#রংধনুর_আকাশ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-০৬
১৩।
অফিস থেকে সোজা বাতিঘরে চলে এলো প্রহর। আজ আর তার বাসা থেকে আসার সময় ছিল না। কারণ অফিসের কাজ শেষ হতে হতে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল। আর আজ যদি সে তার মায়াবিনীর দেখা না পায়, তাহলে আরো এক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে। কারণ মায়াবিনী সপ্তাহে শুধু সোমবারই বাতিঘরে বই পড়তে আসে।
প্রহর বাতিঘরে ঢুকেই তার ব্যাগটা রেখে মায়াবিনীকে এদিক-ওদিক খুঁজতে লাগলো। অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজির পরও যখন সে মায়াবিনীকে দেখলো না, তখন হতাশ হয়ে সে সামনে থাকা একটি বইয়ে যে-ই হাত দিতে যাবে, তখনই আরেকটা হাত সে বই স্পর্শ করলো। প্রহর মুখ ঘুরিয়ে সেই মানুষটির দিকে তাকিয়ে থমকে গেল।
এ তো তার মায়াবিনী! হঠাৎ মেয়েটা কোথা থেকে এলো! এতো কাছ থেকে সে তার মায়াবিনীকে আজ প্রথম দেখছে। এতো মেঘ না চাইতে বৃষ্টি!
মেয়েটি বিনয়ীর সুরে বলল, “দুঃখিত।”
ব্যস, এতোটুকু বলেই প্রহরকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মেয়েটি কয়েক হাত দূরে গিয়ে আরেকটি বই হাতে নিয়ে পাশের একটা বেঞ্চে বসে পড়লো।
প্রহর কিছুক্ষণ সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর একটা বই হাতে নিয়ে আরেকটা বেঞ্চে গিয়ে বসলো আর মনে মনে বলল,
“আজ যে করেই হোক আমি মায়াবিনীর একটা ছবি তুলবোই। আমি দুঃখিত, এভাবে অনুমতি ছাড়া তোমার ছবি তুলছি। কিন্তু তোমাকে পাওয়ার জন্য, তোমার পরিচয় জানার জন্য তোমার একটা ছবি আমার খুব দরকার।”
একটা পরিষ্কার ছবি উঠাতে প্রহরের আধাঘন্টা সময় লাগলো। এই আধাঘন্টায় সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে, কোনো সন্দেহ সৃষ্টি না করেই সে একটা ছবি তুলে প্রশান্তির হাসি হেসে ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে নিলো। এরপর সে বই পড়ার পাশাপাশি মায়াবিনীকে ভালোভাবে দেখায় মনোযোগ দিলো।
হঠাৎ ফোন বেজে উঠায় বই থেকে চোখ উঠিয়ে মহুয়া ফোনের দিকে তাকালো। কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মারিয়া বলে উঠলো,
“চান্দু, তুমি কোথায়?”
“তুই জানিস না আমি এই সময় কোথায় থাকি?”
“হুম, জানি। তুই এই মুহূর্তে তোর প্রেমিকের ঘরে আছিস। এখন বল, বাসায় আসবি কবে? ভুলে গিয়েছিস, কাল কলেজে আমার প্র্যাক্টিকেল খাতা জমা দিতে হবে। আর তোকেই কিন্তু সব চিত্র এঁকে দিতে হবে। তুই তো জানিস আমি ভালোভাবে আঁকতে পারি না। আর কতোগুলো চিত্র বাকী! তুই এক্ষুনি এসে পড় তো। নয়তো রাত জাগতে হবে।”
“মাত্র তিনটা চিত্র! আমার বেশি সময় লাগবে না। আর তুই এখন ফোন রাখ তো! আমাকে বিরক্ত করিস না।”
মহুয়া কল কেটে দিয়ে আবার বই পড়ায় মনোযোগ দিলো। আর এদিকে প্রহর এতোক্ষণ চুপচাপ বসে তার মায়াবিনীর কথা বলার ধরণ দেখছিল। যদিও সে চাপা স্বরেই কথা বলছিল, আর তার একটা কথাও প্রহর শুনতে পায় নি, তবুও তার কথা বলার ধরণ কেন জানি প্রহরের খুব মিষ্টি লাগলো।
প্রহর মনে মনে বলল,
“মায়াবিনী, তুমি কার সাথে এতো মিষ্টি করে কথা বলো? তোমার মিষ্টি কন্ঠের স্বরটা আমারও যে শুনতে ইচ্ছে করে! এভাবে কি আমার সাথেও কিছুক্ষণ কথা বলা যায় না? জানি তুমি লজ্জাবতী, তোমার চোখের মাঝে সংকোচ আর ভীষণ জড়তা। আর আমি তোমার সেই লজ্জায় নত হয়ে যাওয়া চোখ দুটির মায়ায় পড়েছি।”
এদিকে বাসায় ফেরার সাথে সাথেই প্রিয়া ভাইয়ের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,
“ভাইয়া, আজ তুই এতো দেরীতে ফিরলি যে? বাতিঘর যাবি না?”
