রজনী #শারমিন আঁচল নিপা #পর্ব-৪

0
361

#রজনী
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৪

পেছন ফিরতেই তার শরীর হিম হয়ে যেতে লাগল। কারণ তূর্ণা মাটিতে আঁচড়ে পড়ে উপুর হয়ে আছে। তার উপরেই একটা মানব শিশু দাঁড়িয়ে খিলখিল করে হাসছে। ঠোঁটগুলো কাঁটা। উপরের ঠোঁটটা নাকের নীচের চামড়ার সাথে সেলাই করা এবং নীচের ঠোঁটটা থুতুনীর চামড়ার সাথে সেলাই করা। দাঁত গুলো কালো কুঁচকু্চে। ফর্সা চেহারায় কালো দাঁতগুলোকে অনেকটা বেশি বিশ্রি ভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। চোখ আছে তবে চোখের পাতা নেই। চোখের ভেতরের অংশ বিপরীত পরিক্রমায় চলছে। অর্থাৎ কালো লেন্সটা সাদাটে হয়ে আছে আর সাদা অংশটা কালো হয়ে আছে৷ গালের এক পাশে লাল রেখা আঁকা। বাচ্চাটার উচ্চতা ২ ফিটের বেশি হবে না। পা দুটো উল্টো করা। এক হাতে আঙ্গুল গুণে গুণে দশটা হবে। প্রতি দুটো আঙ্গুল জোরা লাগানো। দু হাতে হিসাব অনুপাতে ২০ টা আঙ্গুল। পা জোরা আঙ্গুল বিহীন। শরীরের বিভিন্ন অংশে লাল রেখা টানা। বাচ্চাটার হাসির শব্দ প্রবল হতে লাগল। তূর্ণা মাটিতে পড়ে আর উঠতে পারছে না। দম নিতে তার কষ্ট হচ্ছে। আর এদিকে আয়েশা স্তবির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এটা কী তার কল্পনা নাকি সত্যি সেটার বিস্তার বিবেচনায় ব্যস্ত সে। কী করবে তার বোধগম্য হচ্ছে না। নিজের অজান্তেই চুপ হয়ে গেল। শরীরটা কাঁপছে। হাত, পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। চিৎকার দেবার মতো গলা দিয়ে আওয়াজ তার বের হচ্ছে না। মাথায় তীব্র ব্যথা আঁচ করতে লাগল। এমন সময় তূর্ণা বেশ সাহস করে নিজের হাতটা বাড়িয়ে আয়েশার পা টা টেনে বলল

– আয়েশা আমায় বাঁচা। এ ভার যে সহ্য করা ভীষণ কঠিন। দম নিতে পারছি না। স্তবির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকিস না। বড্ড অস্থির লাগছে। অশান্তি হচ্ছে অনেক।

তূর্ণার ডাকে আয়েশার হুঁশ ফিরল। নিজেকে দ্রূত স্বাভাবিক করল। হাত পা যদিও কাঁপছে তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে হাতটা বাড়িয়ে বাচ্চাটাকে ধাক্কা দিতে নিল। বাচ্চাটাকে স্পর্শ করার সাথে সাথে বাচ্চাটা আয়েশার হাত খাঁমচে ধরে আয়েশার হাতেই ঝুলে পড়ল। আয়েশা হাতটা থেকে বাচ্চাটাকে ছাড়ানোর জন্য বেশ শক্তি খাটাতে লাগল। সে সময়টায় তূর্ণা নিজেকে সামলে উঠে নিল। লক্ষ্য করল আয়েশার হাতে কামড় দিয়ে বাচ্চাটা ঝুলে আছে। তূর্ণা সাহস করে বাচ্চাটাকে টেনে হিঁচড়ে আলাদা করে জোরে ছুরে মেরে আয়েশাকে বলল

