#প্রিয়_ডাক্তার – ২
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
________________________
মহুয়া তার মায়ের সামনে অপরাধীর ন্যায় দাড়িয়ে আছে। ভেতর ভেতর প্রচন্ড খচখচ করছে। মা কি এবার মহুয়াকে বকবে? মহুয়ার মা প্রশ্ন করেন,
‘ ছেলেটা কে? তাকে চিনিস তুই? ‘
মায়ের কথায় মহুয়ার বুক ধড়াস ধড়াস করে। মুখ তুলে চাইবার জো পায় না। মহুয়া যাকে ভাবছে, হয়তো সেই ছেলেটিই কামরুলকে মে’রে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছে। ছেলেটা কে? আদর? ইশ, কি সব ভাবছে মহুয়া! কোথায় আদর আর কোথায় মহুয়া! বামুন হয়ে চাঁদ দেখার স্বপ্ন দেখছে সে! ছিঃ, ছিঃ! মহুয়া নিভু নিভু স্বরে বলে,
‘ আমি তাকে চিনি না, মা। ‘
মহুয়ার মায়ের চোখের দৃষ্টি সংকুচিত হয়ে। ভ্রুতে ভরাট এক ভাঁজ ফেলে বলেন,
‘ না চিনলেই ভালো। আজ থেকে একটু দেখেশুনে চলবি। তোর বাবাকে তো চিনিস। যদি এসব শুনে, তাহলে ঘরকে আর ঘর রাখবে না। কুরুক্ষেত্র বানিয়ে দিবে। ‘
মহুয়া মাথা হেলায়, ‘ঠিকাছে! ‘
মহুয়ার মা ঘাটের দিকে পা বাড়ান। আজ অনেক কাপড় কাচতে হবে। দুটো বিছানার চাদর যা নোংরা হয়েছে। আজ না ধুতে পারলে, ও বিছানায় ঘুমানো যাবে না। গন্ধ নাকে লাগবে। মহুয়া মায়ের দিকে একপল চায়। তারপর আবার ঘরে চলে পড়তে বসে। মহুয়া তার শ্রেণীতে প্রথম হয়েছে এবার। ভীষন ভালো পড়াশোনায়। নতুন একটা মেয়ে এবার তাদের শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছে। স্যার বলেছেন, সে নাকি ভীষন মেধাবী। মহুয়া থেকে তার জায়গা কেড়ে নিবে। মহুয়া চায় না, তার জায়গা অন্য কেউ নেক। তাই সে ভালো করে পড়াশোনা করবে। প্রথম তো এবার মহুয়াই হবে!
মহুয়া ক্লাসে বসে আছে। টিফিনের ঘণ্টা দিয়েছে। সিঙ্গারা খাচ্ছে সে। সিঙ্গারার দাম পাঁচ টাকা। মায়ের কাছ থেকে আজ বহু কষ্টে এই পাঁচ টাকা নিয়ে এসেছে। নাহলে প্রতিদিন মহুয়ার তাকে সবজি আর রুটি টিফিন বক্সে করে দেয়। মহুয়ার এসব খেতে ভালো লাগে না। সবাই বাইরে থেকে কিনে খায়, শুধু মহুয়া খেতে পারে না। তাই আজ মহুয়া বাইরে থেকে খেয়েছে।
‘ স্কুলের সামনে আদর ভাইকে দেখেছিস? কি যে লাগছে তাকে। ‘
সাথীর কণ্ঠে উচ্ছাস উপচে উপচে পড়ছে। মহুয়া অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, ‘ সে এসেছে বুঝি? কই? আমি তো তাকে দেখলাম না স্কুলের বাইরে। ‘
সাথী উত্তর দেয়ার আগে শর্মিলা বলে, ‘ আরে স্কুলের সামনে বলতে, ওই মন্টু মামার চায়ের দোকান আছে না? সেখানে। বন্ধুদের সাথে চা খাচ্ছিল। আমি আসার সময় দেখেছি। ‘
