#হলিডে
#পর্ব_৯_ও_১০
#পর্ব_৯
প্রাইম মিনিস্টার নাজমুল ইসলামের মাথায় আগুন জ্বলছে। তিনি তিনঘন্টায় এই নিয়ে দুটো প্রেশারের ঔষধ খেয়েছেন, কিছুতেই প্রেশার নামছে না। তাঁর ইচ্ছে করছে সামনে যেসব জিনিসপত্র আছে ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলতে, সব আগুন লাগিয়ে জালিয়ে দিতে! দু-একটা লিংক বলছে তাঁর মেয়ে একজন এডির সাথে প্রেম করে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে। এর মানে কি??মি. তামিম সিকিউরিটি উইংএ আছে বলে তাকে এপয়েন্ট করা হয়েছে। ছেলেটা ভালো বলেই বারবার ডাকা। তার মানে কি এই যে, তাঁর মেয়েটা প্রেমে পড়ে যাবে? এটা হতে পারে না। তিনি আবারও ঘড়ি দেখলেন, পনেরো মিনিট পেরিয়ে গেছে। নাফিসা এখনো আসেনি। পাশের ঘর থেকে এ ঘরে আসতে নিশ্চয় পনেরো মিনিট লাগে না। তার মানে কি? নিজের মেয়ে তাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না, এত দুঃসাহস! প্রাইম মিনিস্টার তিনি অথচ তাঁর নিজের মেয়েই তাকে ভয় পায় না.. এটা কোনো কথা হলো?
তিনি কি আবার ডেকে পাঠাবেন?
নাফিসা দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে হাসিমুখে বললো,
—মে আই কাম ইন পাপা?
প্রাইম মিনিস্টার নাজমুল সাহেব মেয়ের দিকে তাকালেন এবং সাথে সাথে তাঁর মন ভালো হয়ে গেল, রাগ পড়ে গেল। নাফিসা একটা সুন্দর নীল শাড়ি পরেছে। সাথে মিলিয়ে সাজগোজ। বাহ্ কি সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে! নাফিসা জন্মাবার পর নাজমুল সাহেবের বেশ মনোকষ্ট ছিল কারণ মেয়ের গায়ের রং খানিকটা চাপা। নাকটাও ছিল বসানো টাইপ। কিন্তু মেয়েটা যত বড় হতে থাকলো, নাজমুল সাহেবের ততই মনে হতে থাকলো গায়ের রংটা চাপা বলেই মেয়েটাকে এত মিষ্টি দেখতে। এরকম গায়ের রং না হলে বোধহয় অত কোমল দেখাতো না। বসানো নাকটা মুখটাতে কেমন মানিয়ে গেছে। একদম রূপকথার পরীদের মতো মিষ্টি লাগছে।
—কি হলো পাপা? আসবো না?
নাজমুল সাহেব চমকে উঠে নিজেকে সামলালেন। মনে মনে বললেন, মাশাআল্লাহ! আল্লাহপাক আমার মেয়েটাকে তুমি শতবর্ষ আয়ু দাও।
—আসো মা, ভেতরে আসো।
নাফিসা দরজায় দাঁড়িয়ে ইশারায় মাথা নাড়লো।
নাজমুল সাহেব এর মানে বুঝলেন। চিফ সিকিউরিটি অফিসার হানিফ সাহেবকে তিনি ইশারায় বেরিয়ে যেতে বললেন।
—আর ইউ ওকে পাপা?
—ইয়েস ইয়েস… কমপ্লিটলি ওকে।
—তুমি আমায় বকবে বলে ডেকেছো, তাই না, পাপা?
নাজমুল সাহেব থতমত খেয়ে গেলেন। সিরিয়াস সিচুয়েশানে মেয়েটা আগেভাগেই অনেক কিছুই বলে ফেলে। পরিস্থিতি তখন সম্পূর্ণ হাতের বাইরে চলে যায়।
নাফিসা বাবার পাশে আয়েশি ভঙ্গিতে বসলো।
—বকো তো বাবা বাকো…. মি. তামিম ব্যাপারে তো? ওকে বকো। দুদিন বাদেই তো আমি চলে যাবো। তোমার কাছ থেকে নেওয়ার তো কিছু নেই, বকা নিয়ে যাই বরং।
নাজমুল সাহেব দ্রুত চিন্তা করতে লাগলেন। নাফিসাকে কথাগুলো তিনি খুব টেকনিক্যালি বলবেন। মেয়েটাকে কষ্ট দেয়া যাবে না।
—মামণি তুমি জানো, তোমার বাবার পেশাটা সবার থেকে আলাদা। তাই সবসময় সতর্ক থাকতে হয়। একটা নিউজপেপার হঠাৎ কিছু লিখে টিখে দিলে? সারাক্ষণ টেনশানে থাকি, নিজের জীবন বলে তো কিছু নেই আমার। তোমাকেই জীবন ভাবি আমার।
—মেইক ইট স্ট্রেইট ফর মি, পাপা। এত ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলার দরকার নেই। কাম টু দ্যা পয়েন্ট!
—দেখো মামণি তামিম ছেলেটা যাস্ট অল্পসময়ে এই পেশায়। তারপরও তুমি কমফোর্ট ফিল করো বলে তোমার সিকিউরিটিতে তাকে রাখা হচ্ছে। তার মানে তো এই নয় যে, সে তোমাকে পারসোনালি মিট করবার জন্য ডাকলেই তুমি চলে যাবে। লাইব্রেরী ঘুরে ঘুরে বই কিনবে।
—পাপা, তোমার কি মনে হয় না তুমি সবধরনের সম্পর্কগুলোকে রাজনৈতিক এঙ্গেল থেকে বিচার করো?
