#রংধনুর_আকাশ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-৩৪ (সাজেক স্পেশাল-০৩)
৫৭।
কংলাক পাহাড় থেকে নেমে তারা সাজেকের স্টোন গার্ডেনে চলে এলো। এখানে আশেপাশে তেমন ভীড় না থাকায় কিছুটা নিরবতা বিরাজ করছে। যদিও জায়গাটা মারিয়াকে ওতো বেশি আকর্ষণ করছে না। কারণ তার কংলাক পাহাড়েই বেশি ভালো লেগেছিলো। সে গার্ডেনের শেষ প্রান্তে থাকা একটি দোলনায় বসে ফোনে কি যেন দেখছে। আর প্রহর তার পাশে একটা ছোট কাঠের ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে প্রকৃতি বিলাস করছে। প্রায় আধা ঘন্টা এভাবেই কেটে গেলো।
নব বিবাহিত দম্পতিদের মধ্যে যেই অনুভূতি থাকে, সেই অনুভূতি প্রহর আর মারিয়ার মধ্যে নেই। তাই দুটি ভিন্ন মনের মানুষ প্রকৃতির কাছে নিজের অনুভূতির প্রকাশ করে যাচ্ছে।
মারিয়া ফোন পাশে রেখে পেছন ফিরে এক নজর প্রহরের দিকে তাকালো। দেখলো প্রহর এক দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছে। মারিয়ার এভাবে একা একা কোনো কারণ ছাড়া এক জায়গায় বেশিক্ষণ বসে থাকতে ভালো লাগে না। তাই সে প্রহরের কাছে এসে বলল,
“এখানে একটা ঝর্ণা আছে, কংলাক ঝর্ণা। আমরা বরং ওখানে যাই।”
প্রহর মারিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
“এখানেই ভালো লাগছে।”
“এখানে ভালো লাগার মতো কিছুই দেখছি না। এর চেয়ে কংলাক পাহাড়েই ভালো লেগেছিলো।”
“পাহাড়ে উঠতে উঠতেই তো অর্ধেক সময় চলে গিয়েছিলো। ভালো লাগার জন্য একটা স্থানে স্থির হয়ে বসা প্রয়োজন। আমরা তো সেখানে বেশিক্ষণ বসলামও না।”
“পাহাড়ে উঠার সময়ই তো বেশি ভালো লেগেছিলো। ওইটাই তো ভ্রমণের বিশেষত্ব। আর কোথাও বসে থাকার চেয়ে চলতে থাকা, আশেপাশের রাস্তায় নিজের পায়ের ছাপ ফেলা, এটাই তো ভ্রমণের মূল আনন্দ। আর আমরা তো আধাঘন্টা এখানেই বসেছি। আর কতো বসবো?”
“আমি আরো আধা ঘন্টা এখানেই কাটাতে পারবো।”
মারিয়া আর কিছুই বললো না। নতুন মানুষের সাথে আর কতোই বা তর্ক করা যায়? সে চুপচাপ প্রহরের পাশে দাঁড়িয়ে রইলো। হঠাৎ প্রহর বলল,
“আমার দু’টো ময়না পাখি আছে। একজনের নাম টুসটুস, আরেকজনের নাম টুসটুসি। বই পড়া ছাড়াও আমার তাদের সাথে কথা বলতে ভীষণ ভালো লাগে।”
“তাই? আমারও ময়না পাখিগুলো দেখতে ইচ্ছে করছে।”
“একদিন বাসায় এসে দেখে যেও।”
“আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে না হলে কি শ্বশুড় বাড়ি যাওয়া যায়?”
“আমাদের তো সমস্যা নেই। তুমি অবশ্যই আসতে পারবে। আর যা হওয়ার তাতো হয়েই গেছে। এখন তো তুমি আমার স্ত্রী। এই সত্য কি আর পালটানো সম্ভব?”
