#বৃষ্টির_রাতে
#রূবাইবা_মেহউইশ
(৩)
ঝরঝরে এক রোদেলা সকাল ঘুলঘুলির ফাঁক, ফোকরে ঢুকে রাজত্ব করছে সুপ্রভার চোখে মুখে। রাতের শীতলতায় জাঁকিয়ে আসা ঘুমটা দুষ্ট মিষ্টি রোদের হুটোপুটি খেলায় বিরক্ত হয়ে চোখের পাতা ত্যাগ করলো৷ টিকটিক করতে থাকা দেয়াল ঘরিতে আধো আধো চোখ খুলে তাকিয়েই চিৎকার করে উঠলো সুপ্রভা। কথা ছিলো আজ খুব ভোরে উঠে সে যাবে তার বান্ধবী টিয়ার কাছে। টিয়া পাখির আগামী সপ্তাহে বিয়ে আর সেই বাহানাতেই তো সে হোস্টেল থেকে বেরিয়েছে। বড়দা ভাই আর মায়ের জন্যই তাকে অতদূরে থেকে পড়াশোনা করতে হচ্ছে৷ নইলে এত সুন্দর, সবুজ রাজ্য ছেড়ে ঢাকা শহরের মত ধূলির রাজ্যে সে ভুল করেও পা ফেলতো না। মনে মনে সে দিন গোনে আর দুটো বছর তারপরই অনার্সের পাট চুকিয়ে বাড়িতে বসত গাড়বে৷ যদিও ততদিনে হয়তো এ বাড়ির বসত তার উঠে যাবে। শ্বশুর বাড়ির আঙিনা অপেক্ষা করবে তার জন্য কিন্তু তার তো খুব করে ইচ্ছে হয় এই গ্রাম, এই ভূমিতে আরো কিছুটা সময় স্বস্তির শ্বাস ফেলতে। কিসব আজাইরা ভাবনা বড়দা ভাইয়ের ঢাকায় থেকে পড়াশোনা করলে বড় কোন শহুরে পরিবারে বিয়ে দিতে পারবে। একটা মাত্র বোনকে শহরের সবচেয়ে দামী, বড়লোক আর শিক্ষিত পরিবারে বিয়ে দিতে পারবে। আদৌ কি এমনটা সম্ভব! বিয়ে হলো নসীবের লেখা। আল্লাহ তা’য়ালা যেখানে, যে পরিবারে এবং যার সাথে লিখেছে তার সাথেই হবে। পড়াশোনা সে ঢাকায় করুক কিংবা সিলেটে বিয়ের জন্য সেই স্ট্যাটাস কোন কাজে আসবে না। চোখ কচলাতে কচলাতে বিছানা ছাড়লো সুপ্রভা তখনি কানে এলো ভাবীর ডাক, “প্রভা, জেগেছিস? প্রভা দরজা খোল তোর ভাইয়া ডাকছে।”
আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে এসে দরজা খুলল সুপ্রভা। পরনে তার পাঞ্জাবীর মত ঢিলেঢালা কূর্তা আর লুঙ্গির মত ঢোলা প্লাজো। ঘুমের ধরণ তার কোনকালেই ভালো ছিলো না আর তাই ঘুম থেকেই উঠলেই লম্বা, সিল্কি চুলগুলোও ঠিক কাকের বাসার মত হয়ে থাকে। আজও ব্যতিক্রম নয় এ অবস্থা থেকে। এলোমেলো চুল দু হাতে মুড়িয়ে ঘাড়ের ওপর রেখে সে ভাবীকে জিজ্ঞেস করলো কেন ডাকছে?
ভাবী মিরা বলল, “তুই প্রত্যেকবার বায়না ধরিস সুনীল কাকার হোটেলে বসে পরোটা, মিষ্টি নাশতা করবি কখনো তো নিয়ে যায় না। এবার তোর ভাইয়ের মতিগতি বদলে গেছে৷ বলছে তোকে সাথে নিয়ে ওখানে নাশতা করবে তৈরি হয়ে আয়।”
“আমাকে সাথে নিয়ে যাবে!”
“হ্যাঁ”
“বাড়িতে নিয়ে আসবে না নাশতা?”
