রংধনুর_আকাশ #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ পর্ব-৪০

0
639

#রংধনুর_আকাশ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-৪০

৬৪।
মহুয়া মারিয়ার সামনে এসে দাঁড়ালো। মারিয়া অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে আছে। মহুয়া নিবিড়কে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আমি মারিয়ার সাথে একটু একা কথা বলতে চাই।”

মারিয়া নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
“নিবিড়, চল আমরা খাবার অর্ডার করি। কি খাবি তুই?”

মহুয়া বলল,
“মাঝে মাঝে অন্যকে কথা বলার সুযোগ দেওয়া উচিত। তুমি যা অনুমান করছো, তা সঠিক নাও হতে পারে।”

মারিয়া মনে মনে বলল,
“আমি ভুল অনুমান করছি? যখন প্রহরকে ফোন দিয়েছিলাম, সে ব্যস্ত আছি বলেই কল কেটে দিয়েছিল। আর এখন আমারই বোনের সাথে খেতে এসেছে! আর আমি নাকি ভুল ভাবছি।”

মহুয়া আবার বলল,
“মারিয়া, আমার কিছু বলার আছে।”

মারিয়া একবার নিবিড়ের দিকে, আরেকবার মহুয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
“যা বলার নিবিড়ের সামনেই বল।”

মহুয়া এবার রাগী কন্ঠে বলল,
“এখন কি ব্যক্তিগত কথাও আমাকে বাইরের মানুষের সামনে বলতে হবে?”

নিবিড় অজুহাত দেখিয়ে মারিয়াকে বলল,
“আমি একটা কল করে আসছি।”

নিবিড় উঠে চলে যাওয়ার পর মহুয়া মারিয়ার মুখোমুখি বসে পড়লো।

মারিয়া বলল,
“কি বলতে চাস?”

মহুয়া বলল,
“ভাইয়া এখানে আমার সাথে লাঞ্চ করতে আসে নি। আমিই ভাইয়াকে জোর করে নিয়ে এসেছি।”

“আচ্ছা? তারপর।”

“আমি বাতিঘরে গিয়ে দেখলাম, ভাইয়া একপাশে স্থির হয়ে বসে আছে। ভাইয়াকে দেখে আমি নিজেও অবাক হয়েছিলাম। তারপর কাছে গিয়ে দেখলাম, তার চেহারার বিধ্বস্ত অবস্থা! তাকে কেমন যেন দুর্বল লাগছিল! আমি সাথে সাথেই ভাইয়াকে পাশের ফার্মাসিতে নিয়ে আসি। ওদের তো একটু-আধটু আইডিয়া থাকে, তাই। ভেবেছি ওরা কিছুটা আন্দাজ করতে পারবে। এরপর ওখানে ভাইয়ার বিপি চেক করার পর বলল, তার হাই ব্লাড প্রেশার। এরপর এই ওষুধটা দিলো।”

মহুয়া মারিয়ার দিকে ওষুধটি এগিয়ে দিতে দিতে বলল,
“খালি পেটে কি এসব ওষুধ খাওয়া যায়? তাই এখানে নিয়ে এসেছি।”

মারিয়া ব্যস্ত হয়ে বলল,
“আমাকে আগে বলিস নি কেন?”

“মাত্রই তো হলো। আগে কিভাবে বলবো? আর এখানে এসেই তো তুই সাপের মতো ফোঁসফোঁস করে নিবিড়ের সাথে এই টেবিলে এসে বসে পড়লি।”

মারিয়া চেয়ার ছেড়ে উঠে প্রহরের পাশে গিয়ে বসলো। আর বলল,
“আমি কি জানতাম আপনার শরীর খারাপ হয়েছে? আমাকে কেন ফোন দিয়ে বলেন নি যে আপনার খারাপ লাগছে? আমি যখন ফোন দিয়েছিলাম, তখন আপনি বই পড়ছিলেন, তাই না? আমাকে বললেই তো হতো। আমি তো জানি যারা বই পড়ুয়া হয়, তাদের জন্য বই পড়া একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আর সেই সময় তারা অন্য কোথাও মনোযোগ দিতে পারে না। আমি তো দেখেছি মহুয়াকে। তাই আমার এতোটুকু ধারণা ছিল। কিন্তু আপনি তো আমাকে কিছুই বলেন নি।”

