তবু মনে রেখো (১২ পর্ব)
.
সকাল নয়টা। সাবিনা বেগম আর মহসিন সাহেব এসে বসে আছেন হায়দার সাহেবের রুমে। ইমা নাশতা নিয়ে এলো৷ মহসিন সাহেব বললেন,
– ‘কেন কষ্ট করতে গেলে মা, আমরা তো নাশতা করেই এসেছি। আর ওদেরকে ডেকে তুলে দাও তো, দেরি হচ্ছে।’
ইমা ‘আচ্ছা’ বলে চলে যায়। সাবিনা বেগমের পরনে শাড়ি। মাথায় কালো ওড়না। গাড়ি রাস্তায়। তিনি রেডি হয়েই একেবারে এসেছেন। মহসিন সাহেব চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন,
– ‘গতকাল পরে কি হলো কিছু বললে না যে হায়দার। ছেলেকে পেয়েছিলে?’
– ‘ও হ্যাঁ, ছেলেটাকে পাওয়া যায়নি আর। ওসব চিন্তা বাদ দাও, কে না কে ছিল।’
সাবিনা বেগম আমতা-আমতা করে বললেন,
– ‘যার জন্য পালিয়েছিল, ওই ছেলে না তো আবার।’
মহসিন সাহেব হেঁসে বললেন,
– ‘চু’রি করার পর চো’র মালিককে উল্টো খুঁজতে কোনোদিন দেখেছো? এতগুলো সোনা আর টাকা পেয়ে সে আবার আসবে কোন দুঃখে।’
হায়দার সাহেব সম্মতি দিয়ে বললেন,
– ‘আমার মনে হয় মজিদার লগেই এসেছিল কোনো ছেলে। আর বানিয়ে বানিয়ে বলে দিছে এগুলো৷ এইসব মেয়েদের দিয়ে বিশ্বাস নাই৷ এরা নাটক বানাতে এক্সপার্ট।’
সাবিনা বেগম চিন্তিত হয়ে বললেন,
– ‘কিন্তু ছেলেকে দেখে তো মনে হয় না মজিদার লগে আসবে।’
মহসিন সাহেব সায় দিয়ে বললেন,
– ‘তাছাড়া মজিদাকে তো আমরা গিয়ে জিজ্ঞেস করিনি যে সে চাপে পড়ে মিথ্যে বলবে।’
হায়দার সাহেব চায়ের কাপটা রাখতে রাখতে বললেন,
– ‘ছেলে ভালো ঘরের হতে পারে। হয়তো আগে দেখা করেনি মজিদার লগে। ফোনে কথা বলতো প্রথম দেখা করেছে৷ আর তোমাদের দেখেই হয়তো মজিদা বাড়ির দিকে গেছে আর ছেলে অন্যদিকে। তাই মজিদা আগে আগে ভয়ে এইসব আবোল-তাবোল কথা বলে দিল।’
মহসিন সাহেব মাছি তাড়ানোর মতো বললেন,
– ‘বাদ দাও এই ফালতু বিষয়।’
আর কোনো কথা হলো না৷ খানিক পর মহসিন সাহেব বললেন,
– ‘তোমাদের বাজারের দোকান ইমাদ বাবাকে ছাড়া চলবে না? আমি ভাবছি কি, আমি আর সাবিনা এখন গ্রামেই থাকবো। বয়স হয়েছে এখন গ্রামেই ভালো লাগে। আর ইমাদ পুষ্পিতা ওরা বাসায় চলে যাক। মার্কেট আর বাসা ভাড়ার টাকা৷ গাড়িগুলো দেখাশোনা এগুলোর জন্য শহরে থাকাই লাগে। তাছাড়া বাসাটা তো ওদেরকেই দিয়ে দিব। গ্রামে থেকে কি করবে ওরা।’
হায়দার সাহেব খুশি হয়ে বললেন,
– ‘সমস্যা নেই, দোকান আমিই সামলাতে পারবো।’
মহসিন সাহেব সাবিনা বেগমকে বললেন,
– ‘তুমি যখন সঙ্গে যাচ্ছ, ইমাদ বাবাজিকে সবকিছু দেখিয়ে বুঝিয়ে দিয়ো। পুষ্পিতা তো আছেই।’
বাইরে গাড়ির ডাক শোনা গেল। ইমা রেডি হয়ে নাশতার ট্রে নিতে এলো। সাবিনা বেগম দেখে বললেন,
– ‘তুমি তো দেখি রেডি, ওরা কি করছে?’
