#রংধনুর_আকাশ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-০৭
১৫।
আরিয়া ফেরদৌসের মুখোমুখি জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে সূচনা। ভয়ে তার হাত পা কাঁপছে। নিজেকে বরাবরই সে সাহসী মনে করে। কিন্তু আজ এতো ভয় পাওয়ার বিষয়টা সে বুঝে উঠতে পারছে না।
মাহাথির ফোন পেয়ে সূচনা যতোটা না আনন্দিত হয়েছে, তার চেয়ে বেশি স্বস্তি পেয়েছে, যখন শুনেছে মাহাথির মা তার সাথে দেখা করতে চান। কিন্তু এই মুহূর্তে আরিয়ার মুখোমুখি বসে মনে হচ্ছে, সে কেন প্রেম করতে গেল? প্রেম না করলে এভাবে প্রেমিকের মায়ের মুখোমুখি বসে এতো এতো চিন্তায় তাকে অস্থির হতে হতো না।
সূচনার নিজেকে এই মুহূর্তে সার্কাসের প্রাণি মনে হচ্ছে। যাকে দেখতে ভীড় জমিয়েছে পাঁচজন মানুষ। সূচনার বামপাশের সোফায় বসে আছে মাফিন আর মারিয়া। ডানপাশে বসে আছে মাহাথি আর মহুয়া। তাদের দিকে একপলক তাকিয়ে সে একনজরে সম্পূর্ণ বসার ঘরটা দেখে নিলো। খুব পরিপাটি করেই সাজানো এই রুম। আরিয়া ফেরদৌস যেই সোফায় বসেছেন তার পাশে কৃত্রিম ফুলের গাছ। বসার ঘরের দেয়ালে দুইটা ক্যালিগ্রাফি ঝুলানো। আর তেমন কিছু নেই। তবে যেই মূল জিনিসটা এই ঘরটিকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে সেটি হলো দেয়ালের উপর নকশা।
সূচনা বসে বসে ভাবছে, টাকা থাকলে মানুষ নিজের সব শৌখিনতা পূরণ করতে পারে।
এসব ভাবতে ভাবতেই সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
মূলত আরিয়া ফেরদৌস সব ধরণের শৌখিন জিনিসপত্র দিয়ে ঘর সাজিয়েছেন। তবে তার ঘরে কোনো বিলাসদ্রব্য নেই। তিনি যেমনই হোক খুব শক্ত মনের মানুষ। দেখতে যা সুন্দর তা তিনি গ্রহণ করেন, তবে যে জিনিস অলসতা ও বিলাসিতার অনুভূতি দেয়, সেসব তিনি বর্জন করেন। ঠিক তেমনি তার বারান্দায় সারি সারি গাছ আছে। আবার কৃত্রিম গাছ বা শোপিসে তিনি পুরো ঘর সাজিয়েছেন। দেয়ালে দেয়ালে কারুকাজ করা আর বিভিন্ন রঙের বাতিতে ঘর ছেয়ে গেছে। কিন্তু অতি গরমের মধ্যেও তিনি কখনো এসি লাগানোর কথা ভাবেন নি। ঘরে একটা মাত্র টিভি আছে, সেটাও বন্ধ থাকে। শুধুমাত্র খেলার মৌসুমে আর ইদের আগে তিনি টিভি চালু করার অনুমতি দিয়েছেন। মহুয়া আর মারিয়ার একটাই পড়ার টেবিল। তাদের সেটিতে ভাগাভাগি করে পড়তে হয়। প্রয়োজনের বেশি কাপড়চোপড় তিনি নিজেও কিনেন না, সন্তানদেরও কিনে দেন না। আরিয়ার সন্তানদের প্রতি আবদার, প্রতিদিন যেকোনো এক বেলায় সবাইকে একসাথে খেতে বসতে হবে। সন্তানরাও তার এই আবদার ফেলতে পারে নি। তাই যতো যা-ই হোক তারা রাতে একসাথেই খেতে বসে।
আরিয়া ঘরে কোনো কাজের মানুষও রাখেন নি। তাই যার যার কাপড় বা খাবারের প্লেট নিজেদেরই ধুয়ে ফেলতে হয়, এমনকি যার যার রুম বা ওয়াশরুম তাদের নিজেদের পরিষ্কার করতে হয়। আরিয়া ফেরদৌস শুধু রান্না করে দেন। তবে মহুয়া মাকে যথেষ্ট সাহায্য করে। মারিয়াকে অনেকবার বলার পরও সে একটা কাজও ঠিকভাবে করতে পারে না। সে যা-ই করবে সেখানে কোনো না কোনো ঝামেলা হবেই। তাই মারিয়ার ভাগের কাজগুলোও মহুয়াকে করতে হয়।
এদিকে আরিয়া অনেকক্ষণ ধরেই সূচনার দিকে তাকিয়ে আছেন। সূচনা ভুল করেও তার চোখ দুটি আরিয়ার চোখের দিকে স্থির করতে পারছে না। আরিয়া ফেরদৌস হঠাৎ সূচনাকে বললেন,
“তুমি কি আমাকে ভয় পাচ্ছো?”
সূচনা মাথা তুলে বলল, “জি, না।”
মারিয়া এতোক্ষণ চুপ করে বসে ছিল। সে অপেক্ষায় ছিলো আগে কেউ কথা শুরু করবে, তারপর সেও কথা বলবে। তাই সে যখন দেখলো, মা কথা শুরু করেছে, সেও আর নিজেকে থামিয়ে রাখতে পারলো না।
মারিয়া সূচনার পাশে এসে সোফার হাতলের উপর উঠে বসলো আর বলল,
“আমি মারিয়া, তোমার কিউট ননদ। আমি তোমাকে এখন থেকে মিষ্টি ভাবী বলে ডাকবো। আমি কিন্তু কখনোই তোমার ছবি দেখি নি। তবুও তোমাকে মিষ্টি আপু নাম দিয়েছি। ভাইয়া তোমাকে এই কথা বলে নি?”
সূচনা উত্তরে সৌজন্যমূলক হাসি দিলো।
মারিয়া আবার বলল,
“তুমি কিন্তু দেখতে সত্যিই মিষ্টি। আর তুমি যা রান্না করো না! ও মাই গড। ইচ্ছে তো করে তোমার হাতটাই খেয়ে ফেলি।”
কথাটি বলেই হাসতে লাগলো মারিয়া। হাসতে হাসতে মায়ের দিকে চোখ পড়তেই সে দাঁড়িয়ে গেল।
মারিয়ার কথাগুলো শুনে মাহাথি আর মহুয়া কড়া চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। অন্যদিকে মাফিন গালে হাত দিয়ে সবার হাবভাব দেখতে ব্যস্ত।
আরিয়া ফেরদৌস এবার মারিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“তুমি ওর রান্না কবে খেয়েছো?”
মারিয়া মাহাথির দিকে একপলক তাকিয়ে আমতা-আমতা করে বললো,
“আপু একবার বানিয়েছিল। তখন খেয়েছিলাম।”
বলেই জিভ কেটে আবার মাফিনের পাশে বসে পড়লো। মাফিন মারিয়ার মাথায় ঠোকা দিয়ে চাপা স্বরে বলল,
“বেশি কথা বলিস তুই! একটু চুপ করে বসে থাক। দেখ কি হয়।”
আরিয়া সূচনাকে আবার জিজ্ঞেস করলেন,
“তোমার নাম কি? বাবা-মা কি করেন? আর ভাই বোন কয়জন?”
“আমার নাম ফারজানা হক সূচনা। আমার বাবা একজন সরকারী কর্মচারী ছিলেন, বর্তমানে তিনি অবসরে আছেন। আর আমার মা একজন গৃহিনী। আমরা মোট ছয় ভাই বোন।”
আরিয়া মাথা নেড়ে বললেন,
“হুম। তো তোমাদের সংসার কি তোমার বাবা একাই সামলাচ্ছে?”
“না, আমিও কিছুটা সাহায্য করি। আমি একটা স্কুলে পড়ায়। আর ভাইরা এখনো পড়াশুনা করছে।”
আরিয়ার হয়তো সূচনার উত্তরটি বেশ পছন্দ হয়েছে। তিনি মুচকি হাসলেন। বললেন,
“বিয়ের পরও কি তুমি চাকরি করতে চাও?”
সূচনা কথাটি শুনে মাহাথির দিকে তাকালো। মাহাথি বুঝতে পারছে না, তার মা এই প্রশ্নটি কেন করেছে? আর এই মুহূর্তে কেমন উত্তর তিনি আশা করছেন! তাই সূচনার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে সে নিচের দিকে তাকালো।
সূচনা মাহাথির হাবভাব দেখে প্রচন্ড বিরক্ত হলো। তার নিজেকে এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে একজন প্রেমিক, আর সে তার প্রেমিকার মায়ের সামনে বসে আছে। যদিও মাহাথির এই রূপ সে আগে কখনোই দেখে নি। সে এতোদিন জেনে এসেছে, তার প্রেমিক একজন নরম মনের মানুষ হলেও খুব সাহসী। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে সে পৃথিবীর সব মানুষের সামনে সাহসী হলেও একমাত্র তার মায়ের সামনেই ভীতু। এই ভীতিকে সে ব্যাক্তিত্বহীনতা বলবে নাকি মায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বলবে সেটাই সে এখনো বুঝতে পারছে না।
আরিয়ার কথায় সূচনা ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো। আরিয়া বললেন,
“আমি কি তোমাকে খুব কঠিন প্রশ্ন করেছি?”
সূচনা মাথা নেড়ে বললো,
“জি, না। কিন্তু আমি ভাবছি আমার উত্তর আপনার পছন্দ হবে কি না!”
“আমার পছন্দের উপর ভিত্তি করেই কি তুমি উত্তর দেবে?”
“আসলে আন্টি, আমি এমন একটা ফ্যামিলি থেকে উঠে এসেছি, যেখানে আমার মা আমাকে শিখিয়েছে নতুন পরিবারে গেলে তাদের কথামতো চলা আমার দায়িত্ব। তারা যা বলবে তা-ই আমার মেনে নিতে হবে। আমার কিছু সঠিক মনে হলেও আমাকে তা ত্যাগ করতে হবে। আর এমনটা যদি আমি না করি, তাহলে সবাই বাবা-মার দেওয়া শিক্ষাকে দোষারোপ করবে। কিন্তু আমি যদি এখন নিজের সিদ্ধান্তটাকে গুরুত্ব দেই, তাহলে হয়তো আমার উত্তরটা আপনার পছন্দ হবে না।”
“ঠিক আছে, আমিও জানতে চাই, তোমার উত্তরটা আমার পছন্দ হয় কি না!”
“আমি চাকরীটা ছাড়তে পারবো না। আমি চাকরীটা ছেড়ে দিলে আমার পরিবারে অভাব শুরু হয়ে যাবে। বাবা অনেক কষ্টে আমাকে পড়াশুনা করিয়েছেন। এখন তার অভাব শুরু হয়েছে। আমি কিভাবে তাদের ফেলে দেই? আজ তিনি পড়াশুনা করিয়েছেন তাই আমি কিছু টাকা আয় করতে পারছি। আর শিক্ষাগত যোগ্যতা ছাড়া তো এখন ভালো চাকরী জুটে না।”
আরিয়া মুচকি হাসলেন আর বললেন,
“আমি কিন্তু শুধুই ইন্টার পাশ করেছি। আর আমার চাকরিটা কিন্তু মোটেও খারাপ না।”
সূচনা হেসে বলল,
“অভিজ্ঞতা আর সৃজনশীলও কিন্তু মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করে দেয়। আমি শুনেছি, আপনি খুব ভালো ডিজাইনার। তবে আমার মধ্যে এমন সৃজনশীল নেই। আমি পাঠ্যপুস্তক বই পড়েই এতোদূর এসেছি। আর এখনো বাচ্চাদের পড়ানোর আগে, আমার নিজেরই একবার পড়াশোনা করতে হয়।”
আরিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন,
“দুঃখিত। আজ আমার একটা কাজ ছিল, তাই এখন আমাকে যেতে হচ্ছে। বাকী দিনগুলোতে সময় হবে না, তাই তোমাকে আজই আসতে বললাম। কারণ আমি একদম সন্ধ্যার পরেই ফ্রি হই। আর আমি চাই নি সন্ধ্যার পর তুমি একা একটা মেয়ে মানুষ এতোদূর আসো। মাহাথি বললো, তোমার বাসা এখান থেকে অনেক দূরে। এখন বেলায় বেলায় চলে যেতে অসুবিধে হবে না। আর আগামী শুক্রবার আমি মাহাথিকে নিয়ে তোমার বাসায় যাবো। বিয়ের কথা আগাতে হবে তো নাকি!”
