রংধনুর_আকাশ #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ পর্ব-৩৫ (সাজেক স্পেশাল-০৪)

0
646

#রংধনুর_আকাশ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-৩৫ (সাজেক স্পেশাল-০৪)

৫৮।
ঘড়িতে রাতে ১টা। প্রহর এখনো বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। তার হয়তো আজও ঘুম আসবে না। এখানে আসার পর থেকেই সে ঠিকভাবে ঘুমোতে পারছে না। তার ইচ্ছে করছে বাসায় ফিরে যেতে, বারান্দায় বসে টুসটুসির সাথে গল্প করতে, আবার সেই ব্যস্ত শহরের ভীড়ে ছুটোছুটি করতে, আর সেই চিরচেনা বাতিঘরে গিয়ে একনজর মায়াবিনীকে দেখে আসতে। প্রহর ভাবছে,
“এভাবেই কি আমার দিন কেটে যাবে? আমি কি আর আমার সুখ স্মৃতিগুলো ফিরে পাবো না?”

প্রহর ইজি চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে শীতল হাওয়া অনুভব করছে। হঠাৎ তার মনে হলো পাশে কেউ বসে আছে। প্রহর ভাবলো, সে আজও ঘুমহীন চোখে স্বপ্ন দেখছে। তাই সে বলল,
“মায়াবিনী, তুমি বারবার আমার কল্পনায় কেন আসো? এখন আমাকে একটু একা থাকতে দাও। আমি তোমাকে ভুলে থাকতে চাই।”

মারিয়া অবাক কন্ঠে বলল, “ইয়া আল্লাহ, আপনাকে কি কোনো পরী বিরক্ত করছে?”

মারিয়ার কন্ঠ শুনে প্রহর থতমত খেয়ে গেলো। সে চোখ খুলে মারিয়াকে পাশে দেখে বলল,
“তুমি ঘুমাও নি?”

মারিয়া চোখ ছোট করে প্রহরের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আপনি একা একা কারো সাথে কথা বলেন?”

“আমি কেন একা একা কথা বলবো?”

মারিয়া বিড়বিড় করে বললো,
“শেষমেশ মা আমার জন্য একটা পাগল খুঁজে এনেছে?”

“বিড়বিড় করে কি বলছো?”

“আমি নিশ্চিত, আপনি অন্য কারো সাথে কথা বলছিলেন।”

“এখানে কেউ নেই। আমি কার সাথে কথা বলবো?”

মারিয়া হঠাৎ চেঁচিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বললো,
“ইয়া আল্লাহ!”

“আবার কি হয়েছে?”

“তার মানে মহুয়া যা বলেছে সব সত্য?”

প্রহর ভীত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“কি বলেছে মহুয়া?”

“মহুয়া আমাকে একটা পেত্নীর গল্প শুনিয়েছিলো।”

প্রহর ভ্রূ কুঁচকে বললো, “পেত্নীর গল্প!”

“হ্যাঁ, গল্পের পেত্নীর নাম কাঁজল কুমারী। আমার মনে হয়, সেই কাঁজল কুমারী, নিজেকে আর কুমারী রাখতে চায় না। তাই এখন আমার বরের ঘাড়ে চড়ে বসেছে।”

“মারিয়া, তুমি কি বলছো এসব? আর তুমি তো ভোরে সূর্যোদয় দেখার জন্য তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিলে, আবার উঠে পড়লে কেন?”

মারিয়া কোমরে দুই হাত রেখে বলল,
“আচ্ছা, আমি ঘুমিয়ে পড়বো, আর আপনি পেত্নীর সাথে পরকীয়া করবেন?”

পরকীয়া শব্দটি শুনেই প্রহর কিছুটা বিব্রতবোধ করলো। সে ইতস্তত ভাব নিয়ে বলল,
“তুমি আমাকে ভুল বুঝছো।”

“আমি একদম ভুল বুঝছি না। মহুয়ায় আমাকে গল্পটা বলেছিল। আর আজ দেখছি এসব সত্যিই হয়।”

“তুমি কোন গল্পের কথা বলছো? আমি তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।”

“বলছি। মহুয়া টুকটাক গল্প লিখতে পারে। ওর একটা ডায়েরী আছে, ওখানে ও একটা পেত্নীর গল্প লিখেছিলো। পেত্নীটার নাম কাঁজল কুমারী।”

“এরপর বলো।”

“আপনি গল্পটা শুনবেন?”