– ‘রেডি হচ্ছে আন্টি।’
– ‘তাড়াতাড়ি করতে বলো মা, গাড়ি এসে গেছে।’
ইমা মাথা নেড়ে চলে যায়। খানিক পরই ওরা রেডি হয়ে বের হলো। সাবিনা বেগম বললেন,
– ‘পুষ্পিতা ড্রাইভারকে তো বলিনি কোথায় যাব। কিছু ঠিক করেছিস?’
– ‘জাফলং সাদাপাথর গিয়েছি৷ আজ না হয় বিছনাকান্দিই যাই। কি বলো ইমা?’
ইমা মাথা নেড়ে বললো ‘হ্যাঁ ঠিক আছে।’
সাবিনা বেগম ইমাদ আর পুষ্পিতাকে বললেন,
– ‘এসি আছে যেহেতু তোমরা পিছনেই বসো।’
মুচকি হেঁসে ওরা পেছনে চলে গেল। সাবিনা বেগম আর ইমা বসলো সামনে। গাড়ি চলছে। ইমাদ খানিক দূরত্ব রেখেই সিটে বসেছে। গতকাল রাতে হাত ধরে চুমু দেয়ার পর ওর চেহারার অভিব্যক্তি দেখে ইমাদ অবাক হয়ে গিয়েছিল। হাতটা যেন কোনো নর্দমায় পড়ে গেছে৷ এমনই ছিল ওর চেহারা। খানিক পর ইমাদ ভাবে তার ভুলও হতে পারে। পুষ্পিতা তো নিজেই বলেছে, আগের প্রেমিক বে*ইমান, প্র*তারক। তাকে সেদিনই ভুলে গেছে৷ ইমাদ তখন নিজের বিভ্রান্তি দূর করার জন্য লজ্জা-শরম ভেঙে পুষ্পিতার কোমল গালে হাত রাখে। চোখ মেলে তাকায় পুষ্পিতা। ইমাদ ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
– ‘একটা কথা বলি?’
– ‘কি?’
– ‘আমার প্রথম রাত থেকেই তোমাকে ভীষণ আদর করতে মন চাচ্ছে। এইযে তোমার গালে হাত রেখেছি, এটা তোমার কাছে সাধারণ, কিন্তু আমার কাছেবিশাল ব্যাপার।’
পুষ্পিতা মুচকি হেঁসে বললো,
– ‘তো আমি কি নিষেধ করেছি৷ তুমি তো একই বিছানায়ও থাকতে চাওনি।’
– ‘আমি একবার তোমার কপালে চুমু খেতে চাই।’
পুষ্পিতা স্বাভাবিকভাবেই মুচকি হেঁসে সম্মতি দেয়। ইমাদ কাছে গিয়ে কপালে ঠোঁট নেয়ার আগেই দেখে পুষ্পিতার মুখের অভিব্যক্তি বদলে গেছে। ভীষণ অবাক হয় সে। তার শরীরে কি গন্ধ খুব? পুষ্পিতা চোখবন্ধ করে নাক মুখ এমনভাবে করেছে, যেন গন্ধ সে নিতে পারছে না৷ ইমাদ তবুও চুমু খায়। পুষ্পিতা পলকেই পাশ ফিরে নেয়। ইমাদ উঠে বাথরুমে চলে গেল। হাতের তালু নিজের মুখের সামনে নিয়ে “হা” করে জোরে হাওয়া ছাড়ে৷ না কোনো গন্ধ নেই। তবুও সে দাঁত ব্রাশ করে হাতমুখ ধুয়ে বের হয়। এসে পুষ্পিতাকে পিছু থেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে ঠোঁট ছুঁয়ে খানিক পর বলে,
– ‘এদিকে পাশ ফিরে ঘুমাও।’
