বৃষ্টির_রাতে #রূবাইবা_মেহউইশ (১২)

0
361

#বৃষ্টির_রাতে
#রূবাইবা_মেহউইশ
(১২)

অফিসের সময় গুলো ভালোই কাটছে তাসিনের আজকাল। প্রথম প্রথম চাকরিটা খুব বিরক্ত লাগতো। মনে হতো চাকরির জন্য জীবনটা উপভোগ করা হচ্ছে না। কলেজ লাইফে একটা প্রেম করেছিল তাতেও ঠিক এমন মনে হয়েছিল তার আর সে কারণে প্রেমটা খুব নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছুতে পৌঁছুতে গার্লফ্রেন্ড তাকে ‘বিরক্তিকর’ উপাধি সাথে ছ্যাকা দিয়ে চলে গেল। এরপর জীবন বদলে বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠলো বন্ধুদের সাথে। কিন্তু বাড়ি থেকে দূরে থাকায় যোগাযোগ কিছুটা কমে গেল বন্ধুদের সাথে। পড়ায় মনোযোগ তার সবসময়ই ঠিকঠাক ছিলো হোক প্রেমে ছ্যাকা খাওয়া কিংবা ছোট মামার সাথে মায়ের একটা বিরোধ এতে তার পড়াশোনায় প্রভাব পড়েনি কখনো। অনার্স শেষে একরকম হুট করেই চাকরি পেয়ে গেল একটা কিন্তু সেটা রাজশাহী থেকে। তাসিন টের পেয়েছিল চাকরির ব্যবস্থাটা ছোট মামাই করেছে তাই সে আর সেদিকে গেল না।নইলে মা জানলে কষ্ট পাবে। চট্টগ্রামেই থেকে গেল বড় মামার পরিচিত একজন চাকরির অফার দিল বলে কিন্তু চাকরি যোগ্যতা ছাড়া পাওয়া যাবে না। ভাগ্য মন্দ তার কোন কালেই ছিল না তাই হয়ত কম্পিউটার দক্ষতার জের ধরে হয়ে গেল কাজটা। এখন সে দিব্যি আছে এ কাজে৷ বেশিদিন হয়নি জয়েন করার তবুও সবার নজরে তার যোগ্যতা, দক্ষতা বেশ আছে। কিন্তু খারাপ লাগে তার এই ভেবে, বসের সামনে সে মিথ্যে বলেছে। সুপ্রভার কারণে অফিসের অনেকেই তাকে বিবাহিত বলে জানে। চাইলেই সেদিন বলা যেত মেয়েটা কে কিন্তু তখন বিপদ ঘাড়ে নিয়ে এসেছিল বন্ধুরা তাই হয়ত মিথ্যেটাকে সত্যি বলে চালিয়ে দিয়েছে। এতে করে বসের কাছ থেকে এক্সট্রা দুটো দিন নেওয়ার সুযোগও পেয়েছিল। মোদ্দাকথা, মিথ্যে দিয়ে লাভ হওয়ায় লসটা নিয়ে ভাবেনি। আজ অফিস ছুটির সময় বড় মামা ফোন দিয়ে বলল, “আমার অফিসের সামনে দেখা করিস তো।”

তাসিন একটু ঘাবড়ে গেল। বড় মামা সচরাচর তাকে ফোন দেয় না। কিছু প্রয়োজন হলে মামীকে বলে মামী ফোন দিয়ে তাকে জানায়। কিন্তু আজ মামা ফোন দিলো কেন ভেবেই ভয় লাগছে। তবে কি ছোট মামা সব ফাঁস করে দিলো! না দেওয়ার তো কারণ নেই। মা আর ছোট মামার মধ্যে এখনো মনোমালিন্যতা আছে তবে সেদিন অবশ্য কক্সবাজারের ব্যাপারটা মামা কাউকে বলেনি৷ মায়ের খোঁজও নিয়েছে বলে শুনেছে তাসিন। অফিস ছুটির পরই রিকশা করে মামার ওখানে যেতেই মামা বলল, ” এটা নিয়ে পার্কিং লটে যা।”
তাসিন দেখলো মামার হাতে তার গাড়ির চাবি৷ হঠাৎ মনে হলো সে হাতে চাঁদ পেয়ে গেছে। খুশিতে চিৎকার করতে ইচ্ছে করলেও চিৎকারটা ভেতরেই দাবিয়ে রেখেছে। এক সপ্তাহের কথা বললেও মামা তাকে গাড়ি দেয়নি প্রায় দেড় সপ্তাহ ধরে। বন্ধুরাও ফিরে যাওয়ার পর তার মন একটু খারাপ থাকায় সেও গাড়ির প্রতি আগ্রহ দেখায়নি৷ তাসিন চাবি নিয়ে নিচে গিয়ে দাঁড়াতেই মনে পড়লো মামা তাকে বলেনি সে চলে যাবে নাকি মামাকেও নিয়ে যাবে! এই কোম্পানিতে মামা মাত্র কিছুদিন আগেই যোগ দিয়েছে। বড় মামার টাকার অভাব নেই আবার চাকরিও দরকার ছিল না। সময় কাটানোর উদ্দেশ্যেই তিনি একটা কিছু করতে চাইলেন আর এটা মামারই এক পরিচিতের কোম্পানি হওয়ায় কাজ দিলো৷ অভিজ্ঞতা থাকায় ভালোই পজিশনে আছেন। যদিও আর খুব বেশিদিন করবেন না বলেই ঠিক করেছেন।

