রংধনুর_আকাশ লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ পর্ব-০১

0
2688

রংধনুর_আকাশ
লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-০১

০১।
ব্যস্ত শহরের ব্যস্ত পার্কে একটা বেঞ্চে পাশাপাশি বসে আছে মাহাথি আর সূচনা। তাদের দুজনের চেহারায় মলিনতার ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। অনেকক্ষণ হলো তাদের মধ্যে নিরবতা বিরাজ করছে। তাদের হাতে বেশিক্ষণ সময়ও নেই। দুজনেরই তাড়া আছে। তাই নিরবতা ভেঙে সূচনা মলিন কন্ঠে বলে উঠলো,
“আমার ভাবতেই খুব অবাক লাগছে যে তুমি এভাবে হুট করে আমাদের দশ বছরের সম্পর্কটা শেষ করে দিচ্ছো! তুমি আমার কাছে সময় চেয়েছিলে, আমি তোমাকে সময় দিয়েছি। তুমি বলেছ, চাকরি পাওয়ার পর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে বাবার কাছে যাবে। কিন্তু এখন চাকরি পেয়েও প্রস্তাব পাঠাতে পারলে না। উলটো বলছ, আমাকে বিয়ে করা সম্ভব না। তাহলে আমি তোমার অপেক্ষায় এতোগুলো সময় কেন নষ্ট করেছিলাম? আমার তো আরো দুই বছর আগেই বিয়ে করে ফেলা উচিত ছিল। তুমি আমার সাথে এমন কেন করছ?”

মাহাথি সূচনার কথাগুলো নিরবে হজম করে যাচ্ছে। কারণ তার কাছে সূচনার প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। সূচনা এবার মাহাথির মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“মাহা, আমি তোমার সাথে কথা বলছি। কিছু তো বলো!”

মাহাথি বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে শীতল কন্ঠে বলল,
“তুমি তোমার বাবার পছন্দে বিয়ে করে নিও।”

কথাটি শুনে সূচনা মনঃক্ষুণ্ন হলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। তারপর মাহাথির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
“আমি জানি তুমি যার হাত ধরবে, তাকেই আগলে রাখবে। আমিই হয়তো একটু ব্যতিক্রম ছিলাম। তাই এভাবে আমার হাতটা ছেড়ে দিয়েছ। এখন ভাবতেই খুব কষ্ট হচ্ছে, যে আমার অস্তিত্ব তোমার জীবনে কোথাও কখনোই ছিল না। মূলত আমি তোমার ভুল ছিলাম। আর তুমি এখন সে ভুলটা তোমার জীবন থেকে বের করে দিচ্ছো। ওহ সরি, দিচ্ছো না, দিয়েই দিয়েছ।”

কথাগুলো বলে সূচনা আর সেখানে দাঁড়ালো না। কিন্তু মাহাথি এখনো সেই জায়গায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ এমন একটা পরিবেশে তার দশ বছরের প্রেমের সমাপ্তিটা ঘটে যাবে, সে নিজেও বুঝতে পারে নি। আর সে অনেক দিন ধরেই সূচনাকে বলতে চাইছিল যে এই সম্পর্কটা রাখা তার পক্ষে সম্ভব না। কিন্তু সূচনাকে দেখলেই কথাটা আর বলতে পারতো না। আর আজ সে অনেক সাহস নিয়েই কথাটা বলে ফেলেছে। মাহাথি ভেবেছিল, সূচনা এতো সহজে এই সম্পর্কটা শেষ হতে দেবে না। সবকিছু শুনে সে মাহাথিকে নিজের কাছে ধরে রাখবে আর বাধ্য করবে তার সাথে থাকতে। কিন্তু সূচনার স্থির ভাবটা দেখে মাহাথির সব ভাবনা মিথ্যে প্রমাণিত হয়ে গেল।

