বৃষ্টির_রাতে #রূবাইবা_মেহউইশ (৩৩)

0
270

#বৃষ্টির_রাতে
#রূবাইবা_মেহউইশ
(৩৩)

“তোর কোন কথাই আমরা শুনছি না। বিয়ের জন্য পাগল হয়েছিস এবার নাচতে নাচতে বিয়ে করবি সংসার করবি। আজ থেকে কলেজে যাওয়া বন্ধ আর হ্যাঁ সন্ধ্যের আগেই তৈরি হয়ে থাকবি মেহমান আজানের পরপরই আসবে।”

কাটকাট গলায় কথাগুলো বলেই আয়নার মা ক্রোধান্বিত চেহারা নিয়ে প্রস্থান করলেন। মনে মনে ঠিক করে নিয়েছেন আজ সারাদিন আর মেয়ের সাথে কোন কথাই বলবেন না সন্ধ্যার আগে। একটা মেয়ে কি পরিমাণ নির্লজ্জ হলে আজ এমন দিনও দেখতে হয়! প্রথমে ভেবেছিলেন অল্পবয়সী আবেগ কতদিন আর চলবে একটা সময় হয়ত শান্ত হয়ে আসবে। তখন না হয় আবারও ভাই ভাবীকে ঠান্ডা মাথায় বলে দেখবেন তাসিনকে বোঝানোর কথা। বলতে নেই তাসিনের ফুপু মিনতি নিজেও মন থেকে চাচ্ছিলেন একমাত্র মেয়ের বিয়েটা ভাতিজার সাথেই হোক। এতে মেয়েটা চোখের সামনে থাকবে আর তার ভাবীও মেয়েটাকে যত্নেই রাখবে। কিন্তু মন্দ কপাল মেয়ে বুঝতে চাইলো না কিছু উল্টো নিজের মত পায়ে পা মাড়িয়ে ঝামেলা বাঁধালো তাসিনের সাথে। এতে সবটাই তাসার চালের মত বদলে গেল চাল। চাল বললেও ভুল হবে মিনতি কখনোই খারাপ ভাবনা নিয়ে কিছু ভাবেননি শুধু নিজের আপন মানুষের কাছে মেয়ে থাকলে ভালো হবে এটাই মনে করতেন। কিন্তু তাসিনকে নিয়ে আয়নার বাড়াবাড়িরকম নির্লজ্জতায় বাবা, মায়ের মা’থা কা’টার জো। আর এসবের মাঝেই এখন সম’স্যা সমাধানের পথ হলো যতদ্রুত সম্ভব আয়নাকে বিয়ে দেয়া। তাসিন নিজেই এক পাত্র পছন্দ করেছে। আয়নার বাবা আবদুল্লাহ্ পাত্রের নাম শুনে মুহূর্তেই চিনে নিয়েছেন৷ তাদের এলাকায় নতুন পুলিশ অফিসার মাত্রই মাস কয়েক আগে এসেছে। পাত্রের খোঁজ নিয়ে তবেই তাসিন কথাবার্তা বলেছে বাড়িতে। এতে অবশ্য রাগের মাথায় তাসিনকে দেওয়া মাস পেরিয়ে গেছে কবেই। কিন্তু সেটা মূলকথা নয়। জীবন কোন গল্প উপন্যাসের সাজানো প্লটও নয় তাই বাড়ির সবাই ভেবে চিন্তে এগোচ্ছে। এখন আবারও পরিস্থিতি ঘোলা করতে চাইছে আয়না। তার কারণেই তাসিনকে নিয়ে একটা তামাশা হতে হতে থেমেছে। সেসব ঘটনা এখনো পরিবারের ভেতরই আছে কিন্তু এসব বাড়াবাড়ি চলতে থাকলে পাঁচকান হতে সময় লাগবে না। এজন্যই আজ মিনতি মেয়েকে কড়া সুরেই শাসিয়েছেন যেন মেহমান এলে কোন নাটক না করে। আজ সেই পুলিশের বাড়ির লোকজন আসবে কয়েকজন মেয়ে দেখতে তারপর আবার মেয়েপক্ষও যাবে পাত্রের বাড়িঘর দেখতে। তাসিন ঢাকায় আছে তাকে আসতে বলা হয়েছিল। কিন্তু সে ছুটি না থাকায় আসছে না। মাছুমা অবশ্য ছেলের কাজে মনঃক্ষুণ্ন হয়ে নিশ্চুপ আছেন কিন্তু আয়নাদের বাড়ি আসবেন একটু পরই। সকল আয়োজন ননদের হাতে হাতে তিনিই করবেন।

