#রংধনুর_আকাশ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-৫৮ (২য় অংশ):
৯৫।
ভালোবাসা এক অদ্ভুত যন্ত্রণা, যারা ভালোবেসেছে তারা হয়তো ভেঙেছে, হয়তো বা সুখী হয়েছে, নয়তো হারিয়ে শক্ত হয়েছে। মারিয়ার পক্ষে হয়তো এমন সম্পর্কে সুখী হওয়া সম্ভব না, আবার হারিয়ে ফেললে শক্ত হওয়ার মতো মানসিক শক্তিও তার এখনো সৃষ্টি হয় নি। তাহলে সে কি ভেঙে পড়বে?
প্রহর বাইরে থেকে এসে হাসিমুখে ঘরে ঢুকে দেখলো মারিয়া অসময়ে শুয়ে আছে। প্রহর তার পাশে বসে বললো,
“মারিয়া, তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে!”
মারিয়া প্রহরের কন্ঠ শুনে চেঁচিয়ে বলল,
“না আনন্দ লাগছে, তাই শুয়ে আছি। দোয়া করেন, যাতে মরে সবাইকে উদ্ধার করতে পারি।”
প্রহর মারিয়ার কথা শুনে অবাক হয়ে গেলো। মারিয়া বিছানা ছেড়ে উঠে বলল,
“আপনি আমার পাশে বসে আছেন কেন? বাইরে যেহেতু এতোই মন বসেছে, তাহলে এখানে এসে কেন বসছেন? বাইরেই বসে থাকুন।”
“তুমি এভাবে কথা বলছো কেন?”
“আমি এমনই, তাই এভাবে কথা বলবো। অনেক সহ্য করেছি। কিন্তু আমি আর পারছি না।”
“কি সহ্য করেছো তুমি?”
হঠাৎ মারিয়ার ফোন বেজে উঠলো। সে প্রহরের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কল রিসিভ করে বলল,
“নিবিড়, আমি তোমার সাথে বিকেলে দেখা করবো। এখন আমি একটু ব্যস্ত আছি।”
ফোন রাখতেই প্রহর বলল,
“তুমি নিবিড়ের সাথে কেন দেখা করবে?”
“আমার ইচ্ছে হচ্ছে, তাই।”
“তুমি এমন রাগী সুরে কথা বলছো কেন?”
“তাহলে কি আমি বিড়ালের মতো ম্যাও ম্যাও করবো? আমি মেয়ে, তাই কি আমাকে নরম ভেবেছেন? সারাদিন আপনি কোথায় থাকেন? কখনো বাতিঘর, কখনো অফিস, আমার বন্ধুরা আমাকে জানায়, আমার বর মেয়ে নিয়ে এখানে সেখানে বসে আছে। আপনি লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করছেন, কিন্তু আমি আপনার মতো বেঈমান নই। আমি আপনাকে জানিয়েই যাচ্ছি। আমি বিকেলে নিবিড়ের সাথে দেখা করবো। এরপর আমরা একসাথে খাওয়া-দাওয়া করবো। রাতে ও আমাকে বাসার সামনে নামিয়ে দেবে। এখন সব জেনেছেন?”
প্রহর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“আমি কোনো মেয়ে নিয়ে এখানে-ওখানে বসে থাকি না। আর বাতিঘরে আমার মহুয়ার সাথেই দেখা হয়েছিল। আজও দেখা হয়েছিল। ওকে নিয়ে পাশে ফুচকার দোকানে বসেছিলাম।”
“আমাকে নিয়ে কখনো ফুচকা খেয়েছিলেন? বউয়ের চেয়ে শালিকার গুরুত্ব আপনার কাছে এতো বেশি? আপনার হালিম পছন্দ, আপনি কবিতা লেখেন, আপনার শাড়ি পরা মেয়ে পছন্দ, আপনার কোন বই বেশি ভালো লাগে, এসব আমি জানতাম না। আমাকে মহুয়া জানিয়েছে। আমার তো মাঝে মাঝে মনে হয়, আপনি আমার বর না, মহুয়ার বর। হয়তো আমিই ভুল করে মহুয়ার জায়গায় এখানে চলে এসেছি। একটা কাজ করি, আমি মায়ের বাসায় চলে যাই, আর মহুয়াকে এখানে পাঠিয়ে দেই। তারপর বাকী যা প্রয়োজন তাও আদায় করে নিতে পারবেন।”
প্রহর রাগী কন্ঠে বললো,
“মারিয়া, বেশি উল্টোপাল্টা কথা বলে ফেলছো!”
