কহিনুর_দ্বিতীয়_খণ্ড,পর্ব:২১

0
888

#কহিনুর_দ্বিতীয়_খণ্ড,পর্ব:২১
কলমেঃ ইয়াসমিন

নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বা আগ্রহ বেশি। চক্ষুর সম্মুখে আর যেটা হাতের নাগালে পাওয়া যায় সেটাতে মানুষের আগ্রহ শূন্য হয়। কিন্তু যেটা মানুষের নাগালের বাইরে সেটার জন্য মরিয়া হতে কার্পণ্য করেনা। নতুনকে পাওয়ার নেশায় মানুষ মরিয়া। এক হাত গলাতে রেখে কথাগুলো ভেবে চলেছে কহিনুর। কয়েকদিন হচ্ছে ওর সঙ্গে কিসব অদ্ভুত অদ্ভুত ঘটনা ঘটে চলেছে। দুদিন হচ্ছে গলার ইঞ্চি কয়েক নিচে সাদা ধবধবে তকের উপরে জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকা স্টোনটা পাচ্ছে পা। কোথায় হারালো জানা নেই। গত বছর জন্মদিনে মায়ের থেকে পাওয়া অসামান্য দামী উপহার যেটা নিজের ভূলে হারিয়ে ফেলেছে। কিভাবে মায়ের সামনে দাঁড়াবে বুঝতে পারছে না। সেই সঙ্গে জুটেছে একটা হতচ্ছাড়া সঙ্গী। হুবহু ওর মতো দেখতে তবুও কত অমিল ওদের মধ্যে। কহিনুরের ভাবনার অবসান ঘটলো রিনরিনে কণ্ঠে শুরেলা আওয়াজ শুনে। ওর পাশে,ঠিক ডান দিকে হুবহু ওরই মতো দেখতে একটা মেয়ে বসে আছে। মেয়েটার মুখে যেনো হাসির ফোয়ারা নেমেছে। কহিনুর ভয়ে চুপসে গেলো। হঠাৎ হঠাৎ মেয়েটা কেনো ওকে বিরক্ত করছে কে জানে। মেয়েটা হাসি থামিয়ে বলে উঠল,
> আমিই তুমি আর তুমিই আমি। আমরা এক। তুমি শাস্ত আমি অশান্ত। আমাকে দেখে ভয়ের কি আছে?

মেয়েটা কথাগুলো বলে মনে হলো খুব মজা পেলো। ওর মুক্তার মতো দাঁতগুলো বের করে চমৎকার করে হাসলো। কহিনুর নিজের রূপে নিজেই বিমোহিত। এভাবে ও কখনও হাসেনি। হঠাৎ ওর মনে হলো ওতো কাঁদতেও জানেনা। দুঃখ কষ্ট হাসি কান্না ছাড়া বাঁচে তাঁকে কি কখনও মানুষ বলে? হৃদয় নেই নাকি ওর?ছোট থেকে মেয়েটা ওর সঙ্গে সঙ্গে থাকতো। কিছুবছর কোথায় জানি হারিয়ে গিয়েছিল আবারও ফিরে এসেছে। লোকেরা ওকে বোবা বধির বলে আক্ষেপ করে অবজ্ঞা করে সব এই মেয়েটার জন্য। ছোট থেকে এই মেয়েটা ওকে ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রেখেছে। আরতো চুপচাপ থাকা যাচ্ছে না কিছু বলতে হবে ভেবে ও মুখ খুঁলতে চাইলো কিন্তু হলো না। মেয়েটা চোখ রাঙিয়ে বলল,
> কথা বলো না ওরা এসে যাবে। ওরা হিংস্র ভয়ংকর। তোমাকে নিয়ে যাবে বাঁধা দিতে পারবে না। ওরা এসে যাবে।