—সেরকম কিছু নয় মামণি। আমি শুধু ক্লিয়ার করতে চাচ্ছি, তোমাকে কেউ ডেকে পাঠাবে এরকম ক্ষমতা কি সহজ করেই কাউকে দেয়া ঠিক? ইউ আর এ প্রিন্সেস। এনজয় ইওর পাওয়ার।
—পাপা, মি. তামিমকে আমিই বলেছি উনি যাতে আমাকে বন্ধু ভাবেন। এবং আমার সাথে বন্ধুত্ব করবার জন্য জোর করেছি বলতে পারো। উনি একটা ছোট্ট ফেবার চেয়েছেন। উনার খুব কাছের একটা মানুষ পড়াশোনা করতে চাচ্ছেন না, তাকে ইন্সপায়ার করে সে যাতে পড়াশোনাটা শুরু করে সেজন্য একটা ফোন করতে বলেছেন। আমি করে দিয়েছি। আর বইয়ের ব্যাপারে যেটা বলবো, কারো সাথে গিয়ে যদি দুটো বই কেনা অপরাধের পর্যায়ে পরে সেটার জন্য শাস্তি পেতে আমি রাজি।
—সেরকম যদি কোনো ফেবার হয়, তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই মা। তুমি প্রাইম মিনিস্টারের একমাত্র মেয়ে, তুমি লোকজনকে ফেবার দেবে না তো কে দেবে? কাউকে পড়াশোনায় উৎসাহ দেওয়ার মতো ভালো কাজ তো তোমার অবশ্যই করা উচিত।অবশ্যই।
নাফিসা বাবার দিকে তাকিয়ে হাসলো।
—এবার বলোতো, আমায় কেমন লাগছে পাপা?
নাজমুল সাহেব মেয়ের কথার জবাব দিলেন না।
—উফ পাপা, এই প্রশ্নটা আমি যাকেই করি সেই উত্তর দেয় না। তার মানে আমি পঁচা দেখতে?
নাজমুল সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলালেন।
—সত্যিই তুমি তাকে ফেবার করার মতো শুধু বন্ধুই ভাবো তো?
—ডোন্ট ওরি পাপা। আমি তোমাকে ছোট করবার মতো কিছুই করছি না। মি. তামিমকে আমি পছন্দ করি কারণ তিনি ভালো লোক। নিঁখুত ভালো লোক। আমার উনার পাশাপাশি থাকলে নিজের কথাগুলো বলতে ভালো লাগে। হি ইজ এ নাইস গাই, টোটালি ডিফারেন্ট এন্ড অফ ট্র্যাক গাই। দ্যাটস অল।
নাজমুল সাহেব মেয়ের পিঠ চাপড়ে দিলেন।
—আই নো দ্যাট, ইউ আর মাই সুইট এন্ড লাভলি ডটার। আই বিলিভ, ইউ উইল মেইক মি প্রাউড।
—-পাপা, একটা মজার বিষয় কি জানো? তুমি যেমন ভাবছো, মি.তামিমও বোধহয় সেরকম ভাবে। আমি যখন উনার সাথে গল্প করি, উনি ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে থাকেন। উনি বিশাল আতঙ্কে থাকেন, আমার খুব মজা লাগে। উনার সবসময় দুশ্চিন্তায় কপাল কুঁচকে থাকে। এই বুঝি, আমি তাঁর প্রেমে পড়ে গেলাম। এই বুঝি…. বেচারা….
নাফিসা খিলখিল করে হেসে উঠলো।
—তার মানে শাড়ি পরে তুমি তাকেও জিজ্ঞেস করেছো যে তোমায় দেখতে কেমন লাগছে, তাই না?
—এক্সাক্টলি পাপা। বেচারা ভয়ে মরে যায় অবস্থা। ফ্যাকাসে করে নিশ্চুপ হেসেছিলেন। মাথা চুলকাতে চুলকাতে মাঝে মাঝে বিড়বিড় করেন। আমার কি যে ভালো লাগলো পাপা। আমি সারাজীবন আমার চারপাশে মেয়েলোভী ছেলেদের দেখেছি পাপা, ইভেন অনেক সিনিয়র আংকেল যাদের নোংরা দৃষ্টি আমায় দেখতে হয়েছে। মাতৃহীনা একটা মেয়ের সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ঘরোয়া পরিবেশে বড় হওয়ার কার্স বলতে পারো। তাই হঠাৎ করে একজন ভালো মানুষ দেখে চমকে গেছি যাস্ট। এইজন্যই উনাকে ভালো লাগে পাপা। আর কিছু নয়। তোমার মেয়ে কিন্তু অতটাও বোকা নয় যে, ফট করেই প্রেমে পড়ে যাবে। ডোন্ট থিংক মি সো সিলি।
নাজমুল সাহেব নিজে উঠে গিয়ে কফিমেকারের কাছে দাঁড়ালেন। নাফিসাও উঠে দাঁড়ালো।
—এখন কফি খাবো না পাপা। ভালো লাগছে না। সারাদিন ঘুরে ঘুরে টায়ার্ড। ডিনার করেই ঘুমোবো।
—তোমার সাথে এক কাপ কফি খাওয়ার সুযোগও পাবো না আমি?
—ওকে দাও পাপা। একটা সুগার কিউব দিও কিন্তু! আই এম ইন ডায়েট।
নাজমুল সাহেব হাসলেন। এক কাপ কফিতে তিনটে সুগার কিউব নেয়া মেয়ে তার, এখন একটা নিচ্ছে ।কত পরিবর্তন! তিনি বিড়বিড় করে বললেন, পাগলী!
কফি মগটা হাতে নিয়ে নাফিসা জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়ালো।
—পাপা, তুমি কিন্তু প্রমিস করেছিলে আমায় নিয়ে কখনো দুঃশ্চিন্তা করবে না। তারপরও কিন্তু করেছো।
—তুমি বাবা হলে বুঝতে মা। মেয়ের জন্য কত ভাবতে হয়!
—তাও পাপা, আই কনফার্মড ইউ মোর এন্ড মোর টাইমস বিফোর, যে আমার যখন কাউকে ভালবাসতে মন চাইবে আমি তোমার পারমিশান নিয়ে ভালোবাসবো। এবং তুমি জানো আমি আমার কথা রাখি। তারপরও তুমি কিভাবে ভেবে নিলে?