আরিয়ার কথা শুনে মুহূর্তেই তার চার সন্তানের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। এতোক্ষণ তারা তাদের মা ও সূচনার গম্ভীর কথাবার্তা শুনছিল। আরিয়ার শেষ কথা শুনেই যেন তাদের সবার মনের আকাশে ইদের চাঁদ উঠেছে।
আরিয়া ফেরদৌস মুচকি হেসে সূচনাকে বললেন,
“চলো, একসাথে বের হওয়া যাক! আমি তোমাকে গাড়িতে উঠিয়ে দেবো। আর বিয়ের আগ পর্যন্ত তুমি আর মাহাথি একটু কম দেখাসাক্ষাৎ করো। ঠিক আছে?”
“জি, মা।”
সূচনা আরিয়ার পা ধরতে যাবে তখনই আরিয়া থামিয়ে দিয়ে বললেন,
“আমি পায়ে ধরে সালাম করাটা গ্রহণ করি না। তুমি আমায় মুখে সালাম দিলে আমি বেশি খুশি হবো।”
“আসসালামু আলাইকুম, মা।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম।”
সালাম গ্রহণ করে আরিয়া সূচনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
এদিকে মা সূচনাকে নিয়ে বের হওয়ার পর মারিয়া সোফায় উঠে লাফাতে লাফাতে বললো,
“ভাইয়ার বিয়ে হবে! আমি লেহেঙ্গা পড়বো, সাজবো, ছবি তুলবো। ওয়াও।”
মাফিন বললো,
“তাহলে বান্দরবান কে যাবে?”
“ওখানে তো বিয়ের আগেই যাবো। এতো তাড়াতাড়ি কি বিয়ে হবে নাকি?”
“আমি তো ভাবছি, বিয়ের তারিখটা ওইদিনই ফেলা উচিত। কি বলো ভাইয়া?”
মারিয়া মাফিনের কথা শুনে সোফা থেকে নেমে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
“তোমরা কেউ আমাকে ভালোবাসো না। তাই ইচ্ছে করে আমাকে ছাড়া বিয়ের আয়োজন করবে বলছো।”
মাহাথি হেসে বললো,
“আরেহ, পাগলী বোন আমার! তোদের দুইজনকে ফেলে আমি কি করে বিয়ে করবো? তুই বান্দরবান থেকে ঘুরে আয়। তারপর বিয়ের তারিখ ঠিক করবো।”
মারিয়া এক গাল হেসে বলল,
“দ্যাটস লাইক মারিয়া নাওয়াল’স ব্রাদার।”
এদিকে পরেরদিন রাতে মাফিন অনেক বুঝিয়ে মারিয়া আর মহুয়ার বান্দরবান যাওয়ার ব্যাপারে মাকে রাজি করিয়ে ফেললো। মা রাজি হওয়ার পর মারিয়া মাফিনের সাথে গিয়ে বান্দরবানে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে নিয়ে আসলো।
অন্যদিকে প্রিয়াও তার কলেজ থেকে সেদিনই বান্দরবান যাচ্ছে। যদিও মারিয়া আর প্রিয়া আলাদা কলেজে পড়ে, তবুও ভাগ্যক্রমে কলেজ থেকে তাদের একই জায়গায় পিকনিকে নেওয়া হচ্ছে। তবে কি প্রহরের মায়াবিনী মহুয়ার সাথে প্রিয়ার খুব শীঘ্রই দেখা হতে যাচ্ছে?
চলবে-