– সামনের দিকে চল। দৌড় দে।

আয়েশার ভাবান্তর হওয়ার আগেই বেশ উদ্রেগ নিয়ে দৌঁড় লাগাল। তূর্ণাও পেছন পেছন দৌড়ে যেতে লাগল। বেশ খানিকক্ষণ দৌড়ে গলির মাথায় আসলো। এখন রাস্তাটা বেশ পরিষ্কার লোক সমাগম আছে রাস্তায়। দুজনেই হাঁপাতে লাগল। তূর্ণা আয়েশার হাতের দিকে লক্ষ্য করল। রাস্তায় জ্বলে উঠা আলোতে আয়েশার হাতটা বেশ স্পষ্ট হয়ে দেখা যাচ্ছে।।রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। রক্তক্ষরণ ও হচ্ছে। সে আয়েশার হাতটা চেপে ধরতেই আয়েশা আহ্ করে উঠল। এতক্ষণ তার ব্যথা অনুভব হয়নি। তবে এখন তূর্ণার কিয়ৎ স্পর্শে তার ব্যথা বেশ ভালোই অনুভব হচ্ছে। চোখ দিয়ে তার পানি গড়িয়ে পড়ছে। আয়েশা উড়নার এক অংশ দাঁত দিয়ে হালকা কেটে তারপর সেটা ফালি করে আয়েশার হাতটা বেঁধে দিয়ে বলল

– তাসকিন ভাইয়ার মৃত্যু স্বাভাবিক না আয়েশা। কোনো গোলমাল অবশ্যই আছে। বাচ্চাটার সাথে মৃত্যু রহস্য অবশ্যই আছে। আমরা এসব বললে কেউ বিশ্বাস করবে না। বিষয়গুলো রাতের আঁধারেই হয় আবার রাতের আঁধারেই তলিয়ে যায়।

আয়েশা হালকা দম নিল। হাতের ব্যথাটা প্রবল হলেও সে নিজেকে দমিয়ে নিল। বেশ স্বাভাবিক সুরেই বলল

– প্রথম থেকেই আমার এ সন্দেহ হচ্ছিল। তাসকিন আমাকে ভালোবাসে সে কেন আত্মহত্যা করবে। সনিয়ার কথা, তারপর তোহার অদ্ভুত আচরণ আমাকে বেশ রহস্যে তলিয়ে নিয়েছিল। আমি জানি যা হচ্ছে সেটা স্বাভাবিক না। কিছু তো আছে যেটা আমাদের জানার বাইরে।

আয়েশার কথা শুনে তূর্ণার মাথায় অনেক কিছুই ঘুরছে। তবে সেটা আয়েশাকে প্রকাশ না করে হালকা গলায় বলল

– ৯ টার উপর বাজে। জানাজা হয়তো শেষ।

তারপর রাস্তা দিয়ে তাকিয়ে দেখল মানুষ সব দলে দলে গন্তব্যে ফেরার পথে। তূর্ণা মানুষগুলোকে ইশারা করে বলল

– দেখ এরা হয়তো জানাজা শেষে বাড়ি ফিরছে।

তূর্ণার কথা শুনে আয়েশার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। নিজের ভালোবাসার মানুষটার মুখটা সে আর দেখতে পারল না। বেশ কষ্ট নিয়ে সে তূর্ণাকে বলল

– কবরটা দেখে আসি। আর তো কিছু দেখার সুযোগ পাব না। এতসব ঘটে গেল। কপালটায় খারাপ আমার।

– মন খারাপ করিস না। রাস্তার মানুষজন গিয়ে নিক। তারপর তুই আর আমি গিয়ে দেখে আসব। ভয় ও লাগছে অনেক। বাসায় ফিরব কী না সেটাও ভাবছি।

তূর্ণার কথা শুনে আয়েশা তার হাতটা চেপে ধরে বলল

– এমন বলিস না। যা হওয়ার হবে আমাকে একটু তার কবরের মাটিতে স্পর্শ করতে দে। আর কিছু চাই না।

তূর্ণা আর কথা বলতে পারল না। ভয়ে তার গা ছমছম করলেও আয়েশার আবেগের কাছে যেন সব হেরে গেল।

তারা দুজন কিয়ৎক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। লোকের ভীর যখন কমল, রাস্তাটা যখন ফাঁকা হলো ঠিক তখন দুজন হেঁটে কবরের কাছে গেল। তাসকিনের কবরটা তাদের পারিবারিক কবরস্থানেই দেওয়া হয়েছে। চারদিক থেকে গোলাপ জলের গন্ধ আসছে। সে সাথে শীতল হাওয়া। হালকা হালকা বৃষ্টি কণা পড়ছে। সবমিলিয়ে পরিবেশটা বেশ শান্ত শীতল।

এদিকে আয়েশার বাবা জানাজা থেকে ফিরে হুহু করে কেঁদে দিল। সহুরা বেগম আয়েশার বাবাকে এভাবে কাঁদতে দেখে আস্তে করে তার কাছে এসে বললেন

– তুমি কান্নাকাটি করো না দয়াকরে। আয়েশা ঘুমুচ্ছে। তোমার কান্নার আওয়াজে ও উঠে কান্না করবে। তুমি চুপ হও।