—হাজার ধরনের ঝামেলায় থাকি মামণি। এর মধ্যে দু-একটা পত্রিকা থেকে ফোন করে… কিছু লোকজন থাকেই তো এসব নিউজ ছড়াতে।
—যত যাই বলো, তুমি তোমার মেয়েকে অবিশ্বাস করেছো। ইট’স এ পানিশেবল ক্রাইম। বলো, কি শাস্তি নেবে?
নাজমুল সাহেব হাসলেন।
—তোমার থেকে দূরে থাকছি, এটাই কি বড় শাস্তি নয়?
নাফিসা মনখারাপ করা চোখ নিয়ে বাবার দিকে তাকালো। তার এই প্রাইম মিনিস্টার বাবা তার কাছে একদম অপরাধী মুখ করে আছে।
—পাপা, আমার জবাবদিহিতা কি শেষ হয়েছে?তাহলে আমি ঘুমোতে যাই।
নাফিসা একমুহূর্ত ভেবে নিলো
—না ঘরে যাবো না, আজ বরং তোমার ঘরেই ঘুমোবো… তুমি একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দাও তো।
নাফিসা সত্যি সত্যি বিছানায় এসে সটান শুয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো। নাজমুল সাহেব ব্যতিব্যস্ত হয়ে মেয়ের পায়ের জুতোটা খুলতে লাগলেন। নাফিসা চট করেই তড়াক করে আবার উঠে বসলো এবং বাবার গাল টিপে ধরে বললো,
—পাপা, আমি যাকে ভালোবাসবো সে হবে দুনিয়ার সবথেকে স্পেশাল গাই। যে তোমার থেকেও আমাকে বেশি ভালোবাসবে। আর সে যখন রাতে ঘুমোতে যাবে, আমি এভাবে তাঁর জুতোটা খুলে রাখবো। লাভ ইউ পাপা।
রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে শফিক মৃদুস্বরে বললো,
—রনি এসেছে ভাবী। আমি এখন ও’র সাথে কথা বলতে পারবো না। আমি বিজি!
লাবণী চা বানাচ্ছিলো, না তাকিয়েই বললো,
—বিজি মানে? কি করছো?
—পড়ছি। মেডিকেলের পড়া।
—বলো কি?
—হু, ভাবী। আমি ঠিক করেছি,
সেকেন্ড প্রফটা দিয়েই ফেলবো। এত করে যখন উনি রিকোয়েস্ট করে বলেছেন!
—কে রিকোয়েস্ট করেছেন?
—নাফিসা ম্যাম।
লাবণী চা বানানো ফেলে এসে শফিকের মুখোমুখি দাঁড়ালো।
—তুমি পড়ছো মানে? সত্যিই বুঝতে পারছি না।
—বললাম তো, সেকেন্ড প্রফের জন্য প্রিপারেশন করছি ভাবী।
—শফিক, তুমি ঠাট্টা করছো না তো?
শফিক রাগী রাগী মুখ করে সিরিয়াস চোখে তাকালো।
—অবিশ্বাস করছো আমায়? লিসেন ভাবী, লেট মি গেট দিস ইন ডিটেল। এই প্রফেশনাল এক্সামের জন্য প্যাথোলজি, মাইক্রোবায়োলজি, ফার্মাকোলোজি, ফরেনসিক মেডিসিন এবং কমিউনিটি মেডিসিন পড়তে হয়। আমি ঠিক করেছি এই সাবজেক্টসগুলো আমি ছয় মাসে পড়ে ফেলবো। ফর ইচ সাবজেক্ট, ওয়ান মান্থ। পাঁচ মাস পড়া, বাকী এক মাস রিভিশান। আমি দেখতে চাই এই কোর্সটা পাঁচ মাসে পড়া সম্ভব কিনা! যে সে পড়া না; একদম ডিটেলে পড়বো।
লাবণীর মুখ হা হয়ে আছে। শফিকের কথাগুলো তাঁর মাথায় ভনভন করছে। তবে শফিক যে সত্যিকথা বলছে বুঝা যাচ্ছে।
—বই কালেক্ট করলে কিভাবে, শফিক?
—নাফিসা ম্যাম পাঠিয়েছেন এবং তিনি আমায় রিকোয়েস্ট করেছেন পড়াশোনা করার জন্য। আমিও বলে দিয়েছি, কোর্স কমপ্লিট করেই তাকে মিট করবো।
—নাফিসা ম্যামটা কে? তোমার টিচার?
শফিক মাথা নাড়লো,
—প্রাইম মিনিস্টারের মেয়ে! দারুণ ভালো মানুষ, বুঝলে। কি সুন্দর বুঝিয়ে বললো! শত হোক প্রাইম মিনিস্টারের মেয়ের অনুরোধ আমি তো ফেলতে পারি না।
লাবণী মোটামোটি ধরনের একটা শক খেয়ে গেল।
শফিক এরকম করে হঠাৎ কথা বলছে কেন? তাঁর মাথা ঘুরতে লাগলো। শরীরও টলছে। সে একহাতে দরজা ধরে নিজেকে সামলে নিলো। শফিকের প্রেম হয়েছিলো জেলা প্রশাসকের মেয়ের সাথে, মেয়ের নামটা যেন কি? লাবণী মনে করার চেষ্টা করলো। মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। কিছুই মনে পড়ছে না। এই অল্প কয়েকটা দিনের মধ্যে শফিকের মাথায় প্রাইম মিনিস্টারের মেয়ে পর্যন্ত চলে এসেছে। ডিসির মেয়ে থেকে প্রাইম মিনিস্টারের মেয়ে! লাবণী মুখ হা করে কিছুক্ষণ তাকিয়েই রইলো। বসার ঘরের দিকে যেতে যেতে লাবণীর মনে হলো শফিকের ঔষধ রিএকশান শুরু করেছে। নাহলে এমন হবে কেন? লাবণী পেছন ফিরে শফিকের দিকে ভালো করে তাকালো। শফিকের একহাতে পেন্সিল, অন্য হাতে বই। সে সমানে পেন্সিল দিয়ে মাথার চুল খোঁচাচ্ছে। বিড়বিড় করে পড়া আওড়াচ্ছে। লাবণীর ইচ্ছে করলো শফিকের মাথার উশকোখুশকো চুলগুলো হাত বুলিয়ে গুছিয়ে দেয়!
