রংধনুর_আকাশ #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ পর্ব-৩২ (সাজেক স্পেশাল-০১)

0
651

#রংধনুর_আকাশ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-৩২ (সাজেক স্পেশাল-০১)

৫৫।
বিকেলে প্রহর আর মারিয়া সাজেক পৌঁছে গেলো। রুমে ঢুকেই মারিয়া ধপ করে বেডে বসে পড়লো। প্রহরও চুপচাপ ব্যাগপত্র গুছিয়ে রেখে সামনে থাকা সোফায় বসে পড়লো। দু’জনই শারীরিক ভাবে ক্লান্ত। কিন্তু মারিয়া মানসিকভাবে এখনো তাজা। সে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে সাথে সাথেই মহুয়াকে কল দিয়ে দিলো।

ওপাশ থেকে মহুয়া কল ধরতেই মারিয়া ফোন স্পিকারে রেখে চেঁচিয়ে বলল,
“চান্দু, আমি এখন কোথায় এসেছি জানিস?”

মহুয়া বলল,
“সাজেক পৌঁছে গেছিস?”

“হ্যাঁ।”

মহুয়ার কন্ঠ শুনে প্রহর একটু নড়েচড়ে বসলো। হুট করেই কেন যেন তার বুকটা হু হু করে উঠেছে। তবুও সে চোখ বন্ধ করে নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। তার আবেগী মন চাইছে এখনি বসা থেকে উঠে ফোনের সামনে গিয়ে মহুয়াকে একনজর দেখে আসতে। আবার তার ব্যক্তিত্ব তাকে এমনটা করতে বাঁধা দিচ্ছে।

এদিকে মারিয়া মহুয়াকে বলল,
“জানিস চান্দু, এতো সুন্দর রাস্তা ছিল!”

“বান্দরবান থেকেও সুন্দর?”

“না, রাস্তাটা একই ধাঁচের মনে হয়েছে। কিন্তু তুই তো জানিস সাজেক আমার ড্রিম প্লেইস। তাই এখানে আসার রাস্তাটা আমার বান্দরবানের রাস্তা থেকেও বেশি ভালো লেগেছে। আর এবার তো সাথে মিস্টার বরও ছিলো।”

শেষ কথাটি বলেই মারিয়া আঁড়চোখে প্রহরের দিকে তাকালো। এদিকে কথাটি শুনার সাথে সাথেই প্রহরের অশান্ত মনটি হুট করেই শান্ত হয়ে গেলো। সে চোখ খুলে দুই হাঁটুর উপর তার দুই হাত রেখে তার উপর ভার দিয়ে ঝুঁকে বসলো। মারিয়া প্রহরের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে মহুয়াকে ঘুরে ঘুরে তাদের কটেজ দেখাতে লাগলো।

কটেজের সামনে একটি বড় এবং খোলা বারান্দা আছে। সেখানে দুটি ইজি চেয়ার রাখা আছে। আর সামনে দেখা যাচ্ছে দৃষ্টিনন্দন সেই দৃশ্যটি, যেটি দেখার জন্য মারিয়া এতোদিন এতো উদগ্রীব ছিলো। মারিয়া এবার চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস নিয়ে আস্তে করে ছাড়লো। আর মহুয়াকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আশেপাশের সৌন্দর্য দেখাতে লাগলো।

মহুয়া মুচকি হেসে বললো,
“বারান্দাটা অনেক সুন্দর। আর সামনের দৃশ্যটা মোবাইলে এতো সুন্দর লাগছে, না জানি সামনা-সামনি কেমন লাগে!”

