#ইস্ক,২৯,৩০ শেষ
#সাদিয়া
২৯
সেদিন ইয়াদের শাস্তি ছিল বিকেল বেলায় লং ড্রাইভে নিয়ে যেতে হবে তিতিল কে। অফিস ফেলে প্রায়শই তাকে তিতিলের এমন কিছু শাস্তি মাথা পেতে নিতে হয়। ভুলের শাস্তি তো মানতেই হতো।
শহরের কোলাহল হতে সবে নিরিবিলি রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে গাড়ি। খোশগল্পে মেতে উঠেছে দুজন। রাস্তার পাশে একটা ঝালমুড়ির দোকান দেখে তিতিল জোরে বলে উঠল,
“থামুন থামুন।”
ইয়াদ ব্রেক কষে বিরক্ত কন্ঠে বলে উঠল “আবার কি?”
“ঝালমুড়ি?”
“কি?”
“খাবো।”
ইয়াদ পিছন ফিরে দেখতে পায় ওপাশে একজন ঝালমুড়ি নিয়ে বসেছে। পরিশেষে সিলবেল্ট খুলে হাটা দেয় ওখানে। যাওয়ার আগে স্পষ্ট করে বলে যায় তিতিল যেন এখান থেকে না নড়ে। বাধ্য মেয়ের মতো গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়ে থাকে এক পাশে।
তিতিল তাকিয়ে দেখতে পেল ইয়াদ ঝালমুড়ি হাতে নিয়ে এদিকে আসছে। মাঝে মাঝে দু একটা গাড়ি ফুল স্পিডে সাই সাই করে দূরে সরে যাচ্ছে। নীরব রাস্তা বলে অনায়াসে গাড়ি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে চোখের সামনে কি হয়ে গেল বুঝল না তিতিল। অবাক হয়ে কাঠের প্রাণহীন পুতুলের মতো ঠাই দাঁড়িয়ে রইল। হাত থেকে ধুপ করে ফোন টা নিচে পড়ে গেল তার। চোখের সামনেই এমন বিদঘুটে কান্ড হয়ে গেল। ইয়াদ নিস্তেজের মতো রাস্তায় উবু হয়ে পড়ে আছে। রাস্তায় রক্ত পড়ে ভয়ংকর দেখাচ্ছে। তিতিল যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না এটা। কি থেকে কি হয়ে গেল? রাস্তায় কয়েকজন মানুষ জড়ো হতে দেখা গেল। তিতিলের চোখ ঝাপসা হতে শুরু করেছে এখন। ওই তো ইয়াদ রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় শুয়ে আছে।
ইনা মেয়েটা বেশ কঠিন স্বভাবের। শেষবার মনে হয় বাবার মৃত্যুতে কান্না করেছিল। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে ইনা হসপিটালে এলো। দুই ভাই বোন কে নিজের থেকে বেশি ভালোবাসে কিনা! মাকে কোনো রকম বুঝিয়ে হিমার কাছে রেখে এসেছে সে। উনার আবার প্রেশার বেড়ে গেছে বলে ডাক্তার পাঠিয়েই দৌড়ে এসেছে এখানে। ইয়াদের কিছু হলে বুকের ভেতর খুব ব্যথা হয় তার। হন্তদন্ত হয়ে হসপিটালে এসেই একজন কে জিজ্ঞেস করে ইয়াদের কেবিনে ঢুকল। বিছানায় নিস্তেজের মতো পড়ে আছে ছেলেটা। পায়ে, হাতে, কপালে ব্যান্ডেজ। ডাক্তার তিতিল কে বলছিল “দেখুন উনার পা টার অবস্থা তেমন ভালো না। ৩ মাসের আগে কোনো প্রেশার দিতেই পারবেন না। সম্পূর্ণ বেড রেস্টে থাকতে হবে। তাছাড়াও মাথার আঘাতটা এতটা গুরুতর না হলেও খেয়ালে রাখতে হবে। ঔষধ গুলি নিয়মিত খাওয়ালে আর যত্ন নিলে আশা করি তাড়াতাড়ি সেরে উঠবেন উনি। ও হ্যাঁ ১ মাস পরপর চেকআপ করাতে নিয়ে আসবেন।” তিতিল মাথায় সম্মতি জানাল। কথা বের হচ্ছে না তার। কেঁদে কেটে একদম বাজে অবস্থা। সে ত্রাসগতিতে এগিয়ে যায় ইয়াদের কাছে। হাত ধরে হুহু করে আবার কেঁদে উঠে মেয়েটা।
ইনা গিয়ে ভাইয়ের এমন অবস্থা দেখে বেশ রেগেই যায়।
“তিতিল খুব বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে না বিষয়টা? এতটা ন্যাকামো করার কি দরকার ছিল? প্রতিদিন কোনো না কোনো বায়না থেকেই যায় তোমার। দেখো তোমার জন্যে ভাইয়ের আজ এ কি অবস্থা। এত ন্যাকামো না করলেই কি নয়? অফিস, কাজ, ক্লাইট রেখে ছেলেটা তোমার আবদার রাখতে ছুটে। আর কত হ্যাঁ? এবার খুশি হয়েছো তো? দেখো কি করে বিছানায় পড়ে আছে।”
ইনার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল কথার ফাঁকে। তিতিল ইনার দিকে তাকিয়ে থাকে অসহায়ের মতো। ইনা রাগে কথা গুলি বললেও তার বেশ খারাপ লাগে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলতেই তিতিল তাকে জড়িয়ে ধরে আবার কেঁদে উঠে। এমন ঘটনায় ইনা অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। তিতিলের মাথায় আলতো হাত রেখে বলে “সরি তিতিল। ভাইয়ের কষ্ট আমার সহ্য হয় না। তুমি চিন্তা করো না দেখবে ভাই একদম ঠিক হয়ে যাবে। কান্না থামাও।”
তিতিলের কান্নার বেগ আরো বাড়ে। হঠাৎ অস্পষ্ট একটা স্বরে তার নাম শুনা যায় “তিতিল।”
ইনা এবং তিতিল দুজনেই তাকায় তার দিকে। ইয়াদ আধোআধো চোখে তাকিয়ে আছে। হাতটা উঁচু করার চেষ্টা করছে সে। তিতিল দৌড়ে গিয়ে ইয়াদের হাত ধরে। বলে “কষ্ট হচ্ছে তোমার?”