প্রহর হালকা হেসে বলল,
“সেখান থেকেই তো আসলাম।”
প্রিয়া ভাইয়ের মুখে হাসি দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“ভাবীর ছবি তুলে এনেছিস নাকি?”
প্রহর চোখের ইশারায় হ্যাঁ বললো। তারপর রুমে চলে এলো। প্রিয়াও তার পিছু পিছু এসে বলল,
“তাড়াতাড়ি ছবি দেখা।”
“আগে বল, পরের সপ্তাহে গিয়ে ওর নাম জেনে আসবি।”
“পরের সপ্তাহ তো পারবো না। আমার কলেজ থেকে বান্দরবান নিচ্ছে। তোকে বলেছি না? ভুলে গিয়েছিস?”
“ওহ, হ্যাঁ।”
“আমি এর পরের সপ্তাহে যাবো, প্রমিজ। এখন তাড়াতাড়ি ছবিটা তো দেখা। আমিও সেই মেয়েকে দেখতে চাই, যে আমার ভাইয়ের হৃদয় হরণ করেছে।”
প্রহর ফোন এগিয়ে দিয়ে তার মায়াবিনীর ছবিটি দেখালো। প্রিয়া ছবি দেখে বলল,
“যদিও ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছে না, তবে আমি দেখলেই চিনে নেবো। ছবিটা একদম ফেটে গেছে। যুম করে তুলেছিস তাই না?”
“হুম।”
“সমস্যা নেই। আমি দেখলেই চিনবো। তবে একটা কথা কিন্তু বলতে হচ্ছে!”
“কি কথা?”
“যার ফেটে যাওয়া ছবিই এতো সুন্দর আসে, সে সামনা-সামনি নিশ্চিত পরীর মতো!”
প্রহর হাসলো। ফোনের স্ক্রিনে মায়াবিনীর দিকে তাকিয়ে ভাবনায় হারিয়ে গেল। যে ভাবনায় শুধু মায়াবিনীর স্থান।
১৪।
আরিয়া ফেরদৌস শক্ত মুখে তার বিছানায় বসে আছেন। আর তার পায়ের কাছে বসে কোলে মাথা ফেলে রাখলো মাফিন। তিনি চুপচাপ বসে ছেলের কার্যকলাপ দেখছেন।
মাফিন মলিন মুখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
“মা, আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি ভুল করে ফেলেছি। আমি তোমার সাথে অনেক বড় বেয়াদবি করে ফেলেছি।”
আরিয়া এখনো চুপ করে বসে আছেন। ছেলের জন্য মায়াও লাগছে, আবার অভিমানও কাটাতে পারছেন না। তবে মাফিন কোলে মাথা রাখার সাথে সাথেই তার মন থেকে পাথর নেমে গিয়েছিল। এখন তার মনটা আগের চেয়ে অনেক হালকা হয়েছে।
মাফিন মাথাটা মায়ের কোলে রেখেই বলল,
“আমি অনেক খারাপ। আমি সবসময় তোমাকে কষ্ট দেই। মা, তুমি আমাকে মারো, শাসন করো, তবুও নিজেকে কষ্ট দিও না। মহু বলেছে, তুমি সকালে কিচ্ছু খাও নি। আবার দুপুরে এসে গতরাতের মরিচ দেওয়া ভাতগুলো খেয়েছো। মা, তুমি এমন করো না প্লিজ। তুমি অসুস্থ হয়ে যাবে, কেন বুঝতে পারছো না?”