“তুই তো গিয়েই খেতে চাস?”
“মতলব কি?”
সন্দিহান মুখে প্রশ্ন করলো সুপ্রভা। মিরা থতমত খেয়ে গেল তার প্রশ্নে। মতলব একটা আছে বৈকি তাই আজকের ভিন্ন এক আয়োজন করেছে সোহরাব সাথে মেহরাবও যুক্ত। চার ভাইয়ের মধ্যে এই দুই ভাই মাত্রাতিরিক্ত চতুর৷ সৌহার্দ্যকে নিয়ে কিছু কথা খোলাসা করতে চায় সোহরাব। বোনকে নিয়ে তার আদর -আহ্লাদে কখনো কমতি ছিলো না কিন্তু এখন এই সৌহার্দ্য সম্পর্কে জানার পর থেকেই তার ভাবনায় লাগাম পড়েছে। সেই সাথে মায়েরও একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া আছে। কিন্তু বোনটা তার বড্ড একরোখা আর জেদি। খুব সম্ভব বাড়ির সবার আদরের পরিমাণটাই তাকে বিগড়ে দিয়েছে।
মিরা তাড়া দিয়ে চলে গেল। সুপ্রভার ঘরের ভেতরেই বাথরুম থাকায় সে মুখ হাত ধুয়ে পোশাক বদলে তৈরি হলো। মিনিট দশেকের মাঝেই সে তার বড়দার সামনে হাজির হলো৷ সোহরাব হাতে দুটো নতুন কলম নিয়ে ভালো করে চেক করলো। একটা সই করার জন্য আরেকটা বলপেন নিলো। তার আড়তে প্রয়োজনের লেখালেখির উদ্দেশ্যে। আজ বোনকে নিয়ে বেশ খানিকটা সময় তার বোনকে দিতে হবে ভেবে কিছু কাজ তৈয়াবকে বুঝিয়ে দিয়েছে। আজকের আকাশ মেঘহীন ঝলমলে তাই দিনের কাজগুলো সে স্বাচ্ছন্দ্যে করতে পারবে বলে আশা করছে। সুপ্রভা ডাকলো, “বড়দা ভাই , নাশতা বাড়িতেই করবো।”
“কেন রে মনা তোর জন্য তো আমি নয়াগঞ্জে খবর পাঠিয়েছি সুনীল কাকার হোটেলে। তোর পছন্দের নাশতা করবো আমরা দুজন সেখানে।”
সুপ্রভা বলতে চাচ্ছিলো সে টিয়ার কাছে যাবে একটু পর কিন্তু বড়দা ভাইয়ের মুখটাতে তাকিয়ে আর ইচ্ছে হলো না বলার। এই মানুষটা বড্ড ভালোবাসে তাকে। সে শতভাগ নিশ্চিত এতোটা ভালো তাকে বাবা কিংবা মা কেউই বাসে না। বিয়ের বারো বছরেও বড়দার ঘর আলো করে একটা ফুটফুটে শিশু আসলো না বলেই কিনা কে জানে সবচেয়ে ছোট এই বোনটাকে সে সন্তানের মতোই আদর, শাসনে বড় করছে৷ মিরাও তেমনই ননদকে ছোট, বোন, বাচ্চা মনে করে সবরকমেই যত্ন নেয়। সুপ্রভা আর কথা না বাড়িয়ে বের হলো ভাইয়ের সাথে। মেজদা ভাই বাবার সাথে ব্যবসায়িক কাজে যাবে। সেজদা ভাইও নিজ কাজে ব্যস্ত বাকি রইলো ছোট ভাই মেহজাব। সে আজ পড়াশোনা রেখে একদম ফ্রী সকাল সকালই। তাই বড়দার কাছে আবদার করলো সঙ্গে যাওয়ার। মায়ের কাছে অনুমতি নিয়ে তিন ভাই বোন অটোরিকশায় চড়ে চলে গেল নয়া গঞ্জের বাজারে সবচেয়ে নামকরা হোটেলে। নিজেদের এলাকার বাজারে এত ভালো হোটেল নেই বলেই সোহরাব সেই হোটেল থেকেই মন্ডা, মিঠাই আর নানা ধরনের মিষ্টি খাবার কেনে৷ রুটি, পরোটা, মাছ – মাংসও পাওয়া যায় সেখানে। মোটকথা সুনীল কাকার বিশাল দোকানটার একপাশে হোটেল অন্যপাশে মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। ভোরে আকাশটা যত পরিষ্কার ঝকঝকে ছিলো এখন আর তা নেই। একটু একটু করে মেঘ জড়ো হচ্ছে যেন নয়া গঞ্জের আকাশটায়। সুপ্রভারা যখন নিজেদের গ্রাম দয়া গঞ্জ ছেড়ে নয়া গঞ্জে পৌঁছুল ততক্ষণে আকাশের রোদ ঢাকা পড়েছে ছাইরঙা মেঘের আড়ালে।