ইনা তিতিল কে বলল “তোমরা কথা বলো আমি বাহিরে আছি।”
ইনা চলে যাওয়ার আগে ইয়াদ মৃদু স্বরে ডাকে “আপু।”
দ্রুত ইনা এগিয়ে গেল ইয়াদের কাছে। অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করল “ভাই এখন কেমন লাগছে?”
ইয়াদের শরীর বেশ দূর্বল হওয়ায় কোনো রকম বলল ‘ ভালো ‘। বিষয়টা ইনা বুঝতে পেরে বলে “হয়েছে আর কথা বলার দরকার নেই ভাই। কষ্ট হলে বলিস কি সমস্যা। আমি বাহিরে আছি। তিতিলের এখানে থাকুক।”
ইনা চলে গেলে তিতিল ইয়াদের ব্যান্ডেজ না করা হাতটা ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। ইয়াদ বেশ কষ্ট করে তাকে কাঁদতে মানা করলেও মেয়েটা নীরবে কেঁদে যায়। নাক টেনে কিছুক্ষণ ফুপায়। তারপর ধরে আসা গলায় বলতে থাকে “আমি আর কখনোই এমন করব না। আমার ভুল হয়ে গিয়েছে। তোমার শাস্তি শেষ হয়ে গিয়েছে। আর শাস্তি দিব না আমি। তুমি তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যাও শুধু।” বলা শেষ করতেই আবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে সে।
ইয়াদ মুখ শক্ত করে তিতিলের হাতের মাঝ থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিতেই অসহায় আর ভীতিগ্রস্ত ভাবে তিতিল তাকায় তার দিকে। তবে কি ইয়াদ এবার তাকে ভুল বুঝবে? তার শাস্তির পরিপ্রেক্ষিতে তাকে কি শাস্তি পেতে হবে? কিন্তু আজ তো ইয়াদ কে সে অন্য এক কারণে নিয়ে এসেছিল। বলার আগেই শরীর কাটা দেওয়া ওমন ভয়ংকর বিদঘুটে একটা ঘটনা ঘটে গেল। এসব ভাবতে ভাবতে নিজের হাতের উপর একটা ভরসার হাতের স্পর্শ পেল সে। মাথা উঁচু করে তাকাতেই দেখতে পেল ইয়াদ স্লান হাসছে। আধোআধো গলায় বলছে,
“পাগলি তুমি আমায় জ্বালাতন করবে, আমায় শাস্তি দিবে আবার রাতে আমার ঘুমন্ত মাথাটা নিজের উষ্ণ বুকে আগলে চেঁপে ধরবে। আমার শেষ দিনটাতেও এমন রূপে চাই আমার তিতিলপাখি। বড্ড ভালোবাসি।”
তিতিল কিছু বলতে পারল না। হু হু করে কেঁদে উঠল। একটা মানুষ কি করে এত ভালোবাসতে পারে সে ধারণা করতে পারে না। কি করে মনে করবে এই মানুষটা একটা সময় তাকে কষ্ট দিয়েছিল? অথচ এত ভালোবাসা দিয়ে সে আগের সব কথা বুলিয়ে দিয়েছে তার মন থেকে। কষ্টের পর সুখ তো সূর্যোদয়!
ইয়াদের হাতে আলতো করে চুমু খেলো তিতিল। তারপর সেই হাতটা গালের সাথে চেঁপে অনুভব করতে থাকে দীর্ঘ সময় নিয়ে।
ইয়াদ আলতো হাসল। এই মেয়েটার নাম তার বক্ষস্থলে খোদাই হয়ে আছে। জীবনের শেষ নিশ্বাসটা এভাবেই এই মেয়েটা কে পাগলের মতো ভালোবেসে পাড় করতে চায়।
“আমি আপনাকে আজ এমনি এমনি নিয়ে আসি নি এখানে।” নাক টেনে বলে তিতিল।
“তবে?”
“বলব না।”
“আমি কষ্ট পাচ্ছি তাও বলবে না?”
তিতিল জবাব দেয় না। শুধু মাথা নাড়ে। ইয়াদ মুচকি হেসে তার গালের দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিতেই তিতিল জলদি হাত ধরে নিজেই নিজের গালের উপর রেখে চোখ বন্ধ করে।
“ময়নাপাখি বলো না কেন লং ড্রাইভিং এ যেতে চেয়েছিলে? বিশেষ কারণটা কি?”
ইয়াদ আজ অনেক দিন পর তাকে ‘ময়নাপাখি’ বলে ডেকেছে। এখন আবেশে মেয়েটা যেন ভাসছে। মুচকি হেসে সে উঠে দাঁড়াল। তারপর ইয়াদের হাতটা আস্তে করে নিজের পেটের উপর রেখে লজ্জা ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে নিল। ইয়াদের শরীর টা যেন কেঁপে উঠল নিমিষে। বুঝতে তার বেগ পেতে হয় নি। শরীরটা কিরূপ যে কাঁপন ধরেছে স্নিগ্ধ শিহরণে তা তিতিল কে বুঝাতে পারবে না সে। কাঁপাকাঁপা শুকনো ঠোঁটে সে বিড়বিড় করে বলল “আমার স সন্তান?”
তিতিল চোখ তুলে তাকাল। ইয়াদের চোখ তখন টলমল করছিল পানিতে। তিতিল দেখতে পেল টপটপ করে কয়েক ফুটা পানি গড়িয়ে পড়ল। শান্ত গলায় শুধু বলল “তুমি খুশি হও নি?” তিতিলের এমন কথা শুনে হুট করে তিতিলের কোমর টেনে কাছে এনেই পেটে মুখ গুঁজে বাচ্চাদের মতো শব্দ করে কান্না করে দিল। তিতিল বরফের মতো জমে গেছে ইয়াদের এমন কান্ডে। এটা তো সেই ইয়াদ যাকে সে তাকে হারানোর জন্যে প্রথম শব্দ করে কেঁদেছিল। এত বড় একটা এক্সসিডেন্ট হয়েও যে চোখের পানি ফেলেনি সে তার বাচ্চা আসার কথা শুনে এতটা কান্না করছে?