“হ্যাঁ, বললেই তো শুনবো।”

মহুয়া গল্প লিখতে পারে, এটা শুনেই মূলত প্রহরের সেই গল্প শোনার প্রতি আগ্রহ জন্মেছে। মারিয়া আবার বলল,
“আপনার ভয় করবে না তো?”

প্রহর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আমি কি তোমার মতো বাচ্চা?”

মারিয়া অবাক কন্ঠে বললো, “আমি বাচ্চা?”

“মারিয়া, তুমি এখন বলবে নাকি ঘুমোতে যাবে?”

“বলছি, বলছি। ঘুমোতে গেলে যদি আপনাকে কাঁজল কুমারী এসে নিয়ে যায়?”

প্রহর মাথায় হাত দিয়ে নিচের দিকে ঝুঁকে বসলো। মারিয়া এবার গল্পটি বলতে শুরু করলো,
“একটি দেশে একজন সুদর্শন যুবক বাস করতো, যুবকটির নাম ছিল রুদ্রদীপ। তাকে একটি মেয়ে খুব ভালোবাসতো, মেয়েটির নাম ছিল রূপবান। একদিন রুদ্রদীপ সমুদ্র যাত্রায় গেলো। সেখানেই সে পথ হারিয়ে ফেললো।”

“রুদ্রদীপ কি নাবিক ছিল?”

“আরেহ, না। ও ভ্রমণ করতে ভালোবাসতো। আমি ধীরে ধীরে বলছি তো। গল্পের মধ্যে কথা বলছেন কেন? চুপচাপ বসে থাকুন।”

প্রহর মাথা নেড়ে মারিয়ার আদেশ মেনে নিলো। মারিয়া এবার মুচকি হেসে বলল,
“তারপর বলি। রুদ্রদীপ যেই জাহাজে ছিলো সেটি ঝড়ের কবলে পড়েছিলো, তাই সে ছাড়া বাকী সবাই সমুদ্রে ডুবে মারা যায়। এবার সে তো একা হয়ে পড়লো। আর তার কাছে সমুদ্রের পথ সম্পর্কে কোনো ধারণায় ছিল না। তাই সে সাহায্যের জন্য চেঁচামেচি করতে লাগলো। হঠাৎ তার সামনে এলো একটি পেত্নী। যার নাম হচ্ছে কাঁজল কুমারী।”

“ওহ, তাহলে পেত্নীটা রুদ্রদীপকে নিয়ে এখন পালিয়ে যাবে?”

“আপনি আবার কথা বলছেন?”

প্রহর হাসতে হাসতে বললো,
“মহুয়া এমন গল্প লিখেছে? একদম ফ্লপ স্টোরি।”

“আচ্ছা, গল্প পুরোটা না শুনেই আপনি ফ্লপ বলবেন? আপনি অনেক খারাপ।”

প্রহর হেসে বলল,
“তারপর বলো, শুনি।”

“হাসছেন কেন? একটু সিরিয়াস হওয়ার চেষ্টা করুন। তারপরই তো ভয় লাগবে।”

কথাটি বলেই মারিয়া আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে প্রহরের আরেকটু কাছে ঘেঁষে বসলো। প্রহর এবার মারিয়ার অবস্থা দেখে অট্টহাসি দিয়ে উঠলো। প্রহরের হাসির শব্দ শুনে মারিয়া ভয়ে চেঁচিয়ে উঠলো। প্রহর সাথে সাথেই মারিয়ার হাত ধরে বলল,
“সরি, মারিয়া। তুমি ভয় পেয়েছো?”

মারিয়া রাগী কন্ঠে বললো,
“এভাবে ভূতের মতো করে কেন হাসছেন?”

“আচ্ছা, আর হাসবো না। এবার বলো।”

মারিয়া কিছুক্ষনের চুপ করে থেকে আবার বলতে লাগলো,
“কাঁজল কুমারী দিদি, রুদ্রদীপকে এসে বলল…”

প্রহর মুখ চেপে হেসে বিড়বিড় করে বলল,
“কাঁজল কুমারী পেত্নী থেকে এখন দিদি? বাহ!”

মারিয়া গল্প থামিয়ে বলল, “কি হলো?”

“কিছু না। তারপর?”