মারিয়া তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“আজ আমাদের সংসারের সাত মাস হতে চললো, বিয়ে তো আরো আগেই হয়েছে। কিন্তু আমি তখনও আপনার কাছের মানুষ হতে পারি নি। এখনো পারছি না। কিন্তু কেন পারছি না?”
প্রহর মারিয়ার সামনে থেকে উঠে ওয়াশরুমে চলে গেলো। এই মুহূর্তে তাকে শান্ত থাকতে হবে। একসাথে দু’জনেই উত্তেজিত হয়ে গেলে সমস্যা আরো বাড়বে। এদিকে মারিয়া প্রহরের নিরবতা মেনে নিতে পারছে না। সে নিবিড়কে আবার ফোন দিয়ে বলল,
“বিকেলে না, আমি তোমার সাথে এখনই দেখা করবো।”
নিবিড় মারিয়ার রাগী কন্ঠ শুনে বলল,
“প্রহর ভাইয়াকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলছো নাকি! নয়তো তুমি তো আমাকে এতো সম্মান দাও না!”
“মানে?”
“তুমি করে ডাকছো, তাই বললাম।”
মারিয়া গলার স্বর উঁচু করে বলল,
“হ্যাঁ, আসো তারপর অনেক কথা হবে।”
মারিয়া আলমারি থেকে জামা বের করতে যাবে তখনই প্রহর ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে বলল,
“তুমি একটু শান্ত হও।”
মারিয়া শান্ত হয়ে বলল,
“আমি শান্তই আছি।”
প্রহর চেয়ারের দিকে ইশারা করে বলল,
“আমরা একটু কথা বলি। ওখানে বসো।”
মারিয়া মাথা নাড়িয়ে বলল,
“না, আপনিই ওখানে বসে থাকেন। আমি গেলাম।”
মারিয়া হনহনিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। কিছুক্ষণ পর মারিয়া যখন বের হলো, প্রহর তার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলো। মারিয়া বলল,
“হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে হবে না। এটাই আমি, মারিয়া নাওয়াল।”
প্রহর মারিয়ার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
“এটা কেমন ড্রেস? এতো শর্ট টপস! আর তুমি ঢিলেঢালা প্যান্ট না পরে এটা কি পরেছো?”
“আমি তো আপনাকে সেটাই বলছি। এটাই আমি, মারিয়া নাওয়াল। আমি মহুয়া নই। আমি আপনার মনের মতো নই। কিন্তু আমি যেমনই হই, আমি নিজেকে খুব ভালোবাসি।”
“নিজেকে ভালোবাসা মানে কি এমন উদ্ভট জামা-কাপড় পরে রাস্তায় বের হওয়া?”
“কারণ আমার এটাই ভালো লাগে!”
“প্রথমত তুমি এখন আমার বউ। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আমাদের বাড়ির কোনো মেয়ে এমন জামা-কাপড় পরে বাইরে বের হয় না। তুমি সেলোয়ার-কামিজ পরে বের হও, আমি বারণ করি নি। দ্বিতীয়ত বাবা দেখলে কি মনে করবে? লোকে কি বলবে?”
“আর আপনি যখন অন্য মেয়ের সাথে বাইরে ঘুরেন তখন?”
“আমি কারো সাথেই ঘুরি না। তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে। আর তুমি এমন জামা পরে বাইরে যেতে পারবে না।”
“আপনার কি মনে হচ্ছে ছেলেরা আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে?”
কথাটি বলেই মারিয়া তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
“যেখানে আমার বর আমার দিকে ভালোভাবে তাকায় নি, সেখানে কি বাইরের ছেলে আমার দিকে তাকাবে?”
প্রহর মারিয়াকে ধমক দিয়ে বলল,
“চুপ, একদম চুপ। লাগামছাড়া কথা বলেই যাচ্ছো তো বলেই যাচ্ছো। ভেবেছি তোমার সাথে সম্পর্ক ভালো হচ্ছে, কিন্তু না। তুমি তো ভালো ব্যবহার পাওয়ার যোগ্যই না। তোমাকে নিয়ে চিন্তাভাবনা করাই ভুল।”
কথাটি বলে প্রহর হনহনিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। প্রহর চলে যাওয়ার পর মারিয়া একটা ভালো জামা বের করে পরতে লাগলো। সে জামা পরছে আর তার চোখ বেয়ে টপটপ করে অশ্রু ঝরছে।
সে কখনোই এমন জামা পরে বের হতো না। সে ইচ্ছে করে প্রহরকে রাগিয়ে দেওয়ার জন্য এতোকিছু করেছে। সে যেহেতু প্রহরের কারণে মানসিক চাপে আছে, তাহলে প্রহরকেও সে শান্তি দেবে না। মারিয়া চোখে কাজল দিতে দিতে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আমি যেহেতু কষ্ট পাচ্ছি, তাহলে মিস্টার বর তোমাকে সেই একই কষ্ট পেতে হবে। আমি ভালোবাসা হারিয়ে কষ্ট পাচ্ছি, কিন্তু তুমি বউয়ের যন্ত্রণায় কষ্ট পাবে। এতোদিন অনেক লক্ষী বউ হয়েছি। এখন দেখবে শাকচুন্নি বউয়ের রূপ। আমি তোমাকে এতো ব্যস্ত করে দেবো যে তুমি মহুয়াকে নিয়ে ভাবার সময়টাও পাবে না।”
কথাগুলো বলে মারিয়া আয়নায় নিজেকে দেখে খিলখিল করে হেসে উঠল। প্রহর তখনই রুমে এসে মারিয়াকে দেখে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। মারিয়া মুখটা আবার ভয়ংকর করে বলল,
“আশেপাশে এতো অদ্ভুত মানুষ যে, আমি ঠিকভাবে আমার মেকাপটাও করতে পারছি না।”
তারপর সে মেকাপ বক্সের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
“উমমম, এখন লাল লিপস্টিকটা লাগবো। তারপর আমাকে সবচেয়ে সুন্দর দেখাবে।”
প্রহর মারিয়ার সামনে এসে লাল লিপস্টিক খুঁজে মারিয়ার মুখে এঁকে দিয়ে বলল,
“এখন লাগছে বিশ্বসুন্দরী।”
মারিয়া টিস্যু দিয়ে লিপস্টিকটা বসিয়ে দিয়ে বলল,
“ওহ, থ্যাংকস মিস্টার বর। আমার আর কষ্ট করে ব্লাশঅন লাগাতে হলো, এই দিকেও একটু লাগিয়ে দাও তো।”
প্রহর লিপস্টিকটা মারিয়ার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল,
“তুমি নিজেই লাগাও।”
এদিকে মারিয়া নিবিড়ের সাথে দেখা করতে এসেছে, সাথে এসেছে প্রহর। সে দূরে দাঁড়িয়ে তাদের দেখছে। নিবিড় মারিয়ার দিকে তাকিয়ে ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“উনি কেন এসেছেন!”
মারিয়া মুচকি হেসে বললো,
“বউকে পাহারা দিচ্ছে!”
“আমি কি কোনো সন্ত্রাস নাকি!”
“হয়তো ওর মনে হচ্ছে।”
নিবিড় একটু বিরক্ত হয়ে বলল,
“এসব কি মারিয়া! আমরা ঠিকভাবে কথাও বলতে পারবো না। দেখো কিভাবে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে আমাকে মেরেই ফেলবে। এতো পজেজিভ হলে বউকে অন্য ছেলের সাথে দেখা করতে দিচ্ছে কেন?”
“কি করবে বল, সে নিজেও তো ইটিসপিটিস করেছে, তাই আর বলার সাহস পাচ্ছে না। আমি আজ চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছি। ভালো করেছি না?”
“কচু করেছো তুমি! এখন কি আমরা ভালোভাবে কথাও বলতে পারবো না?”
“আরেহ, কি আর বলবি। সেই প্রতিদিনের কথা, হাউ টু ইম্প্রেস মারিয়া’স হাসবেন্ড! শুন, আজকে না হয় আমরা একটু আলগা পিরিত দেখিয়ে কথা বলবো। যেমন আমি বলবো জানিস আজ প্রহর অনেক জ্বলছে। কিন্তু এক্সপ্রেশনটা হবে এমন।”
মারিয়া নিবিড়ের দিকে হাত এগিয়ে দিয়ে ওর হাতে চিমটে দিয়ে দিলো। নিবিড় হাত সরিয়ে বলল,
“পাগল হয়েছো!”