—কি হলো, তুমি দাঁড়িয়ে পড়লে যে? ভাবী, প্লিজ তুমি গিয়ে ওকে একটু কম্পেনি দাও। বেচারা বসে আছে। পড়তে হয় ফুল ফ্লোতে, একবার পড়া থেকে উঠলে মহাঝামেলা। এই যে এখন একটু কথা বললাম, কনসেন্ট্রেশন লিক করে গেছে।
লাবণী কোনোরকম অস্ফুট স্বরে বললো,
—শফিক, তুমি তোমার ঔষধগুলো ঠিকঠাক খাচ্ছো তো?
—না ভাবী। মেডিসিন বন্ধ করে দিয়েছি। ঘুম জ্বালাতন করে বেশি। আর শোনো, পড়াশোনার ব্যাপারে রনিকে বলার দরকার নেই। আমার কথা জিজ্ঞেস করলে বলবে, ঘুমোচ্ছি।
লাবণী হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। শফিকের মাথাটা এবার কি শেষ পর্যায়ে চলে গেছে? আর কি কোনো আশাই নেই। লাবণীর বুক কেঁপে উঠলো। দুনিয়া ভেঙ্গে কান্না পাচ্ছে তাঁর। এত ভালো দেওর। সে কিনা একটা মেয়েকে ভালোবেসে আজ এ অবস্থায়! লাবণী ডুকরে কেঁদে উঠলো।
—ভাবী…(শফিক পিছু ডাকলো) রনিকে চা দিলে, আমার ঘরেও দিও। একটু পড়লেই গলা শুকিয়ে আসে। এক জগ পানিও দিও।
লাবণী নিজেকে আর সামলাতে পারলো না। ধপাস করে মেঝেতে বসে পড়লো। চোখে ঝাপসা দেখছে সে….
তামিম টেবিলে রাখা পত্রিকাটায় আবার চোখ বুলালো। নকশার ফ্রন্টেপেজের পুরোটা জুড়েই নীরার ছবি। ছবিতে নীরা বসেছে একটা পুকুর পাড়ে। পুকুর ঘাটের সবথেকে নিচের সিঁড়িতে দু-পা পানিতে ভিজিয়ে। তাঁর শাড়ির আঁচল ভেসে আছে পুকুরের পানিতে। শাড়িটা বেশ খানিকটা তুলে দেওয়া, ভেঁজানো পায়ের নুপুর পানির মধ্যে দিয়ে ছবিটাতে অন্যরকম একটা আভা এনে দিয়েছে। নীরা একহাতে সবগুলো চুল মুঠো করে ধরা, যেন ছেড়ে দিলেই সব চুল পানিতে পড়ে ভিজে যাবে। তবে সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পুকুরে ভেসে থাকা তাঁর শাড়ির আঁচলের দিকে।
তামিম পেজ উল্টালো, তাতেও নীরার ছবি। এখানেও বেশ কয়েকটা ছোট ছোট ফটোর কোলাজ। তামিম এবার ফিচারের মুল পেজটা খুললো। এই পেজের ছবিটাতে নীরাকে অন্যরকম লাগছে। সে পরেছে জিন্সের সাথে স্লিভলেস ফতুয়া। তবে চুলটা এবার সুন্দর করে পনিটেল বাঁধা। সে দু-হাত জিন্সের পকেটে ঢুকিয়ে আরামসে দাঁড়িয়ে আছে। তামিমের হঠাৎ করেই মনে হলো ছবির নীরা মেয়েটার উপর তাঁর রাগ হচ্ছে, ভীষণ রাগ হচ্ছে।
—হারুন সাহেব.. হারুন সাহেব…
হারুন প্রায় হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো।
—এই ছবিগুলো দেখেছেন?
—জি স্যার।
—ছবি দেখে আপনার কি মনে হয়েছে? কেমন লেগেছে?
—জি মানে স্যার ভালো হয়েছে, বেশ ভালো হয়েছে।
—টুবি অনেস্ট, একদম একচুয়েল আপনার মনে যা এসেছে বলুন।
হারুন কিছু না বলে মাথা চুলকালতে লাগলেন।
—আনসার মি হারুন সাহেব!
—স্যার, উনার ছবি দেখে মনে হচ্ছে খুব শীঘ্রই উনি কোনো মুভির হিরোইন হয়ে যাবেন। ছবিগুলো বারবার দেখার মতো।
তামিম পেপারে দুম করে একটা কিল মেরে পেপারটা হারুনের দিকে ছুঁড়ে ফেললো।
—গান লোড করো হারুন। আমি কিছুক্ষণ শুটিং প্রাকটিস করবো। আর হ্যাঁ টার্গেট বোর্ডে তোমার নীরা ম্যাডামের ছবিটা এডযাস্ট করে দাও। আমিও তাকে কিছু শুট করি! তিনি করবেন ফটোশূটিং, আমি করবো পিস্তল শুটিং!
হারুনের মুখ লম্বা হয়ে গেল বিস্ময়ে। স্যার এমন পাগল পাগল কেন করছেন? কি হয়েছে?
#পর্ব_১০
নীরা ঘর অন্ধকার করে বসে আছে তাও এই সন্ধেবেলায়। লাবণী বাতিটা জ্বালিয়ে নীরার পাশে এসে বসলো।
—একটু নিচে আসবে নীরা? বাবা- মা চলে যাবার আগে কিছু বলতে চান।
নীরা জবাব দিলো না। বসা থেকেই একটা আড়মোড়ার মতো করলো।
—তোমার কি শরীর খারাপ নীরা? জ্বর?