আয়েশার বাবা চোখের জল মুছতে মুছতে বলল

– কান্না তো সাধে করছি না। তাসকিনের লাশ চেনার উপায় নেই। কেউ কেউ তো বলছে লাশটা বদল হয়ে গেছে এটা তাসকিন না। মুখটা যে পুড়ে রয়েছে। তবে যে হাসপাতালে ময়না তদন্ত করেছে তারা বলেছে লাশটা নেওয়ার কিছুক্ষণ পর নাকি এমন হয়েছে। জানি না কী হয়েছে। বুকটা ছটফট করছে। মেয়েটা আমার এ যন্ত্রণা কীভাবে সহ্য করছে জানি না। ভালোই হয়েছে যেতে দেইনি। নাহয় এ লাশটা দেখলে ও আরও সহ্য করতে পারত না।

সহুরা বেগম ও মুখ চেপে কেঁদে বললেন
– যে মায়ের বুক খালি হয়েছে তাদের যেন কেমন লাগছে আল্লাহ জানেন।

– তাদের জ্ঞান এ ফিরছে এই যাচ্ছে। সনিয়া তো চুপ হয়ে গেছে। আয়েশার মতো সেও হয়তো কাঁদতে পারছে না। কী থেকে কী যে হয়ে গেল। জীবনটা এত কঠিন কেন।

সহুরা বেগম নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন

– থাক এবার ঘরে চলো। আয়েশা ঘুমুচ্ছে ঘুমাক। ওর কান পর্যন্ত আর নিও না। সারাদিন কিছু খায়নি। এমনি ক্লান্ত অনেক। ঘুম না হলে ও আরও অসুস্থ হয়ে যাবে।

আয়েশার বাবা আর কথা বাড়াল না। ঘরে গিয়ে দুজন বসে রইল চুপ হয়ে।

এদিকে তূর্ণা আর আয়েশা পৌঁছে গেল কবরের কাছে। কবরের কাছে যেতেই আয়েশা কোমল স্পর্শ অনুভব করলো কাঁধে। পেছন ফিরে তাকাতেই দেখল তাসকিন। খানিকটা ভয়ও পাচ্ছিল। তবুও সাহস নিয়ে স্তব্ধ সুরে বলল

– তুমি না মরে গেছো তাহলে কে তুমি?

তাসকিন গলাটা ভার করে বলল

– আমার সাথে যা হয়েছে শুনবে না? আর তুমি ছাড়া আমি কারও সামনে দৃশ্যমান হব না। এমন কি তূর্ণার সামনেও।

তূর্ণা শুধু কন্ঠস্বরের আওয়াজ পেল। তবে আশেপাশে কাউকে দেখতে পেল না। যদিও তূর্ণা দুজনের কথোপকথোনে বুঝতে পারছে এটা তাসকিন। বেশ অগোছালো গলায় তূর্ণা বলে উঠল

– আপনার সাথে কোনো খারাপ কী হয়েছে? প্লিজ বলুন।

তূর্ণার কথায় তাসকিন বলে উঠল

– আমি মৃত নাকি জীবিত বুঝতে পারছি না। আমার জানাজা হয়েছে নাকি অন্য কারও তাও আমি বুঝতে পারছি না। আমি কারও সামনে দৃশ্যমান হতে পারছি না। একমাত্র আয়েশা আমাকে দেখতেছে। আমার আওয়াজ কারও কানে পৌঁছাচ্ছে না। তোমাদের দুজন ব্যতীত কেউ আমাকে উপলব্ধি করতে পারছে না। তবে আমার মনে হচ্ছে আমি মরিনি৷

আয়েশা তাসকিনের এমন কথা শুনে বেশ অবাক হয়ে বলল

– কী এমন হয়েছিল। আর সে লাশটা কার? আর কে তোমার রুমে ঝুলে ছিল। আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না। এটা আমার কল্পনা নাকি মতিভ্রম সেটা বুঝারও অবকাশ পাচ্ছি না।

তাসকিন আশ্বস্ত করে বলল আয়েশার সামনে তাসকিনেই আছে আর এটা বাস্তবতা। তারপর নিজের সাথে ঘটে যাওয়া এক ভয়ংকর কাহিনির বর্ণণা দিল। আয়েশা কাহিনিটা শুনে থমকে গেল। গা হিমহিম করছে। সত্যিই কী এটা সত্য নাকি তার কল্পনা। নাকি আরও গভীর রহস্যে তলিয়ে গেল।

( কপি করা নিষেধ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here