মেয়েটা বিড়বিড় করতে করতে মিলিয়ে গেলো। কহিনুর প্রচণ্ড ভয়ে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়ার ন্যায় বিছানার কোনে গুটিয়ে থাকলো। মাঝেমাঝে চমকে চমকে উঠলো। ওরা কারা আসবে ওর জানা নেই তবে আসবে। ওদের গায়ের গন্ধে মানুষের ইন্দ্রিয় অকেজো হয়ে যায়। সবাই ঘুমিয়ে যাবে তখন ওরা এই কক্ষে আসবে। ওকে তুলে নিয়ে যাবে। কথাগুলো কহিনুর বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলো। অধরা মেয়ের কক্ষে এসে হতবাক হলো। কহিনুরের মধ্যে আজ অবধি ও কোনো ভয়ের ছিটেফোঁটাও দেখেনি সেই মেয়েটা এভাবে হাত পা গুটিয়ে নিয়েছে কিন্তু কেনো? ও দ্রুত মেয়েকে কোলের মধ্যে জড়িয়ে নিলো। টেবিলের উপরের ল্যাপটপে জ্বলজ্বল করে একটা লাইন জ্বলছে। “ওরা চলে আসবে ” অধরা বুঝতেই পারল না কাদের চলে আসার কথা বলা হয়েছে। হঠাৎ দাদুর বলা অর্ধমানবদের কথা মনে পড়ে গেলো। অধরা মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করে দিলো। কাজের মেয়েটাকে পাশে বসিয়ে ও বেরিয়ে আসলো। জুবায়েরের সঙ্গে কথা বলতে হবে। এই বিয়ে নিয়ে কোনোরকমের দ্বিমুখী সিদ্ধান্ত নেওয়া চলবে না। বিয়ে হবে, নিশ্চয়ই হবে। মেয়ের ভালোর জন্য হলেও বিয়েটা অতী জরুরী।
*********
আবাসিক হোটেলের নির্জন কক্ষে বসে আছে আধার। দুদিন ধরে অস্থির হয়ে উঠেছে কিছুতেই শান্তি পাচ্ছে না। সামান্য এক বালিকার রূপের মোহে কি এমন জাদু আছে যেটাকে ও উপেক্ষা করতে পারছে না। মেয়েটার রূপের মাদকতা মা*দক*দ্রব্যের চাইতেও ভয়ানক। নে*শার মতো ওর দেহ মনে ছড়িয়ে পড়েছে। এভাবে চলতে থাকলে মৃ*ত্যু নিশ্চিত। সব কিছু ভাঙচুর করতে মন চাইছে। কিভাবে নিজেকে শান্ত করবে বুঝতে পারছে না। হঠাৎ দরজায় ঠকঠক আওয়াজ শুনে ওর ধ্যান ভাঙলো। আধার সামনে থাকা রিমোটের সুইচ চেপে দরজার লক খুলে দিতেই একটা মেয়ে হুড়মুড় করে ভেতরে প্রবেশ করলো। আধার ভ্রু কুচকে মেয়েটার পা হতে মাথা অবধি স্ক্যান করলো। লাল রঙের শর্টকাট ড্রেস পরিহিত মেয়েটাকে ওর জঘন্য রকমের খ্যাত টাইপ লাগলো। লাল রঙকে এভাবে অপমান করার কোন মানে হয়? তাছাড়া এই মেয়ের সাহস কিভাবে হয় অনুমতি ছাড়া আধারের কক্ষে প্রবেশ করার? আধার গজরে উঠলো। রক্ত চক্ষু মেলে হাতের মুঠো শক্ত করে বলল,
> এখানে কি চাই?
মেয়েটা ওর প্রশ্নের বিনিময়ে হাসলো। শরীর দুলিয়ে খোলা চুলগুলো এক সাইডে নিয়ে লিপস্টিক রাঙা ঠোঁট নাড়িয়ে উত্তর দিলো,
> আজকের রাতটুকু আমি আপনার প্রেয়সী। শুনেছি আপনি নাকি দারুণ প্রেমিক পুরুষ? ভালোবাসা কথা আদান প্রদান করতে এলাম।হৃদয় মন ছুঁয়ে আদর করতে জানি আমি। পাক্কা প্রমিজ একবার সুযোগ দিন নিরাস করবো না।