লাবণী হাত বাড়িয়ে নীরার কপাল ছুঁয়ে দেখলো।
—জ্বর তো নয়, তাহলে?
—বাবা-মা কি রেডী হয়ে গেছেন ভাবী?
—-হুঁ। আধঘন্টার মধ্যে বেরুবেন।
নীরা উঠে দাঁড়ালো। আলনা থেকে ওড়না নিয়ে গায়ে জড়াতে জড়াতে বললো,
—চলো।
লাবণী তাও বসে রইলো।
—কি হলো? চলো ভাবী।
—কিছু হয়েছে নীরা? মুখটা মলিন লাগছে, কোনো ঝামেলা? বলো আমাকে।
নীরা হাসবার চেষ্টা করলো।
—তুমি যে এই এত ঝামেলার সংসারে থাকছো, তোমার কি তাতে মন ভরছে না? তাও তোমার আরো ঝামেলার কথা শুনতে মন চায় বুঝি?
—হ্যাঁ চায়… বলো কি হয়েছে? তুমি কি কোনো বিপদে পড়েছো?
নীরা লাবণীর মুখোমুখি এসে বসলো।
—যেই লোকগুলো আমাদের ভ্যান জ্বালিয়েছিলো, সেই দলেরই কিছু লোক আমায় থ্রেট করছে। তাদের ধারণা তাদের লোক যখন কাউকে মার্ডার করতে চেয়েছিলো তখন আমি তাদের লোকেদের দেখেছি। দু-জনকে নাকি এরেস্টও করা হয়েছে! আমাকে কন্টিনিউয়াস থ্রেট করছে আমি যাতে গিয়ে সাসপেক্টদের শনাক্ত করে না দিই।
—কাকে মার্ডার করার চেষ্টা করছিলো?
—মি.তামিম। তিনি একজন এনএসআই র অফিসার। তিনি নাকি তাদের অনেক খবর জানেন।
—ওহো, আমাদের বাসায় যিনি এসেছিলেন তোমায় খুঁজতে তিনি?
—হুঁ। তিনি হয়তো কিছু আন্দাজ করে এসেছিলেন।
—তুমি কি সত্যিই কাউকে দেখেছো?
—মোটেও না। আমি যখন মি. তামিমকে দেখি, তখন তিনি একা এবং আহত। সেরকম দেখেই আমি তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। আমার মনে হয় কি জানো, সেদিন যে মি. তামিম একা ছিলেন সেটা জেনেই ওরা এটাকটা করেছিলো। আমি তাৎক্ষণিক যাওয়ায় সুবিধা করতে পারেনি।
—ব্যাপারটা মি. তামিমকে বলেছো?
—উনার সাথে যোগাযোগ করা কি ঠিক হবে? যদি ভাবে শেল্টার চাচ্ছি! সাহায্য চাওয়ার মতো তো কিছু নেইও, তাই বলিনি।
—তাহলে এখন কি করবে?
—ঠিক করেছি, ওই শয়তানদের সাথে সরাসরি দেখা করবো। বলবো যে, আমি কাউকে দেখিনি এবং কিচ্ছু বলবো না। এবং মোস্ট ইম্পর্টেন্ট থিং, মি. তামিমকে আমি চিনিই না ভালো করে।
—তোমার যদি কোনো বিপদ হয়?
—হলে হবে, বিপদের মাঝেই তো বসবাস। বিপদই তো মোর জনম সঙ্গী।
লাবণী নীরার কাঁধে হাত রেখে শক্ত করে ধরে পাশে দাঁড়ালো।
—তুমি একা যাবে না নীরা, একদম একা যাবে না। আমিও যাবো তোমার সঙ্গে।
নীরা হাসলো। যে হাসির মানে হলো কঠিন “না”! লাবণী নীরার ঘরের বিছানার চাদরটা টেনে ঠিক করতে করতে বললো,
—এ বাড়িতে যখন বিয়ে হয়ে এলাম, বাড়িতে এসে শুনলাম এ বাড়ির একমাত্র ছোটো মেয়েটি ভাইয়ের বিয়েতে বরযাত্রী যেতে পারেনি কারণ তাঁর জ্বর! নতুন ভাবী আমি কি করলাম, আমার সেই জ্বর গায়ে ননদকে দেখতে তাঁর ঘরে গেলাম। তাঁর বিছানার ধারে, এই এখানটায় বসে…. তাই না নীরা?
—উফ্ চুপ করো ভাবী! ইমোশোনাল ব্ল্যাকমেইলিং। বারবার এক গল্প।
—-চুপ করার তো কিছু নেই নীরা, এটা আমার জীবনের চমৎকার ঘটনা। এটা আমার বারবার বলতে ভালো লাগে। তারপর আমি যখন আমার সেই ননদের মুখটার দিকে তাকালাম, আমার মাথা ঝিমঝিম করে উঠলো।(লাবণী নীরার কাছাকাছি এসে তাঁর দু-গালে হাত দুটো দিয়ে মুখটা তুলে ধরলো) কি সুন্দর বড় বড় চোখ, বাঁ চোখের পাশে এই এত্তবড় তিল। এই থুতনিটা এমন মাঝখানে খাজ হয়ে দেবে আছে। কি সুন্দর সরু ঠোঁট। খাড়া নাকের এই উপরটায় একটা কাটা মিষ্টি দাগ। আমার চোখ জুড়িয়ে গেল। মন ভরে গেল ভালোলাগায়। আমি আমার সেই ননদকে দেখে তাঁর কানে কানে ফিসফিসিয়ে কি বলেছিলাম মনে আছে? বলেছিলাম, ভালোই হয়েছে, বিয়েতে তুমি যাওনি। তুমি বিয়েতে গেলে সবাই তোমাকেই হা করে দেখতো, আমায় কেউ দেখতো না। আর বিয়ের অনুষ্ঠানে বিয়ের কনেকে না দেখলে কত কষ্টই না হতো!
