তবু মনে রেখো (১৬ পর্ব)
.
পশ্চিমের জানালার বাইরে পাশাপাশি তিনটা কদম গাছ। এরপর পাশের বাড়ির পারিবারিক কবরস্থান। ইলহামের পালঙ্ক জানালার ঠিক পাশটায়। কবরের দেয়ালে একটা শালিক পাখি সেই কখন থেকে বসা।
সে বালিশে কনুই ঠেকিয়ে থুতনি হাতের তালুতে রেখে বিষণ্ন মনে সেদিকে তাকিয়ে আছে। প্রায় তিন মাস হয়ে গেল। এখনও সে পুষ্পিতাকে ভুলতে পারছে না। কাটা হাতের দাগ মিলিয়ে যাচ্ছে৷ অথচ হৃদয়ের ক্ষত যেন শুকাতে চায় না। তবে পুষ্পিতা কিভাবে পারে? কিভাবে অন্যের সংসার করছে? ইলহাম বিশ্বাস করতে পারে না৷ এখনও সে রোজ রাতে পুষ্পিতার ছবি দেখে চোখের জলে বালিশ ভিজিয়ে ফেলে। পুরোনো মেসেজগুলো দেখলে বুক ফেটে তার কান্না আসে। চ্যাটে এতো প্রণয়বাক্য আদান-প্রদান। দিন-রাত ফোনালাপ, যখন-তখন ভিডিয়ো কল, এইযে এতসব স্মৃতি, পুষ্পিতার কি একবারও মনে পড়ে না? কেন একবারের জন্য হলেও ফেইসবুকে ওর নামের পাশে সবুজ বাতি জ্বলে উঠে না৷ কেন হঠাৎ তার ফোনে “বিমোহিনী” নামে কল আসে না৷ কিভাবে সে বিয়ে বসলো? কিভাবে সংসার করছে! সে তো ঠিকই ভুলতে পারছে না। প্রতিটি মুহূর্তে তাকে মনে পড়ে। তার বিরহ যন্ত্রণায় কত রাত নির্ঘুম কেটে যায়। কোনোকিছুই ভালো লাগে না। কোনোকিছুতেই মন বসে না৷ সবকিছুই যেন আরও বেশি পুষ্পিতার কথা মনে করিয়ে দেয়৷ গান শুনলে কান্না গলায় দলাপাকিয়ে আসে। মুভি দেখলে মনে হয় এই নায়িকাটাই পুষ্পিতা। জিমে গেলে মনে হয় কি হবে জিম-টিম করে? পুরো জীবনটাই যেন মিথ্যে। সবকিছু থেকে আগ্রহ হারিয়ে গেছে। মাঝে মাঝে তার ইচ্ছা করে ম*রে যেতে। শুধু মায়ের জন্য পারে না। মা কত কষ্ট পাবেন তা সে জানে। মায়ের জন্যই ম’রতে ম’রতে এই বেঁচে থাকা। হেতিমগঞ্জ গিয়ে যখন শুনেছিল পুষ্পিতার বিয়ে হয়ে গেছে। তখনই তার দুনিয়াটা এলোমেলো হয়ে যায়। ফেরার পথে বাস কাউন্টারের পেছনে গিয়ে মুখ ঢেকে হাউমাউ করে কেঁদেছিল সে। খুব কষ্ট করে মা’কে ধোঁকা দিয়ে গাজিপুর থেকে দ্বিতীয়বার সিলেট গিয়েছিল। পুষ্পিতাকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা শোনার পর তার মা ভীষণ কেঁদেছিলেন। এমন কাণ্ড সে করবে তিনি ভাবতেই পারেননি। তাছাড়া ফোনে হুমকি-ধামকি। তার উপর আক্রমণ। সবমিলিয়ে তিনি একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন। তাকে রেলস্টেশন থেকে এসে রিসিভ করে নিয়েছিলেন। বাসায় গিয়ে কাতর হয়ে বলেছিলে আর যেন সিলেটের দিকে পা না বাড়ায়৷ ফোনে কথা বলা লোকগুলো ভয়ংকর। গায়ে হাত তুলে আজ ছেড়ে দিয়েছে। আরেকদিন যে কে*টে নদীতে ভাসিয়ে দিবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। নিজের মোবাইল, সোনা, টাকা-পয়সা সবই সেদিন ছিনিয়ে নিয়েছিল ওরা। এরপর থেকে তার মা আম্বিয়া বেগম কড়া নজরে রাখেন। কিন্তু বাড়িতে আসার পর থেকে কোনোভাবে পুষ্পিতার সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে পুনরায় সে সিলেট চলে যায়৷ মেসেঞ্জারে পুষ্পিতার বিয়ের কার্ডের ছবি ছিল। বিয়ে ঠিক হওয়ার পর এটা পাঠিয়ে তাকে বলেছিল, ‘দেখো কার্ড ছাপানো শেষ।’
