বৃষ্টির_রাতে #রূবাইবা_মেহউইশ (১০)

0
381

#বৃষ্টির_রাতে
#রূবাইবা_মেহউইশ
(১০)

সমুদ্রের মাতাল হাওয়ায় ঢেউয়ের গর্জন মন ভালো করা পরিবেশ। অথচ মন ভালো হচ্ছে না তাসিনের কিছুতেই। সে ঢাকা থেকে কক্সবাজার এসেছে রাত নয়টায়। ততক্ষণে মুরাদদের বাড়ি ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হয়ে গেছে। হোটেলের রুমও ছাড়া হয়েছে আগেই। বাসের টিকিট কেটে রেখেছে মুরাদ কিন্তু সমস্যা হলো তাদের বাস ছাড়বে রাত দেড়টায়। এত রাতে বাসস্ট্যান্ডে কি করে যাবে। আবার আগেই গেলেও সেখানে টিয়াকে নিয়ে কোথায় বসবে, কি করবে! রাস্তাঘাটের পরিস্থিতি এখন মোটেও সুবিধার নয় একটা মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার মত। অনেক ভেবে তাসিন কোন সিদ্ধান্ত না নিতে পেরেই রিশাদের সাথে কথা বলল। রিশাদ স্বভাবে গম্ভীর হলেও আচরণে সে যথেষ্ট আন্তরিক। তাসিন যেচে হেল্প চাইতেই রিশাদ জানালো এখন সে আর বাইরে যাচ্ছে না তার গাড়িটাই ফ্রী আছে৷ কিন্তু মাস তিনেক হলো সে ড্রাইভার ছাড়িয়েছে। আর হোটেলের কাজের জন্য এখন আর প্রাইভেট কার বা মাইক্রো একটাও নেই। তাসিন কিছু একটা ভেবে বলল, “আমি ড্রাইভিং জানি। যদি আপনার আপত্তি না থাকে তো এই যে আমার ফোন।” বলেই তাসিন লক সরিয়ে দিল ফোন থেকে। তারপর নিজের কন্টাক্ট লিস্ট আর ওয়ালেটে থাকা নিজের ন্যাশনাল আইডি কার্ড আর তার ব্যাংক কার্ডটা সামনে দিয়ে বলল, “এগুলো রেখে দিন আপনার কাছে। আমি নিশ্চয়ই গাড়ি নিয়ে ফিরে আসবো তবুও গ্যারান্টি স্বরূপ রাখুন।”

রিশাদের খুব হাসি পেলো তাসিনের কান্ড দেখে। ভরসা জিনিসটা রিশাদের মধ্যে বাইরের মানুষের জন্য নেই বললেই চলে। সে জানে তাসিন গাড়িটা নিলেও কোন ভয় নেই। আর যদি সে কিছু করেই বসে, গাড়িটা নিয়ে গায়েব হয়ও রিশাদের ক্ষমতা আছে দেশের অন্তত কয়েকটা জেলা থেকে সেটাকে একঘন্টার মধ্যে খোঁজ নেওয়ার। তাসিনের কোন আইডিয়া নেই রিশাদ কি ছিল আর এখনো কি আছে৷ সবাই শুধু তার বর্তমান খোলশটাই দেখছে৷ মেহউইশ ঘরে ছিল আর রিশাদ, তাসিন ঘরের সামনেই ছিল। মেহউইশকে ডেকে গাড়ির চাবিটা দিতে বলল রিশাদ। সে এই ছেলেটাকে কি করে বোঝায় ফোন, ব্যাংক কার্ড জিম্মা রেখে গাড়ি দেওয়ার মত দিন তার আসেনি। চাবি দিতেই তাসিন বলে গেল সে বন্ধুদের বাসে দিয়ে ফিরে আসবে৷ আজ রাতও সে হোটেলে থাকবে একটা রুম তাই ছাড়া হয়নি। রুম সম্পর্কিত আলোচনায় রিশাদ থাকবে না এটা রিসেপশনিস্ট এর কাজ তাই সে শুভরাত্রি জানিয়ে ঘুমাতে চলে গেল। তাসিনরাও প্রায় রাত একটা পর্যন্ত হোটেলে বসেই গল্প করল। আধঘন্টা সময় হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো তারা। যথাসময়ে বন্ধুদের বাসে তুলে দিয়ে অপেক্ষা করল তাদের বাস ছাড়ার। বাস ছাড়তেই তাসিন আবার ফিরে আসলো হোটেলে। আসতে আসতে উপভোগ করলো আঁধার ঘেরা রাত, সমুদ্রের জোলো হাওয়া আর অনুভব করলো দেহজুড়ে ভারী ক্লান্তি, মন খারাপ ভাবটা কেটে গেছে ততক্ষণে । হোটেলে ফিরে গাড়ির চাবিটা রিসেপশনে জমা দিয়ে সে রুমে ঢুকে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লো৷ পেটে খিদে থাকলেও নড়েচড়ে উঠার মতও শক্তি পেল না নিজের মধ্যে। কাল সারারাত এক মুহূর্তের জন্য বিছানায় গা লাগায়নি৷ আজ দিনটাও তার তেমনই কাটলো তাই বুঝি এখন আর দেহটা টানতে পারছে না। নিমেষেই তলিয়ে গেল তাসিন গভীর ঘুমে।