প্রহর চুপচাপ বসে আছে। কারণ সে অপরাধী। মারিয়া বা মহুয়া কেউই না জানলেও সে নিজে জানে, সে অপরাধ করেছে। কারণ মারিয়া তাকে ফোন করে দেখা করতে বলেছিল, কিন্তু সে মিথ্যে অজুহাত দেখিয়ে মারিয়ার কল কেটে দিয়েছিল। মূলত আজ প্রহরের মূল উদ্দেশ্য বই পড়া ছিল না। তাই সে এই মুহূর্তে মারিয়াকে কোনো উত্তর দিতে পারছে না। তার মন তাকে বার-বার জানিয়ে দিচ্ছে, সে ভুল করছে, সে মারিয়াকে ধোঁকা দিচ্ছে। আর আজকের এই ঘটনা দেখে তার মনে হচ্ছে, এই ভুল বেড়ে গেলে শুধু তার বৈবাহিক সম্পর্কে নয়, দুই বোনের মাঝেও অনেক বড় সমস্যা সৃষ্টি হবে।

কিছুক্ষণ পর নিবিড় রেস্তোরাঁয় ঢুকে দেখলো মারিয়া প্রহরের হাত ধরে তার পাশে বসে আছে। আর মহুয়া মারিয়ার জায়গায় বসে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। মারিয়াকে প্রহরের পাশে দেখেই নিবিড়ের খারাপ লাগলো। কিছুক্ষণ আগেই সে খোলা চোখে বসে স্বপ্ন দেখেছিল, হয়তো এখনই মারিয়াকে কাছে পাওয়ার সুযোগ এসেছে। কিন্তু না, স্বপ্ন তো স্বপ্নই।
এবার মহুয়ার দিকে তাকিয়ে নিবিড়ের রাগ উঠে গেলো। বিড়বিড় করে বলল,
“এই ভদ্র আপার জন্যই আমার স্বপ্নটা ভেঙে গেছে।”

মহুয়া সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলো নিবিড় তার দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মহুয়া কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। নিবিড় মহুয়ার ইতস্তত ভাব দেখে বলল,
“তুমি তো দেখছি ভালোই মানুষ পটিয়ে ফেলো।”

মহুয়া ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“দুঃখিত। কি বললেন?”

“এই যে হিটলার আপাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে ওইদিকে পাঠিয়ে দিলে।”

মহুয়া চুপ করে রইলো। নিবিড় আবার বলল,
“তুমি হয়তো জানো, হিটলার আপা আমার জন্য..”

মহুয়া নিবিড়কে থামিয়ে দিয়ে বললো,
“মারিয়া এখন বিবাহিতা। আপনি বরং সরে দাঁড়ান।”

নিবিড় দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“দেখো, মারিয়াকে আমি ভালোবাসি। আর আমি জানি তোমরা দু’জন মারিয়াকে ধোঁকা দিচ্ছো। শুধুমাত্র তোমার জন্যই আজ ওর মন খারাপ ছিল। আর সাথে ওই লোকটাও দায়ী।”

মহুয়া ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“আর মারিয়ার এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে যাওয়ার জন্য আপনি দায়ী। এখন আপনি আসুন। আর আমার বোন থেকে দূরত্ব রাখুন।”

নিবিড় চেয়ার ছেড়ে উঠে মারিয়ার টেবিলের দিকে এগিয়ে এসে বলল,
“মারিয়া, আমাকে বাসায় যেতে হবে। একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল। আল্লাহ হাফেজ।”

মারিয়া মুচকি হেসে বলল, “আচ্ছা। আল্লাহ হাফেজ।”

এতোটুকু বলেই মারিয়া আবার প্রহরের দিকে মনোযোগ দিল। আর তা দেখে নিবিড়ের অনেক খারাপ লাগলো। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেখান থেকে বেরিয়ে গেলো।

অন্যদিকে সেদিন প্রহর কিছু না বলেই অনেক বড় ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে গেল। আর সেদিনই প্রহর সিদ্ধান্ত নিলো, সে মারিয়াকে সব সত্য জানিয়ে দেবে। আর কখনোই মহুয়ার জন্য কোনো মিথ্যে অজুহাত দেখাবে না। কারণ সে চায় না, তার জন্য মহুয়ার কোনো বিপদ আসুক। কিন্তু প্রহর মারিয়াকে সত্যটা আর জানাতে পারলো না। সে এরইমধ্যে দুইবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু মারিয়ার কথাবার্তা শুনে বুঝলো, সে এসব বুঝবে না। কারণ বয়সের তুলনায় মারিয়া এখনো ইম্যাচিউর। আর সে তার বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে কখনোই প্রহরের অনুভূতি বুঝবে না। বুঝবে শুধু ভুলটা। সমাজের ভাষায় যাকে বলে, পরকীয়া। সে বুঝবে তার বর তার বোনের সাথে পরকীয়ায় আসক্ত। কিন্তু এই শব্দটা ব্যবহার করলে প্রহরের অনুভূতির অপমান হবে। কারণ পরকীয়ার দুটি সঠিক সংজ্ঞা আছে। প্রথমটি হলো, একজন পুরুষ বা নারীর বিয়ে বহির্ভূত একাধিক নারী বা পুরুষের সাথে প্রেমের সম্পর্ক বজায় রাখা, যেই প্রেম শুধু মানসিক বা শারীরিক আনন্দ দানের জন্য। যেই প্রেম সাময়িক। আর এই সাময়িক প্রেম সম্পর্কে উভয় পক্ষেই অবগত। আর দ্বিতীয়টি আরো নোংরা সংজ্ঞা, আর তা হলো নির্দিষ্ট একজন নারী বা পুরুষের উপর আসক্তি শুধু শারীরিক প্রয়োজনীয়তার জন্য।