“অনেক ভালো লাগবে।”

“এমন একটা জায়গায় বসে আমি তো দু’একটা বই অনায়াসে শেষ করে ফেলতে পারবো। কোনো বিরক্তি আসবে না।”

“তুই এমনিতেও রুমে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা বই পড়তে পারিস। তার জন্য আর আলাদা জায়গার দরকার নেই।”

প্রহর মারিয়ার পেছনে দাঁড়িয়ে মনোযোগ দিয়ে মহুয়ার কথাগুলো শুনছে। সে কেন যে এসব কথা শুনছে, আর এসব শুনে তার কিই বা লাভ হচ্ছে সেটাও সে বুঝতে পারছে না। তবে সে এতোটুকু বুঝেছে মহুয়া তার মতোই চিন্তাভাবনা করে, তাই মহুয়ার কথাগুলো শুনতে তার ভালো লাগছে। আপতত সে এটিই ধরে নিয়েছে।

এদিকে বারান্দায় খোলা আকাশের নিচে বসে পড়ার জন্য, প্রহর একটি বই নিয়ে এসেছিলো। তাই মহুয়ার কথাটি শুনার সাথে সাথেই সে আনমনে হাসলো। কিছুক্ষণ পর মহুয়ার সাথে কথা বলা শেষ করে মারিয়া প্রহরের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“কোথায় হারিয়ে গেলেন?”

মারিয়ার কথায় প্রহর বাস্তবে ফিরে এলো। সে ভাবলেশহীন ভাবে বলল,
“কিছু না।”

তারপর ওয়াশরুমে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে প্রহর ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে সামনে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলো। প্রহর ভ্রূ কুঁচকে মারিয়াকে আপাদমস্তক একবার দেখে নিয়ে বলল,
“তুমি এটা কি পরেছো?”

মারিয়া বুকে হাত গুঁজে প্রহরের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আরেকবার নিজের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কি পরেছি?”

“তুমি ছোট ছোট জামা-কাপড় পরো?”

মারিয়া বেডের উপর পা গুটিয়ে বসে একটা বালিশ তার কোলের উপর রাখলো। তারপর গালে হাত দিয়ে প্রহরকেই পাল্টা জিজ্ঞেস করলো,
“আপনার কি মনে হয়?”

“আমার কি মনে হয় মানে?”

“আপনি কি আগে কখনো আমাকে এভাবে দেখেছেন?”

“অদ্ভুত কথাবার্তা কেন বলছো, মারিয়া? সোজাসুজি উত্তর দাও।”

“সেটাই তো বলছি। আমি ছোট ছোট জামা-কাপড় কেন পরবো? এটা আবার কেমন প্রশ্ন?”

“তাহলে এসব কি?”

“আরেহ, আপনি তো আমার বর।”

প্রহর মাথায় হাত দিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
“আজকালকার মেয়েদের একদমই লজ্জা নেই।”

মারিয়া ভ্রূ কুঁচকে প্রহরকে জিজ্ঞেস করলো,
“ফিসফিস করে কি বলছেন?”

“কিছু না, এখন যাও। একটা লম্বা প্যান্ট পরে আসো। এসব হাঁটু সমান জামা-কাপড় আমার সামনে পরবে না।”

“অদ্ভুত। আপনি আমার বর।”

“অদ্ভুত আমি না, অদ্ভুত তুমি। আমাদের মাত্র আক্দ হয়েছে। তুমি আমাকে এখনো ভালোভাবে চেনোই না। আমার সম্পর্কে এখনো কিছুই জানো না। একটা সম্পর্ক শুরু হলে, আগে তাদের ভালো বন্ধু হতে হয়। আর দেখো, তুমি এখনো অনেক ছোট। জানি না তোমার মাথায় এসব কে ঢুকিয়ে দিয়েছে। কিন্তু মারিয়া, আমি এখন চাই না, তুমি এমন ছোট ছোট জামা-কাপড় পরে আমার সামনে আসো। আর যদি তোমার অস্বস্তি লাগে, তাহলে তুমি টি-শার্ট বা ঢিলাঢালা সেলোয়াড় পরতে পারো, কিন্তু শর্ট প্যান্ট পরে আমার সামনে আসার মতো এতোটা ঘনিষ্ঠতা আমাদের এখনো হয় নি।”