“তিতিল তুুই জানোস না আজ আমাকে কতটা খুশি করে দিলি তুই। আ আমার সন্তান আসবে দুনিয়াতে। আমার রক্ত। আমার অস্তিত্ব। তিতিল আমি আজ দুনিয়ার সব চেয়ে বেশি সুখী মানুষ। হাজার শুকরিয়া আল্লাহ কে আমাকে এত বড় নিয়ামত রূপি উপহার দেওয়ার জন্যে। আমার বাচ্চা!” ঠিক ভাবে কথা বলতে পারছিল না ইয়াদ। তিতিল ঢোক গিলল। ইয়াদের মাথায় আলতে হাত বুলাল। ইয়াদের কান্নায় তার চোখ দিয়েও পানি পড়তে লাগল। সে নিজেও হয়তো এতটা উত্তেজিত হয়নি টেস্ট করার পরে। অথচ এই লোকটা.. তিতিল দাঁত কিটে শক্ত করে জড়িয়ে নিল ইয়াদ কে।
ইয়াদ তার ঘাড়ের পিছনে হাত নিয়ে টেনে কাছে আনল। শুকনো ঠোঁট জোড়া ডুবিয়ে দিল তিতিলের মাঝে। পরম আবেশে ওষ্ঠদ্বয় স্পর্শ করেছে কি না!
চলবে
#ইস্ক
#সাদিয়া
৩০ (অন্তিম পর্ব)
“তিতিল এই তিতিল।”
ধীর পায়ে এগিয়ে এলো তিতিল। পেটে হাত দিয়ে তাকে এগিয়ে আসতে দেখে ইয়াদ দ্রুত পায়ে তার কাছে গেল। “আস্তে” বলে একটা হাত এগিয়ে দিল তিতিলের দিকে। তিতিল এক হাত ইয়াদের হাতের উপর রাখল। ইয়াদ অন্য হাত দিয়ে যত্ন সহকারে এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগল। তার ভয় পাবার কোনো কারণ নেই। কারণ দুনিয়ার সবচেয়ে নিরাপদ কোনো জায়গা যদি তার জন্যে থেকে থাকে তবে সে জায়গাতেই অবস্থান করছে সে। তাই তিতিল যেতে যেতে বলল
“নিজেই তাড়াহুড়ো করে ডাকছিল এখন বলে আস্তে।”
ইয়াদ জবাবহীন বিছানার কাছে এসে তিতিল কে বসিয়ে নিচে বসল। তারপর গরম গরম স্যুপের বাটি হাতে নিয়ে তাতে ফু দিতে শুরু করে। স্যুপের বাটি দেখে বিরক্ত হয়ে তিতিল মুখ গুড়িয়ে নেয়। নাক ফুলিয়ে বলে,
“স্যুপ খাওয়ানোর জন্যে তুমি অফিস ফেলে চলে এলে?”
“তো?”
“দেখো সময়ে অসময়ে এটা ওটা খাওয়ানোর জন্যে অফিস কাজকর্ম ফেলে চলে আসো। এটা কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি।”
“হোক বাড়াবাড়ি। এই সময়ে তোমার যত্ন নিতে হবে আমায়। প্রতিটা স্বামীর উচিৎ এই সময়টা স্ত্রীর পাশে থেকে তার যত্ন নেওয়া। আমি আমার সন্তান আর স্ত্রীর যত্ন নিচ্ছি। এটা দোষের নয়। দুনিয়ার সবচেয়ে বড় যদি কোনো দায়িত্ব থেকে থাকে তবে সেটা হলো এখন আমার স্ত্রী আর আমার বাচ্চার যত্ন নেওয়া খেয়াল রাখা। এটা যদি না করি তবে আমি বাজে স্বামীর কাতারে পড়ে যাবো। আর তা আমি মুটেও চাই না। এবার খেয়ে নাও।”
“এখন কিছু খাবো না। ইচ্ছা হচ্ছে না খেতে।”
“তবুও খেতে হবে।”
“উগলে আসে।”
“প্লিজ লক্ষ্মী সোনা আমার চোখ বন্ধ করে খেয়ে নাও জান।”
এক চামচ স্যুপ এগিয়ে দেয় তিতিলের দিকে।
“আর কখনো কাজ রেখে আসবে না।”
ইয়াদ মুচকি হাসল। তিতিল গাল ফুলিয়ে ওপাশ ফিরে আছে। ইয়াদ তিতিলের গালে আলতো হাত রেখে বলল “আমার দিকে তাকাও তিতিল। দেখো এই সময়টা মেয়েরা নার্ভাস ফিল করে। তারা সবসময় চিন্তা করে কি হবে সেই কঠিন মুহূর্তে। এমন অনেক কিছু নিয়েই তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকে। আর তখন সব স্বামীদের দরকার পড়ে নিজের স্ত্রী কে সহায়তা করা সাহস দেওয়া। কারণ এই সময়টায় সবচেয়ে বড় সাহস জুগানোর মাধ্যম হলো স্বামী। এখন যদি আমি তোমার কেয়ার না নিতাম তুমি কষ্ট পেতে, অসহায় ফিল করতে। ভাবতে তোমায় আমি ভালোবাসি না। এমন অনেক কিছু নিয়ে চিন্তা করে শরীর খারাপ করতে। তিতিলপাখি আমার স্ত্রী আর সন্তানের যত্ন আর খেয়াল নিতে হবেই আমাকে। সব কাজের বড় কাজ এটা। শুধু আমার না সব স্বামীদের স্ত্রী আর অনাগত বাচ্চার খেয়াল রাখা উচিৎ। আর কেয়ার করবে নাই বা কেন বলো তার নিজের রক্ত নিজের অস্তিত্ব ধারণ করছে মেয়েটা তাকে যত্ন নিবে না তো কাকে নিবে? আমি আমার দায়িত্ব পালন করতে জানি তিতিল। এই সময়টা আমাকে তোমার পাশে চায়। আর এতে যদি আমার ব্যবসার কোনো ক্ষতি হয় তবে হোক। একটুআধটু ক্ষতি হলে কি বা এমন হবে? ক্ষতি হতে দোষ কি?”
