#বৃষ্টির_রাতে
#রূবাইবা_মেহউইশ
(২৬)
প্রেমের টানে নয় শুধুই আবেগের তাড়নায় পড়ে আয়না মস্ত এক ভুল করে বসলো। একদিন কলেজ থেকে ফিরে এসে লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে মায়ের সামনে বলে বসলো সে তাসিন ভাইকে ভালো বাসে। বাড়ির প্রায় প্রত্যেকেই বুঝতো এ কথাটা তবুও সরাসরি এর আগে কখনো মুখের ওপর বলেনি আয়না। কিন্তু সেদিন তার কি হলো কে জানে মুখের ওপর কথাটা বলে বসলো। তার মা অবশ্য আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলো এমন কথা শোনার জন্য কিন্তু তাসিনকে নিয়েও ভাবতেন তিনি৷ ভাতিজা নিজ থেকে না চাইলে কোনদিনও মুখ ফুটে বিয়ের কথা তুলতে পারবেন না। কিন্তু কিশোরী আয়নার মন সে মুহূর্তে আবেগ আর তাসিনের মোহে পড়ে বেহায়া হয়ে পড়লো। মাকে বলে ক্ষান্ত হয়নি সে মামীর সামনে গিয়েও একই কথা বলল আর সে কথা তাদের আড়ালে দরজার বাইরে থাকা তাসিনের বাবাও শুনে ফেলল৷ তিনি অতি সাদাসিধা লোক, কম শিক্ষিতও কিন্তু অবিবেচক নন৷ ভাগ্নির কথা শুনে এক মনে খুশিই হলেন। ঘরের মেয়ে ঘরেই থাকবে এরচেয়ে ভালো আর কি হতে পারে কিন্তু অন্য মন সতর্ক করলো৷ যুগটা আর তাদের নেই ছেলের মন কি চায় তা না জেনে শুধু আগাম খুশি হলেই চলবে না। তারা এ যুগের না হয়েও তো এমন মন বিভেদ নিয়ে সংসারটা করছে। অন্যদের দিকে তাকানোর দরকার নেই তার আর মাছুমার দিকে তাকালেই হয়। মাছুমার বিয়েটা তার বাবা মতের বিরুদ্ধে দিয়েছিলেন। আফছার অশিক্ষিত তার চালচলনে গ্রাম্য ছাপ স্পষ্ট। মাছুমা চট্টগ্রাম শহরের মেয়ে , বি.এ পাশ তারওপর বাপের বাড়িতে বাড়ি, গাড়ি আগের জমানা থেকেই ছিল। বলতে গেলে রাজকন্যার মত জীবন ছিলো তার কোন এক বিপদে আফছারের মধ্যে কোন এক সততার ঝলকানি দেখে মাছুমার বাবা মহিউদ্দিন হঠকারী এক সিদ্ধান্ত নিয়ে ছোট মেয়েকে তুলে দিলেন আফছারের হাতে। সে সময়কার মেয়ে বলেই মাছুমা কান্নাকাটি করলো তবুও বিয়ে ভাঙার মত সাহস দেখাতে পারেনি। এরপর কতগুলো বছর এক ছাঁদের তলায় জীবন কাটালো, নারী পুরুষের দৈহিক আকৃষ্টতায় দুনিয়ার বুকে নিজেদের অস্তিত্বও আনলো কিন্তু এতেই কি সব সুখ! মোটেই না। প্রিয় মানুষটির চোখে যখন জীবন যাপনের তৃপ্ততা না পাওয়া যায়, তার হাসি মুখটাতেও যখন বিষাদ ধরা পড়ে তখন আর সংসারটাতে সুখ বলে কিছুই পাওয়া যায় না। আফছারের জীবনেও তাই, মাছুমা হাসি মুখে সংসারটা আগলে রাখলেও কোন কোন এক বিজন রাতে আফছার অনুভব করতো তার প্রিয় নারীটি অস্থির চিত্তে আছে, বিষাদিত হয় তার কিছু কিছু মুহূর্তে আবার বাপের বাড়ি বড় কোন অনুষ্ঠানে যখন তার সব লাখপতি আত্মীয়ের ভিড়ে আফছার যখন শার্টের সাথে লুঙ্গি পরে থাকতো তখন খুব আড়ালে লুকিয়ে নিতো মাছুমা নিজেকে। তবে সেই লুকানোর কারণটা শুধুই তার স্যুট কোট পরা আত্মীয়ের