বৃষ্টির_রাতে #রূবাইবা_মেহউইশ (৩৪)

0
300

#বৃষ্টির_রাতে
#রূবাইবা_মেহউইশ
(৩৪)

মফস্বলের সন্ধ্যায় গাছপালার আড়ালে ঝিঁঝির ডাক শোনা গেলেও অন্ধকার ছাপিয়ে শেয়ালের ডাক পাওয়ার অবস্থা নেই। অন্তত তাসিনদের এলাকায় শেয়ালের বাস নেই বললেই চলে। তবে একটু ভেতরের দিকের গ্রামে গেলে সেখানে প্রায় সকল বাঁশঝাড় আর কবরস্থানের আশপাশ জুড়ে জঙ্গলের দিকে থাকে শেয়ালগুলো। তাসিনের বড় মামী বহুবছর আগে তাসিনদের বাড়ি এসে শেয়াল পেটাতে দেখেছিলো। তখন ছিল বর্ষাকাল আর তাই দূরের কোন এলাকারই দু তিনটে শেয়াল এ এলাকায় ঢুকে পড়েছিল। গ্রামবাসী সেগুলোকেই পিটিয়ে আধমরা করেছে আর তাসিনের মামী বেচারি সেদিন তা দেখেই আজো ভয়ে এ এলাকায় পা রাখতে চান না। আসেন তো নিজেদের গাড়িতে করে একদম তাসিনদের গেইটের ভেতর পেরিয়ে গাড়ি থেকে বের হন। আজ দূর্ভাগ্য গাড়িটা এই ভর সন্ধ্যায় এলাকার মাঝপথে হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে গেছে। রাস্তার একপাশ জুড়ে ধানের ক্ষেত অন্যপাশে গজারি, কড়াই আর কাঠ গাছের একটা বাগান। এদিকটায় ঘরবাড়ি আর নেই তবে আর পাঁচ মিনিটের দূরত্বেই বাড়িঘর দৃশ্যমান। তবুও ভদ্রমহিলা আতঙ্কে চোখমুখ কুঁচকে আছেন। তাসিনের মামী সকালে রওনা দিয়েছিলেন আরো আগেই পৌঁছে যাবার কথা থাকলেও আজ রাস্তায় আরো একবার গাড়ি নষ্ট হয়েছিল। ড্রাইভার ছাড়া আর কেউ আসেনি সাথে সেজন্যই যেন ভয়টা আরো বেশি লাগছে। মিনিট দশেক চেক করেও ড্রাইভার ঠিক করতে পারলো না। এদিকে সন্ধ্যা ঘন হয়ে আঁধারে ঢাকছে চারদিক। নষ্ট গাড়ির ভেতরে বসে থেকে আরো ভয় বাড়ছে যেন মামীর। তিনি ভয়ে ভয়েই গাড়ি থেকে নেমে দাড়ালেন গাড়ির গেইট বরাবর। ড্রাইভার এখনো কিসব পার্সটার্স চেক করে চলছে। নিজের হ্যান্ডপার্স থেকে ফোন বের করলেন তুহিনকে কল করতে। এই নির্জন রাস্তায় আর এক মুহূর্তও থাকার ইচ্ছে নেই তার। হঠাৎ করেই একটা বাইক সাঁই করে চলে গেল পাশ দিয়ে। মিনিট খানেক সময়ে আবার ফিরে এসেছে বাইকটা। তাতে দুজন লোক আর দুজনের গায়েই পুলিশ ইউনিফর্ম। তারা সামনে এসে দাঁড়াতেই যেন একটু স্বস্তি পেলেন মামী। ফোনের ডায়ালপ্যাডে তখন মাছুমার নাম্বার তুলে কল দিতে যাচ্ছিলেন ঠিক তখনই পুলিশ অফিসার জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে গাড়ির?”

ড্রাইভার সমস্যা বলতেই অফিসার এহসান বললেন, “আপনি কোথায় যাবেন বলুন আমি পৌঁছে দিচ্ছি।”

আফছার মীরের বাড়ি যাবে বলতেই অফিসার এহসান সতর্ক হলো। আফছার মীর মানে তুহিনের বাবা। মানে তার আয়নাবতীর মামা! যতোই হোক আয়নাদের আত্মীয় মানেই একটু অন্যরকম ব্যপার। এহসান এবার নিজেই বলল, “আপনি কি বাইকে উঠতে পারবেন?”