মেয়েটা একদমে কথাগুলো বলে থামলো। আধার চোখ বন্ধ করে নিজেকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে কিন্তু বারবার ব্যার্থ। ওকে নিরবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মেয়েটা এগিয়ে আসলো। মেহেদী আঁকা হাতখানা লতার মতো আঁকাবাঁকা করে আধারের গায়ে ছুয়ে দিতে গেলো কিন্তু হলো না। আধার তড়িৎ লাফিয়ে সরে দাঁড়ালো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
> মরার পালক গজিয়েছে না? একদম আমাকে স্পর্শ করার চেষ্টা করবে না। খুব আদর করার সখ না? সহ্য করতে পারবে তো আগুনের উত্তাপ। যে তোমাকে পাঠিয়েছে সে বলেনি পরদিন তোমার লা*শ কোন নর্দমাতে ভাসবে?

আধার কথাটা বলে বাঁকা হাসলো। মেয়েটার চোখেমুখে ভয় খেলা করছে। অচেনা যুবকের সঙ্গে রসিকতা করতে গিয়ে নিজের বিপদ না ঘটিয়ে ফেলে। টাকার চাইতে জীবনের দাম বেশি। দরকার নেই এই কাষ্ঠ পুরুষের সঙ্গে রোমান্টিক সময় কাটানোর। চেহারা দেখে কি আর মানুষ চেনা যায়। মেয়েটা মাথা নিচু করে বেরিয়ে আসতে চাইলো কিন্তু আধার ওকে আঁটকে দিলো। বলল,
> কৌতূহল মিটিয়ে যাও। জাষ্ট একটা অলিঙ্গন করো। তারপর যাও। ভাগ্যে থাকলে আমার ওষ্ঠের উষ্ণতা পেতেও পারো।

আধারের কথায় অহমিকা ঝরে পড়ছে। মেয়েটা মাথা নিছু করে ফেললো অপমানজনক কথাবার্তা শুনে। নিজেকে খুব তুচ্ছ লাগলো। উন্মুক্ত চুলের গোছা হাতের আঙ্গুলে পেঁচাতে পেঁচাতে উত্তর দিলো,
> নিজেকে কি ভাবেন আপনি? এই বিশাল কক্সবাজার জুড়ে আমার চাইতে রূপবতী মেয়ে আর একটাও পাবেন না। সকলে আমার পায়ের কাছে গড়াগড়ি করে আমি চেয়েও দেখিনা। আমার সঙ্গে সময় কাটাতে হলে তপস্যা করতে হয়। আর আপনি?

মেয়েটার বোকাবোকা কথা শুনে আধার শব্দ করে হেসে উঠলো। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল,
> ওহ রিয়েলি? আসো আসো একটা হ্যাক তো করাই যায়? টাইম নষ্ট করেছো প্রচুর। এইটুকু শাস্তি তোমার পাওনা।