নীরা লাবণীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
—আর তোমার সেই বোকা ননদ গাধার মতো তোমায় কি বলেছিলো,
“আমি নায়িকা হবো তো ভাবী, তাই আমি এত সুন্দর। এই দেখো আমার কত লম্বা চুল!”
লাবণী সশব্দে হেসে ফেললো। কিন্তু তাঁর দু-চোখ ভর্তি জল।
লাবণী কিছুক্ষণ নীরাকে শক্ত করে ধরেই থাকলো,
—আমার সেইদিনই মনে হয়েছিলো নীরা, তোমার সাথে আমার অন্য কোন টান আছে যেটা আগে থেকেই বাঁধানো।
নীরা মাথা নাড়লো,
—আর সেই রাতে তুমি বর ফেলে আমার সাথে থাকতে চলে এসেছিলে। ভাইয়ার কি রাগ তখন!
লাবণী চোখটা মুছে এসে বিছানায় বসলো।
—সেই রাতে পুরো রাত আমরা দুজনে ঘুমালাম না। গল্পও কিন্তু করিনি। দু-জনে দুদিক ফিরে নিশ্চুপ জেগে ছিলাম। কি যে জড়তা… নতুন ভাবীর পাশে গুটিশুটি মেরে শুয়েছিলে তুমি। সেই জেগে থাকায় কি মমতা, কি মায়া যে লুকিয়ে ছিল, বুঝতেই পারিনি।
তোমার ভাইয়া চলে গেল, আমার সন্তান চলে গেল, শফিকটা আমাদের সবার মাঝে থেকেও নেই, আমার এই বাড়িতে তো শুধু তুমি আছো। আমি কি কোনো বিপদে তোমায় একা ছাড়তে পারি?
নীরা কাঁদছে।
—আমি তোমার জন্য কিচ্ছু করতে পারছি না ভাবী, কিচ্ছু না। একটার পর একটা ঝামেলাই বয়ে আনছি।
লাবণী নীরাকে এক ঝটকায় সরিয়ে দিলো।
—কিচ্ছু করার দরকারও নেই, চেয়েছি কিছু? তুমি বলেছিলে নায়িকা হবে সেটা হও।
নীরা আবার মেঝেতে বসে পড়লো।
—এ বাড়িতে মা এসেও অভাবই টানলো। তাও মায়ের আশা ছিল বড় ভাইয়া আর শফিক ভাইয়া মিলে একদিন সব ঠিক করে দিবে; তাও হলো না।তুমিও টানছো অভাব। অভাব বুঝলে ভাবী খুব খারাপ জিনিস। সব প্রতিভা নষ্ট করে দেয়। ভালো করে কথা বলার আগ্রহ পর্যন্ত শেষ করে দেয়।
লাবণী হাসলো।
—এরপর থেকে দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে। বাবা- মা তো যাচ্ছেনই দেশের বাড়ির ভিটেটা বিক্রি করতে।ও’টা বেচে দিলে দেখবে টাকা চলে এসেছে। সব শুরু করা যাবে! আমরা আবার ভালো থাকবার স্বপ্ন দেখবো।
নীরার মোবাইল ফোন বাজছে। তাকে থ্রেট করা জসিম বলে লোকটা আবার ফোন করেছে। নীরা ইশারায় মাথা নেড়ে লাবণীকে সেটা বুঝালো।
লাবণী কড়া গলায় বললো,
—ফোনটা ধরো নীরা। শক্ত হয়ে কথা বলো। একদম ভয় পাবে না। বি ব্রেভ! শয়তানদের একদম ভয় পেতে নেই নীরা, এদের মনের জোর বলতে কিছু নেই। ভয় পেতে হয় ভালো মানুষকে। বুঝলে?
নীরা ফোন রিসিভ করলো…..
হারুন প্রায় হন্তদন্ত হয়ে মিটিং রুমে ঢুকে পড়লো।
—স্যার, একটা ইমার্জেন্সি… ওয়ান মিনিট স্যার।
তামিম এক্সকিউজ মি বলে বেরিয়ে এলো।
—স্যার, ওয়াচম্যান বলছে মিস নীরা ও মিসেস লাবণী একসাথে কোথাও বেরুচ্ছেন। তাদের পোশাক দেখে ওয়াচম্যান জানালো, ব্যাপারটা সন্দেহজনক।
—বোরকা পরে বেরিয়েছে?
—ইয়েস স্যার।
—চারজনের একটা টিম রেডী করুন। দুটো গাড়ি নিয়ে ফলো করতে হবে। মি. জাকিরকে সাথে নিন।
হারি আপ হারুন। আমি বেরুচ্ছি যাস্ট! আর একটা কথা, আমি বলা না পর্যন্ত কেউ শ্যূট করবেন না। বি কেয়ারফুল।
তামিম বেরিয়ে গাড়িতে উঠতে যাবে, রিতু ফোন করেছে।
—হ্যালো, রিতু..
—ভাইয়া, আমি রিতু না ইতু..
—ওহ্। রিতুর ফোন থেকে যে? তোরা এসেছিস নাকি?
—হুঁ।
—ফোন করেছিস কেন?
—আমি তোর উপর রাগ করেছি, এটা জানানোর জন্য।
—আচ্ছা জানলাম, এখন ফোন রাখ।
—কেন রাগ করেছি, আগে সেটা জানতে চা।
—বল, কেন রাগ করেছিস?
—তুই প্রেম করছিস সেটা তুই সবার আগে রিতুকে বলেছিস, আমাকে কিন্তু বলিসনি। আমি কি তোর সৎ বোন?
তামিম নিজেকে সামলালো.. রিতু এমনটা কেন বলেছে?
