রংধনুর_আকাশ #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ পর্ব-০২

0
1300

#রংধনুর_আকাশ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-০২

০৪।
মাহাথি এক দৃষ্টিতে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। আর তার পাশে চিন্তিত মুখে বসে আছে মহুয়া। মাহাথির ঘরে নিরবতা বিরাজ করছে। কিন্তু এই নিরবতার মাঝে মারিয়া পাকোড়ার বক্সটা কোলে নিয়ে মাহাথির বিছানায় উঠে পা ভাঁজ করে বসে একটার পর একটা পাকোড়া চিবিয়ে যাচ্ছে।

আরিয়া ফেরদৌস এই সময় বাসায় থাকেন না। তিনি একেবারে সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরবেন। আর মাফিনের অফিস থেকে ফিরতে রাত হয়ে যায়। মাহাথিও কখনো দেরীতে ফিরে, আবার কখনো সন্ধ্যায় চলে আসে। শুধু আজই সে একটু তাড়াতাড়ি বাসায় চলে এসেছে।

মহুয়া মারিয়ার হাত থেকে পাকোড়ার বক্সটা কেঁড়ে নিয়ে বলল,
“আর কতো খাবি?”

মারিয়া আবার বক্সটা মহুয়ার কাছ থেকে টেনে নিয়ে বলল,
“এটাই তো খাওয়ার বয়স। বুড়ো বয়সে ডায়েবিটিস, কোলেস্টেরল এসব বেড়ে গেলে খেতেও পারবো না।”

মহুয়া চোখ গরম করে দাঁতে দাঁত চেপে মারিয়ার কানে ফিসফিসিয়ে বলল,
“আমি কিন্তু ট্যুরের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ফেলবো।”

মারিয়া কথাটি শুনে ঠোঁট ফুলিয়ে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে পড়লো। মহুয়া এবার মাহাথির মুখোমুখি বসে বলল,
“ভাইয়া, কি হয়েছে তোমার?”

মাহাথি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। মারিয়া এবার বলল,
“আচ্ছা ভাইয়া, পাকোড়াগুলো কি সেই মিষ্টি আপুটা বানিয়েছে?”

মাহাথি হাসলো। কিন্তু কিছু বলল না। সে মোটামুটি চুপচাপই থাকে। কিন্তু বোনদের প্রশ্ন কখনোই এড়িয়ে যায় না। যতো কঠিন বা জটিল প্রশ্ন হোক না কেন, মাহাথি উত্তর দেবেই। কিন্তু আজ সে চুপ করে আছে।

মহুয়া এবার বলল,
“ভাইয়া, সূচনা আপুর সাথে কি তোমার ঝগড়া হয়েছে?”

মারিয়া মহুয়ার প্রশ্নটি শুনে মাহাথির হাত ঝাঁকিয়ে বলল,
“মিষ্টি আপুর নাম কি তাহলে সূচনা? অসম্ভব সুন্দর নাম তো! কিন্তু তোমার নাম উপসংহার হলে ভালো হতো। একদম মনে হতো মেইড ফর ইচ আদার।”

মারিয়া এবার মহুয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুই আপুর নাম জানিস, আর আমি জানি না?”

মহুয়া ভাবলেশহীন ভাবে বলল,
“তুমি তো কখনো পাহাড়ে, কখনো বা সমুদ্রে বিচরণ করো। তুমি কিভাবে জানবে এসব? তুমি তো তোমার রাজ্যেই একা।”

“একা নই। আমার মতো অনেকেই আছে যারা প্রকৃতি ভালোবাসে। তুই যেসব প্রকৃতির বর্ণনা বইয়ে পড়িস, আর আমি সেসব লাইভ দেখি। ভবিষ্যতেও দেখতে চাই। বুঝেছিস?”

মাহাথি এবার শীতল কন্ঠে বলল,
“তোরা দু’জন এভাবে আমার কানের দুই পাশে হামলা দিচ্ছিস কেন? ঝগড়া করতে ইচ্ছে করলে অন্য কোথাও গিয়ে কর।”

মহুয়া ও মারিয়া একসাথেই বলে উঠল, “সরি ভাইয়া।”

মহুয়া বলল,
“ভাইয়া, তোমার কি সূচনা আপুর সাথে কোনো ঝামেলা হয়েছে?”