“দোস্ত আর কত পড়বি তুই? ব্যাংকে চাকরি পেয়ে গেছিস এখন তো বিয়ে করে একটা সুন্দরী বউ নিয়ে আয়৷ চাচী তো দেখি প্রায়ই আমার মায়ের কাছে আসলেই বলে একটা বউ থাকলে ভালো হতো।” রিমন বলল মুরাদকে আর মুরাদ পরোটা ছিঁড়ে মুখে দিয়ে গপগপ করে গিলছে তো গিলছেই। তার কান নেই বন্ধুদের কথায়। সে খাওয়া পাগল মানুষ খাওয়ার সময় কোন আলাপ তার পছন্দ নয়। পাশেই বসে সুমন আর তাসিনও খাচ্ছিলো। তারা মুরাদকে এক নজর দেখলো কিন্তু বিশেষ কোন ভাবান্তর নেই তাদের। রিমনের রাগ হলো খুব তা দেখে। মুরাদের মা খুব করে ধরেছে রিমনকে যেন সে আর বাকি বন্ধুরা মিলে মুরাদকে বিয়ের জন্য রাজী করায়। মুরাদের পরিবারে মা আর সে ছাড়া তৃতীয় কোন ব্যক্তি নেই। মুরাদ অনার্স কমপ্লিট করেই ব্যাংকে চাকরি পেয়েছে তার খালুর জোরে। এরপরই সে মাস্টার্সেও এডমিশন নিলো। কিন্তু তার মা নিজের একাকীত্বের পর্দা সরাতেই ছেলের বউ ঘরে আনতে চায়। মুরাদ তা নিয়ে মোটেও মুখ খোলে না। আজ সব বন্ধু একসাথে হওয়ার কথা শুনেই মুরাদের মা রিমনকে বলেছে আজ তোমরাই বলো কিছু একটা। রিমন উদ্দোগ গ্রহণ করলেও বাকিরা গা করছে না। শুধু তাসিন একটু মজা করে বলল, “তুই যতোটা উত্তেজনা দেখাচ্ছিস মনে হচ্ছে বিয়েটা মুরাদকে নয় তুই নিজেই করবি।”
তাসিনের খাওয়া শেষ সে উঠলো হাত ধুতে। হোটেলের মূল গেইটের ডান দিকে বেসিন আছে লাগোয়া। তাসিন পেছনে ফিরে রিমনকে ক্ষেপাতে ক্ষেপাতে সামনে আগাচ্ছিলো। দরজার ঠিক কাছাকাছি আসতেই হঠাৎ কারো সাথে ধাক্কা লাগলো। বেখেয়ালে তাসিন থাকলেও সামনের মানুষটি খেয়ালি দৃষ্টিতেই সামনে আগাচ্ছিলো বলে ধাক্কাটা গুরতর লাগেনি৷ তাসিনের ডান হাতের বাজুতে সামনের মানুষটির মাথা লেগেছে। অল্পতেই সংগাত সামলে নিলেও ভয়ে চিৎকার করে উঠেছিলো মানুষটি আর তাই হকচকিয়ে সামনে তাকায় তাসিন। মেঘলা আকাশটা ঝপাৎ করে ঢেলে দিলো মেঘভাঙা বৃষ্টি। তাসিনের মনে হলো পূর্বপরিকল্পিত এই ধাক্কা। যেন কাল রাতের বর্ষণের স্মৃতিচারণ করাতেই আজ তীব্র রোদকে ঢেকে এই বৃষ্টির আগমন। সামনে থাকা মেয়েটি কি তাকে চিনতে পেরেছে! কথাটা মনে করতেই মনে পড়লো কাল মেয়েটির বলা শেষ শব্দ৷ তাকে পারভার্ট বলেছে, ফালতু আখ্যা দিয়েছে। রুমঝুমে বৃষ্টির মন মাতানো আবহাওয়াও বিরক্তিতে বিষাক্ত লাগছে তার। কত সুন্দর মুখশ্রীর লিলিপুট সাইজ মেয়েটার মুখের ভাষা বিষের মত জ্বলন্ত! তাসিন কিছু বলতে যাবে তার আগেই সামনে থেকে একজন বলল, “আরে মেহরাব যে!”
