ ধুরররর শুধু শুধু কেইস খেয়ে গেলাম!
ইতু বেরিয়ে গেল।
এবার দুর্নিবার উঠে গিয়ে দরজাটা আটকে দিলো।

কামালের মাথা কাজ করছে না। একের পর এক একইরকম দেখতে মেয়ে দুর্নিবার স্যারের ঘরে ঢুকছে আর স্যার দরজা বন্ধ করে দিচ্ছেন। এর মানেটা কি?
রিতু মাথা নিচু করে বললো,
—স্যরি!
—এভাবে স্যরি চাইলে হবে না।
—তো কিভাবে চাইতে হবে?
—একটু আগেই সারাজীবনের জন্য বিরাট কেলেঙ্কারিতে ফেলতে যাচ্ছিলে আমায় আর সামান্য সরি বলছো? ইউ হ্যাভ টু পে সামথিং বিগ।
—বেশি রাগ করেছেন?
দুর্নিবার হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।
—বেশি রাগ করা ভালো নয়!
—কিন্তু তুমি যেটা করলে সেটাও কিন্তু ভালো নয়!
—তাহলে কি করতে হবে হিরো?
—দেখো একটা সম্পর্কে যখন মান-অভিমান আসে তখন সম্পর্কের স্মুথনেস নষ্ট হয়। তখন একে গেটিস দিয়ে আবার ব্যালেন্স করতে হয়।
—যেমন?
—যেমন ধরো, টেবিল বা চেয়ারের পায়া মেঝেতে ঠিকঠাক না পড়লে আমরা কি করি? কাগজ ভাঁজ করে গেটিস দিয়ে যেমন ঠিক করে বসাই; তেমন কিছু!
—ওহ্!
রিতু এগিয়ে এসে দুর্নিবারের গলার টাইটা টেনে ধরে বাঁধতে লাগলো, দুর্নিবার নিচু হলো একটু। তাঁর নিঃশ্বাস গালে পড়ছে রিতুর।
রিতু দুর্নিবারের ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে বললো,
—হেই ডোন্ট কিস, ডোন্ট কিস….. আই এম আন্ডার এইটিন!
দুর্নিবার ফিসফিস করে বললো,
—তোমায় কে বললো, আন্ডার এইটিনকে কিস করা যায় না? আর এটা তো আমি রাগের গেটিস দিচ্ছি।

রিতু চোখ বন্ধ করে ফেললো। এই প্রথম চোখ বন্ধ করে তার ভীষণ ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে, পৃথিবীর সব আনন্দ সে একসাথে দেখতে পাচ্ছে।
সাতরং এর রংধনু দেখার মতো আনন্দ।

(চলবে)

#তৃধা_আনিকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here