—শোন ইতু, আমি কোনো প্রেম করছি না।
—তাহলে রিতু যে বললো, তোর প্রেমটা নাকি পুরো মাখোমাখো পর্যায়ে চলে গেছে। পায়জামাও উল্টো করে ফেলেছিস নাকি?
তামিম থতমত খেয়ে গেল।
রিতুটা আর ইতুটা একই বয়সের অথচ রিতুটা কি বুদ্ধি করে কথা বলে আর ইতু? গাধীটা কোথায় কি বলতে হবে কিচ্ছু সেন্স নেই।
—কি হলো ভাইয়া, কথা বলছিস না কেন? তুই এতদূর অবধি চলে গেলি তাও আমায় জানালি না।
—ইতু, আমি একটা জরুরি কাজে বেরুচ্ছি। বাসায় এসে কথা বলছি তো।
—তোর তো সারাক্ষণই জরুরি কাজ। সোজা করে বলে দে না আমার সঙ্গে কথা বলার তোর টাইম নেই।
—সেরকম কিছু নয় ইতু। আমার প্রেম হয়নি বলে তোকে বলা হয়নি। প্রেম হলে আমি ঠিক বলতাম।
—-শোন ভাইয়া, না বলে ভালোই করেছিস। আমার সিক্রেটসগুলোও তোকে আর বলবো না, কিচ্ছু বলবো না… আমিও একা একা চলতে পারি বুঝলি?
তামিম ফোন কেটে দিলো। ইতুর ফ্যাঁচফ্যাঁচানি শোনার সময় এখন তার হাতে নেই। বেরুতে হবে।
লাবণী শক্ত করে নীরার হাত চেপে ধরে আছে। নীরা বিরক্ত গলায় বললো,
—সাহস দেবার জন্য এসে তো তুমি বরং আমার ভয় বাড়িয়ে দিচ্ছো। এমন ঠকঠক করে কাঁপছো কেন?
লাবণী দাঁত কামড়ে বললো,
—কাঁপাকাঁপির তো এখনো কিছুই দেখোনি নীরা। যখন কথা বলতে শুরু করবে তখন দেখবে, আমি তোমাকে শুদ্ধু নিয়ে কাঁপছি। পুরো রেস্টুরেন্টাই ফাঁকা। এরা যদি মেরে টেরে দেয়?
—মরার এত ভয় তো এসেছো কেন?
লাবণী বিড়বিড় করে বললো,
—ইয়া মাবুদ বাঁচাও….
নীরা গটগট করে টেবিলটার কাছে হেটে গেল। দু-জন স্বাস্থ্যবান লোক বসে। একজন সাদা অন্যজন কালো শার্ট পরা।
নীরা আশপাশটায় আবার চোখ বুলালো। না অার লোক নেই, দু-জনই মাত্র।
—আমি মিস নীরা।
লোকগুলোর কেউই তাতে কোনো জবাব দিলো না।
এদের মধ্যে একজন একটি চিরকুট বাড়িয়ে দিলো। তাতে লিখা, “যা বলার এর উল্টোপিঠে লিখে দিন। মুখে কিছু নয়। ”
অন্যজন নীরাকে বসতে বলল ইশারায়। একটা কলম বাড়িয়ে দিলো। লাবণী একটু দূরে দু টেবিল পরে দাঁড়িয়ে।
নীরা চট করে লিখে ফেললো,
“আমি কোনো বয়ান দিবো না। মি. তামিম বলে লোকটা সম্পূর্ণ আমার অপরিচিত। আপনারা নিশ্চিন্ত থাকতে পারুন। তবে আমার দোকানের ক্ষতিপূরণ না পেলে কথার খেলাপও করতে পারি।
মি. জাকির বললো,
—-স্যার টার্গেট পজিশনে আছে। শ্যূট করবো?
তামিম কঠিন গলায় বললো,
—নো, কোয়াইট নট! লেডী দুজনে আগে সেইফলি বেরিয়ে যাক। লেট দেম গো সেইফলি ফ্রম দ্য সাইট।
নীরা কাগজটা বাড়িয়ে দিলো।সাদা শার্ট পরা লোকটা হাত বাড়িয়ে কাগজ নিলো। অন্য লোকটা আরেকটা চিরকুট এবং ছোট্ট নীল একটা প্যকেট বাড়িয়ে দিলো নীরার দিকে।
চিরকুটে লিখা, “পঞ্চাশ হাজার আছে এতে। ভবিষ্যতে কথার হেরফের হলে মানুষও থাকবে না।”
নীরা প্যাকেটটা নিয়ে এসে লাবণীর হাত ধরলো।লাবণী কোনোরকম তোতলাতে তোতলাতে বললো,
—হাঁটতে পারছি না নীরা। পা টলছে, ঝিনঝিন করছে।
নীরা বিরক্ত গলায় ধমকের স্বরে বললো,
—বেকুবি করবে না ভাবী। এরা খুব ডেঞ্জারাস লোক। চলো।
নীরা লাবণীর হাতটা নিজের কাঁধে নিয়ে বললো,
—আমাকে ধরে ধরে হাঁটো.. হু.. এইভাবে। খুব তো বড়বড় কথা বলেছিলে, এখন তো ঘেটে ডাল হয়ে গেছ।
নীরা রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এসে হাঁফ ছাড়লো। এখন সোজা লিফটের দিকে,
—ও মাই গড! গুলির আওয়াজ কোথা থেকে?
নীরা পিছন ফিরে তাকালো। রেস্টুরেন্টে বসা লোকদুটোর দুজনই ফ্লোরে পরে গোঙ্গাচ্ছেন। গুলি করলো কে??
লাবণী চিৎকার দিয়ে বললো,
—নীরা ধরো আমাকে, ধরো আমাকে.. দৌড়াও নীরা।
নীরা লাবণীকে টেনে লিফট অবধি যেতে পারলো না। লাবণী বেহুঁশ হয়ে গেছে। নীরা লাবণীকে ফ্লোরে শুইয়ে দিলো। হেল্প হেল্প বলে চিল্লানোর মানে হয় না।চোখেমুখে পানিরছিটা দিতে হবে। নীরা ব্যাগ থেকে পানির বোতলটা বের করলো।
—হেই মিস নীরা ঠিক আছেন তো? উনার কি হয়েছে?