রাত বাজে তিনটা অথচ সুপ্রভার চোখের ঘুম ভয়ে এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে। বড়দা ভাইকে ফোন করতেই সে খুব ভালো অভিনয় করছিল তাসিনের কথামত। কিন্তু মেজদা ভাই সাথেই ছিল তাই ফোনটা কেড়ে নিয়ে খুব করে ঝাড়ি মেরেছে। তারা সত্যিটা আগেই টের পেয়েছে কিন্তু কথা হলো সে কেন টিয়ার সাথে বের হয়েছিল। পুরো এলাকায় ছড়িয়ে গেছে শিকদার বাড়ির মেয়ে ভেগেছে। মান সম্মান ধূলিসাৎ করার জন্য এরচেয়ে বেশি কিছু তো লাগে না। আর তাই মেজদা ভাই নিজেই ঠিক করেছে এক মাসের মধ্যে সুপ্রভার বিয়ে দিবে। এ ব্যাপারে বাড়ির কারো কোন কথা শুনবে না সে। ভয়টা তখনো হয়নি সুপ্রভার কিন্তু বড়দা ভাই যখন পাশ থেকে বলল একটা বিয়ের প্রস্তাব এসেছে কিছুদিন আগে তার জন্য । বোন পড়াশোনা করছে বলে ফিরিয়ে দিয়েছিল এখন সেটাই দেখবে আবার৷ ভয়টা ঠিক এখানেই বড়দা ভাই বলে দিয়েছে মানে এটা হবেই। মেহরিন ঘুমাচ্ছিল কিন্তু সুপ্রভা বাতি জ্বালিয়ে রেখেছে বলে তার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটছে। চোখ মুখ কুঁচকে তাকিয়েছে মেহরিন।

“কি সমস্যা প্রভা তুমি বাতি জ্বালিয়ে রেখেছো কেন?”

“মেহরিন জানো আমার বড়দা ভাই না আমাকে বিয়ে দিয়ে দেবে বলেছে।”

“এটা তো ভালো কথা বাতি বন্ধ করো আমি ঘুমাবো।”

বিরক্তিতে বলল মেহরিন কিন্তু সুপ্রভা তাতে পাত্তা দিল না।সে আবার বলল, “আমি যে এখন বিয়ে করবো না কি করি বলোতো?”

“আপাতত বাতি বন্ধ করো তাতেই হবে ” বলেই মেহরিন মাথার নিচ থেকে বালিশ উঠিয়ে উপরে রাখল। বাতির আলোয় তার মাথা ধরছে খুব। সুপ্রভার তাতেও হেলদোল নেই সে অন্যমনস্ক হয়ে কথা বলতেই থাকল, “এখন যদি বিয়ে হয়ে যায় আমার প্রেম করা হবে না।”

মেহরিন জবাব দিচ্ছে না তার এখন ঘুম প্রয়োজন সকালে কাল সাতটায় ক্লাস আছে। সুপ্রভাকেও সে ঘুমানোর আগে জানিয়েছে কিন্তু মেয়েটার তাতে কিছু যায় আসে না। সুপ্রভা আরো কিছু কথা বলতেই থাকল আর এতে রাগ হলো খুব মেহরিনের। সে শোয়া থেকে উঠে প্রচণ্ড ক্রোধের সঙ্গে বলল, “আর একটা কথা যদি বলো না প্রভা তাহলে আমি সৌহার্দ্যকে তোমার নতুন ফোন নম্বর দিয়ে দিব।”

“আহ্ ভয় দেখানোর জন্য আর কিছু পাও না? আমার চিন্তা সত্যিই যদি আমার বিয়ে দিয়ে দেয় আমি পালিয়ে বিয়ে করতে পারবো না।”

“অনেক হলো প্রভা আর ভালো লাগছে না ঘুমাতে দাও প্লিজ। সকালে ক্লাস এটেন্ড করতে হবে আমার।”

মেহরিন টেনে কথাটা বলতেই সুপ্রভা তাকে অবাক করে দিয়ে বাতি বন্ধ করে দিল।

“হায় আল্লাহ! সকালে ক্লাস আছে আগে বলবে না! তোমার জন্য আমার ঘুমের দেরি হয়ে গেল ইশ।” ধপাস করে বিছানায় শুয়ে পড়লো সুপ্রভা। আর অন্ধকারের ভেতরই হা করে বসে রইলো মেহরিন৷ বিড়বিড় করে বলল, “এটা কি হলো!”

