#রংধনুর_আকাশ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-১২
২৩।
আরিয়া ফেরদৌসের মুখোমুখি বসে আছেন খন্দকার রফিক। তার হাতে অনেকগুলো মেয়ের বায়োডাটা। আর তিনি সেগুলো একটার পর একটা আরিয়া ফেরদৌসকে দেখাচ্ছেন। আরিয়াও মনোযোগ দিয়ে প্রতিটি বায়োডাটা দেখছেন। হঠাৎ তার চোখ আটকে গেল একটি নামে। তিনি সেই নামের নিচে পরিচয়টি দেখে বললেন,
“এই মেয়ের ছবি আছে আপনার কাছে?”
খন্দকার রফিক বললেন,
“জ্বি, আপনি চাইলে আমি আজই আপনাকে ছবিটি পাঠাতে পারি।”
এদিকে সূচনা অন্যমনস্ক হয়ে পার্কে বসে আছে। আর তার পাশে বসে এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে মাহাথি। হঠাৎ একটি বাচ্চা মেয়ে তাদের দিকে এগিয়ে এসে বলল,
“ও আফা, ও ভাইয়া আঁত্তুন বউত ডইল্লে ফুলুর চারা আছে। তোয়ারা লইবা নে?”
(আপা-ভাইয়া আমার কাছে অনেক ধরণের ফুলের চারা আছে। আপনারা কি নিবেন?)
সূচনা মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“তোমার কাছে কি কি চারা আছে?”
“গোলাপ, গাঁদা, রজনীগন্ধা, জবা, কদম, আর সূর্যমুখী।”
“তোমার কাছে এতোগুলো চারা আছে?”
“অইয়ো আফা। লইবে নি?”
(হ্যাঁ, আপা। নিবেন নাকি?)
“তুমি এই ফুলগুলো কোথা থেকে এনেছো?”
“আরোর বাগোনোরত্তুন আন্নি।”
(আমাদের বাগান থেকে এনেছি।)
“বাহ তোমাদের বাগান আছে?”
“ও আফা, আর চাচা ফুলুর চাষ গরে। চারা ইন আঁই এডেত্তুন আন্নি।”
(হ্যাঁ, আপা। আমার চাচা ফুলের চাষ করে। আমি চারাগুলো সেখান থেকেই এনেছি।)
“গোলাপের চারার দাম কতো হবে?”
“একশো পঞ্চাশ টিয়া।” (একশো পঞ্চাশ টাকা।)
“একটা দাও।”
মেয়েটি একটা গোলাপ ফুলের চারা এনে সূচনার হাতে ধরিয়ে দিলো। আর সূচনা মেয়েটির হাতে টাকা দিয়ে বলল, “ভালো থেকো।”
মেয়েটি মাথা নেড়ে চলে গেলো। সূচনা এবার চারাটি ভালোভাবে নেড়েচেড়ে দেখে বলল,
“মাহা, তুমি কি জানো গোলাপ ফুলের অনেক যত্ন নিতে হয়?”
“হুম, মা ছাদে অনেক গোলাপ ফুল লাগিয়েছে। মাকে সেই ফুল গাছের পেছনে অনেক সময় দিতে দেখেছি।”
“মেয়েদের জীবনটাও অনেকটা এমন। তাদের আলাদা যত্ন নিতে হয়। এই সমাজে তারা যতোই নিজের পায়ে দাঁড়াক না কেন, দিনশেষে একজন পুরুষই আসে তার দায়িত্ব নিতে। কিন্তু সেই দায়িত্ব নেওয়ার পর কেউ যদি ঠিকভাবে সেই দায়িত্ব পালন না করে, তখন মেয়েদের জীবনটা মলিন হয়ে যায়। যেমনটা, একটা ফুলের চারা তুমি যতো দাম দিয়েই কিনো না কেন! সেই চারার মূল্য যত্ন না নিলে থাকে না।”
“তুমি হঠাৎ এসব কথা আমাকে কেন বলছো?”