প্রহর অন্যমনস্ক হয়েই শেষ কথাগুলো বললো। মারিয়া কিছুটা বিব্রত মুখে জিজ্ঞেস করলো, “মানে?”
প্রহর নিজের বলা কথাগুলো দ্বিতীয়বার ভাবলো। সে বুঝতে পারলো, কথাগুলো বেশ অমার্জিত শুনাচ্ছে।তাই সে ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
“মানে আক্দই তো বিয়ের মূল অংশ। এখন তুমি আমার স্ত্রী। আর তোমার অধিকার আছে আমার বাসায় আসার।”
মারিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“একটা প্রশ্ন করি?”
“হ্যাঁ করো।”
“আপনার উপর কি খুব চাপ পড়েছে?”
“মানে? কিসের চাপ?”
“মনে হচ্ছে আপনি এখানে এসে তেমন খুশি হোন নি। আমি বোধ হয় খুব জোর করেছি।”
“না, তেমন তো কিছু না।”
“আমার আসলে কাশ্মীর যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সামনে তো পরীক্ষা। তাই আপতত এখানেই এলাম। আমার আসলে ভ্রমণ করতে খুব ভালো লাগে।”
“হুম। ভালো।”
প্রহরের শুকনো উত্তরে মারিয়া দমে গেলো। এবার সে প্রহরের সাথে কিভাবে তার কথোপকথন আগাবে বুঝতে পারছে না। তাই সে চুপ করেই প্রহরকে সঙ্গ দিলো।
বিকেলে মারিয়ার জোরাজুরিতে প্রহর ঝর্ণায় যেতে বাধ্য হলো। তাদের অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। মারিয়া মানসিকভাবে প্রস্তুত। কিন্তু প্রহর একদম নির্জীব দাঁড়িয়ে আছে।
পাকা সিঁড়িটা নিচে চলে গেছে। মারিয়া সেই সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছে, আর প্রহর তার পিছু পিছু আসছে। আজ খুব বেশি গরম পড়ছে না। হালকা হাওয়ায় প্রকৃতি নাতিশীতোষ্ণ ভাব ছড়াচ্ছে।
প্রায় এক ঘন্টা পর তারা ঝর্ণায় চলে এলো। মারিয়া এখানে আসতে পেরে মারাত্মক খুশি। সে ঝর্ণার পানিতে ইচ্ছে মতো লাফালাফি-ধাপাধাপি করছে। অন্যদিকে প্রহরের বিরক্তি যেন আকাশচুম্বী। সে একপাশে চুপচাপ বসে আছে। এটা তার স্বভাবের বিপরীতে। এতো পরিশ্রম সে কখনোই করে নি। পুরুষ মানুষ হলেও সে সুখী জীবন অতিবাহিত করেছিল। কিন্তু এখন মারিয়া এসে তার জীবনের সুখ পাখিটা খাঁচা থেকে বের করে দিলো। এখন সেই খাঁচায় প্রহর নিজেকেই দেখতে পারছে।
এদিকে মারিয়া পানিতে ভিজে একদম নুইয়ে পড়েছে। তার ঠান্ডায় শরীর কাঁপছে। সে কাঁপা শরীরে প্রহরের দিকে এগিয়ে এসে বলল,
“আপনি ভিজবেন না?”
প্রহর অন্যদিকে ফিরে ছিলো। মারিয়ার কথায় প্রহর তার দিকে ফিরে স্তব্ধ হয়ে গেলো। মারিয়ার ভেজা চুলগুলো তার গালের সাথে লেপ্টে আছে। মুখে লেগে থাকা বিন্দু বিন্দু পানির কণা তার সৌন্দর্য যেন কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। মারিয়াকে এই মুহূর্তে একদম প্রকৃতির কন্যা মনে হচ্ছে।
মারিয়ার ডাকে প্রহরের ঘোর কাটলো। মারিয়া বলল,
“কি হলো?”