মাহাথি মহুয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“সূচনার কথা আমাকে আর কখনো বলিস না।”

“কিন্তু কেন ভাইয়া? তুমি তো আপুকে ভালোবাসো, তাই না?”

মহুয়ার কথা শুনে মারিয়া চেঁচিয়ে বলল,
“ভালোবাসো? সত্যি? আমি তো ভেবেছি মিষ্টি আপু তোমার জাস্ট ফ্রেন্ড।”

মাহাথি বলল,
“তোরা এসব কথা রাখ। আর মহুয়া, তুই সূচনার কথা আর তুলিস না। ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।”

মারিয়া মলিন মুখে বলল,
“তুমি মাকে বলছো না কেন?”

মাহাথি মলিন দৃষ্টিতে বোনের দিকে তাকালো।
মারিয়া বলল,
“ভয় পাচ্ছো, তাই তো?”

মাহাথি মেঝের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। মারিয়া আবার বলল,
“আমি বুঝি না, তুমি আর মহুয়া মাকে এতো ভয় পাও কেন?”

মাহাথি বলল,
“সব কিছু তোর ট্যুরে যাওয়ার অনুমতি নেওয়ার মতো সহজ না।”

“বলে তো দেখতে পারো।”

“আমি মাকে কষ্ট দিতে পারবো না। মা আমাকে একটা আবদার করেছে, আর সেই আবদার আমি কি করে ফেলবো?”

“আর সেই আবদার পূরণের জন্য তুমি একটা সম্পর্ক ত্যাগ করে দেবে?”

“ব্যাপারটা ওতোটা সহজ না। আমি মাকে তোদের থেকে ভালো জানি। মা আর যা-ই হোক প্রেমের সম্পর্ক মেনে নেবে না। বাবাকে ভালোবেসে মা অনেক বড় ধোঁকা খেয়েছে। আমি দেখেছি মাকে কষ্ট পেতে। সেই সময় কেউ আমার মাকে বাঁচাতে আসে নি। বারবার সেই নরকে ঠেলে দিয়েছিল। আর আজ তাই মা এতোটা কঠোর মানুষ হয়ে পড়েছে। মামার কাছে শুনেছি, মা তোদের বয়সে অনেক চঞ্চল ছিল। কিন্তু দেখ, ভালোবাসা একটা মানুষের স্বভাব চরিত্রকেই পরিবর্তন করে দেয়।”

“সূচনা আপু তো আর বাবার মতো হবে না।”

“মায়ের দৃষ্টিতে প্রেম নষ্টের মূল, প্রেম চিরস্থায়ী অভিশাপ। যদিও বড় মামার সাথে আমাদের তেমন যোগাযোগ হয় না, কিন্তু তার জন্যই মা বাধ্য হয়ে বাবাকে বিয়ে করেছিল। কারণ নানাভাইয়ের মৃত্যুর পর মাকে তার সংসারে বোঝা মনে হয়েছিল। আর তাই তিনি পড়াশুনা শেষ না করিয়েই মাকে বিয়ে দিয়ে দেন।”

মহুয়া বলল,
“মা তো বাবাকে ভালোবাসতো। তাহলে বাধ্য করেছে কেন বলছ?”

“ভালোবাসতো। কিন্তু বাবা খুব সন্দেহপ্রবন মানুষ ছিলেন। তিনি মাকে সন্দেহ করে অনেক আজেবাজে কথা শুনিয়েছিলেন। তাই মা তাকে বিয়ে করতে চান নি।”

মারিয়া বলল,
“শুধু বাবার কারণেই কি মা ভালোবাসাকে অভিশাপ মনে করে?”

“না, মায়ের দৃষ্টিতে তার দেখা কোনো প্রেমই শান্তির ছিল না। শুনেছি বড় মামাকে তার প্রাক্তন স্ত্রী খুব ভালোবাসতো। তারা ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু বাচ্চা না হওয়ায় তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। এরপর মামা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। আর সেখানেই বড় মামা ঠকে যায়। ছোট মামাও একজনকে খুব ভালোবাসতো। মেয়েটা মায়ের বান্ধবী ছিল। কিন্তু তখন মামার অবস্থা ভালো ছিল না, তাই সেই সম্পর্কটাও শেষ হয়ে যায়। মেজ খালাও খালুকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল। কিন্তু তাদের মাঝেও অনেক ঝামেলা হয়েছিল। শুধুমাত্র বড় খালা ভালোবেসে বিয়ে করেন নি। আর তিনিই সুখি হয়েছেন।”

মারিয়া বলল,
“কিন্তু এটা তো ভাগ্যের ব্যাপার।”

“জানি, কিন্তু মায়ের দৃষ্টিতে তো যারা প্রেম করেছে তারাই অভিশাপ পেয়েছে। এখন মাকে কি করে বোঝায় যে সব প্রেম অভিশপ্ত নয়?”

