#ইস্ক,১৭,১৮

0
684

#ইস্ক,১৭,১৮
#সাদিয়া

১৭
সূর্যের তীর্যক রশ্মি ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর বুকে। আলো ফুটতেই সবাই সবার নিত্য কাজে হুমড়ে পরছে। নতুন একটা দিনের আলো ফুটা মানে কিছু মানুষের কাজের শুরু আর কিছু মানুষের আরেকটা আরাম আয়েশের শুরু।
তিতিল সকালে প্রতিদিনকার মতো নিজের কাজ সেরে নিল। একে একে সবাই এসে পরছে নিচে ব্রেকফাস্টের জন্যে। ইয়াদ কে না দেখে ইনা তাকে নিচ থেকে ডাকল। ইয়াদের শব্দ নেই। ইনা তিতিল কে বলল তাকে ডেকে দিতে।

তিতিল গিয়ে দেখল লোকটা সোফায় উল্টোপিঠে উবু হয়ে শুয়ে আছে। ঠোঁট বিড়বিড় করে তিতিল বলল,
“আশ্চর্য উনি এভাবে ঘুমাচ্ছে কেন? জানে না নাকি এভাবে শুয়া আল্লাহ পছন্দ করে না। আজাইরা মাতবরি।”
কপাল কুঁচকে এসেছে বিরক্তে। গিয়েই আচমকা বাহু ধরে ধাক্কা দিতে শুরু করল। মুখে স্পষ্ট বিরক্তির ভাব তুলে তাকাল তিতিলের দিকে।
“সকাল হয়েছে খুব আগে। উঠুন নাস্তার জন্যে বসে আছে ওখানে।”

“আমার টা তুমি করে নাও।”
ঘুম ঘোরে বলল ইয়াদ।

“আশ্চর্য আপনার নাস্তা আমি করে নিব মানে?”

“….

“কালকের মতো পানি ঠেলে দিচ্ছি আমি তবে।”

ধড়ফড়িয়ে উঠল ইয়াদ।
“ইডিয়ট। যাও আসছি আমি।”
তিতিল চুপচাপ চলে গেল। ইয়াদ চোখ ডলতে ডলতে বলল,
“ধানিলঙ্কা পুরো।”

খাবার টেবিলে বসে আছে চারজন। তিতিল পাশে দাঁড়িয়ে ইয়াদের মুখে রুটি আর ডিম তুলে দিচ্ছে। ইনা খাওয়া রেখে তাকাল একবার। তার একটু পর বলল,
“মা ভাই কথা ছিল একটা।”

রেহেলা বেগম বললেন,
“কি কথা?”

“….

“কি হলো আপু বলো।”

ইনা সময় নিয়ে বলল,
“ভাই আর তিতিলের ডিভোর্স নিয়ে কথা বলতে চাইছিলাম।”

থমকে গেল তিতিল। বুকটা ধক করে উঠল। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থেকে তাকাল ইনার দিকে। এদিকে ইয়াদ বিস্মিত হয়ে আছে। চোখ বোনের উপর থেকে সরছেই না। কানে আবার একথাটা বাজতেই সে বুকে ব্যথা অনুভব করল। বিরহের এক চিনচিনে ব্যথা!

“আমি তিতিলের জন্যে একটা ছেলে পছন্দ করেছি। সে তিতিলের সাথে মিট করতে চায়। আর ডিভোর্স নিয়ে আমি উকিলের সাথে কথা বলে নিব।”

অবাক সুরে রেহেলা বেগল বললেন,
“ইনা!”

“কি মা? একটা মেয়ের জীবন তো আমরা এমনি নষ্ট করতে পারি না। আর কত মেয়েটা এভাবে থাকবে? ওর কি ভবিষ্যৎ নেই? মায়ার বশে ওর জীবন টা কি নষ্ট করছি না আমরা? কি দরকার আছে মিথ্যে একটা সম্পর্কের? তার চেয়ে ডিভোর্সের পর নিয়ামের সাথে তিতিলের বিয়ে হয়ে ভালো হবে।”

ভয়ংকর গর্জে উঠে ইয়াদ। চোখ লাল হয়ে গেছে। ডান হাত দিয়ে টেবিলে সজোরে বারি দিয়ে বলল,
“এমন কিছুই হবে না।”

“হবে না মানে? কি বলতে চাস ভাই?”