মহুয়া আর কথা বাড়ায় না। সে এসেছে, আবার যদি মহুয়াকে কোনো প্রশ্ন করে বসে? একবার তার সাথে কথা বলায় মহুয়া অনেক মা’র খেয়েছে। আর খেতে পারবে না। এবার যদি কিছু জিজ্ঞেস করে মহুয়া স্পষ্ট এড়িয়ে যাবে।
স্কুল ছুটি হয়েছে। মহুয়া কাঁধে ব্যাগ নিয়ে স্কুল থেকে বের হয়েছে। আদর এখনো সেই চায়ের দোকানে বসে আছে। মহুয়া মাথা নত করে চায়ের দোকানের পাশ দিয়ে হেঁটে যায়।
‘ মহুয়া? ‘
না, আদরের কণ্ঠ না। মেলায় দেখা আদরের সেই বন্ধু। শিহাব। মহুয়া পা থামায়। শিহাব এসে মহুয়ার সামনে দাঁড়িয়ে একটু প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘ তোমার চুড়ি। ‘
মহুয়া নেয় না। মাথা বারবার ইতি-অতি ঘুরিয়ে চারপাশ দেখছে। শিহাব বলে, ‘ কি দেখছ? তোমার বাবা? সে নেই। বাজারে গেছে। এইমাত্র দেখলাম। ‘
মহুয়া ভরসা পায়। বলে,’ কিন্তু আমি তো টাকা আনিনি। ‘
শিহাব বলে, ‘ টাকা পরে দিয়ে দিও। এখন এটা নাও।’
মহুয়া প্রথমে নিতে চায় না। শিহাব অনেক জোর করায় শেষ পর্যন্ত প্যাকেট হাতে নেয়। শিহাব আড়চোখে আদরের দিকে চায়। আদরের তীক্ষ্ম দৃষ্টি মহুয়ার পানে আটকে। শিহাব চোখ দিয়ে আশ্বাস দিয়ে আবার মহুয়ার দিকে চায়। বলে,
‘ চুড়িগুলো একবার পড়ে দেখো, মাপ ঠিকাছে কিনা। ‘
মহুয়া বলে, ‘ এখন? ‘
‘ হ্যাঁ। আমার সামনে দেখে নাও। মাপ না হলে, এখনি বদলে আনব। ‘
মহুয়া প্যাকেট খুলে একে একে চুড়ি হাতে পড়ে। স্কুল ইউনিফর্ম গায়ে দিয়ে হাতে লাল কাঁচের চুড়ি, অবশ্যই মানানসই না। তবুও আদরের চোখে চুড়ি পড়া মহুয়াকে দেখতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। আদর ভ্রু বাঁকিয়ে চেয়ে রয় মহুয়ার দিকে। মহুয়া চুড়ি নেড়ে দেখতে দেখতে চোখ পড়ে আদরের দিকে। আদর চোখ সরায় না। এখনো মহুয়ার দিকে তীক্ষ্ম চোখে চেয়ে আছে। মহুয়ার বুক কেঁপে উঠে। সে এমন করে মহুয়ার দিকে চেয়ে আছে কেন? খেয়ে ফেলবে নাকি? তার চোখের চাওনি মহুয়ার গায়ের সমস্ত পশম সোজা করে দিচ্ছে। মহুয়া ভয় পায়! চোখ মেলে আদরকে দেখে। আদরকে আজ ভীষন সুন্দর লাগছে। সাদা শার্ট, জিন্স, কলারে ঝুলানো রোদচশমা, গম্ভীর মুখ, বাঁকানো ভ্রু! ইশ, খুব সুন্দর লাগছে তাকে। মহুয়া দ্রুত চোখ সরিয়ে নেয়। চুড়ি খুলে বলে, ‘ মাপ হয়েছে। আমি যাই এখন। টাকা আমি আমি এখনি নিয়ে আসছি বাড়ি থেকে। ‘
শিহাব দ্রুত বলে, ‘ এখনি দেওয়া লাগবে না। আস্তে আস্তে দিও। ‘
মহুয়া মাথা হেলিয়ে চলে যেতে চায়। শিহাব আদরের দিকে চেয়ে, দ্রুত পেছন থেকে বলে ,
‘ মহুয়া, তোমার জ্বর কমেছে? এখন কেমন লাগছে? ‘
মহুয়া পেছন ফেরে। মৃদু স্বরে বলে, ‘ আগের চেয়ে সুস্থ আছি। ‘