আরিয়া এবার মুখ খুললেন। বললেন,
“আমি মৃত্যুতেই সবার জীবনে শান্তি আসবে। আমি তো তোমাদের খুব বিরক্ত করি। তোমাদের বাঁধা দেই।”
“এসব কি বলছো, মা? আল্লাহর ওয়াস্তে এসব কথা বলো না। আর তুমি মোটেও আমাদের বিরক্ত করো না। তুমি বরং আমাদের যথেষ্ট স্বাধীনতা দিয়েছো। জানো, আমরা খুব ভাগ্যবান যে তোমার মতো মা পেয়েছি। তুমি না থাকলে আমি এতো তাড়াতাড়ি নিজের পায়ে দাঁড়াতেই পারতাম না। আমার কতো বন্ধু এখনো চাকরী না পেয়ে বেকার ঘুরছে। আর আমি তোমার দোয়ায় চাকরি পেয়ে গেছি। তুমি আমার উপর রাগ করে থাকলে আমি আজ রাতেই হয়তো..”
আরিয়া খুব জোরেই মাফিনের পিঠে একটা চাপড় মারলেন। মাফিন ব্যথা পেয়ে মায়ের কোল থেকে মাথা তুলে কয়েক হাত দূরে সরে বসলো। তারপর পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“এতো জোরে মারলে?”
আরিয়া রাগী কন্ঠে বললেন,
“যত্তসব অলক্ষুণে কথা তুই কিভাবে বলিস? আমি তোর উপর রাগ করে থাকি নি। একটু অভিমান করেছিলাম। এখন আর সেটাও নেই।”
আরিয়া হাত এগিয়ে দিয়ে বললেন, “এদিকে আয়।”
মাফিন চোখ ছোট করে বলল,
“মা, আর মেরো না। আমি অনেক ক্লান্ত। কাল অফিসে অনেক কাজ। এতো মার খেলে আমি অসুস্থ হয়ে পড়বো।”
আরিয়া মুচকি হেসে বসা থেকে উঠে ছেলের হাত ধরে তার পাশে বসিয়ে দিয়ে বললেন,
“আরেহ, আমার ছেলেটার এক চাপড়েই বেহাল অবস্থা! এভাবে কেমন করে চলবি রে? ছেলেদের একটু শক্তপোক্ত হতে হয়।”
মাফিন মায়ের কোলে আবার মাথা ফেলে দিয়ে বলল,
“ক্ষমা করে দিয়েছো তো?”
আরিয়া মুচকি হেসে বললেন,
“হুম, বাবা। মায়েরা কি সন্তানদের উপর রাগ করে থাকতে পারে?”
“ভাইয়াকেও ক্ষমা করে দিয়েছো তো!”
“মাহাথির উপর আমার রাগ নেই। তবে আমি ভীষণ অভিমান করেছি। ছেলেটা এভাবে আমার আবদার ফেলে দিল?”
“মা, ভুল করে ফেলেছে। মেনে নাও না!”
“বাবা, তুই ওমন ভুল করিস না।”
“হুম, করবো না।”
আরিয়া মলিন কন্ঠে বললেন,
“মাহাথি খুব নরম মনের। ছেলেটা মানুষের ছল-চাতুরী বুঝে না। আর মেয়েটাও কেমন জানি না। আমার ছেলেটা কারো ফাঁদে না পড়লেই হয়।”
“মা, ভাইয়া ওতোটাও বোকা নয়। আর আমি কখনোই মেয়েটাকে দেখি না। তাই বলতে পারবো না সে কেমন! তবে তুমি একবার দেখা করো। হয়তো তোমারও ভালো লাগবে।”
“হুম।”
আরিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তিনি এখনো খুব চিন্তিত। তিনি ভয় পাচ্ছেন, কারণ তার বড় ভাইয়ের দ্বিতীয় স্ত্রী যেভাবে তাদের সংসারটা এলোমেলো করে দিয়েছিল, এই মেয়েটা যদি বিয়ের পর মাহাথিকে তার পরিবার থেকে দূরে সরিয়ে দেয়?
চলবে-