প্রহর ভালোভাবে মারিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি এই ভেজা কাপড় নিয়ে উপরে কিভাবে উঠবে?”
“জামা এনেছি।”
“এখানে জামা পরিবর্তন করার মতো কোনো জায়গা আছে?”
“আরেহ, এই জামার উপরই পরে ফেলবো। আর উপরে উঠতে উঠতে শুকিয়ে যাবে।”
“আচ্ছা, চলো এখন।”
“আপনি ভিজবেন না?”
“না, আমার ইচ্ছে নেই।”
তারা আবার উপরে উঠতে লাগলো। উপরে উঠতে উঠতে মারিয়া বলল,
“উপরে যেহেতু যাচ্ছি, একদম হ্যালি প্যাড থেকে সূর্যাস্তটা দেখেই যাবো।”
“তুমি অন্তত এই অবস্থায় ওখানে যেও না। অন্য একদিন সূর্যাস্ত দেখে নিও।”
প্রহরের তীব্র অনিচ্ছা দেখে মারিয়া আর কিছুই বলার সাহস পেলো না।
এদিকে মারিয়ার মলিন মুখ দেখে প্রহর বুঝতে পারলো, সে তার বিরক্তিটা প্রকাশ করে ফেলেছে। কিন্তু সে যতোই বিরক্ত হোক, মারিয়ার সামনে তার সেটি প্রকাশ করার কোনো ইচ্ছে ছিলো না। তাই এই মুহূর্তে বিরক্তি ভাবটা ধামাচাপা দেওয়ার জন্যই, প্রহর মারিয়াকে নিয়ে হ্যালি প্যাডে উঠল সূর্যাস্ত দেখতে।
সূর্য যখন অস্তগামী হচ্ছিলো, হঠাৎ প্রহর অনুভব করলো, কেউ তার হাতটা আলতো করে স্পর্শ করেছে। সে পাশ ফিরে তার মায়াবিনীকে দেখতে পেলো। মায়াবিনী সাদা শাড়ি পরে তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি অস্তগামী সূর্যের দিকে। প্রহরের বুকটা সাথে সাথেই কেঁপে উঠলো, সারাদিনের ক্লান্তি তাকে এতো সুন্দর কল্পনার সাথে সাক্ষাৎ করিয়ে দেবে, তা সে কল্পনায় করে নি। সে ক্লান্ত চোখে মায়াবিনীর দিকে তাকিয়ে প্রশান্তির হাসি হাসলো। আর বলল,
“মায়াবিনী, তোমাকে পাওয়ার সুযোগ কি এখনো আছে?”
হঠাৎ মারিয়ার হাতের স্পর্শ পেয়ে প্রহরের ঘোর কাটলো। মারিয়া তার দিকে ঝুঁকে আছে। প্রহর মারিয়ার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে বলল,
“চলো রিসোর্টে ফিরে যাই।”
মারিয়া বলল,
“আপনি আমাকে মায়াবিনী ডেকেছেন? আমার নামটা অনেক পছন্দ হয়েছে।”
প্রহর মারিয়ার আকাঙ্ক্ষিত চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। আর মনে মনে বলল,
“এই চোখ দুটি যদি কখনো বুঝতে পারে, আমার এখনো তার প্রতি কোনো অনুভূতির সৃষ্টি হয় নি, তখন কি হবে?”
চলবে–
(✴️আমার এখন নিয়মিত ক্যাম্পাসে যেতে হয়। যাওয়া আসা মোট বারো ঘন্টা আমি বাইরেই কাটায়। এরপর বাসায় এসে খুব কম সময় থাকে হাতে। আবার সকালে ক্যাম্পাসে যাওয়ার জন্য রাতও জাগা যায় না। আজ রাত জেগে লিখলাম। কাল আবার ক্যাম্পাসে যাবো। অনেকে হয়তো দেরী করা নিয়ে প্রশ্ন করছেন। আমি ইচ্ছে করে দেরী করি না। 😔)