সকালের রোদ বুঝি সমুদ্রের এলাকায় একটু আগেই উপস্থিতি জানান দেয়। সবে মাত্র ছয়টা বাজে অথচ এসময়েই ঘর ঝলমলে আলোর জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে শুধু মাত্র জানালার পর্দাটা একটুখানি সরেছে বলে। প্রচণ্ডরকম ভারী ঘুমটা আচমকাই চলে গেল চোখ থেকে তাসিনের। খালি পেটে শরীরে শক্তির ছিটেফোঁটাও নেই তবুও টেনে হিঁচড়ে শরীরটাকে তুলতে হলো। এখনই বেরিয়ে না পড়লে বাড়ি ফিরে আবার অফিসে যাওয়া মুশকিল হবে। বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুমে ঢুকতেই মনে পড়লো সে কাপড় এনেছিল যেই ব্যাগে সেটা কাল রিমনের হাতে ছিল। সে কি ব্যাগ নিয়ে গেছে! দ্রুত আবার বাথরুম থেকে বেরিয়ে হতাশ হলো। যা ভেবেছে তাই শালা বুদ্ধুরাম তার ব্যাগটাই নিয়ে গেছে। পরনের শার্ট প্যান্ট পরেই বের হতে হবে ভেবে শুধু মুখটা ধুয়ে এলো। দু হাত মাথায় চিরুনির মত চালিয়ে ঠিক করে নিল এলোমেলো চুলগুলো । পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে টাকা গুনলো। তিন হাজারই আছে আর। মুরাদের আর তার টাকাতেই সব খরচ কাটিয়ে নিয়েছে। সুমন অবশ্য টাকা দিতে চেয়েছে মুরাদ নেয়নি সে এও জানে মুরাদ সব টাকার হিসেব রেখেছে। টাকা হাতে এলেই সে তাসিনকেও ফেরত দিতে চাইবে। তার এই খাদক বন্ধুটা এদিক দিয়ে খুবই সতর্ক। কখনো কারো থেকে ততক্ষণ কোন সহযোগিতা নিবে না যতক্ষণ তার পক্ষে সম্ভব হয়। এ ব্যাপারে রিমন খুবই কঞ্জুস। হাসি পেল তাসিনের ভাবতেই তারা চারটা বন্ধু চার রকম স্বভাবের তবুও তারা একাত্ম। একজনের বিপদে অন্যজন হামলে পড়ে বিপদ নিজ ঘাড়ে নেয়। নিজেদের কথা ভাবতে ভাবতেই তাসিন দূর্বল পায়ে রিসেপশনে গিয়ে দাঁড়ায়। শুধু মাত্র আজকের রুমের বিলটাই বাকি ছিল সেটা পে করে সে রিশাদের কথা জিজ্ঞেস করলো। শায়খ জানালো রিশাদ খুব ভোরেই উঠে দৌড়াতে বেরিয়েছে। তখনই গেইট দিয়ে বাইরে চোখ গেল। লনের সামনে মেহউইশ হাটছে তার আঙ্গুল ছুঁয়ে হাঁটছে নির্জন। তাসিন সেদিকে এগোতে এগোতে খেয়াল করলো মেহউইশকে। পরনে তার হলুদ একটা সেলোয়ার-কামিজ, ওড়নাটা দিয়ে মাথায় ঘোমটা দেওয়া। সকালের মিঠা রোদ্দুর মেহউইশের গাল ছুঁয়ে দিচ্ছে অহংকারের সাথে। মিষ্টি লাগছে মেয়েটাকে দেখতে একদম যেন মোমের তৈরি কোন পুতুল৷ গোলগাল শরীরের অবস্থার জন্য তার উচ্চতাটা বেশ লাগছে। নির্জনের সাথে বুঝি কিছু বলে হাসছেও মেয়েটা তা দেখে অজান্তেই তাসিনের চোখে ভেসে উঠলো সুপ্রভার মুখ। হ্যাংলা- পাতলা ছিপছিপে দেহের গড়ন, চঞ্চল স্বভাব আর.. আর তার সাথে কোমর বেঁধে ঝগড়া করাটা। উফ, সকাল সকাল কেন সেই আজব মেয়েকে মনে করছে সে! লনের সামনে মেহউইশের মুখোমুখি হতেই রিশাদও এসে হাজির হলো।