মারিয়া দাঁত কেলিয়ে বলল, “জ্বলছে না?”
দূর থেকে প্রহর ভাবলো মারিয়া নিবিড়ের হাত ধরেছে। তাই সে তাদের টেবিলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে দেখলো, তাদের হাত একটু দূরে আছে। প্রহর মারিয়ার হাত ভাঁজ করে দিয়ে বলল,
“এভাবে বসেছো কেন? সোজা হয়ে বসো। এটা কি তোমার বাসা?”
নিবিড় প্রহরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভাইয়া, সমস্যা নেই।”
প্রহর ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“তোমাকে কেউ কথা বলতে বলে নি। তোমরা পড়াশুনার ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে এসেছো, কথা বলো তাড়াতাড়ি।”
নিবিড় অবাক হয়ে বলল, “পড়াশুনা!”
মারিয়া দুষ্টু হাসি দিয়ে চোখ নাচিয়ে বলল,
“ইটস মি, মারিয়া।”
তারপর প্রহরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমাদের একটু বিরক্ত না করলে ভালো হবে।”
প্রহর পাশের টেবিলে বসে পড়লো। নিবিড় ঝুঁকে জিজ্ঞেস করলো, “কাহিনি কি!”
ঘটনা হলো, প্রহর মারিয়াকে নিবিড়ের সাথে দেখা করতে দেবে না সেই সিদ্ধান্তে অটল। কিন্তু মারিয়া তো দেখা করেই ছাড়বে। তারা একই বিষয়ে পড়াশুনা করছে, কিন্তু আলাদা ভার্সিটি। তাই মারিয়া শাশুড়ীকে গিয়ে বলল, প্রহর তাকে ক্লাসমেটের সাথে গ্রুপস্টাডি করতে দিচ্ছে না।
আলাদা ভার্সিটি, তাই তাদের পড়াশুনার ধরণ ভিন্ন। এটা প্রহর ভালোভাবে জানলেও সে তার মাকে বোঝাতে পারে নি। মারিয়া শাশুড়ীকে বুঝিয়েছে ভিন্ন ভার্সিটির কারো সাথে বসে পড়াশোনা করলে বেশি জানতে পারবে, তখন পরীক্ষায় ভালো নম্বর আসবে। এই বিষয়টা মাসুমা আকতারের মাথায় সেঁটে দিতেই তিনি মারিয়ার পক্ষে বললেন, তাকে যাতে নিবিড়ের সাথে গ্রুপস্টাডি করতে যেতে দেয়। আর প্রহরও তার কথায় বেশি জোর পেলো না।
নিবিড় সব শুনে হেসে বলল,
“তোমার মতো বউ পেলে তো কারো দ্বিতীয় বিয়ে করার শখ জন্মাবে না।”
প্রহর ওদিক থেকে তাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“পড়াশোনা করতে এসেছো নাকি হাসতে!”
মারিয়া বলল,
“পড়াশুনাকে যারা আনন্দের সাথে নেয়, তারাই ভালো ফল লাভ করে। তাই আমরা আপতত আনন্দ করছি।”
প্রহর দাঁতে দাঁত চেপে হাত মুঠো করে বসে রইলো। ফেরার পথে প্রহর মারিয়ার সাথে কোনো কথায় বললো না। মারিয়া বলল,
“কাল সন্ধ্যায় নিবিড় বাসায় আসবে। এখন থেকে আমরা বাসায় গ্রুপ স্টাডি করবো।”
প্রহর কিছু বললো না। কিন্তু পরেরদিন মারিয়া অবাক হলো প্রহরকে ঠিক সময়ে বাসায় দেখে। আজ সে বাতিঘরে যায় নি। সোজা বাসায় এসে গেছে। মারিয়া প্রহরকে দেখে মনে মনে খুশি হলো। তার বুদ্ধি কাজে এসেছে। প্রহরকে কাছাকাছি রাখার জন্য তাকে নিবিড়ের সাথে সময় কাটাতে হবে। প্রহর তাকে ভালোবাসুক বা না বাসুক অন্তত স্বামীরা বউদের এসব ব্যাপারে খুবই সতর্ক থাকে, যা এই কয়েকদিনে প্রহরের হাবভাব দেখেই প্রমাণিত হয়েছে।
চলবে-