মহুয়া কিছু বলতে যাবে তার আগেই মাহাথি বলল,
“আমার কাছে মায়ের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই পৃথিবীতে কেউ নেই। কারণ আমি দেখেছি, মা আমাদের জন্য অনেক সহ্য করেছেন। আর আমি কি মায়ের একটা আবদার পূরণ করতে পারবো না?”

মহুয়া আর মারিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারা আর কিছুই বলতে পারলো না। কারণ বুদ্ধি হওয়া থেকে এখন পর্যন্ত তারা একবারো মায়ের একটা কথাও অমান্য করে নি। আর ভুলেও যদি মায়ের কথার বিরুদ্ধে কেউ যেতো, মায়ের মুখটা একদম বিধ্বস্ত হয়ে পড়তো। আর সেটা দেখে তারা আর কিছুই বলতে পারতো না।

পৃথিবীতে সব মায়েরাই কিন্তু সন্তানদের জন্য অনেক কষ্ট সহ্য করে যায়। আর বিনিময়ে তারা সন্তানদের থেকে ভালো ব্যবহার ছাড়া কিছুই চান না। কিন্তু যেসব মায়েরা বাবার দায়িত্ব নিয়ে ফেলেন, তাদের কষ্টগুলো আরো বেশি হয়। তাদের মাথায় অনেক চাপ থাকে। আর তারাও বিনিময়ে সন্তানদের কাছে কিছুই চান না। কিন্তু যদি মন থেকে কোনো আবদার করে বসেন, সেটাও ফেলে দেওয়ার সাহস থাকে না।

০৫।

ফারজানা হক সূচনা, বাবা-মার ছয় সন্তানের মধ্যে তৃতীয় সন্তান। তার বড় দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে আরো বছর খানেক আগে। বর্তমানে সে বোটানিতে মাস্টার্স করছে। তার বাবা, ইলিয়াস হক একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মচারী আর মা, ফৌজিয়া ইসলাম একজন গৃহিনী। তাদের সংসারে টানাপোড়েনের অভাব নেই। সূচনার বড় দুই বোনকে বিয়ে দিতে গিয়েই ইলিয়াস হক তার অর্ধেক সঞ্চয় শেষ করে ফেলেছেন। আর বাকী কিছু টাকা সূচনার বিয়ের জন্য জমিয়ে রেখেছেন। বর্তমানে ইলিয়াস হকের পেনশনের টাকায় ঘর খরচ চলে। আর সূচনা পাশাপাশি একটা স্কুলে শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দিয়েছে, আর বিভিন্ন শ্রেণির বাচ্চাদের বাসায় ব্যাচ পড়িয়ে সে কিছু টাকা নিয়মিত সংসারে দিচ্ছে। সূচনার ছোট দুই ভাইয়ের মধ্যে একজন অনার্স তৃতীয় বর্ষে, আরেকজন প্রথম বর্ষে, আর সবার ছোট বোনটা নবম শ্রেণিতে উঠেছে।

এদিকে ইলিয়াস হক সূচনার বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। কিন্তু সূচনা একের পর এক সম্বন্ধ ফিরিয়ে দিচ্ছে। গত তিন বছর ধরেই শুধুমাত্র মাহাথির জন্য সে এমনটা করে যাচ্ছে। কিন্তু মাহাথি যেন এই সম্পর্কের ব্যাপারে একদম উদাসীন। আর যখন থেকে সূচনা বিয়ের ব্যাপারে মাহাথিকে চাপ দেওয়া শুরু করে, তখন থেকেই মাহাথি আরো চুপচাপ হয়ে যায়।
মাহাথি আর সূচনার দশ বছরের প্রেমের সম্পর্ক। তারা হুট করেই একে অপরের প্রেমে পড়ে যায়। আর আজ হুট করেই তাদের সম্পর্কটা ভেঙে যায়।

জানালার গ্রিল ধরে চোখের জল ফেলছে সূচনা। সে মাহাথিকে খুব বেশি বিশ্বাস করে। সে জানে মাহাথি কাউকে ঠকাবে না। কিন্তু তাকে কেন এভাবে ঠকিয়েছে, সেটাই সে বুঝতে পারছে না। হঠাৎ ফোন বেজে ওঠায় সে চোখের জল মুছে ফোন হাতে নিল। দেখলো মাহাথি কল করেছে। কল ধরতেই মাহাথি বলে উঠলো,
“তুমি কি বিয়ে করে ফেলবে?”