ভেতরে আফছারের লুঙ্গি পরা পরিচ্ছদ নয় বরং আফছারকে মন থেকে না মানতে পারার অকাট্য সত্যই প্রকাশ করত ৷ আফছার বুঝেও না বোঝার চেষ্টা করতো নিজ স্বার্থে। তার মূর্খ অশিক্ষিত মনটা যে ওই রমনীর প্রেমে পড়ে কঠিন বিদ্বেষী ছিল তাকে কিছুতেই হারাতে চাইতো না। রূপকথার দানবের আত্মা রাখা তোতা পাখির মতোই আফছারের আত্মাটাও মাছুমাতে ছিল বলেই সে স্বার্থপর হয়ে এতগুলো বছর মাছুমাকে ছাড়তে চায়নি। আজ যখন নিজের সন্তানদের নিয়ে ভাবার সময় এলো তখন সে একটুও ভুল করতে চায় না। তাসিন বিয়ে করবে তাকে যাকে সে মন থেকে চাইবে। মাইশা, তুহিনের বেলায়ও তেমনই হবে। ভাগ্নিটার জন্য কষ্ট হচ্ছে বলেই আবার সিদ্ধান্ত নিলো সরাসরি তাসিনের সাথে কথা বলবে। কিন্তু তার ভাবনার চেয়ে দ্রুত গতিতে মাছুমা কাজটা করে ফেলল। দু সপ্তাহ হলো ছেলেটা ঢাকায় আছে তারমধ্যে দেড় সপ্তাহ ধরেই মাছুমার কথা কাটাকাটি চলছে ছেলের সাথে। সে আয়নাকেই বাড়ির বউ করবে এবং সেটা যত দ্রুত সম্ভব। তাসিন প্রথম প্রথম ঠান্ডা মাথায় মাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেও এখন আর ধৈর্যে কুলায় না তার। এদিকে ধৈর্য্যের পরীক্ষা তো তার সুপ্রভাও কম নিচ্ছে না। মেয়েটা মেসেজ পাওয়ার পরদিনই ডিনারের প্রস্তাব গ্রহণ করলো। রাত নয়টা অব্দি তাসিন অপেক্ষা করলো সুপ্রভার দেওয়া ঠিকানায়। চমৎকার এক রুফটপ রেস্টুরেন্টে তাসিনের সময় কেটেছিলো উত্তেজনায় অপেক্ষা করে। আটটা থেকে ঠিক নয়টা পর্যন্ত এরপরই অপেক্ষাটা বড্ড ফিকে আর অত্যধিক বিরক্তিকর লেগেছিল।একটা পর্যায়ে সেই বিরক্তি রাগেও পরিণত হয়েছে তার কারণ এতগুলো দিনেও সুপ্রভা তার সাথে যোগাযোগ করেনি এমনকি সেদিন সে অনুপস্থিত ছিল সে উপলক্ষেও একটা ছোট বার্তা দিতে পারতো কিন্তু দেয়নি। আজও সারাদিন অফিস করে রুমে ফিরে তার মনটা তেতো হয়ে রইল। মা ফোন দিচ্ছে বারবার তাই ফোন সাইলেন্ট করে কফি বানাচ্ছে তাসিন। আজ আকাশটা বিকেল থেকেই মেঘলা হয়ে ছিলো এখন আবার থেকে থেকে বিজলীর চমক আর এলোমেলো হাওয়া জানান দিচ্ছে ধরণী ভিজবে অতিসত্বর। বুকের ভেতর দু দিককার ক্রোধ যেন জ্বালিয়ে দিচ্ছে আর তা নেভাতেই এই বৃষ্টিটা প্রচণ্ড দরকার। কফি বানানো শেষ হতেই তাসিন বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। কয়েক সেকেন্ড না গড়াতেই তার চোখে মুখে বাতাসের তোড়ে জাপটে এলো বৃষ্টির ফোঁটা। ফোনের আওয়াজটা তার গত দেড় সপ্তাহ ধরেই প্রচণ্ড মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলেই আজ আর ফোনটাকে সাথে রাখলো না। বর্ষণে আজ শুধু ধরণী নয় আধভেজা হলো তাসিন আর তার কফিটাও। কফি শেষ করে আধঘন্টার বৃষ্টিতে ভিজে চুপচাপ ভাবনায় বিভোর রইলো। প্রথম ভাবনাটাই ছিলো সে কেন সুপ্রভার ওপর রেগে আছে? মেয়েটা তো কোনভাবেই কমিটেড