তবু মনে রেখো (১১ পর্ব)
.
ইমাদের চেহারা ক্রমশই মলিন হয়ে এলো। দু’দিন থেকে পুষ্পিতার মুখে কিছু একটা ভেসে উঠে। ইমাদ টের পায় সেটা৷ চেহারায় তাচ্ছিল্যের হাসি। বিদ্রুপাত্মক প্রশ্ন। সবকিছু কেমন যেন বুঝতে পারছে সে। কিন্তু এর কারণ কি? পুষ্পিতা বাধ্য না হলে তার কাছে বিয়ে বসতো না তা ঠিক। কিন্তু সেও তো জোর করে বিয়ে করেনি। একই ঘরে থেকেও স্বামীর অধিকারের জন্য ঝাপিয়ে পড়েনি। তবুও কেন পুষ্পিতার চেহারায় বারবার এই তাচ্ছিল্য দেখতে পায়। ইমাদ বিষণ্ণ মনে তার বালিশে মাথা রাখে। চোখ এড়ালো না পুষ্পিতারও। বালিশে এসে বললো,
– ‘কী হলো, খারাপ হয়ে কেন?’
ইমাদ জবাব দিল না৷ পুষ্পিতা সতর্ক হয়ে যায়। শাসিয়ে নেয় নিজেকে৷ কেন যে ভেতরে রাগ ঘৃণা চেপে রাখতে পারে না৷ ইমাদকে নিয়েই তো সংসার করতে হবে। এই বাস্তবতাটুকু কেন মেনে নিতে পারছে না সে। বিয়ের পর থেকে ইমাদ আজও সেভাবে স্পর্শ করেনি। দু’দিন থেকে ওর চোখের ভাষা বুঝতে পারে পুষ্পিতা। নিজেকে তবুও কোনোভাবে প্রস্তুত করতে পারছে না৷ কেন সে পারবে না? ইমাদ যে বাসর রাতেই তাকে বিবস্ত্র করে ফেলেনি এটাই তো অনেক। যে ঘটনার পর নিজের খালাই তাকে পুত্রবধূ হিসাবে নেয়নি। সেখানে ইমাদ বিয়ে করেছে। অনেকটা চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। এখন হয়তো লোভে পড়ে মানিয়ে নিচ্ছে ইমাদ। কিন্তু সেও তো চায় মা-বাবাকে নিশ্চিন্ত করতে। সুন্দর একটা সংসার গড়তে। যত ঘৃ’ণা হোক, অপছন্দ হোক কোনোকিছুই প্রকাশ করতে চায় না সে। পুষ্পিতা পুনরায় ইমাদের দিকে তাকায়। সিলিং এর দিকে তাকিয়ে সে কিছু একটা ভাবছে সে৷ পুষ্পিতা পুনরায় বললো,
– ‘ইমাদ কি হয়েছে, বলো আমাকে?’
পুষ্পিতার মুখে নিজের নাম শুনে ইমাদ ওর মুখের দিকে তাকায়। না এখন আর ওই মুখে বিদ্রুপ নেই। ইমাদ কোমল গলায় বললো,
– ‘কিছু না পুষ্পিতা, তবে একটা কথা বলি?’
– ‘কি?’
– ‘আমার জানামতে খারাপ ব্যবহার ছাড়া আর কোনো দোষ করিনি আমি। এখন বুঝতে পারছি তুমি খুবই কষ্ট পেয়েছো তাতে৷ কেন করেছি আমাকে জিজ্ঞেস করো না৷ শুধু আমি মাফ চাচ্ছি। আমাকে মাফ করা যায় না?’
পুষ্পিতার হাসি পাচ্ছিল। তবুও এখন থেকে সে আর সেগুলো প্রকাশ পেতে দেবে না। কোমল গলায় বললো,
– ‘আচ্ছা যাও মাফ, আর এগুলো নিয়ে আমি কিছুই বলবো না। এজন্য কি মন খারাপ?’
ইমাদের বুকটা আবার শিরশির করে। কি মিষ্টি করে কথা বলছে পুষ্পিতা। সে তাকিয়ে রইল।
– ‘কি দেখো এভাবে তাকিয়ে।’
– ‘তোমাকে, কি মিষ্টি তুমি দেখতে।’
– ‘তাই?’
– ‘হ্যাঁ, আচ্ছা একটা কথা।’
– ‘কি?’