” মেহরাব না মাহতাব।”
“ওহ, ভুলে গেছি৷ একইরকম অনেকটা। তা এখানে কেন বউ নাশতা বানায়নি আজ? নাকি কাল রাতের জন্য সত্যিই কোন ঝামেলা হয়েছে?”
সোহরাবের কথা শুনে তাসিন একটা ফাঁকা ঢোক গিলল। কাল রাতে সে বিপদে পড়ার ভয়ে নিজেকে বিবাহিত বলেছিলো৷ আর এই মিথ্যেটা বলতে হয়েছিলো সামনে থাকা সুন্দরী লিলিপুটের জন্য৷ মেয়েটা দেখতে যত সুন্দর আচরণে ঠিক ততোটাই বদ। তাসিন আর সোহরাবের কথার মাঝেই রিমনও এলো হাত ধুতে। সে তাসিনকে ডাকলো, “তাসিন! তুই না বাড়িতে মিষ্টি নিবি বলেছিলি অর্ডার দিয়েছিস?”
কথাটা বলে তাসিন খেয়াল করলো সুপ্রভা, সোহরাব আর মেহজাবকে৷ কিছু জিজ্ঞেস করতে উদ্যত হতেই মেহজাব প্রশ্ন করলো তাসিনকে, “আপনি না কাল বললেন আপনার নাম মাহতাব?”
চোখা চোখে তাকালো সুপ্রভা আর বিড়বিড় করলো, “এ্যাই ছেমড়া লাফাঙ্গা তাতো এর চেহারা দেখলেই বোঝা যায়।”
“হ্যাঁ আমি মাহতাব। তাসিন মাহতাব মীর।”
সোহরাব বুঝতে পারলো তাসিন হয়তো ছেলেটার ডাকনাম৷ সে ঘাটাতে চাইলো না তাই বলল, “এই হোটেলের পরোটা মিষ্টি আমার বোনের খুব পছন্দ তাই আজ নিয়ে এলাম এখানে৷ তুমিও নাশতা করতে এসেছো? চলো আমাদের সাথে বসো।”
সোহরাব ভদ্রতা প্রকাশ করতেই তাসিনকে আমন্ত্রণ জানালো। তাসিনও জানালো তার নাশতা হয়ে গেছে৷ সুপ্রভারা একটা টেবিলে বসলো। ততক্ষণে তাসিনের বন্ধুরা সবাই নাশতা শেষ করে টেবিল ছেড়ে এসেছে। হাত ধুয়ে বিল মিটিয়ে তাসিন তার গাড়ির দিকে গেল৷ বন্ধুরাও গেল সাথে কিন্তু সবারই মুখ চলতে থাকলো৷ সবার এক প্রশ্ন ঘটনা কি! হোটেলের দরজার কাছে গিয়ে বৃষ্টি দেখে তাসিন অবাক হলো৷ সকালে কেমন রৌদ্রজ্বল সময় আর এখনই এমন আকাশ ভেঙে বারিধারা! হঠাৎ করেই মনে হলো মেয়েটাই একটা কুফা। সে এলো বলেই এমন বৃষ্টির শুরু৷ বন্ধুরা সবাই গাড়িতে উঠে বসতেই তাসিন বলল, “আয়নার জন্য কি করা যায় বলতো?”
“বিয়ে কর।”
চলবে