মারিয়া আর কোনো কথা না বাড়িয়ে জামা পালটে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লো। এখন তার লজ্জায় কাঁদতে ইচ্ছে করছে। এভাবে প্রহর মুখের উপর তাকে লজ্জা দিয়ে দেবে সেটা সে কল্পনায় করতে পারে নি। মনে মনে সে মিতুকে বকে যাচ্ছে। এসব তার বান্ধবী মিতুরই বুদ্ধি ছিল। সেই বলেছিলো, বরের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য এমন পোশাক পরতে হয়। মারিয়া বিড়বিড় করে বলল,
“আর কখনো উনার সামনে এমন পোশাক পরবো না। এখন আমি উনার মুখোমুখিও দাঁড়াতে পারবো না। এখন উনি আমাকে কি ভাববে? মনে মনে হয়তো বেহায়া, নির্লজ্জ মেয়ে বলবে। কিন্তু আমি তো বেহায়া নয়। আমি তো বুঝতে পারি নি। আমাকে কেউ শিখিয়েও দেই নি। এটা তো আমার প্রথম অভিজ্ঞতা, তাই না? তাহলে এখানে আমার কি দোষ? আমাকে মিতু যা বলেছে, আমি তো তাই-ই করেছি।”

এদিকে প্রহর বারান্দায় চুপচাপ বসে রইলো। সে বিয়ে নিয়ে কি ভেবেছিলো, আর এখন তার সাথে কি হচ্ছে। মায়াবিনীকে না পেলেও অন্তত সে এমন মেয়ে চাই নি, যার মধ্যে কোনো দ্বিধায় থাকবে না। সে চেয়েছিলো, সেই মেয়ের মধ্যে লাজুকতা থাকবে। আর তার লজ্জা ভাঙাবে প্রহর নিজেই। আর এখন তো মারিয়ার মধ্যে কোনো লাজুকতায় নেই। লজ্জা ভাঙানোর তো প্রশ্নই উঠে না। বরং সে প্রহরকেই লজ্জায় ফেলে দিয়েছে।

প্রহর এসব ভাবতে ভাবতেই চোখ বন্ধ করলো। হঠাৎ তার মনে হলো বারান্দায় কেউ আসছে। সে চোখ খুলে মাথা তুলে পেছনে তাকিয়ে দেখলো, সাদা রঙের শাড়ি পরে একটা মেয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে। সে ভালোভাবে তাকিয়ে দেখলো, মেয়েটি আর কেউ না তার মায়াবিনী। হালকা বাতাসে মায়াবিনীর খোলা চুলগুলো উড়ছে। তার হাতে দুটি চায়ের কাপ। সে ধীরে ধীরে প্রহরের সামনে বসে একটা কাপ তার দিকে এগিয়ে দিলো। প্রহর মুচকি হেসে কাপটি নিয়ে বলল,
“ধন্যবাদ।”

মায়াবিনী আরেকটি কাপ সামনে থাকা ছোট টেবিলের উপর রেখে গালে হাত দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। মায়াবিনীর হাতে এক গুচ্ছ কাচের চুড়ি। মুখে কোনো কৃত্রিম প্রসাধনী নেই। তাকে দেখতে একদম স্নিগ্ধ লাগছে। দেখেই মনে হবে, সৃষ্টিকর্তা
খুব যত্ন নিয়ে মায়াবিনীকে বানিয়েছেন। হঠাৎ সে একটা বই প্রহরের দিকে এগিয়ে দিলো। প্রহর বইটি হাতে নিয়ে দেখলো একটা কবিতার বই।

মায়াবিনী তার মায়া জড়ানো কন্ঠে বললো,
“একটা কবিতা শুনাবেন? এমন সুন্দর পরিবেশে আপনার কন্ঠে কবিতা শুনে প্রকৃতি বিলাস কর‍তে ইচ্ছে করছে।”

প্রহর মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলল,
“তোমার জন্য আমি নিজেই একটা কবিতা লিখতে পারি।”

“তাহলে লিখুন।”

