#রংধনুর_আকাশ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-৩৩ (সাজেক স্পেশাল-০২)
৫৬।
সকালে ঘুম ভাঙতেই মারিয়া পাশ ফিরে দেখলো প্রহর তার পাশে নেই। এরপর আশেপাশেও কোথাও প্রহরকে না দেখে সে বিছানা ছেড়ে উঠে বারান্দায় এসে দেখলো, প্রহর একটা ম্যাট্রেস বিছিয়ে ঘুমাচ্ছে। সে মনে মনে ভাবলো,
“উনি কি সারারাত এখানেই ঘুমিয়েছেন?”
মারিয়া রুমে এসে দেখলো টেবিলে রাতের খাবার রাখা। সে এবার চুপচাপ ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো।
এখনো সূর্য উঠে নি। তবে উঠার প্রস্তুতি নিচ্ছে। মারিয়ার অনেক দিনের স্বপ্ন সে সাজেকে এসে এই দৃশ্য নিজ চোখে উপভোগ করবে। কিন্তু আজ এই সৌন্দর্য তাকে কাঁপিয়ে তুলছে না। সে একদম নির্জীব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার বুকটা কেমন খালি খালি লাগছে। তার মনে হচ্ছে, সে জীবনে প্রথম কারো কাছে অপমানিত হয়েছে। এই বয়স পর্যন্ত সে অনেকবার মা আর ভাইদের বকুনি খেয়েছে, স্কুল-কলেজেও শিক্ষকদের বিভিন্ন শাসনের মুখোমুখি হয়েছে। কিন্তু গতকাল তার জীবনে আসা নতুন মানুষটিই তাকে অপমান করেছে। এটা তার কাছে কোনোভাবেই বকুনি বা শাসন মনে হচ্ছে না। এটা তার কাছে অবহেলা মনে হচ্ছে।
মারিয়া এক দৃষ্টিতে সূর্যোদয় দেখছে। হঠাৎ প্রহর চোখ খুলে মারিয়াকে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বেড ছেড়ে উঠে মারিয়ার পাশে এসে দাঁড়ালো। প্রহরকে দেখে মারিয়া কিছুটা দূরে সরে দাঁড়িয়ে, উড়না ঠিক করে নিলো। প্রহর মারিয়ার ইতস্তত ভাব দেখে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“কাল সন্ধ্যায় ওভাবে বলেছি, তাই তুমি রাগ করেছো, তাই না?”
মারিয়া কোনো উত্তর দিলো না। প্রহর আবার বলল,
“ভেবেছি রাতে তোমার ঘুম ভাঙবে। কিন্তু তুমি উঠো নি।”
এবার মারিয়া বলল,
“গতকাল রাতে আপনি এখানেই ঘুমিয়েছিলেন, তাই না?”
“হুম।”
“আপনার সমস্যা হলে আমরা দুই বেডের রুম নিতে পারতাম।”
কথাটি শুনে প্রহর মারিয়ার দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ নিরব থেকে প্রহর বলল,
“ওরকম কিছু না। আসলে আমি ভেবেছি তোমার সমস্যা হবে।”
“আমি বাসায় একা থাকি না। মহুয়াও আমার সাথে থাকে। তাই আমার অভ্যাস আছে। হয়তো আপনার অভ্যাস নেই।”
প্রহর চুপ করে রইলো। মারিয়া আবার বলল,
“মহুয়া থাকলে ভালো হতো।”
প্রহর কথাটি শুনে চমকে উঠলো। মনে মনে ভাবলো,
“মারিয়া হঠাৎ এই কথা কেন বলছে?”