শিহাব মুচকি হাসে। আদরের দিকে চেয়ে বলে, ‘ এখন যাও। যা জানার সে জেনে গেছে। ‘
মহুয়া চলে যায়। আদর ক্ষুদ্র নিঃশ্বাস ফেলে চায়ের কাপে চুমুক দেয়। শিহাব এসে আদরের পাশে বসে। চপাট করে আদরের পিঠে ঘু’ষি দিয়ে বলে, ‘ এসব নিজে গিয়েই জিজ্ঞেস করতে পারতি। শুধু শুধু আমাকে কাজে লাগালি। তুই ওর সামনে যা! কথা বল। তারপরই না প্রেম আগাবে। এভাবে মনে মনে প্রেম পুষে রাখলে, কাজের কাজ কিছুই হবে না। ‘
আদর চায়ের কাপ দোকানদারের দিকে এগিয়ে দেয়। বিল মিটিয়ে বলে, ‘ ও এসবের জন্যে অনেক ছোট। বড় হোক, বুঝুক। তারপর সামনে যাব। ”
বাঁধন বলে, ‘ দশম শ্রেণীতে পড়ে যে মাইয়া, তাকে তোমার ছোট মনে হয়? এই বয়সে মেয়েরা সব বুঝে। ‘
হারুন বলে, ‘ বুঝেই তো। দেখিস নি, শিহাব কথা বলার সময় বারবার আদরের দিকে তাকাচ্ছিল। মেয়েটা সব বুঝে গেছে। ‘
মহুয়া আদরের দিকে চেয়ে ছিল, দেখেছে আদর। মহুয়া সব বুঝে, আদর জানে সেটা। তবুও ওর মন মানছে না। মহুয়া এখনো অনুভূতির ক্ষেত্রে অবুঝ। এই বয়সে মেয়েরা সব বুঝে, আদর সেটা জানে! কিন্তু তাদের বোঝার মধ্যে থাকে হাজারো ভুল! আবেগে ভেসে যেতে চায় তাদের উড়ন্ত মন! আদর মহুয়ার ক্ষণিকের আবেগ হতে চায় না, প্রকৃত ভালোবাসা হতে চায়।
আদর কপাল ঘষে মাথা শান্ত করার চেষ্টা করে। অতঃপর বন্ধুদের দিকে চেয়ে বলে, ‘ বাড়ি যাচ্ছি। পরে দেখা হচ্ছে। ‘
আদর বাড়ি আসে। বাড়িতে তখন হলুস্থুল কাণ্ড। আদরের চাচাতো বোন ইমার বিয়ে পরশু। বিয়ে উপলক্ষে সম্পূর্ন বাড়ি সাজানো হয়েছে। আদর বাড়িতে প্রবেশ করে। পুরুষরা খেতে বসেছে। আদরের মা, সীমাসহ বাড়ির সকল মহিলারা খাবার বাড়ছেন তাদের। আদর নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। পেছন থেকে আদরের মা সীমা চেঁচান, ‘ আদর, ভাত খাবি কখন? কত বেলা হল। ‘
‘ পরে। ‘
আদর উত্তর দিয়ে চলে যায় নিজের কক্ষে। ছেলের এমন বেপরোয়া আচরন ভালো চোখে দেখলেন না। নিজের ঝাল সব স্ত্রী সীমার উপর মিটাতে বললেন,
‘ ছমাস পর বাড়ি এসেছে। অথচ তোমার ছেলে একবার ঘরে এক ঘণ্টা বসেছে? সারাক্ষণ বাইরে টো টো করে ঘুরছে। আমার কিন্তু এসব ভালো লাগছে না। ছেলেকে সামলাও, সীমা। ‘
আদরের মা সীমা চুপ করে থাকেন। স্বামী সঠিক কথা বলেছেন, তিনি বুঝেন সেটা। কিন্তু ছেলেকে তো সেটা বুঝাতে পারেন না। ছেলে হয়েছে আস্ত এক বেপরোয়া। কারো কথা মানে না। নিজের যা মর্জি হয় তাই করে। ছেলের লাগাম টেনে ধরতে গেলে, দেখা যাবে আর বাড়িই আসছে না। নিজের ছেলেকে সীমা হারে হারে চেনেন। মা তো! মায়েরা সব’ই জানে!
#চলবে
আভা ইসলাম রাত্রি