“সুপ্রভাত।” মিষ্টি হেসে মেহউইশ বলল।

“আপনাদেরকেও, আমি চলে যাচ্ছি। আপনাদের ধন্যবাদ দেওয়ার ছিল। এতোটা সহযোগিতা, আন্তরিকতা আপনারা দিয়েছেন যা হয়ত ধন্যবাদ দিলেও কম হবে।”

“উহুম, আমরা আমাদের হোটেলের প্রতিটি গেস্টকেই এমনভাবে ট্রিট করি। তবে আপনার জন্য বিশেষ একটা কথা।”

তাসিন আগ্রহী দৃষ্টি দিল রিশাদের দিকে। রিশাদ আবার বলল, “ছেলে মেয়ে দুটো পালিয়ে এসেছে এ নিয়ে আপনার এলাকায় ঝামেলা হচ্ছে। আপনার মামা আমাকে বারবার করে বলে দিয়েছে আপনাকে বলার জন্য তাদের সাথে যোগাযোগ না করতে। কিন্তু আমি বলব বন্ধুদের বিপদে এগিয়ে আসাই প্রকৃত বন্ধুত্ব। তবে অবশ্যই বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগিয়ে তাদের বিপদ কাটিয়ে নিজেকেও বিপদমুক্ত রাখতে হবে।”

“বুঝতে পেরেছি ভাইয়া। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।”

রিশাদ, মেহউইশের কাছে বিদায় নিয়ে তাসিন বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। বাড়ি বলতে মামার বাড়ি যেখানে সে থাকে। বাড়িতে ঢুকে প্রথমেই বড় মামার কাছে ঝাড়ি খেল। তা অবশ্য গায়ে মাখলো না অন্তত এক সপ্তাহ এই ঝাড়ি চলবেই এবার তা সে জানে। বড় মামীর সামনে গিয়ে আহ্লাদী কণ্ঠে বলল, “রাত থেকে কিছু খাইনি মামী।”

ব্যস মামীও গলে মোম হয়ে দ্রুত পরোটা বানিয়ে খাইয়ে দিল। তাসিনের মা আর বড় মামা দুজনই এ নিয়ে প্রচণ্ড রাগ দেখায় তার মামীর ওপর। তিনি প্রত্যেকটা ছেলেমেয়েকে প্রয়োজনের অধিক আদর আহ্লাদ করেন। তাসিনের বোন মাইশাও এজন্য প্রায়ই বলে সে মেট্রিক পরীক্ষার পর বড় মামীর কাছে চলে আসবে। নাশতা, গোসল সব শেষ করতেই প্রায় নয়টা বেজে গেল। আজও অফিসে লেট হবে তা আর বুঝতে বাকি নেই। মামার কাছে গাড়ির চাবি চাইলেও পাওয়া যাবে না তা নিশ্চিত ভেবে আজও দুলাভাইয়ের কাছে গেল। ভাগ্য এ পর্যায়েও তাসিনের সুপ্রসন্ন দুলাভাই এখনই বের হচ্ছেন। বলার আগেই দুলাভাই তাকে গাড়িতে নিমন্ত্রণ জানালো। অফিসে পৌঁছুতে পাক্কা পনেরো মিনিট লেট কিন্তু বস তো আজ অফিসেই আসেনি। আরাম করে নিজের ডেস্কে বসে ফাইলপত্র বের করল তাসিন। দেড়ঘন্টা একটানা কাজ করে কফির জন্য ক্যান্টিনে গিয়ে বসল। তখনো এগারোটা বাজেনি তাই অফিসের ক্যান্টিন একেবারেই ফাঁকা বলা যায়। এককাপ কফির অর্ডার দিয়ে ফেসবুক স্ক্রল করছিল সে। ফোনটা বেজে উঠল তার হঠাৎ । স্ক্রীণে ভেসে উঠলো, “তুফান” নামটা।

চলবে
(মন্তব্য কি করবেন না আপনারা? মন্তব্য করলে ভালো লাগে খুব আর যারা নিয়মিত করেন তাদের জন্য অসংখ্য ভালোবাসা আর ধন্যবাদ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here