#রংধনুর_আকাশ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-৩০
৫২।
প্রায় দুই সপ্তাহ কেটে গেছে। এখন আর স্বস্তিকা আগের মতো মাফিনের সাথে ঠিকভাবে কথা বলে না। তবে এই ব্যাপারটি ইদানীং মাফিনের সহ্য হচ্ছে না। সে স্বস্তিকাকে ফোন করলে ওপাশ থেকে ভালোভাবে উত্তর পায় না। দেখা করতে চাইলে স্বস্তিকা এড়িয়ে যায়। কিন্তু দুই সপ্তাহ আগেও মেয়েটি তাকে ফোন করে ঘন্টার পর ঘন্টা বকবক করে যেতো। আজও মাফিন প্রতিদিনের মতো ফোন করে জিজ্ঞেস করলো,
“কেমন আছো?”
স্বস্তিকার সোজাসুজি উত্তর, “জ্বি, ভালো আছি।”
মাফিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“তুমি হঠাৎ এভাবে পালটে গেলে যে! কি হয়েছে তোমার?”
“হঠাৎ করে কেউ পালটে যায় না। মানুষ ধীরে ধীরে পালটে যায়। আর অবহেলা মানুষকে আরো দ্রুত পালটে দেয়।”
“আজকে দেখা করতে পারবে?”
“আমি জানি না।”
“আমি তোমার বাসার সামনে আসছি।”
“কিন্তু..”
স্বস্তিকাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মাফিন কল কেটে দিলো। এরপর অফিস থেকে সোজা স্বস্তিকার বাসার সামনে চলে এলো। বাসার নিচে এসে ফোন করে বলল,
“আমি নিচে দাঁড়িয়ে আছি।”
“আমি এখনো তৈরী হই নি।”
“আচ্ছা, তৈরী হয়ে তাড়াতাড়ি আসো।”
“দুই-তিনঘন্টা লাগবে।”
“মানে?”
“মানে আমার দুই-তিনঘন্টা লাগবে।”
“স্বস্তিকা, তুমি কি আমার সাথে মজা করছো? তৈরী হতে কি এতোক্ষণ সময় লাগে নাকি?”
“হ্যাঁ, কেন লাগবে না?”
“আমি তো কখনো কাউকে এতো সময় ধরে তৈরী হতে দেখি নি৷ সর্বোচ্চ আধা ঘন্টা লাগবে। আর আমি তো তোমাকে নিয়ে কোনো অনুষ্ঠানে যাচ্ছি না। আশেপাশে কোথাও যাচ্ছি। তাহলে তো দশমিনিটের বেশি সময় লাগার কথা না। আর তুমি তো তেমন মেকাপও করো না।”
“তাও আমার সময় লাগবে।”
“অদ্ভুত। আমি তো কখনো মারিয়া আর মহুয়াকেও এতো সময় নিতে দেখি নি।”
স্বস্তিকা তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“ওদের সাথে আমার তুলনা করবেন না। আমার তো হিজাব বাঁধতেই এক ঘন্টা লেগে যাই। আর আপনার বোনরা তো কোনোভাবে গায়ে ওড়নাটা দিয়েই বের হয়ে যায়। তাদের কি আমার মতো হিজাব করার ইচ্ছে আছে?”
মাফিন এবার রাগী কন্ঠে বললো,
“স্বস্তিকা, তুমি এভাবে কথা বলছো কেন?”
“তাহলে আপনিও বা তাদের সাথে আমার তুলনা করছেন কেন?”
“তুমি বিষয়টা অন্যদিকে নিয়ে যাচ্ছো।”
“আর আপনিও প্রসঙ্গটা অন্যদিকে নিয়ে যাচ্ছেন। দুই ঘন্টা দাঁড়াতে বলেছি, তাও পারছেন না? আর এদিকে শুনলাম আপনার বড় ভাবীর জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা বড় ভাইয়া রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকেন।”
“থাক তোমার আসতে হবে না। আমি চলে যাচ্ছি।”
মাফিন ফোন কেটে চলে যেতে নিবে তখনই পেছন থেকে স্বস্তিকা বলে উঠলো,
“আমাকে ফেলেই চলে যাবেন?”