“এ বিষয় নিয়ে আমি আর একটা কথাও শুনতে চাই না।”

ইয়াদ হনহন করে চলে গেল। তিতিলের ভেতরটা ভার লাগছে। চোখ দিয়ে টলমল হওয়া পানিটা গড়িয়ে পড়তেই সে মুছে নিল। কিছু না বলে চুপচাপ উপরে চলে গেল বিষন্ন ব্যথিত মনে।

“ইনা এমন টা করা ঠিক হবে না।”

“ঠিক বেঠিক বুঝি আমি মা।”
ইনাও রাগ দেখিয়ে চলে গেল। অসহায় মুখে বসে রইলেন রেহেলা বেগম।

ইয়াদের ভেতরটা আগুনের মতো জ্বলছে। অস্থির ভাব কাজ করছে তার। দাঁতে দাঁত লেগে আসছে বারবার। ঠোঁট গুলি কাঁপছে রাগে। মুখ ভয়ংকর রুপ ধারণ করেছে। গরম ধোয়া বের হচ্ছে যেন নিশ্বাসের সাথে। স্বস্তি লাগছে না। ইচ্ছা করছে সব কিছু ধ্বংস করে দিক চূর্ণবিচূর্ণ হওয়া হৃদয়ের মতো। লাল লাল চোখ গুলি দিয়ে এক ফোটা পানি পরতেই ইয়াদ সাথে সাথে তা মুছে নিল। বাইকের চাবি হাতে নিয়ে গছগছ করে বেরিয়ে গেল। রেহেলা বেগম পিছন থেকে ডাকলেও শুনেনি ইয়াদ। রেহেলা বেগম খুব চিন্তিত। তিনি জানেন না ভাগ্য কি লিখে রেখেছে।

তিতিল পাথর হয়ে জমে আছে। নিজেকে অনুভূতি শূন্য লাগছে। চোখের কোণার পানিটাও যেন বরফ হয়ে গেছে। টলমলে পানিটা চোখ দিয়েও গড়িয়ে পরছে না। ভেতরে শুধু ভারি একটা কিছু অনুভর করছে যে। যেটা তার দম টা আটকে আটকে আনছে। শ্বাসনালী চেঁপে ধরেছে যেন নিশ্বাস বন্ধ হওয়ার অভিপ্রায়ে।

বাইক বের করে ইয়াদ উপরে তাকাল। কেন মনে হচ্ছিল তিতিল ছাদে আছে। তার ধারণা সত্যি। তিতিল চেয়ে আছে। ইয়াদ মাথা উঁচু করে একবার তাকিয়ে বাইক স্টার্ট করে চলে গেল। এবার তিতিলের চোখের জমা পানিটাও গড়িয়ে পড়ল বাঁধভাঙ্গা।

—-
রেহেলা বেগম চিন্তিত মুখে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে। পাশেই বসে আছে হিমা। সে নির্বাক। কি হতে চলছে কেউ বুঝতে পারছে না। দুজনের মনেই ভয় গুটিয়ে নিয়েছে তাদের।

“হিমা।”

“বলো মা।”

“ইনা এসব ঠিক করছে না। জানি না কি হবে।”

“আমিও সেটাই ভাবছি মা। ভাইয়া যদি জানতে পারে তিতিল আপু গেছে নিয়াম ভাইয়ার সাথে দেখা করতে কি বলবে সেটাই ভাবছি।”

“আমি তো নাই করেছিলাম। তিতিলও যেতে চায় নি। ইনা যে জোর করে..”

“আল্লাহ জানে কি হবে মা।”

“…..