নয় তার সাথে ডিনার করার। আর না সুপ্রভার কোন দায় আছে তার প্রতি তবে হ্যা একটু তো অন্যায় করেছে সেদিন অপেক্ষা করিয়েও না এসে। আর দ্বিতীয় ভাবনা আয়নাকে নিয়ে। এই পুচকি মেয়েটা যা শুরু করেছে তাতে নির্ঘাত তাসিন বাড়িতে থাকলে কষে তাকে দুটো থাপ্পড় মেরে বিয়ের সাধ মিটিয়ে দিত। বৃষ্টি থেমে গেছে কফির খালি মগটা নিয়ে রুমে ফিরে কাপড় বদলালো তাসিন। আজ আর রাতে খাওয়া সম্ভব নয়। টেনশন আর রাগে আজকাল প্রায়ই তার খিদেটা নষ্ট হয়ে যায়। ঘরের বাতি বন্ধ করে শুয়ে পড়লো বিছানায়। ফোনের স্ক্রীণে আবারও আলো জ্বলে উঠেছে৷ তাসিন ইচ্ছে করেই ফোনটা চেক করলো না। সেই এক প্যাচাল কান পচাবে তারচেয়ে বরং ঘুমটাকে কাছে টেনে নেওয়াই উত্তম৷ পরে ভেবে কিছু একটা করতে হবে আয়নার।
গুনে গুনে আজ চৌদ্দটা দিন বাড়িতে বন্দী থেকে হাঁপিয়ে উঠেছে সুপ্রভা। হাতটা ভাঙার কি খুব দরকার ছিলো? রাগে সেদিন মোবাইলটা ফ্লোরে না মেরে সৌহার্দ্যের মাথায় মারা দরকার ছিলো। শা*লা আবা*লের জন্যই ওরকম পিচ্ছিল রাস্তায় সে ওভাবে আছাড় খেয়েছে আর এই হাতটার নাজেহাল। মনে মনে বেশ আফসোসও হচ্ছে তাসিনের কাছ থেকে ট্রিটটাও নেওয়া হলো না। ইশ, বুকের ভেতর ধকধকানি আবারও শুরু হলো ওই অসহ্যকর লোকটার কথা মনে করে। আর এখন রাগটাও হচ্ছে মায়ের ওপর। এতগুলো দিনে নতুন একটা ফোন আর তার সিমটাও সে হাতে পেল না শুধুমাত্র মায়ের কারণে। আচ্ছা মা কি ভাবছে সুপ্রভা সত্যিই কোন ছেলের সাথে ডেটে গিয়ে ওরকম একটা দূর্ঘটনা ঘটিয়েছে! কিন্তু কি করে সম্ভব? সে তো আসল ঘটনা কাউকেই বলেনি। শুধু বলেছে বৃষ্টিতে পথ পিচ্ছিল ছিলো আর সে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়েই পিছলে পড়েছিল। তারপরও কেন বলল, কপাল ভালো রাস্তায়ই ছিলে গড়িয়ে যদি পুকুরটাতে পড়তে! মূল ঘটনা, তাসিনের ওয়্যারড্রোব কেনার দিন রাতেই তাসিনের ডিনার ট্রিট মেসেজটা পেয়ে সে অতি উত্তেজনায় রাতভর ঘুমাতে পারেনি। এত উত্তেজনা কেন হয়েছিলো সে জানে না শুধু মনে পড়ছিলো চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসার পথে তাসিনের বুকে নিজেকে দেখার সেই ভোরটা। ঘুমঘুম আর সরল চোখে তাসিনের তাকিয়ে থাকা, নিঃশ্বাস চেপে তার থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া। আর এবারও ঢাকায় যাওয়ার পথে একই ঘটনা ইচ্ছাকৃত ঘটানো। আসল সত্যি এটাই এবার মধ্যরাতে সুপ্রভা জেগেছিলো। নিজের পাশে তাসিনকে দেখে প্রথমে ভড়কে গেলেও কিছু সময়েই নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়েছিলো। তারপরই প্রথমে যে কথা মনে হয়েছিলো, এটা কি কাকতালীয় নাকি কোন কারণ আছে! এভাবে প্রতিবারই তাদের অজান্তেই কেন তাদের দেখা হয়ে যাবে! এটা কি তাকদীরের কোন ইশারা! নিজেই নিজের ভাবনাতে হেসে