“তারপর কাঁজল কুমারী দিদি রুদ্রদীপকে জিজ্ঞেস করল, “কি হয়েছে?” এরপর রুদ্রদীপ তার সমস্যার কথা কাঁজল কুমারী দিদিকে জানালো। আর সব শুনে কাঁজল কুমারী দিদি তাকে সাহায্য করলো, আর সারারাত বসে গল্প করলো।”

প্রহর এবার ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
“তোমার এই পেত্নী দিদি সমুদ্রের মাঝখানে কোথা থেকে উদয় হলো, এ নিয়ে রুদ্রদীপ দাদা কি কোনো প্রশ্ন করে নি?”

“না, কারণ রুদ্রদীপকে সে মোহ করে ফেলেছিল।”

“আচ্ছা! তারপর।”

“এরপর রুদ্রদীপ যখন আবার দেশে ফিরে আসে, তখন রূপবান তার মনের কথা রুদ্রদীপকে জানায়। কিন্তু রুদ্রদীপের মনে প্রাণে এখন শুধুই কাঁজল কুমারী দিদি। একদিন রূপবানের বাবা এসে রুদ্রদীপের সাথে তার বিয়ে ঠিক করে। আর এরপর তাদের বিয়েও হয়ে যায়। কিন্তু রুদ্রদীপ এই বিয়ে মেনে নিতে পারে নি। কারণ সে রূপবানকে একটুও ভালোবাসে না। শুধুই অবহেলা করে। একদিন রূপবান বুঝতে পারলো, রুদ্রদীপ পেত্নীর সাথে প্রেম করছে। কারণ সে দেখেছিল, রুদ্রদীপ রাতে একা একা কথা বলে, একা একা কারো সাথে হাসে, আর কাউকে স্পর্শ করার চেষ্টা করে। রূপবান তখন বুঝতে পারলো, রুদ্রদীপকে সে আর কখনোই পাবে না। তাই সে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়লো।”

প্রহর বিরক্ত হয়ে বলল,
“এটা আসলেই ফ্লপ স্টোরি। একদম মজা পাই নি।”

“আপনি মজা খুঁজছেন? আসল কাহিনী তো এখনো শুরুই হয় নি।”

“তাহলে আসল কাহিনী কি?”

“রূপবানের মৃত্যুর পর রুদ্রদীপ বুঝতে পারলো সে কি হারিয়েছে। তাই সেও রূপবানকে কাছে পাওয়ার জন্য সেই ছাদ থেকেই লাফিয়ে পড়লো। এদিকে কাঁজল কুমারী তো পেত্নী। সে কখনোই মরবে না। তাই সে শেষমেশ রুদ্রদীপকে আর পেলো না। এদিকে রুদ্রদীপ আর রূপবান মৃত্যুর পর এক হয়ে গেলো। আর কাঁজল কুমারীর এসব দেখে হিংসে হলো। এরপর থেকেই সে বিবাহিত পুরুষদের প্রেমের ফাঁদে ফেলা শুরু করলো।”

প্রহর আলসে ছাড়তে ছাড়তে বলল,
“শেষ? নাকি আরো কিছু আছে?”

“শেষ। জানেন, মহুয়া বলেছে, এসব পেত্নী নাকি সত্যিই আছে। ওর বান্ধবী বলেছিল, এমন পেত্নী নাকি আমাদের আশেপাশেই থাকে। তাই প্রতিটি মেয়ের উচিত তাদের বরদের লুকিয়ে রাখা।”

“এখন ঘুমাতে যাও।”

“না, আমার ভয় করছে।”

“নিজে গল্প বলে, নিজেই ভয় পাচ্ছো?”

“আমার সত্যিই ভয় করছে। চলুন না, আমার সাথে। আমরা একসাথে ঘুমাবো।”

এরপর রুমে এসে প্রহর মারিয়ার সাথে এক বিছানায় শুয়ে পড়লো। কিন্তু দু’জনেই খুব ইতস্ততবোধ করছে। হঠাৎ আশেপাশে কোথাও একটা বিকট শব্দ হওয়ায়, মারিয়া ভয়ে প্রহরের হাত-পা চেপে ধরলো। আর কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আমার সত্যিই ভয় করছে। আমি আর এমন গল্প বলবো না। আপনি প্লিজ কাঁজল কুমারীর সাথে যাবেন না। ওর থেকে দূরে দূরে থাকবেন। ঠিক আছে?”