“আন্টি তো বলেছেন বাসায় এসে বাবা-মার সাথে কথা বলবে। কিন্তু এখনো তো আসেন নি। এইদিকে আমি মাকে বলে ফেলেছি আন্টি বাসায় আসবে। আর এখন মা আমাকে প্রতিদিন জিজ্ঞেস করছে, কবে আসবে? এখনো কেন আসছে না? এখন আমি মাকে কি উত্তর দেবো বলো?”
মাহাথি নরম কন্ঠে বললো,
“এই মেয়ে, তুমি কি ভাবছো বলো তো? মা অবশ্যই যাবে। একটু ধৈর্য ধরো। মা হয়তো কোনো ব্যাপার নিয়ে চিন্তিত।”
সূচনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“তুমি কি বুঝতে পারছো না আমার বয়স হয়ে গেছে? আমি তোমার কথা মাকে বলেছি। কিন্তু বাবাকে বলার সাহস নেই। মাও নিশ্চিত না হয়ে বাবাকে কিছুই বলতে চাইছে না। আর এদিকে বাবা একপ্রকার যুদ্ধ করছে আমার সাথে।”
মাহাথি বলল,
“সরি। আমি আজই মায়ের সাথে কথা বলবো।”
সূচনা চারাটি মাহাথির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“এই চারাটি আন্টিকে দিও।”
কথাটি বলে সূচনা উঠে দাঁড়ালো। মাহাথি সূচনার হাত ধরে বলল,
“আরেকটু বসো।”
“বেশি মায়া বাড়াতে চাই না। যদি আবার হারিয়ে ফেলি?”
মাহাথি সূচনার কথা শুনে থমকে গেলো। সে মনে মনে ভাবলো,
“সূচনা তুমি আমার মাকে ভুল ভাবছো। মা একবার যেহেতু বলেছে তোমার বাসায় যাবে, সে যাবেই।”
বাসায় এসে মাহাথি চুপচাপ বসে রইলো। আরিয়া ছেলেকে নিরব বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,
“মাহাথি, কি হয়েছে তোমার? এভাবে বসে আছো কেন?”
“মা, তেমন কিছু হয় নি। তুমি বসো।”
আরিয়া বসে মাহাথির দিকে একটি মেয়ের ছবি এগিয়ে দিয়ে বললেন,
“দেখো তো একবার ছবিটি!”
মাহাথি দেখলো একটা সাদা শাড়ি পরিহিতা মেয়ে একটা দোলনার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটির গায়ের রঙ হালকা চাপা, তবে তার চেহারায় অসম্ভব মায়া। আর তার হাসিটাই মাহাথির বেশি আকর্ষণীয় লাগছে।
সে এবার মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
“মা, তুমি হঠাৎ এই ছবিটি আমাকে কেন দেখাচ্ছো?”
“তুমি আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও, তারপর বলছি। মেয়েটিকে কেমন লেগেছে?”
মাহাথি কিছুটা ইতস্তত ভাব নিয়ে বলল,
“খারাপ না, ভালোই।”
“হুম, তোমার পছন্দ হয় নি তো?”
মাহাথি একবার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মেয়েটি অপছন্দ হওয়ার মতো নয়। কিন্তু এই ছবিটি আমাকে কেন দেখালে?”
“তোমার কি মনে হচ্ছে?”
“আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”
“আচ্ছা, তাহলে শুনো। তোমার আর সূচনার সম্পর্কে আমার কোনো আপত্তি নেই। মেয়েটিকে আমার পছন্দ হয়েছে। কিন্তু তুমি তো জানোই আমার প্রেমের সম্পর্কে আস্থা নেই। আমি আমার চোখের সামনেই প্রেমের সম্পর্কগুলো নষ্ট হতে দেখেছি। আমি জানি না এই পৃথিবীতে কোন প্রেমের সম্পর্ক সুস্থ, তবে এটা জানি আমার সামনে যতোগুলো প্রেমের সম্পর্কে গড়েছিলো প্রায় সবগুলোই অসুস্থ। আমার তাই ভয় হচ্ছে। আমি চাই না তোমার মতো ভুল মাফিন করুক। তাই আমি ভাবছি, তোমার আর মাফিনের বিয়েটা আমি একসাথেই দিয়ে দেবো। এখন মাফিনকে এই ছবিটি দেখিয়ে বিয়ের জন্য রাজী করানোর দায়িত্ব তোমার। মাফিন রাজী হলেই আমি পাত্রীপক্ষের সাথে কথা বলবো।”
“যদি রাজী না হয়!”