ফেলে সুপ্রভা। কেমন সিনেমেটিক একটা ভাবনা ছিলো আর তাসিনের গায়ের গন্ধটা আবারও সেই প্রথম দিনের মত নাকে লেগেছিল খুব করে। চোখ বুঁজে আপনাআপনি ঢলে পড়েছিলো তাসিনের কাঁধে যেন এলকোহলের মত টানছিলো তাকে। মনের মাঝে এক সুপ্ত ভালোলাগার শুরুটা হয়েছিলো কক্সবাজার থেকেই কিন্তু তা যে কখনো এতখানি গাঢ় হবে তা কি ভেবেছিলো তারা! দু প্রান্তে দুজন মানুষের ভাবনার জগত একটাই। অথচ দুজন দুজনার ভাবনা সম্পর্কে কিছুই জানে না। সংকোচ আর দ্বিধায় কখনো মন খুলে অনুভূতিকে অনুভব করার সাহসটাও আসে না তাদের মাঝে। হাত ভাঙার পরই সৌহার্দ্য সুপ্রভাকে হাসপাতালে ভর্তি করায়। সারাদিন হাসপাতালে কাটিয়ে বাড়িতে ফোন করে সুপ্রভার অবস্থার কথা সৌহার্দ্য নিজেই সুপ্রভার বড়দাকে জানায়। আর তাতেই রেগে হাসপাতালে বসেই ফোন ভেঙে ফেলে সুপ্রভা। রাগটা তার সৌহার্দ্যের ওপর থাকলেও তা মিটিয়েছে ফোনের ওপর। এরপরই মনে পড়েছে তার কাছে তাসিনের নাম্বারটা আর কোথাও নেই। কয়েকটা ডিজিট মনে থাকলেও সবটা নেই। তাসিন নিশ্চয়ই রেস্টুরেন্টে তার জন্য অপেক্ষা করবে! এরপর তো বড়দা এসে নিয়ে গেলো বাড়িতে৷ কয়েকবার ভাবীর ফোন থেকে তাসিনকে কল করতে চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু নাম্বারটা আর ঠিকঠাক মনেই করতে পারেনি এদিকে তার এফবি একাউন্টের পাসওয়ার্ডটাও মনে নেই৷ নয়তো এফবি থেকে টিয়ার কাছ থেকে জোগাড় করা যেত মুরাদ ভাইয়ার মাধ্যমে। নিজেকে নিজেই শ’খানেক গালি দিয়ে বসলো আফসোসে।
মহিলা কলেজের সামনে একদল বখাটে নিয়মিতই ঘুরঘুর করতো। রায়হান আর তুহিনের ঝামেলাটা পুলিশ পর্যন্ত যাওয়ার কারণেই এহসানকে একটু ঘাটাঘাটি করতে হয়েছে ব্যপারটা। রায়হান শুধরেছে কিনা খুব একটা বোঝা না গেলেও আয়নার পেছনে তার আনাগোনা বন্ধ হয়েছে। একটু আধটু খোঁজ নেওয়ার কারণেই এহসান দুদিন কলেজেও গিয়েছিলো যদিও সরাসরি এসব কাজ সে করে না। কলেজের প্রিন্সিপালের সাথে ইচ্ছাকৃত ভাবেই একটু সাক্ষাতের জন্যই প্রথমদিন যাওয়া। সেখানে গিয়েই প্রথমেই সে ভুলবাশতই ধাক্কা খেয়েছিলো আয়নার সাথে। আয়নাকে দেখতেই মনে পড়লো প্রথমবার বাজারে রায়হানের সঙ্গে দেখেছিলো মেয়েটিকে৷ মেয়েটিও যে তাকে দেখেই চিনতে পেরেছে তা বোঝা গেল মেয়েটির আঁড়চোখে তাকানো দেখে। এহসানের কি হলো কে জানে সে এরপরও আরো একদিন কোন কারণ ছাড়াই এসেছিলো কলেজে৷ ঘুরেফিরে তার দৃষ্টি অজান্তেই আবার আয়নাকে খুঁজে ফিরলো। দেখা মেলেনি সেদিন আর। এরপর পরপর আবারো এলো এহসান একদিন, দুদিন আরো কয়েকদিন। হঠাৎ করেই তার মনে হতে লাগলো সে বখাটেদের তাড়াতে গিয়ে এখন নিজেই বখাটেদের ভূমিকায় চলে এসেছে। মেয়েটিকে সে এখন রোজই একবার করে দেখে তবে তা অবশ্যই লুকিয়ে। কেমন যেন নিজেকে আজকাল পুলিশ কম চোর চোর বেশি মনে হয়।
চলবে