ভদ্রমহিলা এ জীবনে কোনদিন বাইকে উঠেনি। আজও উঠার ইচ্ছে নেই আর অচেনা এই ছেলের সাথে তো নয়ই! এহসান বোধহয় অন্ধকারেও মহিলার মনোভাব আচ করতে পারলো। গলা খাকাড়ি দিয়ে বলল, “আন্টি একটু সামনেই তুহিনদের বাড়ি চাইলে হেটেও যাওয়া যায়।”

মামী এবার একটু বিষ্মিত হলেন পুলিশের গলায় অন্যরকম আন্তরিকতা দেখে। পরমুহূর্তেই মনে পড়লো তাসিনের বলা কথা ‘এহসান পুলিশ!’

ভাগ্যিস নামটা মনে ছিলো তাই তিনি সরাসরি প্রশ্ন করলেন, “আপনার নামটা যদি বলতেন!”

“এহসান মাহমুদ”

এবার আর সন্দেহ নেই একটুও। তার মানে মূল ঘটনা তো এর মাধ্যমেই হবে। ভালো হলো ছেলেটাকেই পাওয়া গেল। সায় জানিয়ে এহসানের সাথেই তাসিনদের বাড়ির পথে রওনা হলেন তাসিনের মামী। ড্রাইভারকে সাহায্য করতে দ্বিতীয় পুলিশটি রয়ে গেলেন।

“ওদিকের খবর কি?”

“ঠিকঠাকই আছে এখনো। তোমার মা আর মামী পৌঁছে গেছেন আয়নাদের বাড়ি।

‘আয়না!’

নামটা শুনলেই কেমন যেন কলি’জাটা ধরাস করে ওঠে সুপ্রভার। বারবার মনে হয় মেয়েটা তাসিনকে ভালোবাসে। তাসিনের জন্য বেহিসেবী পাগলামি করে বেড়ায়। ক’দিন আগে তাসিনের মুখেই শুনেছে আয়নার পুরনো কীর্তি যা তাসিনকে ভালোবেসে করতো। মেয়েটা এত এত ভালোবাসে তাসিনকে সে কি একটুও আকৃষ্ট হয় না মেয়েটার প্রতি! আবার মনে হয় আকৃষ্ট হলে এত চোটপাট করে পাত্র খুঁজতো না নিশ্চয়ই! আবার মনে হয় যদি এহসান ভাইয়ার খোঁজ না পেতেন তখন কি করতেন! নিজেই বাধ্য হয়ে বিয়ে করতেন? সুপ্রভার সত্যিই আজকাল কষ্ট হয় খুব। মন বারবার উতলা হয় লোকটার জন্য অথচ লোকটা একটিবারও মুখ খোলেননি। একবারও বলেননি, সুপ্রভা আমার তোমাকে ভালো লাগে, আমি তোমায় নিয়ে কিছু অনুভব করি। কখনোই কিছু বলেন না অথচ লোকটার দৃষ্টি কত কি যে বলে যায় চুপিসারে!

তাসিন অপেক্ষা করে আছে সুপ্রভা কি বলে তা শোনার জন্য । কিন্তু সে তো অন্যমনস্ক হয়ে অন্য কিছু ভাবছে। তাসিন এবার প্রশ্ন করলো, ” কি হলো?”

সুপ্রভা বুঝতে পারলো না তাসিনের কথা, “কি হবে!”

“ওই তো যা হওয়ার ছিল।”

“কি হওয়ার ছিলো!”

“ছেলে, মেয়ে অবশ্যই না। তবে কিছু একটা হওয়ার ছিলো মনে হলো।”

শান্ত দিঘির জলের মত শীতল স্বরে বলল তাসিন। সুপ্রভা আবারও চমকালো আর এখনই বুঝতে পারলো শীতল স্বরে তাসিন মজা করছে তার সাথে। সে এবার নিঃশব্দে হাসলো। তাসিন আবার প্রশ্ন করলো, “পরীক্ষা শেষ হলে বাড়ি চলে যাবে?”