হঠাৎ বেঞ্চের দিকে চোখ পড়তেই সে খেয়াল করলো সূচনা তার টিফিনবক্সটা সেখানেই রেখে চলে গেছে। মাহাথি বক্সটা খুব যত্নের সাথে হাতে নিয়ে সেটি খুলে দেখলো সূচনা তার জন্য গরম গরম ঝাল পাকোড়া নিয়ে বানিয়ে এনেছে। সে পাকোড়ার দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো। হঠাৎ তার চোখের কোণা জ্বালা করতে লাগলো। বিরহের যন্ত্রণা বোধহয় এখন তার শরীরের প্রতিটি অঙ্গ অনুভব করছে। অথচ তার মুখের ভাষা শুধু একটাই বাক্য বের করছে, আর তা হলো, “সূচনা আমার জন্য নয়।”

মাহাথি টিফিনবক্সটা হাতে নিয়ে পার্ক থেকে বেরিয়ে ক্লান্ত পায়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগল। হাঁটতে হাঁটতেই তার চোখে সূচনার মায়া জড়ানো মুখটা ভেসে উঠলো। সে মনে মনে বলল,
“যাকে পাওয়া সম্ভব নয়, তার জন্য মায়া বাড়িয়ে কি লাভ! আমার উচিত সূচনার মায়া ত্যাগ করা।”

০২।

আরিয়া ফেরদৌস একজন নামকরা ফ্যাশন ডিজাইনার। তিনি বর্তমানে তার সন্তানদের নিয়ে নিজের কেনা ফ্ল্যাটে থাকেন। স্বামী, মিরাজ জামান নীরের সাথে তার চৌদ্দ বছর আগেই ডিভোর্স হয়ে গেছে। এরপর তিনি একা একাই তার সন্তানদের মানুষ করেছেন। ডিভোর্সের প্রথম কয়েকবছর তার ছোট ভাই ফায়াজ আলম ও একমাত্র বন্ধু রিদ্ধ সেনের সহয়তায় তিনি কিছুটা বিরূপ পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু এরপর তার আর কারো সাহায্যের প্রয়োজন হয় নি। অনেকে বলেছে তাকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে। কিন্তু চার সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তিনি আর কোনো সম্পর্কে জড়ান নি। আর বর্তমানে তার একমাত্র পরিবার তার দুই ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে।

আরিয়ার প্রথম সন্তান মাহাথি। তার ভালো নাম মাহাথি ইবনে উম্মী। সে একটা সরকারী ব্যাংকে চার বছর ধরে চাকরি করছে। কিন্তু আরিয়া এখনো তাকে সংসার চালানোর দায়িত্ব দেন নি। তাই বর্তমানে মাহাথি যা আয় করছে তা সে সঞ্চয় করছে। তবে মাঝে মাঝে সে বোনদের জন্য বাড়তি এটা ওটা কিনে নিয়ে আসে। যা আরিয়া মোটেও পছন্দ করেন না। তিনি চান মাহাথি সঞ্চয় করুক। আর ঘরের প্রয়োজনীয় খরচ তো তিনি নিজেই দিচ্ছেন। বাড়তি খরচ আর বিলাসিতা তার মোটেও পছন্দ না। কারণ একটা সময় তিনি টাকার জন্য তার ভাই ফায়াজকে নিঃস্ব হতে দেখেছিলেন। আর অনেক কষ্টেই সে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছিল। এমনকি টাকার অভাবে আরিয়া নিজেও অনেক কষ্ট করেছিলেন। স্বামীর শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার সহ্য করেও তিনি অনেক বছর সংসার করেছিলেন শুধুমাত্র টাকা ও ঠিকানার অভাবে। আর আরিয়া চান না তার সন্তানরা কোনো অভাবের কারণে এমন মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করুক। তাই এখন থেকেই তিনি সঞ্চয়ের ব্যাপারে খুবই সচেতন। আর অভাব তো বলে আসে না। হুট করে যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যায়? এখনো দুই মেয়েকে বিয়ে দেওয়া বাকী, তাছাড়া তাদের পড়াশুনা, আবার দুই ছেলের জন্য বউ আনা এসব ব্যাপার নিয়ে তিনি এখন থেকেই খুব চিন্তিত।

আরিয়ার দ্বিতীয় সন্তান মাফিন ইবনে উম্মী। সে বর্তমানে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং-এ মাস্টার্স করছে। পাশাপাশি সে একটা কোম্পানিতেও নতুন জয়েন করেছে।