– ‘তুমি আমাকে বন্ধুর মতো ভাবতে পারো। আমি জানি তুমি আমাকে বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছো। তুমি একজনকে ভালোবাসতে, বিয়ে ঠিক হয়েছিল আরেকজনের সঙ্গে, মাঝখান থেকে আমার স্ত্রী হয়েছো। পুরোটাই পরিস্থিতির শিকার তুমি। আমাকে কি মন থেকে আদৌও গ্রহণ করতে পেরেছো?’
– ‘কি বলো এসব। আমি ঠিকই গ্রহণ করতে পেরেছি। তুমি নিজেই পারছো না। তাই তো এরকম ব্যবহার করেছিলে। তাছাড়া তুমিও পরিস্থিতির শিকার।’
ইমাদ মুচকি হাসলো। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
– ‘পুষ্পিতা ওই রূঢ় আচরণগুলো ভুলে যাও। আর একটা সত্যকথা জেনে রাখো। স্বীকার করতে দ্বিধা করবো না। আমি পরিস্তিতির শিকার হয়ে বরং খুশি হয়েছি। আগে থেকেই আমার ভালো লাগতো তোমাকে।’
পুষ্পিতা ভ্রু কুঁচকে বললো,
– ‘শিওর? তুমি আঙ্কেলের চাপে বিয়ে করোনি?’
– ‘এসব প্রশ্ন থাক৷ আমার কথাটা বুঝতে চেষ্টা করো। তোমাকে আমার ভালো লাগতো। তারপর একটা পরিস্তিতির ভেতর দিয়ে তোমাকে পেয়েছি।’
পুষ্পিতা মুচকি হেঁসে বললো,
– ‘আর পেয়ে তুমি খুশি, সেটা বুঝাতে চাচ্ছ?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘কিন্তু তুমি আমার দিকে না তাকিয়ে কথা বলছো কেন? আমি তো তোমার স্ত্রীই। তুমি মেয়েদের অনেক লজ্জা পাও তাই না?’
ইমাদ বিভ্রান্ত হয়ে যায়। পুষ্পিতা কি পুনরায় বিদ্রুপ করতে শুরু করেছে? সে কোনো জবাব দিল না। পুষ্পিতা আবার বললো,
– ‘আচ্ছা এটা বলো, তুমি কি এর আগে কোনো প্রেম করোনি?’
– ‘না।’
– ‘বাহ, আমাকে ভালো লাগলে কখনও বলোনি কেন? ভালো লাগলে তো প্রপোজ করতে হয়।’
– ‘করলে গ্রহণ তো করতেই না, উল্টো রাগ করতে।’
পুষ্পিতা ফিক করে হেঁসে বললো,
– ‘এটা কেন মনে হলো?’
– ‘তোমার খালাতো ভাই আমার থেকে সবদিক থেকে ভালো৷ ফ্রান্স থাকে। সেই মানুষকেই তুমি বিয়ে করতে চাওনি। আমি তো খুবই সাধারণ একজন মানুষ।’
– ‘এখনও কি মনে হচ্ছে আমি তোমাকে এখনও গ্রহণ করতে পারছি না?’
– ‘সেটাই তো স্বাভাবিক, তুমি আরেকজনকে ভালোবাসতে।’
– ‘ওই ভালোবাসা ওইদিনই ভুলে গেছি। একটা বে*ইমান, প্র*তারককে ভালোবাসা যায় না।’
ইমাদ পাশ ফিরে ওর দিকে তাকিয়ে ব্যগ্র গলায় বললো,
– ‘ওকে তুমি খুবই ভালোবাসতে তাই না?’