“এখানে থেকে কি করবো? আমার সব বন্ধু-বান্ধব ছুটি কাটাবে বিভিন্নভাবে যে কয়টা দিন সুযোগ আছে।”

“তা কবে যাচ্ছো বাড়ি?”

“এ সপ্তাহটা এখানেই আছি।”

“আচ্ছা! ”

আচ্ছা বলেই তাসিন চুপ হয়ে গেল। আপাতত তার বাড়ি যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। তবে সুপ্রভা চলে গেলে সে খুব মিস করবে তাকে। এই যে এখন হুটহাট কোন এক বাহানায় দেখা করে, প্রয়োজন ছাড়াও কত কি কেনার নামে দু, এক ঘন্টা একসাথে কাটায় এই জিনিসটাই মিসিং হয়ে যাবে। দুজনে থেমে থেমে এমন আরো ঘন্টা খানিক কলেই থেকে গেল। এরপরই তাসিনের ফোনে মায়ের কল আসছে দেখে বিদায় নিতে হলো সুপ্রভার কাছে। আজই সুপ্রভার ফেসবুক একাউন্টে এড হয়েছে তাসিন৷ তারপর ম্যাসেন্জারে কল করেছিল। এখন ফোন রাখলেও মনে মনে ভাবলো যখন তখন দেখার একটা সুযোগ হয়ে গেল এবার।

মাছুমা ফোন করেছেন ছেলেকে একটা কথা বলতে। পাত্রপক্ষ নাকি আয়নাকে দেখেই বায়না করছে তারা আংটি পরিয়ে যাবে আজ। অথচ মেয়েপক্ষ তো এখনো ছেলের বাড়িই দেখলো না। তাসিন শুনে বলল, “ফুপু আর ফুপা যা ভালো মনে করেন তা করতে বলো। যদি ঠিক লাগে তো করুক আর না হয় সময় নিয়ে পাত্রের সমন্ধে আরেকটু যাচাই করে বাড়িঘর স্বচক্ষে দেখে তবেই এগিয়ে যাক। তাড়াহুড়ো না করাই ভালো।”

মুখে কথাটা বললেও মনে মনে ভয় ঢুকলো এহসান ছেলেটা ভালো হবে তো আয়নার জন্য! লোকমুখে শোনা প্রশংসাই তো সব নয়। আয়না মানসিক ভাবে এহসানকে মানতে প্রস্তুত নয় এ কথা তো একটা বাচ্চাও বুঝবে। তবুও ভরসা রাখছে আল্লাহর ওপর আর রিমনদের ওপর। তারা কখনো মিথ্যে খোঁজ নেবে না। রিমন, মুরাদও আয়না আর মাইশাকে আপন বোনের মতোই স্নেহ করে। মায়ের ফোন কাটলেও মনে মনে চিন্তা জমলো এখন অপেক্ষা মামীর ফোন কলের।

মাছুমার বড় ভাবী আজ এসেছেন অনেকগুলো বছর পর। খুশিতে সে কি করবে, কি রাঁধবে এই নিয়ে বেশ উত্তেজিত হচ্ছিলো তা দেখে তার ভাবী থামিয়ে বললেন, ” তুই তো এসে দেখলাম বাড়ি নেই। তোকে কে বলল আমি এসেছি?”

“হ্যাঁ ভাবী আমি আমার ননদের বাড়ি ছিলাম। আজ আমাদের আয়নাকে দেখতে সমন্ধ এসেছে।”

“ওহ তাহলে তুই চলে এলি কেন আমি তো থাকবোই কদিন। হ্যাঁ রে মিনতির মেয়েটা বড় হয়ে গেছে তাই না একেবারে বিয়ের যোগ্য!”