প্রহর মারিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি তোমার পাশেই আছি। কোথাও যাচ্ছি না। এখন ঘুমাও।”

পরের দিন সকালে প্রহর আর মারিয়া ঘুম থেকে উঠেই একসাথে সূর্যোদয় দেখলো। এরপর তারা সকালে নাস্তা সেরেই ব্যাগ পত্র গুছিয়ে লুসাই গ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলো। এখানে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো, গাছের উপরে থাকা কর্টেজ। মারিয়ার ইচ্ছে ছিলো এই কর্টেজে এক রাত থাকার। তাই প্রহরও মারিয়ার খুশির জন্য আরো এক রাত সাজেকে থেকে গেলো। মারিয়া সেদিন পুরো গ্রাম ঘুরেছে আর ইচ্ছেমতো আশেপাশের সৌন্দর্য ফোনে ধারণ করেছে।

পরের দিন তারা চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলো। তবে পথিমধ্যে মারিয়ার সেই ভ্রমণপিপাসু মনে অ্যাডবেঞ্চারের শখ জন্ম নিলো। তাই তার সেই শখের পূর্ণতা দিতেই প্রহর তাকে খাগড়াছড়ির আলু টিলা গুহা, রিসাং ঝর্ণা, দেবতা পুকুর, ঠান্ডাছড়া আর মায়াবিনী লেক ঘুরিয়ে আনলো। মারিয়ার কাছে আলু টিলা গুহার সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত ছিলো, মশাল হাতে গুহাটি পার করা। এরপর রিসাং ঝর্ণার নিস্তব্ধ পথ, দেবতা পুকুরের স্থির দৃশ্য, ঠান্ডাছড়ার দুর্গম রাস্তা আর মায়াবিনী লেকের চমৎকার পরিবেশ স্মৃতিতে নিয়ে মারিয়া চট্টগ্রাম ফিরে এলো।

প্রহর মারিয়াকে তার বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে বলল,
“কাঁজল কুমারী থেকে সাবধান!”

মারিয়া প্রহরের কথা শুনে চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকালো। প্রহর হাসতে হাসতে বললো,
“মজা করলাম।”

মারিয়া মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“দেখুন, মাথায় রাখবেন কিন্তু।”

“কি মাথায় রাখবো?”

“আপনি এখন বিবাহিত। অন্যদিকে মনোযোগ দিবেন না।”

মারিয়ার কথাটি শুনে প্রহরের মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেলো। সে মলিন মুখে বললো,
“ভালো থেকো। মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করো। সামনে কিন্তু তোমার পরীক্ষা।”

মারিয়া কানে হাত গুঁজে বলল,
“ইয়া আল্লাহ, বাঁচাও আমাকে।”

কথাটি বলেই মারিয়া তার ব্যাগ নিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে গেলো। তারপর লিফটে উঠে বিড়বিড় করে বললো,
“এখন আবার সেই পুরোনো ডায়লগ শুনবো, “সামনে পরীক্ষা, পড়তে বসো।” কেউ কি এখনো বুঝতে পারছে না, আমার নতুন বিয়ে হয়েছে! যেখানে আমার বরই বুঝছে না, সেখানে বাকীরাও বা কি বুঝবে।”

এদিকে বাসায় এসে মারিয়া ফ্রেশ হয়ে সবার সাথে সাজেকের গল্প করলো। আর রাতে ঘুমানোর সময় সে প্রহর সম্পর্কে মহুয়াকে অনেক কিছুই বললো। মহুয়া সব শুনে প্রহরকে নিয়েই ভাবতে লাগলো। আর মনে মনে বললো,
“প্রহর ভাইয়া একদম আমার মতোই। আমি চাই এমন একটা ছেলে আমার জীবনেও আসুক।”

এদিকে মারিয়া মনে মনে ভাবতে লাগলো,
“আমার মনে হচ্ছে, উনি ইচ্ছে করেই আমার কাছ থেকে দূরে থাকতে চাইছেন। কিন্তু কেন? প্রেমের বিয়ে হোক, বা পারিবারিক ভাবে বিয়ে হোক, সব নব দম্পতিই বিয়ের পর একে অপরের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে। কিন্তু তিনি তো আমার পছন্দের খাবার কি সেটিও জিজ্ঞেস করলেন না। বেশিরভাগ সময় চুপচাপ সময় কাটিয়েছিলেন। তিনি কি মূলত চুপচাপ স্বভাবের? নাকি অন্য কোনো কারণ আছে?”

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here