“তাহলে তোমার আর সূচনার বিয়েটা পিছিয়ে যাবে। তবে আমি আগামীকাল সূচনার বাবা-মার সাথে দেখা করবো। কথাটা পাকাপাকি করে রাখবো। কিন্তু বিয়েটা মাফিন রাজী হওয়ার পরই হবে।”
“মা, তুমি কি আমাকে শর্ত দিচ্ছো?”
“এছাড়া আমার আর কোনো উপায় নেই। যেহেতু মাফিনের কোনো পছন্দ নেই, সেহেতু ওর আমার পছন্দমতো মেয়েকে বিয়ে করতেও কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু সমস্যা একটাই। আর সেটা হলো ও এখন বিয়ে করতে চাইবে না। আর আমি চাই, ও বিয়ে করুক। আর ওকে রাজী করানোর একমাত্র উপায় তোমার আর সূচনার বিয়েটা আটকে রাখা। হয়তো আমার এমন আচরণ তোমার খুব অদ্ভুত লাগছে। কিন্তু আমি নিরুপায়। আমি সত্যিই চাই এই বাড়িতে আর কোনো প্রেমের বিয়ে না হোক। তোমারটা না হয় মেনেই নিলাম। কিন্তু বাকীগুলো নিতে পারবো না। মহুয়া খুব শান্ত মেয়ে। ও হয়তো আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে যাবে না। কিন্তু মারিয়া আর মাফিন! ওরা তো নিজেদের ইচ্ছেমতো চলাফেরা করে।”
“তাই বলে এভাবে শর্ত দিয়ে ওকে বিয়েতে রাজি করানো আমার পক্ষে সম্ভব না।”
“তবুও একবার শর্ত ছাড়াই বলে দেখো। যদি রাজি হয়ে যায়!”
মাহাথি দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে চলে গেলো। আর আরিয়া সেখানেই চুপচাপ বসে রইলেন।
এদিকে-
বাতিঘর থেকে বেরোনোর সাথে সাথেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। মহুয়ার কাছে কোনো ছাতাও ছিলো না। সে একপাশে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির স্নিগ্ধতা অনুভব করতে লাগলো।
এদিকে প্রহরের আজ একটু দেরী হয়ে গেলো বাতিঘরে আসতে। সে মনে মনে ভাবছিলো, হয়তো এই সপ্তাহে তার আর মায়াবিনীকে দেখা হবে না। এসব ভাবতে ভাবতেই সে তড়িঘড়ি করে বাতিঘরে ঢুকতে যাবে তখনই তার মায়াবিনীকে দেখে থমকে দাঁড়ালো।
দমকা হাওয়ায় মহুয়ার চুলগুলো উড়ছে। আর প্রহর দেখছে এলোকেশী নৃত্য। মহুয়ার দৃষ্টি আটকে আছে বৃষ্টি কণার মাঝে। পিচঢালা রাস্তায় সেই বৃষ্টি কণা দেখতে মুক্তোর মতো লাগছে। হঠাৎ মহুয়ার চোখ পড়লো প্রহরের দিকে। প্রহর এখনো মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার মায়াবিনীকে দেখায় ব্যস্ত।
এদিকে একটা অপরিচিত ছেলে হাঁ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে, যা দেখে রীতিমতো মহুয়া লজ্জায় পড়ে গিয়েছে। সে এক মুহূর্তও আর সেখানে দাঁড়ালো না। বৃষ্টির মধ্যেই সে নেমে পড়লো রিকশা খুঁজতে। প্রহরও ব্যাপারটি বুঝতে পেরে থতমত খেয়ে গেলো। সে তার মায়াবিনীর পিছু যাবে নাকি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে তা বুঝে উঠার আগেই মহুয়া রিকশায় উঠে পড়লো। প্রহর আর বাতিঘরে ঢুকলো না। সে সোজা বাসায় চলে এলো।
চলবে-