আধার মেয়েটাকে এবার কথা বলতে দিলো না। দ্রুত ওকে জড়িয়ে ধরলো আর মেয়েটা সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করতে শুরু করলো। কয়েক মূহুর্ত্তের মধ্যে মেয়েটার ফর্সা নরম তকে কালো আর লাল রঙের মিশ্রণে ফোসকা উঠে গেলো। মেয়েটা যতক্ষণ চিৎকার করলো ততক্ষন অধার ওকে ছাড়লো না। এক সময় মেয়েটা নিস্তেজ হয়ে ধুপ করে ফ্লরে পড়ে গেলো। চারদিকে আবারও সেই নিস্তব্ধতা নেমে আসলো। সমুদ্র যেনো আজ ক্ষণেক্ষণে গর্জন করে উঠছে। আধার আলগোছে মেয়েটাকে কোলে তুলে নিলো। ওর মুখের দিকে তাঁকিয়ে তাচ্ছিল্যপূর্ণ হেসে বেলকনি থেকে ধপাস করে ফেলে দিয়ে দূরের সমুদ্রের দিকে এগিয়ে গেলো। নিয়তি ওকে কোন দিকে টানছে কে জানে।
**********
সাররাত না ঘুমিয়ে চোখ দুটো ফুলে গেছে পাথরের। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত যেটা ও নিজে নিতে চেয়েছিল আজ সেটা ওর বাবা নিতে চলেছে। মেয়েটা কথা বলতে পারেনা শুনেই ও আগ্রহ হারিয়েছে। যে কথা বলতে জানেনা সে কিভাবে ওকে ভালো রাখবে ওর জানা নেই। দেখা গেলো সারাজীবন ওকেই ওই বোবা বধির মেয়েকে ভালো রাখার সংগ্রাম করতে হচ্ছে। সব দিক বিবেচনা করে পাথর লুকিয়ে জার্মানি যাওয়ার টিকেট কেটে নিয়েছে। একবার যেতে পারলে জীবন থাকতে আর বাবার সম্মুখে পড়বে না। মৌসুমী মেয়ে হিসেবে খারাপ ছিল না। ওকেও যদি পছন্দ করতো সেটাও একরকম ছিল আনমনে কথাটা ভেবে ওর কেমন বিরক্তি লাগলো। কার সঙ্গে কিসের তুলনা করছে। ভোররাত এখন,কিছুক্ষণের মধ্যে সূর্যমামা পর্ব আকাশে দৃশ্যমান হবেন এর আগেই ওকে এই হোটেল থেকে বের হতে হবে। কথাটা ভেবে ও দ্রুত বেরিয়ে আসলো। সকলে ঘুমিয়ে আছে। পাশের কক্ষে শামীর তালুকদার সস্ত্রীক ঘুমিয়ে আছেন। যতক্ষণে ঠিক পাবেন ততক্ষণে পাথর হাওয়া। ও দ্রুত পা চালিয়ে করিডোরের কাছে আসেই মেয়েলি কণ্ঠে পেছন থেকে বলে উঠলো,
> নুন খেয়ে গুণ গাওয়া ব্যঞ্জনীয় জানিস তো পাথর?
পাথরের পা আটকে গেলো সাদা চকচকে টাইলসের উপরে। পেছনে কে আছে আবছা অন্ধকারে ওঠিক চিনতে পেরেছে। এত সকালে নিজের আন্টিকে এভাবে দেখবে ও আশা করেনি। ভদ্রমহিলা ধীরগতিতে হেঁটে আসল। তারপর কণ্ঠটা কিছুটা চাপিয়ে ফিসফিস করে বলল,
> পালিয়ে যাচ্ছিস? তোর বাবা কিন্তু সুলতান পরিবারের সঙ্গে অঙ্গীকার করেছে আজ তোদের বিয়েটা হবে। তুই পালিয়ে গেলে আমাদের সম্মান কোথায় থাকবে বলতো?
পাথর কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে মিনমিন করে বলল,
> আমার অনুমতি নেওয়ার দরকার ছিল। ভদ্রলোক কখনও আমার ভালো চাইনি শুধুমাত্র নিজের স্বার্থ বুঝে। যেখানে আমার মতামতের দাম নেই সেখানে আমি থাকতে চাইনা আন্টি। আমি চলে যাচ্ছি।
> যাচ্ছিস ভালো কথা তবে যাওয়ার আগে একটা সত্যি কথা শুনে যা। অধিকার দেখিয়ে যাকে স্বার্থপর বলছিস সে তোর জন্য ঠিক কি কি করছে শুনবি না?