পুষ্পিতা পাশ ফিরে। ইমাদ ওকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে চুমু খেতে ঠোঁট এগিয়ে নিতেই পুষ্পিতা চোখ বন্ধ করে ফেলে। ইমাদের চুমু বারবার লক্ষ্যচ্যুত হয়, ঠোঁট গিয়ে অধর রেখে লাগে থুতনিতে। পুষ্পিতা যেন নিজের অজান্তেই মুখ সরিয়ে নেয়। কয়েকবার চেষ্টা করে তার আর বুঝতে অসুবিধা হয় না, এই নারীর মন সে এখনও পায়নি।
তার মাথায় আসে পুষ্পিতার একটা কথা, ‘আমার আসলে ছেলেদের ব্যাপারে পছন্দ একটু আলাদাই ছিল। আমি চাইতাম যাইহোক ভাই, আসল হলো সুদর্শন একটা ছেলে হতে হবে। বর সুন্দর না হলে টাকা-পয়সা দিয়ে কি হবে।’
ইমাদ বুঝতে পারে, পুষ্পিতা ছেলেদের রূপের ব্যাপারে খুবই সচেতন। মেয়েরা সাধারণত এমন হয় না। কত-শত রূপবতী নারী বয়স্ক, ভুড়িওয়ালা, বিরলকেশী পুরুষের কাছে বিয়ে বসে নিজের রূপ-যৌবন অবলীলায় তুলে দেয়। এভাবেই একটা জীবন কাটিয়ে দেয়। সন্তানের মা হয়। বেঢপ স্বামীর সংসারও যত্ন সহকারে করে। পুরুষদের চাই রূপবতী, নারীর চাই আর্থিক নিশ্চয়তা। এটাই তো নিয়ম। কিন্তু পুষ্পিতা এখানে অনেকটাই ভিন্ন। সেই বিবেচনায় সে কি পুষ্পিতার কাঙ্খিত পুরুষ হতে পারবে? তার তো অর্থও নেই। দেখতেও খুব একটা ভালো নয়। সেও প্রাণহীন মনহীন পুষ্পিতাকে চায় না। মনের বিরুদ্ধে পুষ্পিতা নিজেকে তুলে দিলে সে গ্রহণ করবে না। স্পর্শ করবে না। মন ছাড়া দেহ তো প্রাণহীন মৃ’ত লা’শের মতো।
গাড়ি চলছে, ইমাদ অন্যমনস্ক হয়ে বাইরে তাকিয়ে এগুলোই ভাবছিল। পুষ্পিতা আস্তে করে বললো,
– ‘ওদিকে এত কি দেখছো, আমার চেয়ে সুন্দরী কেউ না-কি?’
সাবিনা বেগম শুনে ফেললেন। মুখ টিপে হাসছেন তিনি। চোখেও পানি চলে এসেছে। এতো মিষ্টি হয়েছে মেয়েটা। কিন্তু ইমাদ বাবাজীর মনমরা কেন? গতকালই তো একসঙ্গে লুডু খেলতে দেখেছেন তিনি।
ইমাদ বাইরে থেকে চোখ ফিরিয়ে এনে স্মিথ হেঁসে বললো,
– ‘কিছু না।’
– ‘মন খারাপ না-কি?’
– ‘না না, ঠিক আছি আমি।’
– ‘বেড়াতে গেলে ফুরফুরে মেজাজে থাকতে হয়। মনমরা হয়ে থাকবে না তো।’
ইমাদ হাসলো। ড্রাইভার পিছু ফিরে তাকিয়ে বললো,
– ‘গান কি ছাড়বো?’
পুষ্পিতা সম্মতি দিয়ে বললো,
– ‘ছাড়ো সমস্যা নেই।’
তারপর দীর্ঘ সময় নীরবতায় কেটে গেল তাদের। নীরবতা ভাঙলো পুষ্পিতা। ইমাদের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেঁসে বললো,
– ‘মাইন্ড করবে না, একটা কথা বলি?’
ইমাদ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,
– ‘আচ্ছা বলো।’
– ‘তোমার চুলগুলো এমন চ্যাপটা করে আঁচড়াও কেন?’
ইমাদ বিব্রত চেহারায় হেঁসে বললো,
– ‘তাহলে কিভাবে আঁচড়াব?’