ইয়াদের জ্ঞানসম্পন্ন কথায় তিতিল হেসে উঠল। তার পাশেই ফ্লোরে বসে থাকা ইয়াদের মাথায় হাত রেখে চুল গুলো এলোমেলো করে দিল। মাথার পিছনে হাত রেখে এগিয়ে গিয়ে চুমু খেলো ইয়াদের কপালে। ইয়াদ অপলক তাকায় তিতিলের দিকে। কে বলবে এই মেয়েটা পিচ্চি। কিছুদিন আগেও পিচ্চির মতো দেখতে ছিল। তবে এখন কেউ দেখলে বলবে না তাকে পিচ্চি। তবুও এখনো তার কাছে সে পিচ্চি তিতিলপাখি। তিতিল কে দেখতে বেশ লাগে। চেহারায় শরীরে বেশ পরিবর্তন এসেছে মেয়েটার। ৮ মাস প্রায় শেষের দিকে। পেট ফুলে উঁচু হয়ে আছে। খানিক মুটা হয়েছে। শরীরে অল্প পানিও এসেছে। দেখলে কেউ বলবেই না এটা তার পিচ্চি তিতিল পাখি। খুব ভয় হয় তিতিল কে নিয়ে। তাই সবসময় খেয়াল রাখে তার। যখনি সময় পায় অফিস ফেলে ছুটে আসে বাসায়। কাজে ব্যস্ত থাকলে বাসায় না আসতে পারলেও ভিডিও কল করে দেখে তিতিল কি করছে না করছে, সাবধানে আছে কিনা! নামাজের প্রতিটি মোনাজাতে ইয়াদ নিজের স্ত্রী আর সন্তানের সুস্থতা কামনা করে। এই মেয়েটা তার জীবনের সবটুকু বাঁচার কারণ। জীবনের শেষ দিনটাও তিতিলের হাসিমাখা মুখটা চোখের সামনে দেখতে চায় সে।
তাকিয়ে থাকতে থাকতে ইয়াদের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানির ফোঁটা পড়ে গেল। কি ভেবে মনটা বিষণ্ণতার কালো মেঘ আকাশ জুড়ে ছুঁয়ে গেল। হুট করে সে তিতিলের কোলে মাথা গুঁজে দিল নিজেকে লুকাতে। তিতিলও বুঝল না কি হলো আবার। এই না কি সুন্দর কথা বলছিল। তিতিল মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করল “কি হয়েছে তোমার?”
“জানি না।”
“তাহলে?”
“আমার জীবনের সবটা তুই। তোকে হারানোর কষ্ট আল্লাহ যেন আমায় না দেন কখনো।”
“পাগল জানটা কিছু হবে না আমার। চিন্তা করো না। এবার উঠো। অফিস যাও।”
“ইচ্ছা হচ্ছে না।”
“আবার পাগলামি করে। দেখো ইনা আপুর নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে একটু তো সময় কাটাতে দাও উনার হাজবেন্টের সাথে।”
“আরফিন ভাইও তো কাজে ব্যস্ত।”
“তাতে কি তুমি তাড়াতাড়ি যাও তো এবার। সন্ধ্যায় চলে এসো এবার যাও।”
—-
ডালিমের দানা টুকটুক করে খাচ্ছে তিতিল। পাশেই তার কেয়ারিং হাজবেন্ট বসে আছে। সে ডালিমের খোসা ছাড়িয়ে দিচ্ছে। আজকাল তিতিলের শরীরটা তেমন ভালো যায় না। ইয়াদ অফিস যাওয়া কমিয়েই দিয়েছে। সবসময় নজরে নজরে রাখে তিতিল কে। দরকারি কাজ হলেও অনলাইনে সেরে ফেলার চেষ্টা করে বাসায় বসে। তবে খুব বেশি দরকারি কাজ হলে অফিস যায়। সব দিক সামলাতে সে হিমসিম খেলেও হাল ছাড়ে না। দায়িত্বশীল স্বামীর মতো বউ আর অনাগত বাচ্চার খুব খেয়াল রাখতে জানে সে।
রেহেলা বেগম পাশে এসে বসলেন তিতিলের। আজ সকালে ইনা আর তার স্বামী আরফিন এতগুলি ফল মিস্টি নিয়ে দেখা করতে এসেছিল। অন্যসব ফল তিতিলের ভালো না লাগলেও ডালিম তার বেশ প্রিয়। ডালিম হাতে নিলে ইয়াদ তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে সুন্দর করে খোসা ছাড়িয়ে দিচ্ছিল আর সে ইঁদুরের মতো টুকটুক করে খাচ্ছিল।
“মা তিতিল তোর শরীর টা এখন কেমন?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালোই লাগছে।”
“দিনকাল পড়ে যাচ্ছে। মা সাবধানে থাকিস। আর সবসময় আল্লাহর নাম মুখে রাখবি।”
“হ্যাঁ আম্মা। বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা।”
“কিছু হবে না চিন্তা করিস না ধৈর্য রাখ।”
“ইনশাল্লাহ আম্মা।”
মুচকি হেসে তিনি তিতিলের গালে হাত রাখলেন। ইয়াদ এবার বউ শাশুড়ির কথার মাঝে বলল,
“আম্মু কাল আমার অফিস যেতে হবে। দুপুর নাগাত চলে আসবো তুমি এর সাথে থেকো। আর ফরিদা আন্টি কে বলে দিবে কি লাগবে না লাগবে দেখার জন্যে। আর তিতিল একদম নিচে যাবে না সিঁড়ি বেয়ে।”
রাহেলা বেগম বললেন,
“চিন্তা করিস না বাবা খেয়াল রাখব তোর বউ বাচ্চার। এবার উঠি পরে একসময় আসব।”
রাহেলা বেগম চলে যেতেই তিতিল মৃদু চড় মারে ইয়াদের বাহুতে।
“আহ কি হলো?” কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করে ইয়াদ।
“তোমার কি লজ্জা করে না আম্মা কে এসব বলতে?”
“আরে পাগল নাকি? আম্মু কে বলছি এতে লজ্জার কি আছে? স্বামীরা তো আর সর্বদা বাসায় বসে থাকে না কাজে বের হতে হয়। তো ওই সময় নিজের বউমার একটুু খেয়াল রাখলে কি এমন হয়? এতে লজ্জার কি আছে বুঝাও তো?”