মাহাথি যতোটা নম্র ও শান্ত, মাফিন ঠিক ততোটাই রাগী ও চঞ্চল। তবে তারা দুই ভাই মাকে প্রচন্ড শ্রদ্ধা করে। মায়ের কথা ছাড়া তারা কোনো কাজই করে না। এমনকি নিজেদের সব ছোট-বড় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আগে মায়ের সাথে পরামর্শ করে নেয়। যদিও আরিয়া ফেরদৌস ছেলে-মেয়েদের যথেষ্ট স্বাধীনতা দিয়েছেন। তবুও তারা মায়ের পরামর্শ নেওয়াটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করে।

অন্যদিকে আরিয়ার ছোট দুই মেয়ে নুসরাত মহুয়া ও মারিয়া নাওয়াল। তারা উভয়ে এ বছর কলেজে ভর্তি হয়েছে। জমজ হওয়ায় তারা দেখতে হুবহু একই। শুধুমাত্র চালচলন ও কথাবার্তা তাদের দুজনকে আলাদা করতে সক্ষম। একদিকে মহুয়া খুবই শান্ত, আর অন্যদিকে মারিয়া খুবই চঞ্চল। মহুয়া সারাদিন বইয়ের মাঝে ডুবে থাকে আর মারিয়া বান্ধবীদের নিয়ে কোথায় ঘুরতে যাওয়া যায়, সেই পরিকল্পনায় ব্যস্ত থাকে।

০৩।

বেল দিতেই দরজা খুলে দিল মহুয়া। দরজার ওপাশে মাহাথির ক্লান্ত ও মলিন মুখটা দেখে সে খুব অবাক হলো। মাহাথি বোনের দিকে এক পলক তাকিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে নিজের রুমে চলে গেল। মহুয়া চিন্তিত মুখে দরজা বন্ধ করে ভাইয়ের রুমের কাছে আসতেই ভেতর থেকে তার ফুঁপানো কান্নার শব্দ শুনতে পেল। সে মাহাথির দরজায় কড়া নাড়তে যাবে তখনই কোথা থেকে মারিয়া এসে তাকে জাপটে ধরে টেনে তাদের রুমে নিয়ে গেল।

মহুয়া ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
“তোর আবার কি হয়েছে? তুই এতো ছটফট করিস কেন বলতো? আর এদিকে বাসায় কতো কিছু হয়ে যাচ্ছে, সেদিকে তোর কোনো খেয়ালই নেই।”

মারিয়া ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আমি তোকে এখানে এনেছি একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার জন্য। আর আমি কি এমন ছটফট করি? আর যদি করেই থাকি, এখানে সমস্যার কি আছে? এটাই কিন্তু ছটফটানোর বয়স, বুঝলি? এখন ছটফট না করলে কখন করবি? বাচ্চার মা হওয়ার পর, ডাবাল চিন বের হওয়ার পর নাকি মরিচ থেকে টমেটো হওয়ার পর?”

মহুয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“মেয়েদের একটু ধীরস্থির হওয়া ভালো।”

মারিয়া বিরক্তির সুরে বলল,
“উফফো! তোর এমন শান্তশিষ্ট লেজবিশিষ্ট কথাবার্তা শুনার জন্য আমি তোকে ডাকি নি। আমি তোর কাছে আমার পরবর্তী ভ্রমণসঙ্গী হওয়ার প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। আমার কলেজ থেকে ট্যুরে যাচ্ছে। আর তুইও আমার সাথে যাচ্ছিস।”

“কখনোই না। তোদের কলেজে ছেলে-মেয়ে একসাথেই পড়ে। আর তুই জানিস আমি ছেলেদের সামনে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না।”

“ওরা তোর দিকে তাকাবেই না। সবাই যখন জানবে মহুয়া হচ্ছে মারিয়ার বোন, তখন তোর দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহসও পাবে না।”

“কেন? তুই কি এমন করবি যে ওরা তাকাবে না?”

মারিয়া ভ্রূ নাচিয়ে বলল, “তুমি বুঝবে না চান্দু।”

“ঠিকই বুঝেছি আমি। পড়াশোনা না করে তুই গুন্ডামি করে বেড়াস।”

“ইশ, কি বাজে শুনাচ্ছে শব্দটা! এভাবে বলে না চান্দু। বলবি নারী জাগরণের নেত্রী মারিয়া নাওয়াল….”

মারিয়াকে থামিয়ে দিয়ে মহুয়া মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“হয়েছে। এখন চল ভাইয়ার কি হয়েছে দেখে আসি।”

মারিয়া মহুয়ার হাত ধরে অনুরোধের সুরে বলল,
“আগে বল তুই আমার সাথে কলেজ ট্যুরে যাবি।”

মহুয়া চোখ ছোট করে মারিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। মারিয়া করুণ সুরে বলল,
“ভাই, হ্যাঁ বল হ্যাঁ। শুধু আমার কলেজে ছেলে আছে, তাই মা আমাকে একা একা ট্যুরে যেতে দেবে না। এখন আমি কি শখ করে ওই কলেজে ভর্তি হয়েছি? নাকি সেই ছেলেদের ইনভাইট করে আমার কলেজে ভর্তি করিয়েছি? আমার এসব ছেলে-পেলের প্রতি কোনো আগ্রহ নেই। আমার সব আগ্রহ সেই ট্যুর নিয়ে। ভাই মহুয়া, আমার চান্দু, আমার বোনু, হ্যাঁ বল হ্যাঁ। আমি তোকে সবচেয়ে সুন্দর বইটা উপহার দেবো।”

মহুয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“সবচেয়ে সুন্দর বই কোনটা সেটা তুই কখনোই বুঝবি না। কখনো বইয়ের একটা পৃষ্ঠাও উলটে দেখেছিস? তুই শুধু মলাট দেখে বই কিনিস। তাই আমাকে কোনো বই উপহার দিতে হবে না। আমি এমনিতেই যাবো। কিন্তু তারপরও যদি মা না করে দেয়?”

মারিয়া দাঁত কেলিয়ে বলল,
“মেজো ভাইয়া আছে না? ভাইয়া এসব ব্যাপারে মাকে পটিয়েই ছাড়ে। আর আমি ভাইয়াকে আগে থেকেই বলে রেখেছি। তাই আমি এখন চিন্তামুক্ত।”

“আচ্ছা, বাবা। এখন আমার সাথে চল। বড় ভাইয়ার মন ভালো নেই। হয়তো কোনো সমস্যা হয়েছে।”

“অফিসে কোনো ঝামেলা হয়েছে হয়তো!”

“না, আমি ভাইয়ার ঘরের কাছে গিয়ে কান্নার শব্দ পেয়েছি। ভাইয়া ফুঁপিয়ে কান্না করছে।”

মারিয়া ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“ভাইয়াও আবার কান্নাকাটি করে নাকি!”

“মারিয়া প্লিজ। একবার গিয়ে দেখে আসি।”

“আমি কি বলেছি যাবো না? আমি তো একটু অবাক হচ্ছি! ভাইয়া এই বয়সে এসে কান্নাকাটি করছে? আমি ভাইয়ার বয়সে গেলে তো ওয়ার্ল্ড ট্যুর দেবো।”

মহুয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো। মারিয়াও এবার পিছু পিছু চলে এলো মাহাথির রুমের সামনে। মহুয়া দরজায় কড়া নাড়তেই কয়েক মিনিট পর মাহাথি দরজা খুলে দিল। মারিয়া হুড়মুড় করে মাহাথির রুমে ঢুকে পড়লো। তারপর টেবিলের উপর সূচনার টিফিনবক্সটা দেখে সেটা খুলে মারিয়া বলল,
“ভাইয়া, পাকোড়া কে বানিয়েছে? ওয়াও, আমি একটু খেয়ে দেখি?”

মাহাথি মুচকি হেসে ইশারায় সম্মতি দিল। মারিয়াও আর দেরী না করে গপাগপ দুই তিনটা খেয়ে নিল। কিন্তু মহুয়া মাহাথির দিকে তাকিয়ে আছে। সে মনে মনে ভাবছে,
“ভাইয়াকে আগে এতোটা বিধ্বস্ত কখনোই দেখি নি। তাহলে আজ হঠাৎ কি হয়েছে?”

চলবে–

(চরিত্রগুলো সম্পূর্ণ কাল্পনিক।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here