সকাল থেকেই মনটা আনচান করছে একটা মেসেজের। কিন্তু কিছুতেই যেচে কল দেওয়া হবে না আজ। মানুষ কতোটা কঠিন হলে দুদিনেও একটা কল, মেসেজ না দিয়ে থাকতে পারে! তাসিনের ওপর ভীষণ রে’গে আছে সুপ্রভা। আজ দুদিন হলো লোকটা তাকে একটাবার কথা না বলে থাকতে পারছে অথচ সে কি যে ছটফট করছে। আজ তার পরীক্ষা নেই তাই সকাল থেকেই বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে আর বই নাড়াচাড়া করছে। আর মাত্র একটা পরীক্ষা বাকি তারপর একটা লম্বা সময় পাবে সে। ইয়ার চেঞ্জ পরীক্ষা অথচ তার আচরণ পরীক্ষা নিয়ে অনুভূতিশূন্য। তার সকল অনুভূতি গিয়ে জমে বরফ হয়ে আছে সেই শুভ্র রঙা শার্ট পরিহিত অগোছালো চুলের মানুষটার ওপর। থেমে থেমে শুধু চোখে ভাসে বৃষ্টির সেই রাত্রি। রাতের দ্বিপ্রহরে অচেনা লোকটার সেই উদ্ভট আচরণ তাকে সেদিন বিরক্ত করলেও এখন সেই রাতটাই বড় আদুরে এক স্মৃতির পসরা নিয়ে চোখের তারায় বসে থাকে। গত মাসের সেই ঘটনা যেদিন হোস্টেলের সামনে এসে অস্থির মুখ করে বলেছিলো, সুপ্রভা তুমি কি বিশটা মিনিট সময় দিতে পারবে এখন!” তখন না চাইতেও মনটা বলছিল বিশটা কেন আমি তো পুরো জীবনটাই আপনাকে দিতে পারি একবার চেয়েই দেখুন না!
আহা, কি ফিল্মি ইমোশন! ভাবতেই লজ্জা পেয়ে গেল সুপ্রভার। সে আজকাল একটু বেশিই উতলা হয়ে উঠছে অথচ ওই হামবড়া লোকটাও তার মত একই অনুভূতি নিজের ভেতর রেখেও অস্থির হচ্ছে না। হ্যাঁ সুপ্রভাও টের পেয়ে গেছে তাসিনের মনের হাল সেদিন যখন কথা বলতে এলো এহসানকে নিয়ে তখনই বারংবার উদাসী চোখে সুপ্রভার দিকে তাকাচ্ছিলো। মন কেমন করা দৃষ্টি সেদিন একটুও ভুল পড়েনি সুপ্রভা। সেদিনও বৃষ্টি শুরু হয়েছিলো এলোমেলো ভাবে। সুপ্রভার মন বলে ওপরওয়ালা যদি চান তবে তাসিন যেদিন তাকে মনের গোপন বিশেষ কিছু কথা জানাবে সেদিনও হবে এমন বর্ষণ। সেদিন তাসিন বলেছিলো, “আমার ফুপাতো বোন আমাকে ভীষণ ভালোবাসে। কিন্তু আমার ধারণা এটা ভালোবাসা নয় অল্প বয়সী আবেগমাত্র। কৈশোর পার হতে হতেই এই আবেগ কাটিয়ে উঠবে সে।”

“এটাতো ভালো কথা তা এসব আমাকে কেন বলা হচ্ছে?”

তাসিনের প্রথম কথা শুনেই বুকের ভেতর মুচড়ে উঠেছিলো বিষাক্ত যন্ত্রণা। ধ্ক করে বুকটা আচমকাই নিস্পন্দন হয়ে থেমে গিয়েছিলো। বড়োই কষ্টে শ্বাসটাকে চেপে নিজের গম্ভীর স্বরটাকে বের করে বলেছিলো সুপ্রভা। সে যে গত এক সপ্তাহ কোন যোগাযোগ না করায় তাসিনের ওপর রেগে ছিল সেই রাগেও ভাটা পড়ল এ ক্ষণে। তাসিন একটুও বিচলিত না হয়ে ধীরে ধীরে সবটা বলে গেল আয়নাকে নিয়ে তৈরি হওয়া ঝামেলা। শুধু কিঞ্চিৎ লুকিয়ে গেল আজকাল তার মনে সুপ্রভাকে নিয়ে দানা বাঁধা অনুভূতিটাকে। সুপ্রভা সব শুনে বলেছিলো, “এহসান ভাইয়া খুবই ভালো ছেলে। আমার কাজিন বলে বলছি না। ভাইয়া কিন্তু যথেষ্ট সৎ মানুষ চরিত্রের দিক থেকে৷ আর আপনার বোনকে পছন্দ যদি করেই থাকে তবে বলতে হয় আপনার বোনের সৌভাগ্য।” সুপ্রভা বারবার ‘আপনার বোন’ কথাটা যেন নিজেকেই শুনিয়ে আশ্বাস দিচ্ছিলো তাসিনের মনে আয়না নেই। কি আজব! সে ঠিক সেই মুহূর্তেই যেন আয়নাকে জোর করেই এহসানের জীবনে ঢুকিয়ে দিতে চাচ্ছিলো৷ তারপর আরো অনেকটা সময় দুজন সেই রেস্টুরেন্টে বসেই আলাপ আলোচনা করলো। সুযোগ বুঝে এহসানকে ফোন করে সুপ্রভা ঠাট্টার ছলে বলে ফেলল সে আয়নার কথা জানে। কি করে জেনেছে তা জানাটা মূখ্য বিষয় না বলেই তাসিনের মাধ্যমে জানার কথাটা এড়িয়ে গেছে। এরপর আরো দু চারদিন কথাবার্তা বলে সুপ্রভা তার বড়দাকে ফোনে বলে দিল এহসান ভাইয়ের ঘটনা। দিনরাত চো’র- ডা’কাতদের জীবন ওষ্ঠাগত করা এহসান টের পেল বাড়িসুদ্ধ আত্মীয়স্বজনে তাকে নিয়ে আলোচনার ঝড় বইছে৷ তার মা উঠেপড়ে লেগেছেন তার পছন্দ করা মেয়েটাকে দেখতে। সে কিছুতেই বোঝাতে পারলো না মেয়েটা এখনো ছোট অন্তত বিয়ের জন্য উপযুক্ত নয়। মনে মনে সুপ্রভাকে একশোটা গালি দিয়ে দোয়া করলো অতি শিগ্রই যেন সুপ্রভাকে জোরজবরদস্তি বিয়ের পিড়িতে বসতে হয় তখন বুঝবে কেমন লাগে। সুপ্রভার মাধ্যমে এহসানের পরিবারে জানাজানি হলো আর ওদিকে রিমনের মাধ্যমে পরিচিত লোক লাগিয়ে এহসানের বাড়িসুদ্ধ গোষ্ঠীর খোঁজ নিলো তাসিন। আয়নাকে শুধু বিয়ে দিয়ে ঘাড় ফাঁকা করা নয় ফুপুর একমাত্র কন্যার সুন্দর ভবিষ্যতও চিন্তা করতে হবে। তার কোন প্রকার ভুল পদক্ষেপ আয়না জীবন নষ্ট করে সে বোঝা আজীবন বয়ে চলা সম্ভব নয়। তবে রিমনের তথ্য অনুযায়ী এহসান মাহমুদ আয়নার পেছনে দেওয়ানা হয়ে আছে অনেক আগে থেকেই৷ শুধু ব্যক্তিত্ব আর কর্তব্যের বিরোধী হয়ে রোমিওগিরি করতে পারছে না বেচারা। আর সুপ্রভা তো বলল এহসানের মা নাকি ছেলের পছন্দের কথা জানার পর থেকেই সুপ্রভাদের বাড়ি আসা যাওয়া করছেন খুব। উদ্দেশ্য সুপ্রভার মাকে নিয়ে যেকোন একদিন পাশের গ্রামে সেই মেয়ের বাড়ি যাওয়া। তাদের কোনপ্রকার ঝুঁকি নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হলো না। সুপ্রভার বড়দা সোহরাব মেয়ের পরিবারের খোঁজখবর নিয়ে বুঝেছেন তাদের পক্ষ থেকে ঘটক পাঠিয়ে কথা বললে হয়ত ভালো হবে৷ তাই পরিচিত এক ঘটক পাঠিয়েই মেয়ের বাড়িতে ছেলের বায়োডাটাসহ বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে৷ এই যে আজই যাবে সন্ধ্যার পর এহসানের মা, তার ফুপু মরিয়ম, তার বড় চাচী আর সুপ্রভার ভাবী মীরা। ঢাকায় বসে সব খোঁজই নিচ্ছে সুপ্রভা সেই সাথে পুলকিত মনে অপেক্ষা করছে তাসিনের ফোনের।

সূর্য অস্তমিত পশ্চিম আকাশে। কমলা রোদ এখন সিঁদুরে রঙ ধারণ করেছে। তাসিন অফিস থেকে বেরিয়েছে আরো আগেই। রুমে ফিরে ঘামে ভেজা শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে ফোনটা চেক করলো। নাহ কাঙ্খিত কোন ফোনকল নেই৷ ভেজা শার্ট হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে নিজেই ডায়াল করলো সুপ্রভার নম্বরে। এক হাতে চুলোগুলোকে নেড়েচেড়ে ভাবতে লাগবো কলটা কি প্রথমে ফুপিকে করা দরকার ছিলো! ভাবনার মাঝেই প্রথম কলটা কেটে গেল। আশ্চর্য আজ মেয়েটা কল ধরলো না! পুনরায় কল দিতে উদ্যত হতেই তাসিনের ফোনে কল এলো। ‘বড় মামী’ নামটা দেখেই ক্লান্তিমাখা মুখটা উজ্জ্বল হয়ে গেল তার। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে হাস্যজ্বল কণ্ঠস্বরে ভেসে এলো, “পথের কাঁটা সত্যিই দূর করতাছেন আব্বা?”

উজ্জ্বল মুখে এবার চওড়া হাসি জায়গা করে নিলো। আসল ঘটনা তো একমাত্র তাসিন আর মামীই জানে।

চলবে
(ফোন যদি মায়ের হাতে থাকে আর কলে যদি আপু থাকে তাহলে ফোন আর আমি ধরতে পারি না 🥺 আজ কত ইচ্ছে ছিল সাড়ে দশটায় গল্প পোস্ট করবো😑🙂)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here