মাছুমা হাসলেন, “হ্যাঁ ভাবী বড়ই মোটামুটি। এইতো কয়েক মাস পরে ইন্টার ফাইনাল পরীক্ষা দেবে। এদিকে তো এই বয়সেই বিয়ে দেয় মেয়েদের।”

“আচ্ছা তুই ও বাড়ি যা মিনতির সাথে থাক। এক কাজ করি চল আমিও যাই তোর সাথে।” মনে মনে অবশ্য আগেই ছক এঁকেছিলেন এসেই ও বাড়ি যাবে নইলে বিয়ে আগাবে কি করে! আরো আগেই আসতেন কিন্তু ব’দ মার্কা গাড়িটাই দেরি করিয়ে দিলো পথে।

মাছুমা আর তার ভাবী একসাথে বের হলেন আয়নাদের বাড়ি যাবেন বলে। মাইশা ঘরেই বসে আছে বই নিয়ে। তারও খুব মন চাচ্ছে মা আর মামীর সাথে ও বাড়ি যেতে কিন্তু মা সারাদিনেও ওদিকে যেতে দেননি৷ এখনও মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে তার। আয়না আপু আজ সাজবে, শাড়ি পরবে আবার হবু দুলাভাই আসবে৷ সে দেখেছে ওই পুলিশটাকে। তার ধারণা ছিলো পুলিশ মানেই পেট মোটা, মাথায় টাক আর লম্বা গোঁফ থাকবে। কিন্তু এই লোকটা একদমই তেমন নয়। খুব লম্বা আর ফিটনেসও সুন্দর। লোকটাকে দুলাভাই ডাকতে তার একটুও খারাপ লাগবে না। এই তো সেদিন তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আইসক্রিম খাচ্ছিলো। হুট করেই জিজ্ঞেস করলো ‘কোন ক্লাস!’

মাইশার বান্ধবী বলেছে, “ক্লাস টেন।”

“তো এই সময় স্কুলের বাইরে কেন আপনারা!” ভয়ে ভয়ে মাইশা বলেছিল, খুব গরম তো তাই কোক খেতে…”

“এখন নিশ্চয়ই হাফ পিরিয়ড কিংবা ছুটির সময় নয়! এভাবে সময়ের আগে স্কুলের গেইটের বাইরে আসবেন না কখনো।”

তারপরই লোকটা নিজে তাদের সবাইকে আইসক্রিম খাইয়েছিলো। আহা! এটা দুলাভাই হলে মাইশা তার বান্ধবীদের কাছে কত কি বলবে।

সবুজ রঙের একটা কাতান শাড়ি পরা আয়না ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে ফোনের দিকে। ভিডিও কলে আছে তাসিন প্রায় পনেরো মিনিট ধরে। তার এক কথা, “তাসিন ভাই মনে রেখো তুমি ছাড়া অন্য কারো সাথে আমার বিয়ে হলে আমি বিয়ের রা’তেই বি’ষ খাবো।”

অনেকটা সময় পর্যন্ত তাসিন তাকে বুঝিয়েও কিছুই বোঝাতে পারলো না। অবশেষে বাধ্য হয়েই বলল, “আমি একজনকে ভালোবাসি খুব খুব খুউব ভালোবাসি।”

বাইরে বৃষ্টি নেই তবুও শো শো বাতাস বইছিলো। এই মুহুর্তে হঠাৎই যেন সে বাতাস বন্ধ হয়ে ঘরটা অক্সিজেনহীন হয়ে গেল। আর কোন টু শব্দ না করে কল কেটে দিলো আয়না। একটু আগেই তাসিন ভাইয়ের মামী তাকে শাড়ি পরিয়ে তার হাতে, গলায় কিছু গহনা পরিয়ে দিয়েছিল। ধীরে ধীরে সব গহনা খুলে শাড়িটাও খুলে ফেলল আয়না। মাথার ওপর চলতে থাকা ফ্যানটা বন্ধ করে অপলক তাকিয়ে রইলো সেটার দিকে। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোঁটা তপ্ত নোনাজল।

চলবে
(যত ভাবি ৩৫ পর্বে শেষ করবো গল্পটা ততোই দেখি রাবারের মত লম্বা হচ্ছে 🥺। আরো কয়েক পর্ব লিখতে হবে ততদিন সবাই ধৈর্য্য রাখবেন প্লিজ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here