নীরা তাকালো। মি. তামিম কথা বলছেন। তাঁর হাতে পিস্তল।
নীরা তড়াক করে উঠে দাঁড়ালো।
—ভা…. বী.. ভাবী মানে বেহুঁশ হয়ে গেছেন।
তামিম পিস্তলটা ক্যারিয়ারে ঢুকিয়ে নিতে নিতে বললো,
—ওকে আমি দেখছি।
নীরা অবাক চোখে দেখলো, গুলিবিদ্ধ লোক দুজনকে স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাচ্ছে।
নীরা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
—লোকগুলো কি মরে গেছে?
তামিম হাসতে হাসতে বললো,
—মরা কি এত সোজা? দুজনকেই পায়ে গুলি করা হয়েছে।
—হ্যালো মিসেস লাবণী চোখ খুলুন। হ্যালো।
তামিম আবার কিছু পানি ছিটিয়ে দিলো। লাবণী এবার চোখ মেললো। নীরা স্টাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
লাবণী বিড়বিড় করে বললো,
—আমি কি মারা গেছি?
তামিম আশ্বস্ত করা গলায় বললো,
—আপনি সম্পূর্ণ ঠিক আছেন মিসেস লাবণী। ইউ আর কমপ্লিটললি এলাইভ।
লাবণী তামিমকে দেখলো এবং সাথে সাথেই উঠে বসলো।
—আপনি? আপনি কি করে?
নীরা হতাশ গলায় বললো,
—ইনিই গুলি করেছেন ভাবী।
—আপনার… আপনার কাছে বন্দুক আছে? আপনি গুলি চালাতে জানেন?
তামিম জবাব না দিয়ে পকেট থেকে টিস্যু বের করে দিতে দিতে বললো,
—নিন মুখটা মুছুন। আপনি বরং এই স্কার্ফটা খুলে নিন। এতে সাফোকেটিং ভাবটা কমবে।
নীরা ভয়ার্ত গলায় বললো,
—আমরা কিছু টাকা নিয়েছি ওদের কাছ থেকে। এই নিন।
তামিম বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বললো,
—দ্যাটস ভেরি গুড। আমাকে দিতে হবে না। আপনি তো পুলিশের কাছ থেকেই টাকা নেন, গুন্ডা তো গুন্ডাই!
নীরা শুকনো একটা ঢোঁক গিললো। মাত্র তো ৮৫০ টাকা ঠকিয়েছে। এটাও মনে রেখেছে?
লাবণী অনুরোধ ভরা কণ্ঠে বললো,
—আমাদের একটু বাসায় পৌঁছে দিন না তামিম সাহেব। আমার মাথা ঘুরছে।
হারুন দৌড়ে এসে বললো,
—সব ওকে স্যার। আমরা কি চলে যাবো?
—আপনারা অফিসে যান। আমার একটু কাজ আছে। ড্রাইভারকেও নিয়ে যান। গাড়ির চাবিটা দিয়ে যেতে বলুন।
—ওকে স্যার!
নীরা বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে।
—ওকে চলুন মিস নীরা। যাওয়া যাক।
লাবণী ব্যাগটা নিয়ে সামনে হাঁটতে থাকলো। নীরা ফিসফিসিয়ে বললো,
—এই ব্যাটা আপনার লোক? একে আপনিই পাঠিয়েছিলেন? কি ভয়ানক, কি ভয়ানক!
—মিস নীরা, আপনার মুখটা একটু এদিকে আনুন তো। রক্ত লেগে আছে নাকি?
নীরা মুখ বাড়িয়ে দিলো।
—কোথায়? কোথায়?
—এই যে ডান গালে
বলেই তামিম চট করে একটা চুমু খেয়ে নিলো।
নীরা আকস্মিক ঘটনায় বিস্মিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।
লাবণী পেছন ফিরে তাকালো।
—দাঁড়িয়ে আছো কেন নীরা?
তামিম দ্রুত এগিয়ে এসে বললো,
—হ্যাঁ হ্যাঁ.. চলুন চলুন। আরে মিস নীরা, আপনি অত বড় হা করেছেন কেন? ব্রিদিং প্রবলেম হচ্ছে? দেখবো আমি?
নীরা কিছু না বলে রোবটের মত হেঁটে এগিয়ে এলো।
হারুন আবার এসেছে।
—স্যার, গাড়ির চাবিটা।
—-গুড। মি. জাকিরকে বলুন, আমি আসার আগ পর্যন্ত কোনো ধরনের জিজ্ঞাসাবাদ নয়।
লাবণী গাড়িতে বসেই বোরকাটা খুলে নিয়ে বললো,
—আপনি অত বড় অফিসার বুঝতেই পারিনি। গুলি… বন্দুক… আচ্ছা, আমরা যে এখানে এসেছি খবরটা কি করে পেলেন বলুন তো?
—আমাদের দু-জন ওয়াচম্যান মিস নীরাকে ফলো করছেন কদিন যাবৎ। ডাউটিং কিছু বুঝতে পেরেছিলো বলে ইনফর্ম করেছে আমাদের। আমি অবশ্য আগেই আন্দাজ করেছিলাম এমন কিছু ঘটতেই পারে! এটা অনেক কমপ্লিকেটেড একটা কেইস। সব ইনফরমেশন আগে পেয়ে যাই তারপর বলবো।
নীরা চোখ বন্ধ করে বসে আছে।
লাবণী নীরার হাতটা ধরে ঝাঁকি দিলো।
—এমন দুম মেরে আছো কেন? কি হয়েছে? শকড?
নীরা জবাব দিলো না। তার কথা বলতে ভালো লাগছে না।
তামিম হাসলো…..
(চলবে)
#তৃধা_আনিকা