– ‘অবশ্য এভাবে চ্যাপটা থাকলেও সমস্যা ছিল না। তুমি বেশি তেল দিয়ে একেবারে চ্যাপটা করে ফেল।’
– ‘ও আচ্ছা, এরপর থেকে খেয়াল করবো।’
– ‘আরও কয়েকটা বিষয় আছে।’
ইমাদ সামনের সিটের দিকে তাকিয়ে আন্দাজ করলো গানের কারণে ওরা শুনতে পাচ্ছে না। পুষ্পিতা ফিসফিসানি ছাড়াও খুব আস্তে কথা বলতে পারে। সেও নীচু গলায় বললো,
– ‘কি কয়েকটা বিষয়, নিরদ্বিধায় বলো, আমি কিছু মনে করবো না। আমি আসলে প্রেমও করিনি, মেয়ে বান্ধবী তো ছিলই না৷ তোমাদের পছন্দ কেমন কিছুই জানি না। এগুলো নিয়ে কখনও ভাবতেও যাইনি।’
পুষ্পিতা হেঁসে বললো,
– ‘তোমাদের নিজেরই কাপড়ের দোকান আছে অথচ কাপড় পরার বেসিক সেন্সও তোমার নাই।’
– ‘বাবা, কাপড় পরারও সেন্স লাগে না-কি? আমার কি কাপড় পরা হয়নি।’
পুষ্পিতা ওর দিকে ভালো করে তাকিয়ে ফিক করে হেঁসে বললো,
– ‘হয়েছে, এইযে কোনোকিছু দেখা যাচ্ছে না। কাপড় পরা হয়েছে।’
ইমাদ খানিক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে রসিকতাট বুঝতে পারে। পুষ্পিতা কি তাকে বিপর্যস্ত করতে চাচ্ছে? ভেতরে ভেতরে কি অসহ্য লাগছে তাকে? সে নিরীহ গলায় বললো,
– ‘আমি তো আগেই তোমার কাছে স্বীকার করে নিয়েছি এসব আমি কম বুঝি। তুমি এবার রসিকতা না করে বলতে পারো। আমি এরপর থেকে সেভাবে থাকবো।’
– ‘এখন বলে কি হবে। এভাবেই তো বিছনাকান্দি যাবে, এরপর বাসায় ফিরবে। সবাই দেখবে।
– ‘আচ্ছা তারপরও বলো।’
– ‘এইযে তুমি প্যান্ট পরেছো৷ এটা একেবারে স্কিনের সঙ্গে লেগে আছে৷ টাইট প্যান্ট। এখন এই প্যান্টের সঙ্গে এমন ঢিলেঢালা শার্ট কি মানায়?’
– ‘ওরে বাবা, এরকম প্যান্ট তো সবাইই পরে।’
– ‘তুমিও পরবে তা তো সমস্যা নেই, কিন্তু এরকম টাইট প্যান্টের সঙ্গে গেঞ্জি পরতে হয়। শার্ট পরতে হয় একটু লুজ প্যান্টের সাথে।’
– ‘তাই না-কি? কিন্তু কেন?’
– ‘যে বুঝার এটুকুতেই বুঝে ফেলতো। নিজেই কল্পনা করো টাইট প্যান্টের সঙ্গে ঢিলে শার্ট। কেমন বিশ্রী লাগে।’
ইমাদ জবাবে আর কিছু বললো না। ওদের বাসায় অনেক ভাড়াটিয়া আছে। পুষ্পিতা বোধহয় তাদের নিয়ে ভাবছে। ব্যাগেই কিছু কাপড় এনেছে সে।
আমতা-আমতা করে বললো,
– ‘তাহলে তুমি টাউনে গিয়ে একটা গেঞ্জি চয়েজ করে দাও, কিনে সেখানেই পরে নিব। আর না হয় আমার ব্যাগে কাপড় আছে কিছু।’
পুষ্পিতা নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
– ‘স্যরি আমি মনে হয় অন্যভাবে বলে ফেলেছি। আচ্ছা গেঞ্জি যাওয়ার সময় নেয়া যাবে।’
ইমাদ মুচকি হেঁসে বললো,
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’
সিলেট শহরে তারা ঘণ্টা খানেকের ভেতরেই চলে এলো। আকাশের অবস্থা থমথমে। মৃদু বাতাস। ইমাদ আর পুষ্পিতা শপিংমলে ঢুকে গেঞ্জি কিনেছে, ইমাদ সেটা পরে, শার্ট ওই ব্যাগে ভরে বের হওয়ার পর পুষ্পিতা একটা দোকান দেখিয়ে বললো,
‘ওখান থেকে পকেট টিস্যু নিয়ে আসো’ বলে পুষ্পিতা গাড়িতে উঠে বসে। ইমাদ ফিরে আস্তে আস্তেই মুষলধারে বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো। সে গাড়িতে এসে উঠে বসার পর পুষ্পিতা বললো,
– ‘মা আজ বাদ দেই যাওয়া৷ বাসায় চলে যাই। কাল যাব।’
– ‘কেন রে মা?’
– ‘ভালো লাগছে না। বৃষ্টি দেখলেই কোথাও যাওয়ার ইচ্ছা মরে যায়।’
সাবিনা বেগম ড্রাইভারকে বললেন,
– ‘আচ্ছা তাহলে বাসায়ই চলে যাও।’
ড্রাইভার গাড়ি ঘুরিয়ে নিল। ইমাদ টিস্যু বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
– ‘নাও।’
পুষ্পিতা মুচকি হেঁসে বললো,
– ‘যেজন্য এনেছিলাম তার তেমন আর দরকার নেই। তোমার তেলে জবজবে চুল মোছানোর জন্য। তবুও মুছে চুল ঝেড়ে নাও।’
ইমাদ ভালোভাবে চুল ঝেড়ে-মুছে বললো,
– ‘এবার কি করবো ম্যাডাম।’
পুষ্পিতা হেঁসে বললো,
– ‘হাত দিয়ে চুলগুলো ঠিক করে নাও। খাঁড়া করে উপরের দিকে নিতে পারো।’
ইমাদ স্মিথ হেঁসে তাই করলো। মিনিট কয়েক পরই গাড়ি একটা বিশাল বাসার গেইটের সামনে এসে থামে। দারোয়ান গেইট খুলে দিল। ইংরেজি “ইউ” আকৃতির দুইতলা বাসা। মাঝখানে উঠানের মতো বিশাল পাকা জায়গা৷ সোজা সামনের গেইটে তাদের নামিয়ে দিয়ে দরজা খুলে দিল ড্রাইভার। সবাই নামে গাড়ি থেকে। সাবিনা বেগম ইমাদকে হাত দিয়ে দেখিয়ে বললেন, এই দুই পাশের সকল ফ্ল্যাট ভাড়া। আর এটাতে আমরা থাকি। ইমাদ অনাগ্রহের সুরে বললো ‘ও আচ্ছা।’
এইযে এটা গাড়ি পার্কিং এর জায়গা। আমাদের তিনটা গাড়ি ভাড়া চলে। পুষ্পিতা বাসায় ঢুকতে ঢুকতে বললো,
– ‘এগুলো পরেও দেখাতে পারবে মা, চলে আসো।’
সাবিনা বেগম ভ্যানিটিব্যাগ থেকে চাবি বের করে বললেন,
– ‘আসো ভেতরে যাই।’
দরজা খোলার পর সবাই ভেতরে গেলেন। ইমাকে নিয়ে সাবিনা বেগম নিজের রুমে চলে গেলেন। পুষ্পিতা ভেতরে গিয়ে দরজা ভেজিয়ে বললো,
– ‘আমার রুমের একটা বিশেষত্ব আছে তুমি বের করো তো।’
ইমাদ চারদিকে তাকিয়ে বিছানায় বসে বললো,
– ‘বুঝতে পারছি না।’
পুষ্পিতা জানালার পর্দা টেনে সরিয়ে বললো- ‘এই দেখো।’
ইমাদ মুগ্ধ হয়ে যায়,
– ‘বাহ, দারুণ তো। কি সুন্দর চা বাগান আর পাহাড় দেখা যাচ্ছে।’
সাবিনা বেগম ড্রিংক নিয়ে এসে সোফায় বসলেন। পুষ্পিতা বিরক্ত হয়ে বললো,
– ‘মা কাপড়ও পালটাওনি। বাসায় ঢুকেই এখানে চলে এসেছো।’
– ‘তোর কাছে আসিনি, এটা এখন শুধু তোর রুম না, আমি ইমাদ বাবাজির সঙ্গে গল্প করতে এসেছি।’
– ‘তাহলে আমি চলে যাই।’
– ‘ধ্যাৎ, বস। এসে কি শুনলাম যেন। পাহাড়ের কথা কি বলছিলে তোমরা।’
ইমাদ জানালার দিকে দেখিয়ে বললো,
– ‘ওই চা বাগান আর পাহাড়ের কথা আন্টি।’
আন্টি ডাক সাবিনা বেগমের কানে লাগলো। তিনি ড্রিংক এগিয়ে দিয়ে বললেন,
– ‘বাসাটা ভালো জায়গায়ই আছে। তবুও তোমার শ্বশুর বিক্রি করে দিতে চাচ্ছিল।’
– ‘তারপর?’
পুষ্পিতা আয়নার সামনে থেকে মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। সাবিনা বেগম অবাক হয়ে বললেন,
– ‘কেন তোমার বাবা এই বাসার ব্যাপারে কিছু বলেননি?’