তিতিল জবাব দিল না। ঠোঁট উল্টে মুখ ঘুরাল। এই জ্ঞান দেওয়া ভাণ্ডারের সাথে তর্ক করে লাভ হবে না তাই চুপ থাকাই ভালো। কোনো দিন ইয়াদের তর্কের সাথে সে পেরে উঠেনি।
অফিস যাওয়ার আগে ইয়াদ সুন্দর করে বারবার বলে গেছে কোনো সমস্যা হলে তৎক্ষণাৎ তাকে যেন জানানো হয়। তিতিল স্লান হেসেছে জবাবে। চাইলেও বলনি ভোর থেকে পেটে খানিক ব্যথা তার। শুধুশুধু লোকটা দুশ্চিন্তা করবে বা অফিস যাবে না। তাই এটা আর ইয়াদ কে বলে না।
সকাল ১০ টা বেজে ৩৪ মিনিট। ব্যথা কমবে বৈ বাড়ছে। সে পিটপিট পায়ে নিচে গেল। রাহেলা বেগমের কাছে পেটে হাত দিয়ে বসে ডাকল উনাকে।
“আম্মা।”
“কিরে তোর কি কিছু হয়েছে? এমন দেখাচ্ছে কেন চোখ মুখ?”
“আম্মা পেট টা ব্যথা করছে ভোর থেকে।”
“ভোর থেকে পেট ব্যথা আর তুই এখন বলছিস? তুই কি আমাদের সেই যুগেই পড়ে আছিস নাকি?”
তিনি বেশ রাগ দেখালেন তিতিলের উপর। কিন্তু তিতিল এবার ব্যথা সহ্য করতে না পেরে মুখ বিষিয়ে তুলল। রাহেলা বেগম হিমা কে বললেন ইয়াদ কে যেন তাড়াতাড়ি এ কথা জানায়। হিমা দ্রুত ইয়াদ কে কল করে।
“হ্যাঁ রে মা ব্যথা বেশি করছে?” এই বলে তিনি তিতিলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। বেশ বুঝতে পারছে ব্যথা বাড়ছে তিতিলের। কোনো জবাব আসে না তাই।
“আমার যখন বাচ্চা হবে তখন রাত থেকে ব্যথা ছিল। শরমে তোর বাবা কিংবা কাউকে বলিনি। ভেবেছিলাম কমে যাবে। তারপর দিন সকালে ব্যথা সহ্য করতে না পেরে তোর বাবা কে বলি। তারপর হাসপাতালে নিয়ে যায় আমায়। কিন্তু খুব সমস্যা হয়ে গিয়েছিল। আজকালকার যুগেও এমন মেয়ে আছে বোকা? এই সময়টা কত সাবধানে থাকতে হয়। বোকার মতো লজ্জায় চুপ থাকলে চলবে? কিছু হবে না মা আল্লাহ আল্লাহ কর। এখনি হয়তো ইয়াদ চলে আসবে।”
হিমা অস্থির কন্ঠে বলে “আম্মু ভাইয়া তো কল ধরছে না বোধহয় কাজে আছে।”
“আরে তাহলে ইনা কে কল দে তাড়াতাড়ি করে।”
“আচ্ছা আম্মু।”
তিতিল দাঁত কিটে সোফায় শুয়ে আছে। মুখটা কেমন কালো হয়ে গিয়েছে। রাহেলা বেগমের খারাপ লাগছে সাথে ভয়। কি করবেন বুঝতে পারছেন না। আজই কেন এমন হতে গেল।
মিটিং রুমে বসে ইয়াদ ক্লাইটদের কাজ সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দিচ্ছিল। হঠাৎ ইনা এসে তাকে একটু দূরে নিয়ে যায়।
“আপু এভাবে ডাকলে কেন? দেখছিলে..”
“ভাই..” বলেই থেমে যায় ইনা। এতে আবার কপাল কুঁচকে আসে ইয়াদের। কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কি হয়েছে আপু?”
“আসলে ভাই তিতিলের পেইন উঠেছে।”
“কি বলছো?”
ইয়াদের বুকটা যেন কেঁপে উঠেছে। ভয়ে এখনো লাফাচ্ছে ভেতরটা। কথা বলার শক্তি পাচ্ছিল না আর।
“ভাই তুই ওখানে যা। আমি এদিকটা সামলে নিচ্ছি। কি হয় জানাস আমায়।”
ইয়াদ ঘড়ি দেখল। এখান থেকে যেতে অনেকটা সময় নিবে তার। তাই যেতে যেতে কোথায় কল দেয় সে।
বাড়িতে এম্বুলেন্স আসার শব্দ পেয়ে হিমা বের হলো। ইয়াদ তাকে কল করে বলে দিয়েছে এম্বুলেন্স আসলে তাড়াতাড়ি তিতিল কে নিয়ে যেন হসপিটালে চলে যায়। সে ওখানেই যাবে। তিতিলের চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। ব্যথা এবার তীব্র হতে চলেছে। কোনো ভাবে সহ্য করবে এমন নয়।
ইয়াদের ভেতরের অস্থিরতা এখনো কমেনি। স্পিডে গাড়ী চালানোর চেষ্টা করছে সে। গাড়ির ভেতর এসি চললেও ঘামছে একদম। ভেতরটা ভয় আর উত্তেজনায় লাফাচ্ছে বেগতিক হারে। কেন যেন আজ ইয়াদের কান্না করতে ইচ্ছা করছে। কেন এমন হচ্ছে সে বুঝতে পারছে না। দমটা যেন তার গলায় এসে আটকেছে। না শ্বাস নিতে পারছে আর না ফেলতে পারছে। এক অন্যরকম অনুভূতি যেন তাকে ঝাপটে ধরেছে। যা তাকে শ্বাস নিতে দিচ্ছে না।
এম্বুলেন্স পৌঁছানোর আগেই ইয়াদ হসপিটালে চলে গিয়েছিল। ভেতর থেকে যখন তিতিল কে ওমন অবস্থায় নামানো হলো তখন ইয়াদ আর সহ্য করতে পারল না। চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছা হলেও নিজেকে খুব কষ্টে সামনে নিয়ে দৌড়ে এগিয়ে গেল তিতিলের কাছে। তিতিলের হাতটা শক্ত করে চেঁপে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। তিতিলের কপালে চুমু খেয়ে যেতে যেতে বলল “কিছু হবে না। চিন্তা করো না। একটু সহ্য করো জান।”