সেই কার্ডের ঠিকানা নিয়েই সে হেতিমগঞ্জ যায়। কাজটা রিস্কি ছিল সে জানে। গ্রামের রাস্তায় গিয়ে লোকজনকে একটা মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করা মোটেও সহজ ছিল না। সবাই উল্টো নানান প্রশ্ন শুরু করেছি। গহিন গ্রামে তাকে ধরে মে*রে ফেললেও কেউ জানবে না। তবুও গিয়েছিল সে। খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে রাস্তায় মজিদার কাছে জানতে পারে পুষ্পিতার বিয়ে হয়ে গেছে। পুষ্পিতা নিজের শ্বশুরবাড়ি। এরপর ফিরে এলে মা খুব রাগারাগি করেন। তাকে জানান আজও কল এসেছিল ওই নাম্বার থেকে। ওরা টের পেয়ে খুঁজতে বেরিয়েছিল৷ পেয়ে গেলে নি’র্ঘাত মে’রেই ফেলতো। মা তার পায়ে ধরে অবধি কান্নাকাটি করেছিলেন। আর যেন সিলেট না যায়৷ মেয়েটির বিয়ে যেহেতু হয়ে গেছে আর কিছু করার নেই। সেও বলেছিল আর যাবে না। আজও যায়নি। কিন্তু পুষ্পিতাকে তো ভুলতে পারেনি সে। মেসেজ বা কল এলেই তাড়াতাড়ি হাতে নেয়। এই বুঝি বিমোহিনী নামটা ভেসে উঠবে। কিন্তু তার বিমোহিনী কখনও আর মেসেজ বা কল দেয় না। প্রথম প্রথম প্রায়ই পাগলামি করতো। হেতিমগঞ্জ থেকে এসে রাতে হাত-টাত কেটে র’ক্তা-র’ক্তি কাণ্ড করেছিল। সবাই ধরাধরি করে পাশের ক্লিনিকে নিয়ে যায়। সেসব এখন আর করে না। আম্বিয়া বেগম তাকে সব সময় চোখে চোখে রাখেন। গতকাল রাতে খাওয়ার টেবিলে বললেন,
– ‘আমাদের স্কুলে একজন এক্সট্রা টিচার দরকার। স্কুলে প্রতিদিন একবার আয় না। তাহলে দিনও কাটবে। নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি স্কুলে পড়ালে মন্দ কি?’
ইলহাম মাথা নেড়ে বলেছে,
– ‘আচ্ছা মা সমস্যা নেই যাব।’
মা তাকে ব্যস্ত রাখতে চান সে বুঝতে পারে। খানিক পর দরজায় নক পেয়ে সে ভাবনা থেকে চমকে উঠে। এভাবেই সারাক্ষণ ডুবে থাকে নিজের ভেতর। দেয়ালে শালিক পাখিটি এখন আর নেই। ইলহাম উঠে দরজা খুলে দিল। এই একটা বদ অভ্যাস হয়েছে। সারাক্ষণ এখন দরজা বন্ধ করে অন্ধকারে পড়ে থাকে।
– ‘কিরে বাবা, রেডি হয়ে যা। কাল কি বললাম।’
– ‘রেডিই আছি মা। শুধু গেঞ্জিটা পরে নিচ্ছি।’
ইলহাম গেঞ্জি গায়ে দিয়ে মায়ের সঙ্গে স্কুলে চলে গেল। জোহরের আগেই আবার সে চলে এলো বাড়িতে। তাসনিম তখন কল দিল। তাসনিম তার মামাতো ভাই। রিসিভ করলো ইলহাম,
– ‘হ্যালো।’
– ‘কিরে ইলহাম বাড়িতে আছিস?’