– ‘না, তবে অনেক আগে একবার শুনেছিলাম বাসা বিক্রি করবেন আপনারা।’
– ‘সেটা না বাবা, এই বাসা তোমার নামে দিয়ে দিচ্ছি বলেই বিক্রি করা বাদ।’
লজ্জায় ইমাদের মুখটা মলিন হয়ে এলো। কান দিয়ে যেন গরম বাতাস বের হচ্ছে। সাবিনা বেগম কথা বলতে লাগলেন,
– ‘বাবা এই বাসা না শুধু, তোমার বাবার থেকে যেসব জায়গা কিনেছি আমরা সেগুলোর তো কাগজপত্র এখনও হয়নি। তা আর কাগজ করবো না৷ সবকিছুই তোমার বাবার সঙ্গে কথা হয়েছে। তাছাড়া তুমি ইতালি যেতে চাইলেও আমরা পাঠাবো। আমার একটা মাত্র মেয়ে। তুমি শুধু সুখে রাইখো বাবা৷ এটাই শুধু চাই। তুমি যা চাইবে তা পাবে। আমার মেয়ের সুখ ছাড়া আর কিছুই চাই না আমরা।’
কথাটি বলে সাবিনা বেগম চোখের পানি মুছলেন। ইমাদ লজ্জায়-ঘৃণায় ঘেমে গেল। ওরা কোনোভাবে কি ভেবেছে এগুলো না দিলে সে পুষ্পিতাকে সুখে রাখবে না? সরাসরি এসব কেন বলা হচ্ছে তাকে? চরম অপমানে ইমাদ খানিক্ষণ চুপচাপ থেকে বললো,
– ‘পুষ্পিতাকে সুখে রাখার জন্য এগুলোর কি সম্পর্ক। আর এসব আমাকে কি বলছেন। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’
পুষ্পিতা ভেবে পাচ্ছে না ইমাদ কি এসব জানে না? সে বিভ্রান্ত হয়ে বললো,
– ‘কেন তোমাকে না আঙ্কেল সবকিছু বলেছেন। ওইদিন তো তুমিই বললে ফার্নিচারের কথা আঙ্কেল বাজারে বলেছেন তোমাকে। সেদিনই তো এসব কথা হয়েছে।’
ইমাদ বিস্মিত হয়ে তাকালো পুষ্পিতার দিকে৷ নিজের অগোচরে তার অবস্থান এতটাই নিচে নেমে গেছে যে ওরা এসব বিষয় সরাসরি বলতেও দ্বিধাবোধ করছে না। ইমাদ খানিক রূঢ় গলায় বললো,
– ‘বাবা আমাকে এগুলো বলেননি। তাছাড়া আসবাবপত্র তোমরাই না-কি দিতে বলেছো। এটা আমি কিছুটা স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছি। সবাইই দেয়। তাই বলে এসব নেয়ার মতো ছোটলোক আমি না। আমাকে আগে বলো এই আলোচনাই বা কেন উঠেছিল।’
সাবিনা বেগম আর পুষ্পিতা অবাক হয়ে একজন আরেকজনের দিকে তাকালেন। খানিক পর সাবিনা বেগম বললেন,
– ‘কি যে বলো বাবা, ছোটলোক হবে কেন? আমাদের সবকিছু তো পুষ্পিতারই।’
– ‘আন্টি আমি এসব বিষয়ে কথা বলতে চাই না। জানি না এগুলো কিভাবে আমার সামনে বলতে পারলেন। আমি পুষ্পিতাকে সুখে রাখতে হলে এগুলো লাগবে না। আর আপনাদের সবকিছু পুষ্পিতার হলে সেটা আইনমতো নিয়মমতো সে যখন পাবার পাবে। কিন্তু এখনই আমাকে এগুলো বলার কারণ কি? আমি কি এসবের লোভে বিয়ে করেছি?’
সাবিনা বেগম অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে ইমাদের কাছে এসে বললেন,
– ‘ইয়াল্লা, বাবা তুমি ভুল বুঝতেছো কেন? আমি এভাবে বলতে চাইনি। আর ভেবেছিলাম এগুলো তুমি জানো।’
– ‘যাইহোক আন্টি, আমাকে কখনও এসব বলবেন না। আর এই বাসাটাও আমাকে দেয়া লাগবে না। আপনারা দরকার থাকলে বিক্রি করুন, না হয় ভেঙে ফেলুন। আমার কোনো সমস্যা নেই।’
পুষ্পিতা এতক্ষণ নির্বাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। সে দু’কদম এগিয়ে এসে শীতল গলায় বললো,
– ‘মা এখন তুমি যাও প্লিজ।’
পুষ্পিতার গলায় কিছু একটা ছিল। সাবিনা বেগম উঠে চলে গেলেন।
~ চলবে….
লেখা: জবরুল ইসলাম