“গাড়ি বের করিসনি কেন?”

মামার কথায় তাসিন সামনে তাকালো। মামাও যাবে তাহলে! গাড়ি বের করতেই মামা উঠে বসলেন৷ গাড়ি স্টার্ট দিতেই মামা বলল, “বাড়ি যাবো না এখন।”
“তাহলে!”

“কাচ্চিবিরিয়ানি খাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে খুব। ভালো কোন রেস্টুরেন্টে চল মামা ভাগ্নে খেয়ে যাই।”

মামার কথা শুনে তাসিনের চোখ দুটো বিশাল গোলাকৃতি হয়ে গেল। মামার কড়াভাবে নিষেধ আছে এমন সব রিচ ফুড খাওয়াতে। বাড়িতে তো এখন সয়াবিন তেলও খাওয়া বন্ধ হয়েছে। গরু, খাসি এসবেও নিষেধাজ্ঞা আছে তাই মামীর দুরকমের রান্না করতে হয় বাড়িতে৷ তাসিন মুখ খুলতে গিয়েও সুযোগ পেলো না। মামাই আগে বলল, “খবরদার বাড়িতে কাউকে কিছু বলবি না।”

“মামী যখন খাবার খেতে ডাকবে তখন?”

“তোর মামীকে ভয় পায় কে রে! ডাকলে বলে দিবি আমি আর মামা খেয়ে এসেছি। কি খেয়েছি সেটা বলার দরকার নেই।”

মামা কিছুটা জোর দিয়েই বলল। তাসিনও জানে বোকা মামীকে কিছু একটা বলে দিলেই মেনে নিবে৷ কিন্তু সমস্যা আপা তাই মামা যে বাড়ি গিয়ে ঘুমের নামে কেটে পড়বে সে ভালো করেই জানে৷

“আর আপা যখন জিজ্ঞেস করবে তখন কি বলবো?”

“কিছু বলবি না, নুরের সামনেই পড়বি না আজকে।”

গাড়ি ড্রাইভ করতে করতেই কথা হচ্ছিলো মামা ভাগ্নেতে। তাসিন পরিচিত এক রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি থামিয়ে বের হলো। মামা বের হলে গাড়ি লক করে মামাকে নিয়ে ঢুকলো রেস্টুরেন্টে৷ প্রায় আধ ঘন্টার মত সময় নিয়ে মামা ভাগ্নে খাওয়া শেষ করতেই তাসিন বলল কফি, কোল্ড ড্রিংকস কিছু খাবে কিনা! মামাও সুযোগ পেয়ে বললেন আজই তো খাবো একটা কোকাকোলাই নিয়ে আয়৷ আজ মামাকে কিসে পেয়েছে কে জানে! এমনটা ভাবতে ভাবতেই তাসিন উঠে গেল কোক আনতে৷ তার ফোনটা সে খাওয়ার সময় টেবিলের রেখেছিল সেখানেই বেজে উঠলো। মামা দেখে ফোনটা হাতে নিতে গিয়েও অপেক্ষা করল তাসিনের কিন্তু সে আসছে না। একজন বেয়ারা এসে দুটো কোক রেখে গেল টেবিলে৷ কলটা কেটে গেছে বাজতে বাজতে৷ পুণরায় কল আসতে মামা ভাবলেন হয়ত জরুরি৷ তিনি হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিলেন। স্ক্রিনে ভাসা নামটা উচ্চারণ করলেন, “তুফান” এ কেমন নাম আবার!