পাথর বিস্ময়কর দৃষ্টিয়ে তাঁকিয়ে আছে। নতুন করে শোনার মতো কি আছে কে জানে। ওকে চুপচাপ দেখে ভদ্রমহিলা বললেন,
> বহুকাল আগে এক গর্ভবতী মা আর তাঁর ছেলের দ্বায়ভার নিয়েছিলেন ওই লোকটা। হসপিটালে মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে থাকা মায়ের কোল থেকে সেই মাসুম বাচ্চাকে নিজের পরিচয়ে মানুষ করেছে এই লোকটা। আরও কিছু শুনছি? সেই ছেলেটা এখন বড় হয়ে বলছে লোকটা নাকি স্বার্থপর কি অদ্ভুত না?
পাথরের হাত থেকে লাগেজটা ধুপ করে পড়ে গেলো। চারদিকে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। দূর থেকে ট্রাকের আওয়াজ ভেসে আসছে। মসজিদের মাইকে শেষ আজানটা হয়তো শুরু হয়েছে সেটাও কিছুক্ষণের মধ্যে মিলিয়ে গেলো। পাথরের চোখে এক বিন্দু অশ্রু তার থেকে সামান্যও বেশি নেই। বাবার ওর প্রতি এমন খাপছাড়া ভাবভঙ্গী ওকে এতদিন কষ্ট দিতো ঠিক তবে আজকের মতো না। কি বলবে কিছুই মুখে আসছে না। শুধু বিড়বিড় করলো,
> আমি অপবিত্র?
সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ আসলো,
> কখনও না। আমার বোন একদম পবিত্র। এক যুবকের সঙ্গে ইসলামিক রীতিতে কালেমা পড়ে বিয়ে হয়েছিল কিন্তু এক সপ্তাহ পর সে গায়েব। কোথাও খুঁজে পাইনি। দিশেহারা অবস্থা। বিয়ের খবরাখবর কেউ জানত না। তারমধ্যে বোন আমার নতুন খবর দিলো। নতুন প্রাণ আসতে চলেছে। লোকজন সমাজ সব কিছু বিচার বিবেচনা করে আবারও নতুন করে বিয়ের অনুষ্ঠান করা হলো।তবে সেটা এই লোকটার সঙ্গে। কিছু করার ছিল না। লোকটা সব মেনে নিয়েছিল। হোক টাকার জন্য বা ক্ষমতার জন্য। একজন মানুষ সব দিক থেকে উত্তম হয়না কিছু না কিছু ত্রুটি থাকে। টাকার নেশা লোকটা মুদ্রা দোষের মতো। এখন এই ছোট্ট কারণে তুই উনাকে অপমান হতে দিবি!ঋণ শোধ করবি না?
ভদ্রমহিলা একদমে হড়বড় করে সবটা বলে দিলো। পাথরের হৃদয় ক্ষতবীক্ষত হয়ে গেলো। কি নির্মম সত্যির মুখোমুখি আজ। এতদিন বাবার উপরে যতটা অভিযোগ ছিল সব পানির মতো ঝরে গেলো। লোকটা ওর আপনার কেউ না। একজন এতিম বাচ্চার দায়িত্ব নিয়েছে মাত্র । পাথর নিশ্চয়ই এর মূল্য যোগাবে। কথাটা ভেবে ওর লাগেজ হাতে তুলে নিয়ে আন্টিকে পাশ কাটিয়ে নিজের কক্ষের দিকে এগিয়ে গেলো। ভদ্রমহিলা এবার দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। কতগুলো উনি বলতেন না কিন্তু আজ না বললে ঝামেলা ছিল। স্বামীকে উনার চেনা আছে। ছেলেটাকে উচিৎ শিক্ষা দিতে ভালো ব্যবস্থা ঠিক করে ফেলতো। দরকার নেই এটা ভালোর
***********
জুবায়েরের দেওয়া শর্ত মেনে নিয়েছে দাদু।। জামসেদের সেটা নিয়ে আফসোসের শেষ নেই। বারবার ওর বউকে নিয়ে খোঁটা দিয়েছে। জুবায়ের সেসব পরোয়া করেনা। ভালো কথা হচ্ছে কহিনুর এই বাড়িতেই থাকবে। বিয়ের পরে আপাতত ওই বাড়ির সঙ্গে তেমন যোগাযোগ রাখবে না। মেয়ে উপযুক্ত হলে তখন অনুষ্ঠান করা হবে। তাছাড়া বিয়েটা হচ্ছে খুব গোপনে। চৌধুরী বাড়ির কয়েকজন ছাড়া আর কোনো নিমন্ত্রিত অতিথি নেই। কহিনুরকে সাজানো পযর্ন্ত হলো না। শুধুমাত্র নতুন লাল রঙের একটা গাউন পরানো হলো। কহিনুরের চোখে বিস্ময়। শুধুমাত্র বাবা মায়ের এক কথায় রাজি হয়ে চুপচাপ আছে। অধরা খুব ভালো করে মেয়েকে বুঝিয়ে বলেছে। বিয়ে বলতে একটা কাগজে সাইন তাছাড়া আবার কি। ঐশ্বর্য মুখ ফুলিয়ে ঘুরছে। আদিকে বিয়ের বিষয়ে জানানো হয়নি। তাছাড়া ও এই বাড়ির বিষয়ে খুব উদাসীন। ফোন করে ঐশ্বর্যকে আঘাত করে জঘন্য জঘন্য ভাষায় গা*লি*গালা*জ করেছে। বিয়ে করতে জুবায়ের নিষেধ করেছিল ও শোনেনি। ছেলেটার জন্য বাবা মেয়ের সম্পর্ক নষ্ট হলো। এখন আফসোস করে কি হবে। চৌধুরী সাহেব আর ডালিয়া হক বিয়েতে এসেছেন। গোপন রাখার জন্য বাড়ির ছোটদের জানানো হয়নি। যাইহোক সকল ঝুট ঝামেলা শেষে কাজী আর একজন উকিল এসে কহিনুরের অনুমতি নিয়ে গেলো। অধরা মেয়ের পাশেই ছিল। মন শক্ত করে চোখের পানি ধরে রেখে মেয়ের বিয়ে শেষে করে দৌড়ে কক্ষ থেকে ও বেরিয়ে গেলো। জুবায়ের তখন কপালে হাত রেখে সোফায় হেলান দিয়ে শুয়ে ছিল। বাইরের সবটা দাদু আর জামসেদ দেখাশোনা করছে। ওকে দরকার হয়নি। একবার গিয়ে দেখা করে এসেছিল। তাছাড়া দুভাই এক রকম হওয়ার দরুন কেউ বুঝতে পারলো না কে মেয়ের বাবা আর কে চাচা।