– ‘হ্যাঁ আছি তো, তুই কোথায়?’
– ‘আমি তোদের বাড়িতে আসছি। রাস্তায় আছি।’
– ‘আচ্ছা আয়।’
তাসনিম বিকেলেই চলে এলো। আম্বিয়া বেগম ফিরলেন তার কিছুক্ষণ আগে। দরজা খুলে তাসনিমকে দেখে অবাক হয়ে বললেন,
– ‘আরে তুই? আয় আয়, কি মনে করে। বাবা এতদিন পর ফুপুর কথা মনে পড়লো বুঝি।’
তাসনিম মুচকি হেঁসে বললো,
– ‘কেন তুমি কি জানতে না আমি আসবো।’
– ‘না তো।’
– ‘ইলহাম কই, তাকে কল দিয়েছিলাম তো।’
– ‘আর বলিস না ওর কথা। বস তুই আসছি।’
আম্বিয়া বেগম তাকে এনে ড্রিংক দিলেন। বসলেন সামনের সোফায়। তাসনিম চুমুক দিয়ে বললো,
– ‘ইলহাম কই?’
– ‘ওরে নিয়ে যে কি যন্ত্রণায় আছি বাবা বলে বুঝাতে পারবো না।’
– ‘হ্যাঁ শুনেছি আম্মুর কাছে। হাত-টাত না-কি কেটে ফেলেছিল।’
– ‘হ্যাঁ, এইতো সারাক্ষণ দরজা বন্ধ করে পড়ে থাকে। রাতেও ঘুমায় না। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে৷ খাওয়া-দাওয়ারও ঠিক নাই।’
– ‘বলো কি, এই অবস্থা৷ ও তো আগে জিম -টিম করতো। অনেক ফ্যাশন সচেতনও ছিল।’
– ‘সেসবের কিছুই এখন নাই বাবা।’
– ‘এখন কই, আমি তো কল দিয়েই এলাম।’
– ‘এইতো স্কুলে নিয়ে গিয়েছিলাম চলে এলো। এখন দরজা বন্ধ করে রুমে পড়ে আছে। এরকমই চলছে বাবা। কোন কা*লনাগিনীর পাল্লায় যে ছেলেটা পড়েছে আল্লাহই জানেন।’
তাসনিম উঠে গ্লাস রেখে ইলহামের রুমের দিকে গেল। দরজায় চাপড় দিয়ে ডাকলো সে,
– ‘ইলহাম, এই ইলহাম।’
ইলহাম দরজা খুলে দিল,
– ‘আরে তুই এসে গেছিস। আয় বস এসে।’
– ‘কই বসবো শা*লা পা*গল৷ ঘর অন্ধকার কেন।’
– ‘ওয়েট জানালা খুলে দিচ্ছি।’
ইলহাম জানালা খুলে দিল। তাসনিম চেয়ার টেনে বসে হেঁসে ফেললো ওর দিকে তাকিয়ে।
– ‘তুই তো ছ্যাঁকা খেয়ে একেবারে ব্যাঁকা হয়ে গেছিস রে।’
ইলহাম বিছানায় বসে ফ্যাকাসে মুখে হেঁসে বললো,
– ‘তোর খবর কি?’
– ‘আমার খবর আবার কি। আমার তো সব স্বাভাবিক। খবর তো তোর কাছে। গাঁ*জাখোরের মতো অবস্থা কি করে হলো।’
ইলহাম কিছু না বলে কেবল হাসলো।
– ‘আচ্ছা কিরকম কি বলতো। আমি এসে মায়ের কাছে শুধু শুনলাম এগুলো। এতো সিরিয়াস অবস্থা জানতাম না। ফেইসবুকে না-কি প্রেম? ফেইসবুকের প্রেম এতো সিরিয়াস হয় কিভাবে? বাচ্চামো ছাড়া কিছু হইল এগুলো?’
– ‘বাদ দে তাসনিম। চল বাইরে যাবি?’
– ‘বাইরে কেন, আর রুমে দেখি সিগারেটের গন্ধ। সিগারেট খাওয়া ধরেছিস না-কি?’
– ‘হ্যাঁ, একটু-আধটু খাই এখন।’
তাসনিম হেঁসে ফেললো।
– ‘তুই না সিগারেট খাওয়া নিয়ে জ্ঞান দিতি। সব জ্ঞান হাওয়া হয়ে গেছে তাহলে?’