আরো কয়েক সেকেন্ড বেজে কল কেটে গেল। তাসিন আসেনি ফোনটা তৃতীয়বার বাজতেই মামা আর অপেক্ষা না করে ফোন কানে নিলেন।

“হ্যালো!”

“কে ফোন করেছে মামা।”

ওপাশ থেকে জবাব আসার আগেই তাসিনের কথা শোনা গেল। মামা ফোনটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “তোমার ফোন এসেছে। তুফান কে, এ কেমন ধারা নাম!”

বুকটাতে একটা ঘন্টার টুং শব্দ হয়ে গেল। ওই মেয়ে ফোন করেছে আর তা মামা তুলেছে! সে দ্রুত ফোন মামার থেকে নিয়ে কানে ধরলো, “হ্যালো, জ্বী আপনার নোটসগুলো পাঠিয়ে দিব পরীক্ষার আগেই। আচ্ছা। বাই।”

বিরতিহীনভাবে সবটা বলে তাসিন ফোন কাটলো। মামাকে বলল, “ব্যাচমেট আমার। সামনে একটা পরীক্ষা আছে তার জন্য কিছু নোট চেয়েছিল। আমি দিতে ভুলে গেছি।”

“কি ব্যাপার! এই লোক পাগল নাকি কিসের পরীক্ষা, কিসের নোটস! ব্যাটার কি মাথায় গন্ডগোল আছে!” সুপ্রভা বিড়বিড় করছে একা একা। তার রুমে বসে আছে জয়া নামের এক জুনিয়র মেয়ে৷ পাশের রুমের মেয়ে সে এসেছিল মেহরিনের কাছে কিন্তু মেহরিন নিচে গেছে ৷ সুপ্রভাকে বিড়বিড় করতে দেখে এগিয়ে এলো, ” বিড়বিড় করছো কেন প্রভা আপু৷ তুমি কি পাগল হয়ে গেছো?”

‘পাগল!’ কথাটা কানে লাগলো খুব সুপ্রভার৷ মাত্রই তো সে ওই বদলোককে পাগল বলল। আর এই মেয়ে বলে কিনা সে পাগল! মেজাজটাই বিগড়ে একদম আলুর ভর্তা অবস্থা। ফোনটা বিছানায় রেখে সে উঠে বাথরুমে ঢুকে গেল। ইচ্ছেমত মাথায় পানি দিয়ে এসে আবার নিজের বিছানায় শুয়ে পড়লো। আর তার কান্ড দেখে জয়া হা করে রইলো। আরও কিছু জিজ্ঞেস করার ছিল হয়ত মেয়েটার কিন্তু ভয়েই করেনি। সুপ্রভা যে খিটখিটে মেজাজের তা দু বছরে হোস্টেলের প্রায় বেশিরভাগেরই জানা। সেই সালিশের পর কয়েকটা দিন চলে গেল সুপ্রভা এখনো টিয়ার সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি। মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ কোথাও এক্টিভ পাচ্ছে না প্রিয় বান্ধবীটিকে সেজন্যই আজ আবার তাসিনকে ফোন করেছিলো। কিন্তু লোকটা এমন করলো কেন! রাগ হচ্ছে খুব সামনে থাকলে নিশ্চয়ই সে লোকটার মাথায় বেল মা*রতো।

আয়না আজ কতদিন হয়ে গেল মামীর কাছে যায় না। সেই যে সেদিন মামী বলল তাসিন ভাইকে তার পছন্দের মেয়ের সাথেই বিয়ে দিবে তারপর আর আয়না পা মাড়ায়নি ওদিকে। মাঝেমধ্যে মাইশা আসে বিকেলে তার সাথে গল্প করতে, সময় কাটাতে। কিন্তু সে আর এখন গল্প খুঁজে পায় না। আগে বলতো খুব তাসিনকে নিয়ে। হাজারো কথার ফুলঝুরি ছুটতো সবই তাসিন সম্পর্কিত। মাইশা তখন বিরক্ত হয়ে বলতো সব কথাতে ভাইয়া কেন আসে আপু?