সূচনা শীতল কন্ঠে বলল,
“তুমি কি চাও আমি সারাজীবন তোমার অপেক্ষায় থাকি? তুমি তো আমাকে বিয়েই করবে না। তাহলে এভাবে অপেক্ষায় থাকার কোনো অর্থই হয় না। তুমি জানো আমার পরিবারের অবস্থা। এইবার অনেক হয়েছে। আমি আর বাবাকে না করবো না।”

“দু’একদিন পর কি বাবাকে বলা যায় না?”

“কেন? দু’একদিন পর এমন কি হবে?”

“আমি মাকে তোমার কথা বলবো।”

“তুমি ভেবে বলছ তো?”

“হ্যাঁ, একবার বলে দেখি।”

সূচনা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,
“তার মানে এখনো একবারো বলো নি।”

“মাকে বলার সাহস হয় নি।”

“তাহলে প্রেম করার সাহস কিভাবে হয়েছিল? আমাকে প্রেমের প্রস্তাব দেওয়ার আগে তোমার এসব মাথায় আসে নি? আন্টি তো প্রেমের বিরুদ্ধে অনেক আগে থেকেই ছিলেন। কিন্তু তুমি তো সব জেনেশুনে তার বিরুদ্ধে গিয়েই আমার সাথে প্রেম করেছ। এখন বিয়ে করার সময়ই পিছুপা হচ্ছো? তোমরা পুরুষরা না পারোও বটে।”

“এভাবে কেন বলছ? আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবাসি।”

“দেখো, মাহা। তুমি যেমন তোমার মাকে অনেক ভালোবাসো, আমিও ঠিক তেমনি আমার বাবা-মাকে ভালোবাসি। তুমি তোমার মায়ের আবদার ক্ষুণ্ণ হবে তাই আমাদের সম্পর্কের কথাটা বলতে পারছো না, আর আমি তিন বছর ধরে আমার বাবা-মার সাথে যুদ্ধ করেছি, একের পর এক সম্বন্ধ ফিরিয়ে দিয়েছি। সব ত্যাগ কি শুধু মেয়েরাই করবে? আমার হাতটা তো তুমি ছেড়েই দিলে। এখন আবার বলছ দু’একদিন সময় দিতে? কি চাও তুমি?”

“যদি আমাকে বলা হয়, যেকোনো একটা হাত ধরতে, তাহলে আমি তার হাত ধরতে চাই, যে আমার হাতটা খুব শক্ত করে ধরেছিল। আর সেই হাতটা ধরার জন্য আমি সব ত্যাগ করতে প্রস্তুত। এমনকি তোমাকেও। কারণ মায়ের জন্য আমি বেঁচে আছি। আমার ভাই-বোনরা বেঁচে আছে। তোমাকে আমি এতোকিছু বোঝাতে পারবো না। তবে আমি মাকে তোমার কথা বলবো। হয়তো সব শুনে মা কষ্ট পাবেন। কিন্তু এরপর যদি মা রাজি না হোন..”

সূচনা মাহাথিকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“তারপর তুমি মায়ের পছন্দে বিয়ে করে নেবে। আর আমিও আমার বাবা-মার পছন্দে বিয়ে করে ফেলবো। অন্তত এই সমাধানে তোমার আরো তিন বছর আগে আসা উচিত ছিল। এতোটা ছোটও নও তুমি।”

“তুমি আমাকে বুঝতে পারছো না।”

সূচনা এবার নরম কন্ঠে বললো,
“তিন দিন সময় দিলাম। এরপর আর আমি তোমার অপেক্ষায় থাকবো না।”

কথাটি বলে সূচনা কল কেটে দিল। এদিকে মাহাথি ভাবছে, কিভাবে মাকে এই কথা জানাবে! কারণ আরিয়ার রাগ ও কঠোর ভাবটা একবার প্রকাশ হলে সেই মাসে ঘরে কোনো শান্তি থাকে না।

চলবে–

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here