মারিয়া আবার বলল,
“মহুয়া অনেক চুপচাপ থাকে। কিন্তু ও অনেক ভালো শ্রোতা। আমি যা বলবো ও খুব মনোযোগ দিয়ে শুনবে। আমার সব কথায় ওর খুব আগ্রহ থাকে। কথাগুলো যুক্তিহীন হলেও সে শুনবে। আর যুক্তিযুক্ত হলে নিজের মতামত রাখবে। অন্যদিকে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড মিতু ও সিয়া, ওরা আমার সাথে অনেক গল্প করবে। সবগুলোই ট্যুর নিয়ে, বা নতুন কোনো টিভি প্রোগ্রাম নিয়ে, কখনো কখনো ভিত্তিহীন কথা বলেও আমরা অনেক হাসাহাসি করি। আর ওদের সাথে আমি কখনোই বিরক্ত হই না। কিন্তু আপনার সাথে কয়েক ঘন্টায় আমি হাঁপিয়ে উঠেছি। আমার খুব একা একা লাগছে। ইচ্ছে করছে মায়ের কাছে চলে যেতে। এখানে এসে যতোটা খারাপ লাগছে, এর চেয়ে তো বড় ভাইয়া আর মেজো ভাইয়া বকলেও ওতোটা খারাপ লাগে না। মহুয়া কতো আগ্রহ নিয়ে আমাকে ওর পড়া বইগুলোর গল্প শুনাতে। তখন আমার খুব বিরক্ত লাগতো, কিন্তু এখন ও আমার পাশে এসে যদি ওসব গল্প শোনায়, আমি একদমই বিরক্ত হবো না। খুব মনোযোগ দিয়ে শুনবো।”
কথাগুলো বলতে বলতেই মারিয়া ফুঁপিয়ে উঠলো। প্রহর মারিয়ার কাছে এসে বলল,
“আমি দুঃখিত, মারিয়া৷ আমি হয়তো তোমাকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। চলো আমরা বসে গল্প করি।”
“আমি আপনার সাথে গল্প করবো না।”
“আচ্ছা, চলো। আগে আমরা নাস্তা করে আসি। তুমি রাতে কিছু খাও নি। তাই দুর্বলতার কারণে এমন মনে হচ্ছে। দেখবে, খেয়ে নিলে তোমার সবকিছু স্বাভাবিক মনে হবে। তারপর আমরা একসাথে বাইরে ঘুরতে যাবো।”
“না, আমি বাসায় যাবো।”
“মারিয়া, আমরা মাত্র গতকাল এসেছি। বিষয়টা সুন্দর দেখাবে না।”
“তাহলে আপনি এক্ষুনি ভাইয়াকে বলুন, মহুয়াকে নিয়ে আসতে।”
“মারিয়া, তুমি বাচ্চাদের মতো আবদার করছো।”
মারিয়া এবার রাগ দেখিয়ে রুমে এসে সোফায় বসে পড়লো। এদিকে প্রহর কিছুক্ষণ বারান্দায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। সে বুঝতে পারছে না, মারিয়াকে কিভাবে শান্ত করা যাবে। অনেক ভাবাভাবির পর সে মারিয়ার কাছে এসে তার পাশে বসে বলল,
“তুমি শাড়ি পরতে জানো?”
মারিয়া প্রহরের দিকে তাকিয়ে বলল, “না।”
“মহুয়া পারে?”
“হ্যাঁ।”
“তুমি ওর থেকে শেখো নি কেন?”
“আমার ভালো লাগে না, তাই।”
“এই প্রথম কোনো মেয়ে দেখলাম, যার শাড়ি পরতে ভালো লাগে না।”
“আপনি ক’টা মেয়ের সাথে মিশেছেন?”
প্রহর হেসে বলল,
“মা যখন নানুর বাড়ি যেতো বা আমাদের বাসায় রেখে কোথাও ঘুরতে যেতো, তখন প্রিয়া চুপিচুপি গিয়ে মায়ের আলমারি থেকে শাড়ি বের করে পরতো, আর ছবি তুলতো। আমি ওকে মাঝে মাঝে ভয় দেখিয়ে বলতাম, মাকে বলে দেবো। কিন্তু ও বলতো, সব মেয়েরই নাকি শাড়ি পরতে ভালো লাগে। তাদের এই ভালো লাগা থেকে তাদের দূরে সরিয়ে দিলে তারা নাকি খুব অসন্তুষ্ট হয়৷ আর তাদের অসন্তোষ করে কোনো পুরুষজাতি নাকি শান্তি পায় না।”
প্রহরের কথা শুনে মারিয়া হেসে দিলো। প্রহর বলল,
“প্রিয়া এমনই। ও আমাকে খুব অদ্ভুত অদ্ভুত সব যুক্তি দেখাবে। কেন জানো?”