একটুপর বাইকের আওয়াজ পেয়ে মা মেয়ের আত্মা শুকিয়ে গেছে। অজানা ভয়ে তাদের শুকনো পাতার মতো নিগড়ে নিয়েছে সক রস। ইয়াদ এসে গেছে এবার কি হবে?

ইয়াদ বাড়িতে ঢুকে দেখে হিমা আর মা কে। ওদের মুখের ভাব দেখে কপাল কুঁচকালেও কিছু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হলো না আর। রান্নাঘরে ফরিদা আন্টি কে বলল,
“ফরিদা আন্টি তিতিল কে বলেন আমার জন্যে ফ্রিজ থেকে পানি দিয়ে আসতে।”

ইয়াদ চলে গেল।

“ইয়াদ আব্বা তিতিল মা তো বাসায় নাই।”

সিঁড়ির ধার থেকে ইয়াদ চমকে গেল। ফিরে এসে একবার মায়ের দিকে তাকাল। উনাকে খুব অস্থির লাগছে। জিজ্ঞেস করল,
“তিতিল কোথায়?”

“…..

“কি হলো তিতিল কোথায় মা?”

“ও একটু বের হয়েছে বাবা।”

“কোথায় গেছে?”

“….

এবার সে জোরে চিৎকার করে উঠল।
“তিতিল কোথায় গেছে?”

ফরিদা আন্টি রেহেলা বেগম হিমা ভয় পেয়ে গেয়ে নিস্তব্ধ হয়ে উঠেছেন। ঢোক গিলে বললেন,
“বাবা ও ইনার সাথে গেছে।”

“আপুর সাথে মানে?”

“….

“কি হলো বলছো না কেন?”

“ইনা অফিস থেকে এসে তিতিল কে নিয়ে গেছে নি নিয়ামের সাথে দেখা করাতে।”

রেহেলা বেগম জানেন না ছেলে এবার কি বলবে। ইয়াদ তাকিয়ে আছে স্তব্ধ হয়ে। মুখের ভাব কেমন দেখাচ্ছে। অজানা ভয়ে এবার আরো কুঁকড়ে উঠলেন তিনি। হঠাৎ ইয়াদ বলল,
“কাজ টা ঠিক হয় নি।”

ইয়াদ প্রবল বেগে ছুটল বাহিরের দিকে। রেহেলা বেগম হিমার ডাকে সে সাড়া দেয় নি। রাগে ফুসফুস করতে করতে বাইক নিয়ে আবার বের হয়ে গেছে।

পাগলের মতো বাইক চালাচ্ছে ইয়াদ। ভেতরে যেন দাবানল শুরু হয়েছে। চোখ গুলি বারবার নাম না জানা ভয়ে ঝাপসা হয়ে আসছে তার।

ইনার অফিসে গিয়ে চিৎকার শুরু করল তার কেবিনে।
“হচ্ছে টা কি ভাই?”

“তোমার সাহস কি করে হয় আপু এমন একটা কাজ করার?”

“কি বলতে চাস তুই?”

“কি বলতে চাই বুঝতে পারছো না? তিতিল আমার বউ আর তুমি।”

“কিসের বউ?”

“মানে?”

“দুই বছর বউ কোথায় ছিল তোর? ভালো করেই জানিস এখানে এসেছিস ডিভোর্সের জন্যে। আর আমরা তিতিলের জীবন টা নষ্ট করতে পারি না।”

“আপু তুমি ভালো করেই জানো আমি ব্যবসার কাজে এসেছি এখানে। আর ডিভোর্স দিব কি দিব না সেটা আমি বুঝব। তিতিল কোথায় বলো।”

“নিয়ামের সাথে।”

“কোথায় আছে সেটা বলো।”

“আস্তে ভাই এটা অফিস।”

“ও কোথায় আছে আমায় ঠিকানা দাও।”

“রেস্টুরেন্টে আছে ওরা।”

মাথার রগ এখনো দপদপ করে উঠানামা করছে ইয়াদের। নিজের রাগ কে কিছুতেই সামলে নিতে পারছে না সে।

“ভাই একবার ভাব ডিভোর্সের পর মেয়েটার কি হবে?”

রাগের মাত্রা বাড়ে ইয়াদের। বোনের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে ধীর গলায় বলল,
“তিতিল কে না আমি ডিভোর্স দিচ্ছি না আর না এই জীবন থাকতে দিবো।”

চলবে♥

#ইস্ক
#সাদিয়া

১৮
উন্মাদের মতো তিতিল কে বাইক থেকে নামিয়ে টানতে টানতে নিয়ে যেতে লাগল ভেতরে। ড্রয়িংরুমে রেহেলা বেগম আর হিমা তাদের আসতে দেখে দাঁড়িয়ে পরল।তিতিল তাকাল তাদের দিকে। কিন্তু ইয়াদ থামল না। মুখে টু শব্দ না তুলে সে তাদের সামনে দিয়ে টেনে উপরে নিয়ে গেল তাকে।
ঘরে ঢুকে ইয়াদ তার হাত ছেড়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। তিতিল জানে না কি হবে এখন। লোকটার মুখে স্পষ্ট ভয়ংকর রাগের চিত্র দেখা যাচ্ছে। লাল চোখ আর দাঁত কিটা ভাব দেখেই আড়ষ্ট হয়ে পরল তিতিল। ইয়াদ তাকাল তিতিলের দিকে। মুখে শান্ত ভাব দেখে ঠাসসস করে এক থাপ্পড় বসিয়ে দেয় গালে। ছিটকে পড়ে তিতিল। গাল দিয়ে গরম ধোয়া বের হতে শুরু করেছে। যেন চুলার গরম আঁচ থেকে সবে নামানো হয়েছে। চোখ গুলি আধাঁর হয়ে আসছে তার। মুখের লালা দিয়ে শুকনো গলা ভিজানোর চেষ্টা চালিয়ে মাথা তুলে তাকাল সামনে। লোকটা কে উন্মাদ বললে তার খুব একটা ভুল হবে না হয়তো। আচমকা ঝড়ের প্রবল হাওয়ার গতিতে ইয়াদ তিতিল কে ঝাপটে ধরে। এই প্রথম তিতিল কে শক্ত ভাবে আঁকড়ে ধরা। ইয়াদ আরেক ধাপ চেঁপে ধরল প্রেয়সী কে। এক চুল হাল্কা হলেই বুঝি আঁধারে মিলিয়ে যাবে। তিতিল নির্লিপ্ত অবাক ভঙ্গিতে তাকিয়ে রয়েছে শূন্যে। ইয়াদের শক্ত বাহু বন্ধনে তার দম আটকে আসলেও চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। ইয়াদ যে তাকে জড়িয়ে প্রবল বেগে ফুপাচ্ছে তা সে বেশ টের পাচ্ছে। স্নিগ্ধ এক আবেশময় শিহরণ বয়ে যাচ্ছে শরীরে। ঠোঁট কামড়ে ধরল নিজের।

বহুক্ষণ যাওয়ার পর ইয়াদ তিতিল কে বুক থেকে ছাড়িয়ে দ্রুত তিতিলের মুখ হাতের আঁচলে নিয়ে এলো। এলোমেলো অস্থির দৃষ্টি দিয়ে তাকাল তিতিলের দিকে। ঠোঁট গুলি কাঁপছে তার। ভেতরে কত চেষ্টা করে নিজের কষ্ট মিশ্রিত চোখের নোনা পানিটা সে আটকে ধরেছে তা বুঝাতে পারবে না কেউকে। কাঁপা ঠোঁট আর ঘন নিশ্বাসের বশে ইয়াদ বলল,
“তুই আমার বউ। মাথায় এটা রাখবি তুই ইয়াদের বউ।”

ইয়াদ কেন যেন নিজেকে আর সামলে ধরে রাখতে পারছিল না। ভাতের ফাঁপর আসার মতো ভেতরের জমানো কান্না উগলে আসছে। রাগের বশে কাঁপা শরীর নিয়ে সে পিছু ঘুরল। চোখের পানিটা আড়াল করে সে পা বাড়াল।

হঠাৎ পিছন থেকে শুনা গেল,
“আপনার এই রাগের কারণ কি?”
তিতিলের প্রশ্নের তীর তাকে থামিয়ে দিল। কিন্তু পিছনে তাকিয়ে নিজের ব্যথিত মুখটা তিতিলের সামনে প্রতিবিম্বের মতো তুলে ধরে নিজের দূর্বলতা প্রকাশ করতে চাইছে না। ঢোক ভেতরে ঠেলে দিয়ে ইয়াদ প্রত্যুত্তর না করেই চলে গেল নিজের কষ্ট ছাপামুখ নিয়ে।

তিতিল বিছানায় বসে আছে স্তব্ধ নির্জীব মানুষের মতো। জির্ণশীর্ণ মুখে তিতিল কে কালো গোলাপ লাগছিল। যেন সাদা শিউলি ফুল গুলি প্রাণ হারিয়ে ধূসর রঙ গ্রহণ করেছে। সে নির্বাক চিন্তিত। ইয়াদ কে নিয়ে দুটানায় অনুভূতি গুলো তাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলছে ক্রমশ। একটু আগের ইয়াদ আর দুই বছর আগের ইয়াদ কোন টা কে মেনে নিবে সে?
রেস্টুরেন্টে গিয়ে তাকে দেখতে পেয়েই ইয়াদ ছুটে গিয়েছিল। তিতিল তখন অস্বস্তি অবস্থা চেঁপে মুখে ঠেলে হাসি রাখার চেষ্টায় মেতে থাকতে চাইলেও মনে ব্যকুলতার ভাব তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তাকে দেখতে পেয়েই ইয়াদ কিছু না বলে হাত ধরে টান দেওয়া শুরু করে। তা দেখে নিয়াম নামের গাঢ় বেগুনি কালার শার্ট পরা ছেলেটা ততক্ষণে উঠে দাঁড়ায়। ফর্সা গায়ে বেশ লাগছে এই রঙ্গে। সে ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে ‘ কে আপনি? ‘ ইয়াদ নিজের জ্বলন্ত আগুনের ফুলঙ্গির ন্যায় দৃষ্টি দিয়ে সূক্ষ্ম গলায় জবাব দেয়,
“keep your mouth shut up. Because she is my wife.”
তারপরেই টানতে টানতে নিয়ে এলো তাকে বাসায়। তিতিল ভাবছিল বসে এসব। কি করবে সে বুঝতে পারছে না। মন ব্যাকুল হওয়ায় উদাসীন হয়ে উঠেছে মন কোণায় লুকিয়ে রাখা মানুষটার তরে।

—-
দুপুরে খাবার টেবিলে ইয়াদ সবাই কে সাফসাফ করে জানিয়ে দিয়েছে।
“তিতিল আর আমার ডিভোর্স নিয়ে ওর সাথে আমি আলাদা কথা বলতে চাই। কাল বাগান বাড়িতে যাচ্ছি আমরা।”

তার কথায় তিতিল সহ বাকিরা স্তব্ধ হয়ে যায়। ইনা খাবারে মুখ গুঁজে চোখ তুলে তাকাল ইয়াদের দিকে। তার ভাই তখন তার দিকেই তীক্ষ্ণ চোখে চেয়েছিল বিধায় চোখ নামিয়ে নেয় সে। রেহেলা বেগম খুশি হলেন। তিনি চান ছেলে আর তিতিল কে সুখী দেখতে। নিজের ভুলের কারণে মেয়েটার জীবন নষ্ট হোক তিনি চান না। উনার ভালো করেই জানা আছে মেয়েটা তার ছেলের জন্যে প্রতিটা দিন তাদের আড়ালে চোখেরধারা ঝরিয়েছে। তিতিল কে দেখে উনার পছন্দ হয়েছিল বলেই বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। বাবা মা যে কোনো দিন ছেলেমেয়ের খারাপ চাইতে পারে না। তবে তিতিল কে বেশ ভারাক্রান্ত মনের লাগছিল। যেন পথ হারানো পথিকের ন্যায় রাস্তা হারিয়ে পাগলের মতো এদিক ওদিক করেও রাস্তা না পেয়ে হায়হুতাশে ডুবে আছে মেয়েটা। ইয়াদ খাওয়া শেষ না করে চলে যায় তখন।

—-
ব্যালকুনিতে দাঁড়িয়ে আছে তিতিল। মনটা বড্ড হিসপিস করছে। ইয়াদের সাথে যাওয়া উচিৎ কিনা তা নিয়ে ভাবনায় মাথা দুলছে চরকির মতো। যেন মাত্র চরকি হতে মাটিতে পা দিয়েছে সে। মস্তিষ্ক বড্ড চঞ্চল আর উদগ্রীবে ঘিরে নিয়েছে। এমন অস্বস্তিকর পরিবেশে নিশ্বাস নেওয়ার শক্তিটুকও যে শরীরে মজুত নেই। গলাকাটা মুরগির মতো শুধু দাপাতে পারছে না। চিন্তায় উদ্বিগ্নতায় নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে অসহায় অসুখী আর সর্বহারা লাগছে।
লোকটা সেই দুপুরে খেয়ে বের হয়েছিল আর এখনো আসেনি। কোথায় গেছে কে জানে। যাওয়ার আগে তিতিল দেখেছে লোকটা রাগান্বিত ভাবে ফুঁসছিল। কোথায় চলে গেল বাইক নিয়ে? এগারোটার উপরে বাজে সবার খাওয়া শেষ। আর এখনো সে দাঁড়িয়ে চাতক পাখি হয়ে আছে। বিষন্ন মনের উত্তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে দিতেই খেয়াল করল বাইক নিয়ে ইয়াদ বাসায় এসেছে। তিতিলের মাথাটা থেকে একটা দুশ্চিন্তা নামার সরূপে ফুস করে নিশ্বাস ফেলে দিল।

ইয়াদ একটা শুকনো ঢোক গিলে হাতে একটা শপিং নিয়ে রুমে এলো। ব্যাগ টা বিছানায় ফেলে দিয়ে সে তিতিল কে ডাকল। তিতিল ব্যালকুনি হতে ধীর পায়ে ছুটে এলো ভেতরে। ইয়াদ ততক্ষণে বিছানার উপর বসেছে। তিতিল আসতেই শান্ত চাউনিতে তাকাল ওর দিকে। মেয়েটার কোমল মুখটা চোখে ভাসতেই স্নিগ্ধ হাওয়ায় মাতিয়ে উঠে সে। ভেতরে প্রশান্তির অবাধ্য ঢেউ আছড়ে পড়ে বুকে। সূক্ষ্ম কোমল চোখে তাকাতেই ইয়াদ থমকে গেল। দুপুরের চড়টা এখনো মেয়েটার গাল রঙ্গিম হয়ে আছে কৃষ্ণচূড়া ফুলের মতো। বড্ড মায়া হলো ইয়াদের সাথে টনটনে একটা ব্যথা। বুঝতে পারল এতটা রাগান্বিত হওয়া ঠিক হয়নি তার। কিন্তু কি করবে সে? ভালোবাসা হারানোর মতো যন্ত্রণা কি এই পৃথিবীতে আর দুটো হয়? টনটনে ব্যথিত মন নিয়ে তিতিল কে ডাকল নিজের কাছে। তিতিল দূরত্ব রেখে সামনে এসে দাঁড়াল শক্ত মুখের ভাবে। হঠাৎ ইয়াদ তার কোমর পেঁচিয়ে নিজের কাছে এনে সেখানে মুখ গুঁজে অঝোর দ্বারায় কেঁদে উঠল। কষ্টে তিতিলের বুক হু হু করে উঠল সঙ্গেসঙ্গে। লোকটা এভাবে কাঁদছে কেন? কি হলো উনার? কিন্তু তিতিল অনুভব করতে পারছে তার মনের সাগরে উথালপাতাল ঢেউ শুরু হয়েছে। আর সেই ঢেউয়ে সে আছড়ে পরছে তাল সামাল দিতে না পেরে। গলায় কিছু একটা এঁটে আছে শক্ত ভাবে। ঠোঁট গুলি কেঁপে উঠছে নরম ঢগা বাতাসে নড়বড়ের মতো। ইয়াদের এই অশ্রু তাকে বড্ড জ্বালাতনের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ইয়াদ কেন কাঁদছে নিজেও বুঝতে পারছে না। শুধু বর্ষণের মতো ঝড়তে চাইছে প্রেয়সীর মাঝে। কালো স্তূপে স্তূপে মেঘ যেমন ঘর্ষণ তুলে বর্ষণের সৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে জমিনের বুকে তেমনি ইয়াদের মনের কালো স্তূপের মেঘ গুলির আঘাতে আঘাতে বর্ষণ তুলছে সেও।

অনেকটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পর ইয়াদ নাক টেনে তিতিলের কোমর থেকে নিজের শক্ত হাতের বাঁধন খুলে দিল। মাথা তুলতে ভীষণ বাঁধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। তিতিল কি ভাবল তার এভাবে কান্না করায়? তাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করেছে বলে কি মেয়েটা নাক ফুলিয়ে লাল হয়ে আছে রেগে? নাকি বুকের ভেতরে কষ্টের ঝড় বইছে?
তিতিল নিজেকে ধাতস্থ করে দাঁড়াল। ভেতরের ঝড়টা বাহিরে প্রকাশ পাওয়ার কোনো অবকাশই দেখা যাচ্ছে না তার মাঝে। নিজেকে খিঁচে শক্ত হয়ে আছে সে। ইয়াদের সামনে নিজের মনের দূর্বলতা সে প্রকাশ করতে নারাজ। তবে মন বলছে বড্ড, ওই লাল মুখের অশ্রু সিক্ত নয়ন গুলি দেখতে হাতের তালুতে এনে। খুব বলতে ইচ্ছা করছে,’ আপনি কি জানেন না যাকে ধরে কান্নায় মেতে উঠেছেন তার ভেতরের প্রবল ঝড়ের খুঁজ? ‘

ইয়াদ তিতিলের চোখের দিকে তাকাল না। বিছানার উপর ব্যাগটা দেখিয়ে বলল,
“কাল এটা পরে রেডি হয়ে থাকবে। সকাল সকাল বের হবো আমরা।”

“….

ইয়াদ উঠে দাঁড়াতেই তিতিল বলল,
“আমার কোথাও যেতে ইচ্ছা হচ্ছে না।”
ইয়াদ পিছন ফিরে তাকাল তিতিলের দিকে। লাল লাল অশ্রুসিক্ত চোখ গুলি দেখে ত্রাসে নেতিয়ে গেল মেয়েটা। আবারো ঢেউ আছড়ে পড়তে শুরু করেছে বেসামাল ভাবে। তিতিল ঢোক গিলল। মিনমিনে গলায় বলল,
“কি দরকার আছে বাহিরে যাওয়ার? আমরা ছাদে গিয়ে কথা বলতে পারি।”

“রাগ চটিও না আমার। আশা করি কাল তাগাদ দিতে হবে না এ নিয়ে। কাল আমার আপনাকে চাই আলাদা ভাবে। কিছু কথা ক্লিয়ার করতে হবে মিস ইয়াদ। তারপর যা চাইবেন পাবেন আপনি।”

ইয়াদ আর দাঁড়াল না। ঝটপট ওয়াশরুমে চলে গেল। এ যেন নিজেকে লুকানোরই অভিপ্রায়।

চলবে♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here