আয়না তখন লজ্জায় রাঙা হয়ে যেত। কথা ঘুরিয়ে অন্যকিছু বলতে গিয়ে আবারও তাসিনকে নিয়েই বলতো। এমন করে অবশ্য মাইশাও বুঝে গেছে আয়না আপু তার ভাইয়াকে পছন্দ করে। কিন্তু এখন আয়নার পরিবর্তন চোখে পড়ছে। আয়নার মাও সেদিন খুব করে বকেছে তাকে তাই জেদ ধরেছে সে আর কখনো তাসিনকে নিয়ে কথা বলবে না। আজও তেমনই চুপ রইলো মাইশা আসার পর । আজ মাইশা আর তার মা দুজনই এসেছে একসাথে। এক বক্স আমসত্ব আর চিংড়ির বড়া বানিয়ে এনেছে। মাছুমার মনে হলো আয়নার অভিমান হয়েছে তাই মান ভাঙাতেই তার পছন্দের বড়া আর ঝড়ের সময় পড়া আম দিয়ে বানানো টক, ঝাল, মিষ্টি আমসত্ত্ব নিয়ে আসা৷ আসার পর থেকেই মাছুমা ননদের সাথে বসে কথা বলছে৷ আয়নাকে ডাকতে গিয়েছিল। গিয়ে দেখলো আয়না চুপচাপ বইয়ে মুখ গুঁজে আছে। কিন্তু সে কি পড়ছে না শুধু দৃষ্টি বুলাচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না। মাইশা আলতো করে কাঁধে হাত রাখতেই ভীষণরকম চমকে গেল আয়না।
“ভয় পেলে আপু?”

“তুই কখন এলি?”

“মাত্রই। আসো ফুপির ঘরে মা’ও এসেছে।”

আয়না বিষ্মিত হলো মামী এসেছে শুনে৷ মনে মনে কুণ্ঠিতও হলো সেদিনের কথা মনে করে। মামী কি সেদিন কিছু বুঝেছিল! বুঝেছিল নিশ্চয়ই সে কেমন বেহায়ার মত প্রশ্নগুলো করেছিল! লজ্জায় এখন মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু মাইশার জোরাজুরিতে উঠতেই হলো৷ মায়ের ঘরে ঢুকে আরো এক দফা সংকীর্ণতায় ভুগলো আয়না। ঘরে পা দিতেই টের পেল মা আর মামী ভিডিও কলে কথা বলছে তাসিন ভাইয়ের সাথে। তারই মাঝে মামী তাকে দেখে বলে উঠলো, “তোমার কি হয়েছে শুনি, ও বাড়ির পথ বেশ ভুলে বসে আছো দেখছি!” মামীর কথাটাতে অভিমান স্পষ্ট। মামী সবসময় তাকে তুই করে বলে। শুধু রেগে গেলে কিংবা অভিমান হলেই এমন আচরণ করে৷ তাসিন মায়ের কথা শুনে বলল, “কাকে বলছো আম্মা।”

“আর কাকে আমাদের ধিঙ্গি বুড়িকে৷ সেদিন কি না কি বলেছি তারপর থেকেই আর আমাদের বাড়ি যায় না। তাই আজ ঘটা করে বড়া বানিয়ে আনতে হলো মান ভাঙাতে।”

মায়ের কথা শুনে তাসিন হাসতে হাসতে বলল, “ওর আবার মান আছে নাকি! ক্যামেরাটা ওর দিকে দাও তো দেখি মান ভরা মুখটা।”

তাসিনের কথায় সবাই একসাথে হেসে উঠলেও আয়নার হাসি পেলো না। বরং একটা কান্নার ঢেউ বুক থেকে উথলে গলায় এসে আটকে গেল। মাছুমা ফোনটা আয়নার দিকে ধরতেই আয়না উল্টো ফিরে বলল, “আমি চা বানিয়ে আনছি।”

আর এক মুহুর্তও দেরি না করে আয়না বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। তাসিন একাই বোধহয় খেয়াল করলো আয়নার কথার ভেতর চাপা কান্নার ঢেউ। বাকিরা ভাবলো রাগ বেড়েছে।

চলবে।

(পরের কয়েকটা পর্ব শুধু তাসিন-সুপ্রভার জন্যই থাকবে৷ বাকিরা প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে একটু আধটু আসবে)
আগের সবগুলো ছবি ক্রেডিট ঃ Nurjahan Sarker
আজকেরটা মাইশাতুল মিহির

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here