পুষ্পিতা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
– ‘তা তো বাসতাম, না হলে এতো বড়ো ভুল কি করে করলাম।’
ইমাদ আস্তে আস্তে পুষ্পিতার হাতটা ধরে বললো,
– ‘আমি তোমার সবকিছু শুনতে চাই পুষ্পিতা। আমাকে বন্ধু ভাবতে পারো। দেখবে তোমার ভালো লাগবে। অবশ্য যদি তোমার অসুবিধা না থাকে।’
পুষ্পিতা মুচকি হেঁসে বললো,
– ‘কি শুনতে চাও।’
– ‘ওই ছেলে সম্পর্কে। কিভাবে সম্পর্ক হয়েছিল।’
– ‘শুনে কি হবে। এগুলো থাক।’
– ‘না সব শুনতে চাই আমি।’
– ‘তুমি না আমাকে পছন্দ করো। এগুলো শুনলে হিংসা লাগবে।’
– ‘তা লাগলেও সমস্যা নেই আমার।’
পুষ্পিতা মুচকি হেঁসে বলতে শুরু করে,
– ‘আমার আসলে ছেলেদের ব্যাপারে পছন্দ একটু আলাদাই ছিল। আমি চাইতাম যাইহোক ভাই, আসল হলো সুদর্শন একটা ছেলে হতে হবে। টাকা-পয়সা দিয়ে কি হবে বর সুন্দর না হলে।
কিন্তু মা-বাবা বিয়ে ঠিক করে আছেন মিনার ভাইয়ের সঙ্গে। যে কি-না বিয়ে করে ইংল্যান্ড গিয়েছিল। সেই স্ত্রী ছেড়ে চলে যাওয়ায় ফ্রান্স গিয়ে গ্রিন কার্ড পেয়ে দেশে আসছে বিয়ে করতে। টাকা-পয়সার তার অভাব নেই। ভালোই ইনকাম করে। কিন্তু সে বিবাহিত, বয়স্ক, মাথায় টাক। মাথায় চুল নেই দেখলেই তো আমার হাসি পায়। আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারিনি। টাকাই তো জীবনে সবকিছু না। আমি ভালোবাসতাম ইলহামকে। রিলেশন হয়েছিল অদ্ভুতভাবে। কিভাবে যেন ফ্রেন্ডলিস্টেই ছিল। একদিন ওর ছবি দেখি। থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট, খালি গায়ে ছবি আপ্লোড দিয়েছে। জিম করা মেদহীন ফরসা শরীর। ঠোঁটগুলো লাল। ঘন কালো চুল। চেহারা খানিকটা কোরিয়ান ছেলেদের মতো। আমি পাগল হয়ে যাই দেখে। সেদিন একটা পাগলামো করলাম। আমার ফ্রেন্ডলিস্টের সবাইকে আনফ্রেন্ড করে তাকে শুধু রাখি। প্রফাইল লক দেই৷ এরপর নিয়মিত ছবি আপ্লোড করি। হঠাৎ একদিন সে লাভ রিয়েক্ট দেয়। এটা দেখে তো আমি পাগল প্রায়। ওইদিনই তার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য আইডিতে ঢুকে আমি সকল ছবিতে লাভ রিয়েক্ট দেই। ইলহাম অবাক হয়ে আমাকে মেসেজ দেয়। সেটাই প্রথম মেসেজ ছিল,
– ‘আমার সকল ছবিতে লাভ রিয়েক্ট দেখে আপনার আইডি ভিজিট করে অবাকই হলাম।’
আমি খুশিতে আত্মহারা হয়ে মেসেজ দেই,
– ‘কেন?’
– ‘আপনার ফ্রেন্ডলিস্টে আমি ছাড়া কেউ নেই দেখে।’
আমার ওকে এতবেশি আপন লেগেছিল, যেন যুগ যুগ ধরে চিনি। ভীষণ অভিমান নিয়ে বললাম,
– ‘আমার ইচ্ছা তাই, আপনার জানা লাগবে না।’
এভাবেই আমাদের শুরু হয় প্রেম। তখন আমি সবেমাত্র ইন্টারে ভর্তি হয়েছিলাম। প্রায় তিন বছর রিলেশন ছিল আমাদের। হঠাৎ ঝামেলা হয় মিনার ভাইয়ের জন্য। দুই পরিবার রাজি আমাদের বিয়ে দেবে। বিয়ের পর আমাকেও নিয়ে যাবে তার কাছে। আমি মা-বাবাকে বললাম, বিয়ে করবো না। আমি রাজি হইনি। বললাম আমার পড়ালেখা এখনও বাকি। বিয়ে করতে চাই না। মা-বাবা শুনতে চাননি আমার কথা। জোর করে গ্রামে আনে বিয়ে দিতে।’
ইমাদ বুঁদ হয়ে শুনছিল। পুষ্পিতা থামতেই বললো,
– ‘এরপর?’