ইলহাম লাজুক হেঁসে বললো,
– ‘চল তো বাইরে চল। সিগারেট আনতেই যাব।’
দুইজন বাইরে যাচ্ছে দেখে আম্বিয়া বেগম পেছনে এসে বললেন,
– ‘কোথায় যাও তোমরা।’
ইলহাম দরজা খুলে বললো,
– ‘বাইরে মা, সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসবো।’
পাকা রাস্তা ধরে দু’জন হাঁটছিল। তাসনিম ওর কাঁধে হাত রেখে বললো,
– ‘মেয়েটার সঙ্গে যোগাযোগ কি একেবারে নেই? মানে হয়েছে কি? আমি তো পুরোপুরি জানি না।’
– ‘ভাব ধরছিস। সবই জানিস।’
– ‘আরে না, আমি বাড়িতেই তো আসি না।’
– ‘তুই না-কি মেসে থাকিস এখন।’
– ‘হ্যাঁ, মামা চট্টগ্রাম থেকে ট্রান্সফার হয়ে অন্য জায়গায় চলে গেছেন। আমার ভার্সিটি থেকে দূরে।’
– ‘ও আচ্ছা, বুঝেছি।’
– ‘এড়িয়ে যাচ্ছিস কেন বল। শা*লা তুই আবাল না-কি। প্রেম কি বন্ধু-বান্ধবদের লুকানোর কিছু।’
ইলহাস হেঁসে বললো,
– ‘আরে তা না, তোর সঙ্গে তো দেখাই হয় না। বলবো কিভাবে।’
– ‘তাইলে আজ বল। তোর মতো ফুটানি মারা পোলার এই অবস্থা কিভাবে হইল জানতে আগ্রহ হচ্ছে।’
ইলহাম পাশের দোকানে গিয়ে সিগারেট নিয়ে এলো।
– ‘চল সামনের ব্রিজে গিয়ে বসি।’
– ‘হুম চল।’
দু’জন ব্রিজের রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরালো। তাসনিম সিগারেটে টান দিয়ে বললো,
– ‘মেয়েটার ছবি দেখাবি না?’
ইলহাম মোবাইলের পাওয়ার বাটনে ক্লিক করে ওর সামনে ধরলো।
– ‘বাব্বাহ ওয়ালপেপার দেয়া। কিন্তু ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে না৷ ফটো দেখা বের করে।’
– ‘এটা কি ফটো না।’
– ‘থাক ভাই দেখানো লাগবে না৷ আমার গার্লফ্রেন্ডকে দেখবি? শা*লা ও তোর নাম পর্যন্ত জানে। তোকে রাস্তায় দেখলে চিনে ফেলবে। আর তোর কাছ থেকে কোনো কথা বো*মা মা*রলেও বের হয় না।’
ইলহাম হেঁসে মোবাইল থেকে একটা ছবি বের করে দেখালো। পুষ্পিতার পেছনে চা বাগান। পরনে কালো কামিজের উপর গোলাপি কটি। তাসনিম দেখে বললো,
– ‘বাহ সুন্দর তো। মেয়েটির বাড়ি কোথায় রে?’
– ‘সিলেট।’
– ‘সিলেট কোথায়।’
– ‘জেলা কোথায় জানি না। গ্রামের নাম হেতিমগঞ্জ।’
– ‘হেতিমগঞ্জ, মানে হবিগঞ্জের হেতিমগঞ্জ।’
ইলহাম অবাক হয়ে বললো,
– ‘আরে তুই চিনিস না-কি? কিভাবে চিনিস বল।’
– ‘আমার রুমমেটের বাড়ি হেতিমগঞ্জ। ওর বাবা চেয়ারম্যান। গ্রামের নাম মনে আছে কারণ ওর বাবা নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিল তো। ওর ফেইসবুকে আর মুখে সারাক্ষণ এগুলোই ছিল।’
ইলহাম সিগারেট ছুড়ে ফেলে ওর হাত ধরে ফেললো,
– ‘তোর ফ্রেন্ডের সঙ্গে আমি দেখা করতে চাই। প্লিজ তাসনিম৷ তুই আমাকে একটা হেল্প করতে হবে।’
__চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম