প্রিয় ডাক্তার – ৩
আভা ইসলাম রাত্রি
__________________________
আগামীকাল ইমার বিয়ে। বিয়ে উপলক্ষে সম্পূর্ন ডাক্তার বাড়ি সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। ফুলে ঘ্রাণে ম-ম করছে সারা বাড়ি। মহুয়া স্কুলে যাবার পথে ডাক্তার বাড়ির এই সাজসজ্জা দেখে গেছে। মহুয়ার চোখ জুড়িয়ে গেছে এসব দেখে। সরল মনে সাধ জেগেছে, ‘ ইশ, আমার বিয়েতেও যদি এমন করে হত! ‘
মহুয়ার সাধ পূরণ হবে না, জানে মহুয়া। মহুয়ার যে বড়লোক ঘরে জন্ম হয়নি। কে যেন বলেছিল, তুমি গরীব হয়ে জন্মেছ, এটা তোমার পাপ নয়। তবে তুমি গরীব হয়ে মৃ’ত্যবরণ করলে, এটা তোমার পাপ। কে বলেছেন? বিলগেটস? হ্যাঁ! মহুয়া একদিন অনেক বড় হবে। ডাক্তারি পড়বে। এই ডাক্তার বাড়ির ন্যায় তাদের বাড়িরও নাম হবে, ডাক্তার বাড়ি। মহুয়া তার মাকে নিয়ে সুন্দর একটা সংসার পাতবে। বাবাকে লা’থি দিয়ে বের করে দেবে তাদের সংসার থেকে।
‘ কি মহু? দাঁড়িয়ে পড়লি কেন? চল। ‘
মহুয়া কাঁধের ব্যাগের বেল্ট ঠিক করে এগিয়ে যায় বাড়ির দিকে।
ছাদের কিনারে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল আদর। তার সদ্য রোপণ করা গাছে পানি দিচ্ছিল। পরনে এখনো রাতের সাদা টিশার্ট ও ট্রাউজার। মুখে পানি অব্দি দেয়নি। সময় কোথায় তার? এই তো! একটু পরই হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরুবে। আর আসবে রাতে। সারাদিন কই থাকে, কি করে কেউ জানে না। তার বন্ধুরা সাথে থাকলে তার আর কারো প্রয়োজন আছে নাকি? উহু, নেই তো।
আদর গাছে পানি দেওয়া শেষ হলে সিড়ি ভেঙে নিচে নেমে আসে। আদরের মা সীমা কোমড়ে আঁচল গুঁজে রান্না করছেন। আদর মায়ের কাছে এসে বলে,
‘ মা, একটা কথা বলার ছিল। ‘
সীমা রান্নার ফাঁকে একটুখানি তাকান। পরপরই মসলার কৌটা হাতে নিয়ে ব্যস্ত কণ্ঠে শুধান, ‘ হু, বল। ‘
আদর বলে, ‘ রমিজ কাকাকে চেনো? ‘
আদরের মা বেখেয়ালি ভঙ্গিতে বলেন, ‘ হুম। ওই মদ খেয়ে রাস্তায় পড়ে থাকে যে লোক। সে? ‘
‘ হ্যাঁ। তার মেয়েকে আমার পছন্দ। ‘
সীমা তরকারিতে মসলা ঢালেন। আদরের কথা বোধহয় তার কানে প্রবেশ করতে দেরি করল। কিন্তু পরপরই তিনি ঘাড় কাত করে মৃদু চেঁচিয়ে বলে, ‘ কি? ‘
আদর মাথা নাড়ায়। অর্থ, হ্যাঁ। সে ঠিক বলেছে। সীমা বিস্ময়ে কথাই বলতে ভুলে যান যেন। কানের ভেতরে ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। মাথার ভেতর মশার ভ্যানভ্যান শব্দ শুনতে পাচ্ছেন। সীমা বলেন, ‘ মহুয়া? জনাব আলী হাই স্কুলে পড়ে সেই মহুয়া? ‘
আদর ভ্রু কুচকে ভাব নেই এমন করে বলে, ‘ হ্যাঁ। ‘
সীমা বলেন, ‘ কিন্তু, বাবা। মেয়েটা তো অনেক ছোট। তোর সাথে কি তার যায়? ‘
আদর কাটছাট কণ্ঠে বলে, ‘ আমি পছন্দ করি মানে অবশ্যই যাবে। ‘
সীমা দমে যান। ছেলে হয়েছে একরোখা। যা চাইবে তাই চাই। কথার গরমিল হলে বাড়িসুদ্ধ মাথায় তুলবে। সীমা খানিক ভেবে বলেন, ‘ একদিন নিয়ে আয়। তোদের দুজনকে দেখি মানায় কি না। ‘
আদর বলে, ‘ আমি ওকে এখনো কিছুই বলিনি। তুমি ইমার বিয়েতে ওদের নিমন্ত্রণ করো। শুধু ওর মা আর ও। রমিজ কাকাকে বলো না। ‘
সীমা ছেলের মুখের পানে চেয়ে মিষ্টি হাসেন। বলেন, ‘ তুই গিয়ে নিমন্ত্রণ দিয়ে আয়। আমি কার্ড দিচ্ছি। ‘
আদর আর কথা বাড়ায় না। রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে। সীমা আঁচলে মুখ ঘষে মৃদু হাসেন। তার বেপরোয়া ছেলের একটা হিল্লে হলো তবে!