– ‘আমি আসলে ইলহামের দিক থেকেও শক্তি পাচ্ছিলাম না। জানোই তো মেয়েরা চাইলে নাইনে থাকতেও বিয়ে বসতে পারে। কিন্তু ছেলেদের তো নিজের কেরিয়ার গোছাতেই অনেক বয়স হয়ে যায়। ইলহাম তখন সবেমাত্র অনার্স ফাইনাল ইয়ারে। ওর বাবা সৌদি। মা একটা স্কুলের টিচার। সে নিজের পরিবারকে রাজি করাতে পারছিল না। অন্যদিকে আমার পরিবার তো রাজি ছিলই না। বিয়ের দু’দিন আগে কল দিয়ে অনেক কান্নাকাটি করলাম দু’জন। সে বললো ওর পরিবার রাজি হয় না৷ নিজে বেকার। কি করবে ভেবে পায় না৷ তাও যদি এখন হাতে টাকা থাকতো আপাতত কোথাও পালিয়ে গিয়ে একটা কাজ খুঁজতো। কিন্তু সেটার জন্য হলেও কয়েক মাস কোথাও থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা তো করা লাগবে।
তখনই আমি বললাম এই ব্যবস্থা আমি করতে পারবো। আপাতত চলার মতো টাকা আর সোনা নিয়ে আমি বের হতে পারবো। এভাবেই আমাদের প্ল্যান হয় পালানোর। সে ওইদিনই ট্রেনে উঠে৷ আমাকে রিসিভ করবে আমাদের রেলস্টেশনে এসে।’
– ‘তারপর?’
পুষ্পিতা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
– ‘আমি বিয়ের আগের দিনই সবকিছু একটা ব্যাগে ভরি। রাতে সুযোগ বুঝে পালিয়ে যাই রেলস্টেশনে। তখন অনেক রাত। সে বসে আছে স্টেশনে৷ কল দিয়ে আমি বের করি। তাকে জড়িয়ে ধরে আমি কেঁদে ফেলি। সে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
– ‘ট্রেনের টিকিট কেটেছি। এখান থেকে ডায়রেক্ট বাসেও যাওয়া যেত, ট্রেনেই যাই কি বলো?’
আমি সম্মতি দিলাম জানাই। খানিক পর সে চারদিকে তাকিয়ে আমাকে বললো,
– ‘তুমি এখানে বসো। আমি বাইরে থেকে কিছু খাবার-দাবার নিয়ে আসি। ট্রেনে খেতে হবে তো।’
আমি তখন নিজ থেকেই বললাম, এই স্টেশনে ছিনতাই হয়। রাতও অনেক হয়ে গেছে। তুমি এগুলো তোমার ব্যাগে নাও। আমি টাকা আর সোনা ওর ব্যাগে দিলাম। সে চলে গেল বাইরে। আমি এভাবে ঘণ্টা বসে অস্থির হয়ে উঠলাম। সে আসছে না৷ কল দেই রিসিভ করে না৷ সারারাত স্টেশনেই বসে কেঁদেছি। তাকে কল দেই ধরে না। এক সময় অফ দেখায়। আমি অবাক বিস্ময়ে পাগল হয়ে যাই। এটা কিভাবে সম্ভব। আমি যা আশংকা করছি ইলহাম সেরকম কাজ করতেই পারে না। সামান্য ক’টা টাকা আর সোনার জন্য সে পালিয়ে গেল! এটাও কি সম্ভব? আমি এরপর ঠিক করি বাড়ি ফিরবো না। এই মুখ মা-বাবাকে কিভাবে দেখাবো আমি।’
– ‘এরপর?’
– ‘রাত অনেক হয়েছে ঘুমাবে না? কাল আবার আরেক জায়গায় যেতে হবে।’
– ‘আচ্ছা তাহলে অন্য একদিন বলবে তো?’
পুষ্পিতা মিষ্টি করে হেঁসে বললো,
– ‘এগুলো শুনে কি হবে? উল্টো তোমারই খারাপ লাগবে।’
ইমাদ কোনো জবাব না দিয়ে ওর মিষ্টি হাসি দেখে বুঁদ হয়ে তাকিয়ে আছে।
পুষ্পিতা ভ্রু কুঁচকে বললো,
– ‘এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?’
ইমাদ ওর কোমল হাতটা নিয়ে নিজের গেলে চেপে ধরে, তারপর হাতে চুমু খেয়ে ‘শুভ রাত্রি’ বলতে গিয়ে পুষ্পিতার মুখের অভিব্যক্তি দেখে সে হাতটা ছেড়ে দিল।
___চলবে….
লেখা: জবরুল ইসলাম