“কেন?”
“ও মনে করে যারা বইপ্রেমী হয়, তারা অন্যের অনুভূতি নিয়ে খুব চিন্তা করে। তাদের উপর যদি এমন মনগড়া আবেগপ্রবণ কিছু উক্তি চাপিয়ে দেওয়া হয়, তারা নরম হয়ে যাবে।”
“সত্যি?”
“হয়তো। তুমি চেষ্টা করে দেখতে পারো। তোমার সামনেও কিন্তু বইপ্রেমী বসে আছে। আর আমি প্রচুর বই পড়ি।”
মারিয়া কিছু একটা ভেবে মুচকি হাসলো। মারিয়াকে হাসতে দেখে প্রহর কিছুটা নিশ্চিন্ত হলো আর মনে মনে হাসলো। এবার মারিয়া মুখে হাত দিয়ে প্রহরের দিকে ঝুঁকে বলল,
“কোনো এক কবি বলেছেন, সুখী সেই ব্যক্তি যিনি সুন্দর বউ পান, আর সেই বউয়ের সেবা করেন।”
প্রহর মারিয়ার কথাটি শুনে হাসতে লাগলো। হাসতে হাসতে সে মারিয়ার পাশ ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। মারিয়ার মুখে এমন কথা শুনে তার খুব হাসি পেয়েছে। প্রহর নিজের হাসি আটকানোর চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু কোনো ভাবেই সে হাসি আটকাতে পারছে না। এদিকে মারিয়া মুগ্ধ দৃষ্টিতে প্রহরের দিকে তাকিয়ে রইলো। সে হয়তো প্রথম কোনো পুরুষকে এতো সুন্দর করে হাসতে দেখেছে। প্রহরের মুখটা হাসতে হাসতে একদম লালচে আভায় পরিণত হয়েছে। আর মারিয়া সেই লালচে মুখটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবলো,
“এই সুন্দর পুরুষটা শুধুই আমার। তাকে কাছে পাওয়ার আর কারো অধিকার নেই, শুধু আমারই আছে।”
প্রহর হাসি থামিয়ে দিয়ে মারিয়ার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“এই পাঠক জানতে চাই, কে সেই কবি।
আমি দেখতে চাই তার ছবি।”
মারিয়া মুখ টিপে হাসলো, আর ইশারায় নিজেকে দেখিয়ে দিয়ে বলল,
“আপনার সৌভাগ্য, সে আপনার সামনে বসে আছে। কবিদের কবি, জাতির কবি, মারিয়া নাওয়াল।”
প্রহর হেসে বলল,
“কবিদের কবি, জাতির কবি, আপনি যদি আমাকে দু’টো কবিতার লাইন শুনিয়ে দিতেন।”
মারিয়া গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“দেখুন, এতো সহজে আমি কাউকে আমার কবিতা শোনায় না। আপনাকে একটু ধৈর্য ধরতে হবে। ততোক্ষণে আপনি সুখী ব্যক্তি হওয়ার চেষ্টায় লেগে পড়ুন।”
প্রহর মুচকি হেসে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। প্রহর চলে যাওয়ার পর মারিয়া এক লাফে বিছানায় উঠে গিয়ে নাচতে নাচতে বলল,
“ইয়েএএএ, আমি মিস্টার বরকে পটিয়ে ফেলেছি।”
এরপর মারিয়া লাফাতে লাফাতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“তুমি খুব বুদ্ধিমতী মারিয়া। খুব বুদ্ধিমতী। পথভ্রষ্ট স্বামীকে সহজে পটানো, গোমড়ামুখো বরকে হাসানো, বাংলার পাঁচের মতো করে রাখা মিস্টার হাসবেন্ডের মুখকে সোজা করতে চান? এক্ষুনি যোগাযোগ করুন সাধু মা, মারিয়া নাওয়ালের সাথে। জয় বাংলা।”