মহুয়ার মা উঠোন ঝাড়ু দিচ্ছেন। মরা পাতা একদিকে ঝোঁপ করে রাখা। আদর তাদের বাড়ির উঠোনে এসে গলা ঝাড়ে।
‘ কাকী? ‘
মহুয়া মা মুখ তুলে চান। আদরকে দেখে ঝাড়ু উঠোনে ফেলে মাথায় কাপড় দেন। চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বলেন,
‘ বসো বাবা। ‘
আদর বসে না। বলে, ‘ নিমন্ত্রণ করতে এসেছিলাম। আগামীকাল রওশন কাকার মেয়ে ইমার বিয়ে। আপনারা আসবেন। ‘
মহুয়ার মা ফ্যালফ্যাল চোখে আদরের দেওয়া বিয়ের কার্ডের দিকে চেয়ে আছেন। এত বড় ঘরের নিমন্ত্রণ পাওয়া এ যে আস্ত এক পূর্ণিমা চাঁদ হাতে নিয়ে বসে থাকা। মহুয়ার মা নিমন্ত্রণ গ্রহন করবেন কি করবেন না, দ্বিধায় পড়ে যান। আদর তা লক্ষ করতে পেরে বলে, ‘ মা দিয়েছেন। মায়ের সাথে আপনার নাকি সেদিন দেখা হয়েছে। মায়ের আপনাকে পছন্দ হয়েছিল। তাই নিমন্ত্রন করেছেন। ‘
মহুয়ার মা মৃদু হাসেন। ডাক্তার বাড়ির গিন্নি সীমা বেগমের সাথে মহুয়ার মায়ের সেদিন পথে অনেক কথা হয়েছে। খুব সুন্দর করে কথা বলেন সীমা বেগম। আর মুখখানা, যেন চান্দের টুকরা। আদর পুরোপুরি তার মায়ের গঠন পেয়েছে। যেমন মা, তেমন তার ছেলে। মহুয়ার মা নিমন্ত্রন গ্রহন করেন। আদর একপল আশেপাশে তাকায়। ঘর থেকে মহুয়ার পড়ার শব্দ কানে আসছে। আদরের মন চায়, টুপ করে মহুয়ার ঘরে প্রবেশ করতে। তারপর মহুয়ার হাত ধরে বলতে, ‘ এত সুন্দর করে কিভাবে পড়িস মহু? এই যে তোর পড়ার শব্দ কানে আসলে আমি পাগল পাগল হয়ে যায়! কে দায় নেবে তার? ‘
তবে আফসোস, আদর বলতে পারল না তা। নিজেকে শক্ত খোলসের মধ্যে আবৃত করে মহুয়ার মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এল তাদের বাড়ি থেকে।
বিয়েতে যাবে! অথচ মহুয়ার ভালো কোনো জামা নেই। রাগে দুঃখে মহুয়ার কান্না আসছে। মহুয়া ঠোঁট ভেঙে মায়ের দিকে চেয়ে আছে। মহুয়ার মা একে একে আলমারির সমস্ত সুন্দর জামা বের করে মহুয়াকে দেখালেন। অথচ এসবের একটাও মহুয়ার পছন্দ হল না। মহুয়ার মা শেষমেশ বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘ লাটসাহেবের বেটি হয়েছিস? তোর বাপের কি অনেক টাকা, যে প্রতিবার নতুন নতুন জামা কিনে দেবে? ‘
মহুয়া ভেজা চোখে মায়ের দিকে চেয়ে থাকে। বাবা তো মহুয়াকে এখন পর্যন্ত একটা জামা অব্দি কিনে দেয়নি। যা কিনে দেন, সব মহুয়ার মা। মা সারাদিন সেলাই করে,যা পান তাই মহুয়ার পেছনে খরচ করেন। মায়ের টাকায় পুরো সংসার চলে। মহুয়া দেখেছে তার মা কত কষ্ট করে সংসার চালান। মায়ের অনেক ধৈর্য্য! মা কষ্টকে কত সুন্দর গিলে ফেলতে জানেন। মহুয়া কেন জানে না?
মেয়ের চোখে অশ্রু দেখে কষ্ট হয় মহুয়ার মায়ের। তিনি মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলেন, ‘ এইবার এটা পড়ে নে। এইবার ইদে সুন্দর এক জামা কিনে দেব। ‘
কি আর করার। মহুয়া রাজি হল। অতঃপর একটা বেগুনি রঙের ত্রি পিস পড়ে মহুয়া ডাক্তার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
#চলবে
আভা ইসলাম রাত্রি’