প্রহর চোখ বন্ধ করলো আর তার মায়াবিনীর জন্য কবিতা বানাতে লাগলো,
“আমার একটা স্বপ্ন ছিল,
খুব মায়াবী সেই স্বপ্ন,
খুব আবেগী সেই স্বপ্ন,
খুব চমৎকার সেই স্বপ্ন।
আমি সেই স্বপ্ন বারাবার দেখতে চাই।
এখন তুমি জিজ্ঞেস করবে, কি সেই স্বপ্ন? কেমন সেই স্বপ্ন।
আমি হেসে উত্তর দেবো,
যেই স্বপ্ন আমাকে তোমায় কাছে পাওয়ার অনুভূতি দেয়, আমি সেই স্বপ্ন দেখতে চাই। বারবার দেখতে চাই।”

মায়াবিনী প্রহরের কবিতা শুনে হাসলো। প্রহর তার দিকে তাকিয়ে বলল,
“কেমন লেগেছে আমার কবিতা?”

“এমন একটা কবি পাশে থাকলে, আর কি লাগে বলুন? আমারও কিন্তু একটা স্বপ্ন আছে।”

“কি স্বপ্ন!”

“আপনাকে স্পর্শ করতে চাই।”

প্রহর ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“আমাকে স্পর্শ করো না, তোমাকে হারিয়ে ফেলবো। আমি তোমাকে হারাতে চাই না। তুমি আমার কল্পনায় থেকো, প্লিজ। আমার তোমাকে খুব প্রয়োজন। জানি, আমার কল্পনা বাস্তবতার বিপরীতে। থাক, মানুষ কতো পাপ করে, আমি না হয় কল্পনায় পাপ করে যাবো।”

“কিন্তু এভাবে কাকে ঠকাবেন? নিজেকে নাকি যাকে বিয়ে করেছেন তাকে?”

“আমি কাউকে ঠকাতে চাই না। আমি খারাপ পুরুষ হতে চাই না। কিন্তু প্রকৃতি আমাকে কাপুরুষ বানিয়ে দিয়েছে। একদিকে আমার অবাধ্য মন, অন্যদিকে বাস্তবতা। আমি কার ডাক শুনবো?”

মায়াবিনী হঠাৎ কোনো অনুমতি ছাড়াই প্রহরের হাতটি স্পর্শ করে বলল,
“কল্পনা নিয়ে মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না। মাঝে মাঝে বাস্তবতায় মানুষকে অনেক সুখী করে। আপনি চোখ খুলে দেখুন, সুখ আপনার কাছে নিজেই ধরা দিচ্ছে। কিন্তু আপনি গ্রহণ করছেন না। একদিন সেই সুখ হারিয়ে গেলে আর কাছেও পাবেন না। যেমন, আকাশে রংধনুর স্থায়িত্ব বেশিক্ষণের জন্য হয় না, ঠিক তেমনি আমিও আপনার কল্পনায় আসা সেই রংধনু, যে আপনাকে শুধুই মুগ্ধ করবে, কিন্তু বেশিক্ষণ পাশে থাকবে না। খোলা আকাশটাই আপনার জন্য রেখে যাবে। যেই আকাশে সাদা মেঘ, কালো মেঘ, কখনো কখনো বা রঙিন মেঘের ছুটোছুটি হবে। আপনি সেই মেঘগুলোই স্পর্শ করুন। দেখবেন সুখের বৃষ্টি আপনার পিছু ছাড়বে না।”

কথাটি বলেই মায়াবিনী হারিয়ে গেলো। প্রহর সাথে সাথেই চোখ খুলে দেখলো, সে এতোক্ষণ স্বপ্ন দেখেছিলো। সে চেয়ার ছেড়ে উঠে রুমে এসে দেখলো, মারিয়া এলোমেলোভাবে ঘুমিয়ে আছে। প্রহর মারিয়ার পাশে বসে আনমনে হাসলো। মনে মনে বলল,
“বাচ্চা একটা মেয়ে!”

তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্যাগ থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষের কবিতা বইটি বের করে আবার বারান্দায় চলে গেলো। এবার সে কিছুক্ষণ নিজেকে সময় দিতে চাই।

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here