কথাটি বলতে বলতেই মারিয়া হাসতে হাসতে সোফায় বসে পড়লো। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ শুনে সে সাথে সাথে শান্ত হয়ে গেলো। দেখলো প্রহর নাস্তা নিয়ে এসেছে। এরপর তারা একসাথে বারান্দায় বসে নাস্তা করলো।
নাস্তা করে তারা বেরিয়ে পড়লো কংলাক পাহাড়ের উদ্দেশ্যে। মারিয়া একটা বাঁশ হাতে নিয়ে তুমুল উৎসাহের সাথে পাহাড় বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো। মারিয়ার ট্রেকিং করার অভ্যাস আছে। এর আগেও সে বান্ধবীদের সাথে সীতাকুন্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়ে গিয়েছিলো। আর সেই জায়গায় তার মোট দু’বার যাওয়া হয়েছে। এছাড়া মারিয়ার প্রচুর হাঁটার অভ্যাস আছে। তাই তার জন্য এই পথটা খুবই সহজ। কিন্তু প্রহর এসবে অভ্যস্ত নয়। শরীরে শক্তি থাকায়, তার অসুবিধে না হলেও, মন থেকে সে মোটেও ট্রেকিংয়ের জন্য প্রস্তুত ছিলো না। তবুও একপ্রকার জোর করেই সে মারিয়াকে সঙ্গ দিচ্ছে। প্রায় এক ঘন্টা পর তারা পাহাড়ে উঠলো। এরপর প্রহর পাশে একটা বেঞ্চে বসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
“তুমি বসো। একটু বিশ্রাম করো।”
মারিয়া তখন আশেপাশের দৃশ্য ফোনে ধারণ করতে ব্যস্ত ছিল। অনেকক্ষণ পর মারিয়া ফোনটা প্রহরের হাতে দিয়ে বলল,
“দেখুন, নীল আকাশটা কতোই না সুন্দর। মনে হচ্ছে হাত বাড়ালেই আকাশটা স্পর্শ করতে পারবো।”
প্রহর মারিয়ার ধারণ করা ভিডিওটি দেখে বলল,
“তুমি খুব ভালো ভিডিওগ্রাফি করতে পারো।”
মারিয়া হেসে বলল,
“ধন্যবাদ। কিন্তু আপনাকে তো খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে।”
“আসলে আমার অভ্যাস নেই।”
“কেন? আপনি কখনো ঘুরতে যান নি?”
“গিয়েছি। কিন্তু কখনো পাহাড়ে উঠি নি।”
“তাহলে আপনার প্রিয় স্থান কোনটি?”
“আমার প্রিয় স্থান লাইব্রেরি।”
মারিয়া অবাক দৃষ্টিতে প্রহরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনি তো পুরাই চান্দু।”
“মানে?”
“মহুয়াকে আমি আদর করে চান্দু বলি।”
“এর অর্থ কি?”
“জানি না। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই ওকে চান্দু বলে ডাকি। তাই এই নামে ডাকতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কেন এই নামটা দিয়েছি, তা আমার মনে নেই।”
“ওহ।”
মারিয়া বলল,
“আসলে কি! লাইব্রেরি নিরব ভাষায় আপনাকে জ্ঞানী করবে। কিন্তু পাহাড়ের নিরবতা আপনাকে মুগ্ধ করবে। একটা আত্মিক প্রশান্তি দেবে। বই পড়ে আমি কখনো সেই শান্তি পাই নি। কারণ আমি চাক্ষুষ সৌন্দর্যে বিশ্বাসী। শুধু বই পড়ে, কল্পনা করে, আমি সেই শান্তি পাই না।”
এবার প্রহর বলল,
“মাঝে মাঝে কল্পনা করে তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ হতে পারো। কারণ বাস্তবে মানুষ অনেক কিছুই পায় না। কিন্তু কল্পনায় সব সম্ভব।”
চলবে–