স্বস্তিকার কন্ঠ শুনে মাফিন পেছন ফিরে দেখলো, স্বস্তিকা নীল শাড়ি, হাতে আকাশী রঙের চুড়ি, আর মাথায় সাদা রঙের হিজাব পরে দাঁড়িয়ে আছে। মাফিন স্বস্তিকাকে এভাবে দেখে ঘোরের মাঝে চলে গেলো। স্বস্তিকা মাফিনের তাকানো দেখে লজ্জায় মাথা নামিয়ে বলল,
“আমি শাড়ি পরে হাঁটতে পারছি না। আমাকে একটু ধরবেন?”
মাফিন স্বস্তিকার কথা শুনে ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
“কি বললে?”
“আমি শাড়ি পরে হাঁটতে পারছি না। অভ্যাস নেই তো, তাই। আমাকে একটু ধরবেন?”
“তাহলে শাড়ি পরে এসেছো কেন?”
“বরকে দেখাবো বলে।”
মাফিন স্বস্তিকার কথা শুনে তার দিকে এগিয়ে এসে বলল,
“এখন যদি রাস্তায় শাড়ি খুলে যায়?”
স্বস্তিকা চোখ বড় বড় করে বলল,
“এভাবে বলছেন কেন? শাড়ি ধরে ধরে হাঁটবো, আর আপনি আমাকে ধরে রাখবেন।”
মাফিন এবার উচ্চশব্দে হেসে উঠলো। স্বস্তিকা ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“হাসার মতো কিছু বলি নি।”
স্বস্তিকা মুখ ফুলিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। মাফিন এবার স্বস্তিকার মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
“ডোরেমন, তোমাকে শাড়িতে খুব ভালো লাগছে।”
স্বস্তিকা কথাটি শুনে মুচকি হাসলো। তার হাসি দেখে মাফিন আবার বলল,
“কিন্তু যদি তোমার শাড়ি-টারি খুলে যায়, আমি তো তোমাকে সেখানে রেখেই চলে আসবো।”
স্বস্তিকা ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে মাফিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“স্ত্রীর দেখাশোনা করা স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য। আর এই দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন না করলে, স্বামীকে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে।”
মাফিন মুখ টিপে হেসে বলল,
“ওওও.. তাই। আর স্বামীর সাথে ঝগড়াঝাঁটি করলে?”
“ওটাকে ঝগড়া বলে না। খুনসুটি বলে। আর খুনসুটিতেই ভালোবাসা থাকে।”
“বাহ! দুই-তিনঘন্টা এই খোলা রাস্তায় রোদের মধ্যে আমাকে অপেক্ষা করতে বলে তুমি আমার সাথে খুনসুটি করতে চেয়েছিলে? কি চমৎকার তোমার খুনসুটি! আর সাথে তুমি মহুয়া আর মারিয়াকেও টেনে এনেছিলে।”
“একটু গম্ভীর কথাবার্তা না বললে, খুনসুটিতে কোনো মজা নেই। তাই একটু গরম মশলা দিয়ে কষিয়ে নিয়েছি, যাতে খুনসুটিটা খুব মজাদার মনে হয়।”
মাফিন মুচকি হেসে বললো,
“হুম, বুঝলাম। এবার চলো।”
মাফিন স্বস্তিকার হাত ধরে তাকে রিকশায় উঠালো। তারপর দু’জন অনেকক্ষণ শহরের অলিগলি ঘুরলো। এরপর চলে গেলো সি.আর.বিতে। সেখানে কিছুক্ষণ বসে মেলায় গেলো। মাফিনের আজ একটুও বিরক্ত লাগছে না, বরং স্বস্তিকার হাত ধরে হাঁটতে তার আলাদা আনন্দ লাগছে। তাহলে কি সে এবার প্রেমে পড়তে যাচ্ছে?
অবহেলা যেমন দূরত্ব বাড়ায়, তেমনই দূরত্বও মাঝে মাঝে ভালোবাসা বুঝতে শেখায়। দূরত্বের পর যেই অনুভূতির সৃষ্টি হয়, এটি রংধনুর মতো। বৃষ্টির পর যেমন আকাশে রংধনুর দেখা পাওয়া যায়, ঠিক তেমনই দূরত্বের পর মনের আকাশে রংধনু উঠে। আর এই রঙ মনের মাঝে ছড়িয়ে একটা ভালোবাসার গল্প সৃষ্টি করে। আর আজ হয়তো সেই রংধনুর আকাশে মাফিন আর স্বস্তিকার ভালোবাসার গল্প লেখা হচ্ছে।
অন্যদিকে কালো মেঘের সমাবেশে আকাশটা দেখতে খুব মলিন মনে হয়, যেন খুব দুঃখ-যন্ত্রণার সাক্ষী এই আকাশ। ঠিক এমনই কালো মেঘযুক্ত আকাশের নিচে বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে মারিয়া আর প্রহরের সম্পর্ক।
বৈবাহিক জীবন সম্পর্কে বান্ধবীদের কাছ থেকে বিস্তর অভিজ্ঞতা নিয়ে মারিয়া প্রহরের কাছে অনেক কিছুই আশা করে রেখেছে, যার একটাও প্রহর পূর্ণ করতে পারছে না। যার ফলে মারিয়ার মনে অভিমানের ভীড় জমছে।
সে প্রতিদিনই নিজ থেকে প্রহরকে ভিডিও কল দেয়, আর প্রহর চুপচাপ তার কথা শুনতে থাকে। মাঝে মাঝে ভিডিওতে মহুয়াকে দেখা গেলে প্রহর একটু নড়েচড়ে বসে, যা মারিয়াকে খুব বিরক্ত করে। তবে মারিয়া এবার প্রহরকে একটা আবদার করে বসলো। আর তা হলো টেস্ট পরীক্ষার পর প্রহর যাতে তাকে নিয়ে সাজেক যায়। কিন্তু প্রহর মারিয়াকে বোঝালো, তার অফিসে কাজের চাপ বেশি আর মারিয়ারও এই মুহূর্তে পড়াশোনায় মনোযোগ দেওয়া উচিত। তবুও মারিয়া জেদ করতে লাগলো। আর সেই জেদের কাছে মা আর প্রিয়ার জোরাজুরিতেই প্রহরকে হারতে হলো।
এদিকে মারিয়ার টেস্ট পরীক্ষা শুরু হয়ে গেলো। আর দুর্ভাগ্যক্রমে নিবিড়ের পাশেই মারিয়ার সিট পড়লো। নিবিড় প্রথম পরীক্ষার দিনই মারিয়াকে তার পাশে বসতে দেখে মনে মনে অনেক খুশি হলো। আর মারিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“হয়তো সৃষ্টিকর্তা আমাদের আবার এক করতে চান।”
মারিয়া ভেংচি কেটে নিবিড়ের দিকে চোখ ছোট করে তাকিয়ে বলল,
“সৃষ্টিকর্তা যেহেতু আমার কপালে আমার মিস্টার হ্যান্ডসাম বরকেই লিখে রেখেছেন, তাহলে এটা আর কারো পরিবর্তন করার সাধ্য নেই। এখন যেহেতু আশেপাশে আকাশ-কুসুম চিন্তাভাবনা করা মানুষের অভাব নেই, তাতে আমারও কিছু করার নেই, সাথে আমার বরেরও বা কি যায় আসে! কারণ তার বউ তো তারই থাকবে।”
“তোমার বর তোমাকে খুব ভালোবাসে, তাই না?”
“হুম, খুব ভালোবাসে। আর জানিস, পরীক্ষার পর আমি আর মিস্টার বর মধুচন্দ্রিমায় যাবো।”
কথাটি বলেই মারিয়া দাঁত কেলিয়ে হাসলো। নিবিড় কথাটি শুনে মলিন মুখে বললো,
“ও। তা কোথায় যাচ্ছো?”
“তোকে কেন বলবো?”
“এমনিতেই।”
মারিয়া মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“ঘুরে এসেই বলবো।”
মারিয়া এভাবে প্রতিদিনই নিবিড়কে প্রহর সম্পর্কে আজগুবি কথাবার্তা বলে বিরক্ত করে। কখনো বলে প্রহর তার জন্য শাড়ি কিনে এনেছে, আর তা নিজ হাতে তাকে পরিয়ে দিয়েছে। কখনো বা বলে তারা একসাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আইসক্রিম খেয়েছে। কখনো কখনো তো মারিয়া কল্পনায় প্রহরকে নিয়ে যা ভাবে তা-ই বাস্তব বলে নিবিড়ের সামনে চালিয়ে দেয়। আর এসব কথাবার্তা সম্পূর্ণ মারিয়ার কাল্পনিক হওয়ায়, তা যতোটা না নিবিড়কে কষ্ট দেয়, তার চেয়ে বেশি মারিয়াকেই কষ্ট দেয়। কারণ দিনশেষে সে প্রহরকে নিয়ে যা কল্পনা করে তার আগেপিছেও প্রহরকে দেখা যায় না।
চলবে-