ইয়াদ যেন দাঁত কেটে কষ্ট সহ্য করছে। তিতিল অনবরত কাঁদছে কিছু বলতে পারছে না। তবে শক্ত করে ইয়াদের হাতটা আঁকড়ে ধরে রেখেছে। চেঁপে রাখা হাতের উল্টো পিঠে ইয়াদ গভীর চুমু দিয়ে বলল,
“তিতিল বড্ড ভালোবাসি তোমায়। অপেক্ষায় থাকব তোমার। সুস্থ ভাবে আমার সন্তান কে কোলে নিয়ে ফিরে এসো আমার বুকের মাঝে। মনে রেখো তোমার ইয়াদ তোমার অপেক্ষায় থাকবে।” বলতে বলতে ইয়াদের চোখ ফেটে বৃষ্টি নেমেই গেল। নিজেকে আর সামলে রাখতে পারছিল না ডুকরে কেঁদে উঠে ইয়াদ। তিতিল কেও তাড়াতাড়ি করে ওটিতে নিয়ে যাওয়া হলো। ইয়াদ ওটির দরজায় দাঁড়িয়ে কাঁদছিল বাচ্চাদের মতো। রাহেলা বেগম এসে ছেলেকে সামলাতে ব্যস্ত হলেন। আশেপাশের অনেকে বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছেন ইয়াদের কান্ড দেখে।
খুব কষ্টে নিজেকে সামলে ইয়াদ বসে আছে। যেন নীরবে যুদ্ধ করছে।
“লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মীনাজ যোলিমীন” আর
“আল্লাহুম্মা ইন্নি আস আলুকাল আফিয়াহ্” পড়তে লাগল। নিশ্চয় আল্লাহ উত্তম দানকারী।
বেশ কিছুক্ষণ পর একজন নার্স তোয়ালে মুড়ানো একটা নবজাতক কে নিয়ে এগিয়ে এলেন। মার্জিত ভাষায় বললেন,
“মিস্টার ইয়াদ মাহামুদ আপনার বাচ্চা। পেশেন্ট বলল প্রথম আপনার কোলে দিতে।”
ইয়াদ যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। বোধগম্য হীন মানুষের মতো অবাক চোখে তাকিয়ে আছে কোলে থাকা বাচ্চাটির দিকে। রাহেলা বেগম এসে তার কাঁধে হাত রাখতেই চমকে উঠল সে। শুকনো ঢোক গিলল।
“শুধু না আমার বাচ্চা আমার বাচ্চা করতি। কোলে নে এবার।”
মায়ের কথায় ঘোর কাটে ইয়াদের। একপা একপা করে এগিয়ে যায় নবজাতকের দিকে। আবার ঢোক গিলে হাত বাড়িয়ে দেয়।
“অভিনন্দন আপনার মাশাল্লা সুন্দর একটা ছেলে হয়েছে।”
কেঁপে উঠে ইয়াদ। ছেলেকে কোলে নিয়ে নিভৃতে অঝোর দ্বারায় কেঁদে উঠল সে। তিতিল গাল ফুলিয়ে বলত “আমার ছোট্ট একটা ইয়াদ’ই চাই।”
“এটা তো মনে হচ্ছে আমার ছোট ইয়াদ।” মায়ের কথায় ঘোর কাটে ইয়াদের। এখনো শিহরণ কাটেনি তার। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে ছোট ঠোঁটের স্পর্শ দেয়। আবার কেঁদে উঠে। এটা সুখের, প্রাপ্তির কান্না! মায়ের কোলে দিয়ে আবার এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে “আমার ওয়াইফ? আমার ওয়াইফ কেমন আছে?”
নার্স কিছু বলতে যাবেন তার আগেই ইয়াদ ফের প্রশ্নের তীর এগিয়ে দেয়।
“কি হলো বলুন আমার স্ত্রী কেমন আছে?”
“শান্ত হোন মিস্টার ইয়াদ। ঘাবড়াবেন না আপনার স্ত্রী সুস্থ আছেন। একটু পর বেডে দেওয়া হবে। তখন দেখা করে নিবেন।”
ফুস করে একটা নিশ্বাস বের হয়ে এলো ইয়াদের বুক থেকে। অনেক শান্তি লাগছে তার। চোখ বন্ধ করে মনে মনে হাজারো শুকরিয়া জানায় আল্লাহর দরবারে। তারপর এগিয়ে যায় ছেলের কাছে। আবার কোলে তুলে নেয়। মনের আনন্দ সব এক সাথে জড়ো করে ছেলের কানে কানে আযান দেয় সুমিষ্ট কন্ঠে।
ছেলেকে কোলে নিয়ে ইয়াদ এগিয়ে গেল তিতিলের বেডের কাছে। ক্লান্ত হয়ে মেয়েটা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে বিছানায়। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না। তার ছোট তিতিল আরেকটা ছোট্ট বাচ্চার জন্ম দিয়েছে। ছেলের দিকে তাকিয়ে প্রাণ ভরে হাসল সে। পা টিপে বেডের কাছে গিয়ে তিতিলের বুকের সাথে মিশিয়ে রাখল ছেলেকে। তারপর তোয়ালে ভালো করে মুড়ে দিয়ে ফিসফিস কন্ঠে বলল “তোমার আম্মু এখন ঘুমুচ্ছে একটুও বিরক্ত করো না।” ইয়াদের কন্ঠ পেয়ে তিতিল চোখ খুলল। ক্লান্ত ভরা মুখটায় এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। তিতিল কে দেখে ইয়াদ তার দিকে ঝুঁকে তিতিলের কপালে চুমু দিল। বেশ সময় নিয়ে সমস্ত গভীরতার সংমিশ্রণে। তারপর পাশের চেয়ারে বসে তিতিলের হাতটা আলতো করে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