কক্ষে এসে অধরা জুবায়েরের বুকে ঝাপটে পড়ে এলোমেলোভাবে কাঁদলো। ফুপিয়ে ফুপিয়ে বলল,
> আমাদের সঙ্গে বারবার কেনো এমন হচ্ছে বলুন তো? মেয়েটাকে ভালো রাখতে বিপদে ফেলে দিলাম। কি হবে এখন? প্রচণ্ড ভয় করছে। আমি কোনো লা*শ বা র*ক্ত দেখতে পারবো না।
জুবায়েরের ওর পিঠে ডান হাত রেখে কিছুটা নিজের দিকে টেনে নিয়ে বলল,
> চিন্তা করোনা। আমি আছি তো। মেয়েকে জীবন দিয়ে হলেও আগলে রাখবো। অর্ধমানবের থেকে এটাইতো ভালো হয়েছে বল? মেয়েটা আমাদের থেকে কোথাও যাচ্ছে না ভাবছো কেনো। চুপচাপ ঘুমাও।
> ঘুম আসবে না। চিন্তা হচ্ছে।
জুবায়েরের অধরার কপালে ওষ্ঠ রেখে চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলল,
>আচ্ছা ঘুমাতে হবে না। আমার সঙ্গে রোমান্স করো। এটাতো পারবে?
জুবায়ের কথাটা বলে হেঁসে ফেলল। কিন্তু অধরা গম্ভীর। বাইরের শোরগোল হচ্ছে। বিয়ের শেষে আত্মীয়দের বিদাই জানানো হচ্ছে। পাথর আজ পাথরের মতো অনুভূতি শূন্য হয়ে আছে। কলের পুতুলের মতো আচরণ করছে। দরকার ছাড়া একটা শব্দ্ও উচ্চারণ করছে না। কার সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে বা পাত্রী দেখতে কেমন কিছুতেই ওর আগ্রহ নেই। দেখার প্রয়োজন মনে করলো না। রাত বারটায় ওর ফ্লাইট। এখান থেকে সোজা বিমানবন্দরে গিয়ে থামবে। এটাই হয়তো ওর জীবনের শেষ বাংলাদেশ সফর। হয়তো কখনও আর এখানে আসার দরকার পড়বে না। ভয়ংকর এক অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরতে হচ্ছে যা ওর জীবনের অমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে দিবে।

(চলবে)

ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here