অথচ মহুয়া তো পবিত্র। সে তো জানেই না প্রহর তাকে ভালোবাসে। আর প্রহরের ভালোবাসা তো নোংরা নয়। সে তো মহুয়াকেই বিয়ে করতে চেয়েছে। কিন্তু একটা ভুল তথ্য তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। এখন হয়তো এই সত্যটা মারিয়াকে জানিয়ে দিলেই প্রহর মানসিকভাবে চাপ মুক্ত হবে। কিন্তু এখনো সেই সময় আসে নি। মারিয়াকে আরেকটু বড় হতে হবে। তার এই সত্যটা বোঝার মতো মন-মানসিকতা থাকতে হবে। নয়তো যা নয়, তা ভেবে সে আরেকটা ঝামেলা পাকিয়ে দেবে।

এরপর কয়েক সপ্তাহ কেটে গেলো। আর স্বস্তিকা এবং মাফিনের বিয়ের কথাবার্তা শুরু হয়ে গেলো। স্বস্তিকার বাবা-মা খুব ধুমধাম করে মেয়ের বিয়ে দিতে চান। তাই তারা সময় নিলেন। আর এমনিতেই একমাস পর মারিয়া ও মহুয়ার পরীক্ষা। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর পরই বিয়েটা হবে। দেখতে দেখতে কেটে এলো একমাস। মারিয়া ও মহুয়ার পরীক্ষা শুরু হয়ে গেলো। দুই বোন আলাদা কলেজে পড়ে বিধায়, তাদের পরীক্ষার কেন্দ্র দুই জায়গায় পড়েছে। মহুয়াকে প্রতিদিন আরিয়া ফেরদৌস নিয়ে যান, কারণ তার অফিস থেকে মহুয়ার কেন্দ্রটি কাছেই ছিল। তবে মাঝে মাঝে মাফিন নিয়ে যায়, আর নিয়ে আসে মাহাথি। যেদিন মাফিন মহুয়াকে নিয়ে যায়, সেদিন আরিয়া ফেরদৌস মারিয়াকে কেন্দ্রে নিয়ে যান। কিন্তু মারিয়াকে বাসায় আনার দায়িত্ব প্রহরের। আর প্রতিদিনই কাজ থাকুক বা না থাকুক প্রহরকে সব ছেড়ে ছুড়ে মারিয়াকে আনতে যেতে হবেই। আর সেখান থেকে রিক্সায় উঠার পর যেই না শুরু হয় মারিয়ার বকবকানি, এ যেন রেলগাড়ী! থামার কোনো নাম নেই। থামতে বললেও আরো কিছুক্ষণ বকবক করার পরই থামবে। তবে এই কয়েকদিনে প্রহরের এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে তার খুব অসহ্য লাগে। তখন ইচ্ছে করে মারিয়ার মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে দিতে। আবার মাঝে মাঝে ভালো লাগে। ইদানীং এই মিশ্র অনুভূতি প্রহরকে দ্বিধায় ফেলে দিচ্ছে। সে নিজেও বুঝতে পারছে না তার কি হচ্ছে।

মানুষের মন আসলেই বিচিত্র, যা হুটহাট পালটে যায়।একবার অতীতে ফিরে যায়, আবার চোখের পলকে বাস্তবে ফিরে আসে। একবার চমৎকার প্রেমিক হতে চাইলে, আরেকবার ইচ্ছে করে দায়িত্ববান স্বামী হতে। কিন্তু এই মনের যেন স্থির কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। হয়তো প্রহর নিজেই এখন অস্থির, তাই এমন মনে হচ্ছে।

চলবে-

(🫥আগামী পর্বে থাকবে মাফিন-স্বস্তিকা স্পেশাল।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here