“তোমাকে ধন্যবাদ তিতিল। এত যুদ্ধ করে আমাকে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার দেওয়ার জন্যে। আমার জন্যে এতটা কষ্ট করে এত কঠিন পথ পাড়ি দেওয়ার জন্যে। আমার অস্তিত্ব কে আমার সামনে উপস্থাপন করার জন্যে আল্লাহ তা’য়ালার পরে তোমায় অসংখ্য ধন্যবাদ তিতিলপাখি।”
ইয়াদের এমন পাগলামি সম্পূর্ণ কথায় দরজার সামনে থেকে রাহেলা আর ইনা হেসে উঠে। তারপর ভেতরে প্রবেশ নাা করে চলে যায়। হিমা আরফিনের সাথে বাজারে গিয়েছে বাচ্চার জিনিসপত্র আনতে। ইনা খুশিতে কেঁদে দিয়েছিল। রাহেলা বেগম ইনার পাশে বসে বললেন,
“মা এবার তোরাও আমাকে আরেকটা নাতি দেখার সুযোগ করে দে।”
মায়ের এহেন কথায় লজ্জা মাখা রূপে হাসল ইনা।
তিতিল ছেলের দিকে তাকাল। খানিক ঝুঁকে মাথায় চুমু খেলো। ইশারায় ইয়াদ কে তার কাছে যেতে বললে ইয়াদ উঠে তার দিকে বেশ ঝুঁকে গেল। তিতিল আলতো করে ইয়াদের কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিল। পাল্টা ইয়াদও সেই চুম্বন ফিরিয়ে দিল ওষ্ঠে।
—-
ইয়াদের দায়িত্ব যেন এখন আরো বেড়েছে। ছেলে স্ত্রী অফিস সামলিয়ে নাজেহাল অবস্থা। সংসারের দায়িত্ব এখন সব তার আর তিতিলের উপর। ইয়াদ তার বাবার ছবির দিকে তাকিয়ে আছে।
“বাবা দায়িত্ব বুঝি এতটা কঠিন? কই আগে তো বুঝতে পারিনি। যখন তুমি বেঁচেছিলে তখন তো এত কিছু নিয়ে আমায় ভাবতে হতো না। কিন্তু দেখো আমিও এখন বাবা হয়েছি। আমার ইরফাতের এখন ৫ বছর চলছে। এখন সব দায়িত্ব আমার উপর। এখন আমি বুঝতে পারি প্রতিটি বাবার উপর কত টা কঠিন দায়িত্ব থাকে। বাবা সব দায়িত্ব সামলাতে সামলাতে না আমি ক্লান্ত হয়ে যাই। তবে যখন নিজের স্ত্রী বাচ্চা কে খুশি দেখি তখন সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। আবার নতুন উদ্যোগে দায়িত্ব সামলানোর শক্তি পাই অদ্ভুত ভাবে। বাবা এখন তোমায় খুব মিস করি। দেখো তোমার মতো আম্মুও ফেলে চলে গেল আমায়। যখন তোমাদের কথা মনে হয় তখন ইরফাতের দিকে তাকালে ক্ষততে যেন মলম লাগানো হয়। আমি সুখে আছি।”
তিতিল এগিয়ে এলো স্বামীর দিকে কাঁধে হাত রেখে বলল “দুনিয়ার নিয়ম এটা। তোমাকে আমাকে সবাই কেই যেতে হবে। আর দুনিয়া চলবে তার নিজের নিয়মে। এখানে কারো জন্যে কিছু থেমে থাকবে না।”
পিছন ফিরে তিতিল কে জড়িয়ে ধরল বুকের সাথে। না এখন একটু প্রশান্তির হাওয়া পাচ্ছে সে। প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিতেও পারছে।
ইরফাত এখন বেশ দুষ্টামি করে। হিমার বিয়ে হয়েছে আজ তিনদিন। ইনার ১ বছরের একটা বাচ্চা আছে। সুখের সংসার তাদের। বোন কে বিদায় দিয়ে ইয়াদের যেন বেশ কষ্ট লাগছে। দম বন্ধ হয়ে আসছিল বলে বুঝি ব্যালকুনিতে হাওয়া খেতে গিয়েছে। হিমা সবার ছোট ছিল বলে আদরটাও বুঝি ও বেশি করত। কিন্তু সেই ছোট বোন এখন অন্য কারো ঘরের লক্ষ্মী। ইয়াদ নিশ্বাস ফেলে দেয়। তপ্ত নিশ্বাস!
তিতিল পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল ইয়াদ কে। ইয়াদ চোখ বন্ধ করে তিতিলের স্পর্শ অনুভব করল। মেয়েটা যেন তার দুঃখ কষ্ট নিঃশেষের এক মারাত্মক ঔষধ।
“কষ্ট পাচ্ছো? তোমায় হ্যাপি করে দেই?”
জবাব না দিয়ে ইয়াদ তিতিলের হাতের উপর হাত রাখে। তারপর মুখামুখি করে দাঁড় করিয়ে কপাল থেকে চুল সরিয়ে দেয়। মৃদু আওয়াজে বলে,
“কিভাবে শুনি?”
“….
“কি হলো?”
তিতিল ইশারা করে তার কাছে আসার জন্যে। ইয়াদ ভেবেছে চুমু দিবে তাই চোখ বন্ধ করে মুখ এগিয়ে দেয় তিতিলের দিকে। কিন্তু তিতিল তার অনুমান ভুল করে দিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
“আমি বোধ করছি আপনার আরেকটা অস্তিত্বের।”
ইয়াদের চোখ গুলি খুলে যায়। ফুস করে নিশ্বাস ফেলে হেসে উঠে সে। তিতিলের দিকে তাকিয়ে তার বাহুতে ধরে অস্থির গলায় জিজ্ঞেস করে
“মানে?”
“মানে আমার মনে হচ্ছে আপনার আরেকটা অস্তিত্ব আসতে চলেছে। আর আপনি দ্বিতীয় বারের মতো বাবা ডাক শুনতে যাচ্ছেন।”
ইয়াদ সেদিনের মতো খুশিতে কেঁদে দিল। শক্ত করে জড়িয়ে ধরল তিতিল কে। প্রশান্তির এক ঝাঁক হওয়া তার হৃদয় কে শীতল করে দিচ্ছে। ইয়াদ বেশ বুঝতে পারছে দুনিয়াতে দিন এভাবেই কাটবে। সুখের উল্টোপিঠে দুঃখ আর দুঃখের পরে প্রশান্তি। দুনিয়া ক্রমশ যেতে থাকবেই।
—-
বসন্তের সময় চলে পুড়ে দমে। শীতের রুক্ষ শুষ্কতা দূরে ঠেলে সব দিক সবুজ হতে শুরু করে দিয়েছে। হীম হাওয়া বইছে। জানালার ধারে বসে আছে তিতিল। সেদিনের দিন গুলি সতেজ লাগছে এখনো। এই বারান্দায় কতই না কান্না করেছিল ইয়াদ তাকে পাবার জন্যে। জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো চিৎকার করে কেঁদেছিল। তার চিৎকারে চারপাশ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল একদম। দরজার ওপাশে সেও তো কেঁদেছিল নীরবে। ইয়াদের সেই কান্নার কথা মনে হলে এখনো তিতিলের শরীর কাটা দিয়ে উঠে। চোখ ভিজে উঠছে তার। বুকের ভেতরটা হাহাকার করছে শূন্যতায়। বুকের বা পাশ টা চিনচিন ব্যথা করছে তার। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। তাদের পরিপূর্ণ ভালোবাসা গুলি সজীব হতে শুরু করেছে কিনা। তিতিলের ভেতরটা প্রবল কনকনে শীতে হাঁড় কাঁপার মতো কাঁপছে। চোখ বন্ধ করতেই টিপটিপ করে পানি গড়িয়ে পড়ল।
সেদিনই না তারা বৃষ্টিতে ভিজল। তার এখনো মনে আছে ইয়াদের সেই শরীর হীম করা প্রথম ওষ্ঠের স্পর্শ। অন্তরটা আবার ডুকরে কেঁদে উঠে তার। চোখ বন্ধ করে বুকে হাত রাখল তিতিল। এই তো ইয়াদ কে অনুভব করতে পারছে সে।
“দাদুমি। ও দাদুমি।”
ইশাতের কথায় চোখের পানি লুকানোর চেষ্টা করল সে। ইয়াতের এই ছেলেটা তাকে একটু কাঁদতে দেখলেই অস্থির হয়ে যায়।
“দাদুমি তুমি আবার কান্না করছিলাম এখানে দাঁড়িয়ে?”
তিতিল গালে ভাজ পড়া চামড়া নিয়ে খানিক হাসে।
“না দাদুসোনা।”
“দাদাভাইয়ের কথা মনে পড়ছিল?”
“….
“আমার দিকে তাকাও। আমার চোখের দিকে তাকাও। তুমি না বলো আমাকে দেখতে একদম দাদাভাইয়ের মতো।”
“হুম।”
“দেখো তুমি এই বাগান বাড়িতে আছো বলে হবু বউ কে রেখে এখানে পড়ে আছি। তিনি ওদিকে রেগে লাল। তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও আমি ওর সাথে দেখা করতে যাবো।”
“দাদুসোনা তুই যা না আমি আসছি। একটু একা অনুভব করতে দে ওকে।”
“তাড়াতাড়ি করবে কিন্তু।”
বলে ইসাত তিতিলের কপালে চুমু খেয়ে চলে গেল। তিতিল আবার জানালার ওপাড়ে শূন্যে তাকিয়ে কি যেন ভাবতে লাগল।
“ইয়াদ, আমার কৈশোরের ভালোবাসা! তোমাকে ছাড়া আমার ৭ টা বসন্ত পাড় হয়ে গিয়েছে। তোমাকে এখনো অনুভব করতে পারি আমি। এখনো চোখ বুজলে তোমায় দেখি। নাক টানলে এখনো তোমার ঘ্রাণ পাই। দেখো এখনো পাচ্ছি। ইয়াদ বলতে না এই বাগান বাড়িতে তোমার দাদু অপেক্ষা করতেন উনার স্বামীর জন্যে। এখানে উনাদের কত ভালোবাসা লেগে আছে। যখন বলছিলে আমি মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম। কিন্তু আমি তো আর জানতাম না এটা আমার ভাগ্যেও লেখা ছিল। দেখো কি আশ্চর্য ব্যাপার এখানে আমাদের ভালোবাসাও লেগে আছে আনাচেকানাচে। যেদিকে তাকাচ্ছি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি। আমি তুমি আমাদের দুই ছেলে মেয়ে কতটা আনন্দময় সময় কাটিয়েছি এখানে। আর মজার ব্যাপার কি জানো? দাদুর মতো আমিও এখানে তোমার জন্যে অপেক্ষা করি। জানো ইয়াদ দাদুর মতো আমিও এখানেই শেষ নিশ্বাস টা ত্যাগ করব। আরো মজার ব্যাপার কি জানো, তুমি যেমন দাদুকে সঙ্গ দিতে তোমার নাতি ইশাতটাও না এমন আমার সঙ্গ দেয়। দেখো কত কাকতালীয় মজার ব্যাপার। ইশাতটা ইচ্ছা করে এমন করে যাতে তোমার জন্যে এত কষ্ট না পাই। দুনিয়া কেমন ক্রমবর্ধমান তাই না ইয়াদ? জীবনটা আসলে জটিল এক চক্রের মতো ইয়াদ। তোমাকে ছাড়া আমার একটুও ভালো লাগে না ইয়াদ। তোমার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে তোমার তিতিলপাখি।”
তিতিল একা একা বিড়বিড় করে তপ্ত নিশ্বাস ঝেড়ে ফেলে। ভেতরের শূন্যতাটাও কেমন সতেজ লাগছে তার। শূন্যতার হাহাকার চারিদিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে দ্রুত বেগে। ভেতরের চিনচিনা ব্যথাটা কেমন নিশ্বাস আটকে দিচ্ছে তার। চোখের কালো ফ্রেমের চশমাটা খুলে ঝাপসা হওয়া চোখের পানি টা মুছে আকাশের দিকে তাকাল। বিড়বিড় করে বলল,
“আমার সবটা জুড়ে আজ তুমি, আহ আমার ভালোবাসা! আমার ইস্ক!”
তিতিল আবার আওড়াল “এই তো আমার ইস্ক জুড়ে সবটাই তুমি। আমার ইয়াদ, আমার কৈশোরের ভালোবাসা, আমার ইস্ক!
সমাপ্ত