#রজনী
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ১
হবু বরের আত্মহত্যার খবরটা আয়েশার কানে আসে বিয়ের আগের দিন রাত চারটায়। হবু বরের বন্ধু কল দিয়ে জানায় তাসকিন আত্মহত্যা করেছে। তাসকিন আয়েশার হবু বর। যার সাথে তার সম্পর্ক ছিল দুই বছরের। একই সঙ্গে দুজন চাকুরি করত। অফিসের কলিগ হওয়ার সুবাদে তাদের পরিচয়টা হয়। সে থেকে সম্পর্ক আর সে সম্পর্কের সূত্র ধরেই প্রণয় হতে যাচ্ছিল কাল। আয়েশা ভেবেছিল এটা হয়তো সাবিদ মজা করছে। তাই বেশ খামখেয়ালে হাসি দিয়ে বলল
– এমন মজা করা ঠিক না।
কিন্তু তার সে হাসিটা মলিন করে সাবিদ বলে উঠল
– ভাবি আমি মজা করছি না।
আয়েশার মুখটা মলিন হয়ে গেল। কিছুতেই বুঝতে পারছে না তাসকিন কেন আত্মহত্যা করবে৷ এই তো কিছুক্ষণ আগেই কথা হলো। দুজনে এক সাথে কত স্বপ্ন বুনল। আয়েশার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। তাই নিশ্চিত হওয়ার জন্য তাসকিনের ছোট বোন সনিয়াকে কল দিল। সনিয়াকে পরপর চারবার কল দেওয়ার পরও তুলল না সে৷ আয়েশার ছটফটানি বাড়তে লাগল। তাসকিনকেও কল দিয়ে পাচ্ছিল না। সব মিলিয়ে সে খুব হতাশ হয়ে বসে আছে। মনের মধ্যে নিশ্চয়তা অনিশ্চয়তা দুটোই কাজ করছে৷ এর মধ্যে তার মা সহুরা বেগম এসে সজোরে কান্না করে দিলেন। মেয়ের পাশে বসে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আহাজারি করতে লাগলেন। আয়েশার এবার বুঝতে বাকি রইল না সাবিদ যা বলেছে সবটা সত্যি। সে দম ধরে বসে রইল। তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না। চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। বুকের যন্ত্রণা বহুমাত্রা বেড়ে গেলেও সেটা প্রকাশ করতে পারছে না। হাত দুটোতে তাকিয়ে দেখল এখনও মেহেদী রাঙা হয়ে আছে। টুকটুকে লাল হয়েছে মেহেদী। স্বাভাবিক মৃত্যু হয়তো এত কষ্ট আয়েশাকে দিত না কিন্তু আত্মহত্যার ব্যাপারটা সে মানতে পারছে না। নিজের অজান্তেই দম ধরে বসে ছিল। চোখ দিয়ে পানি বের হওয়া ছাড়া আর কোনো উপক্রম তার মধ্যে পরিলক্ষিত হলো না। তার মা সহুরা বেগম তার দিকে তাকিয়ে তার অবস্থা দেখে আরও জোরে কেঁদে দিয়ে বলল
– মা রে একটু চিৎকার দিয়ে কান্না কর ভালো লাগবে।
আয়েশা আর কোনো কথা বলতে পারছে না। শুধু হাতের দিকে তাকিয়ে চোখের জল ফেলছিল।
আস্তে গলায় বলল
– মা আমি আসকিনদের বাসায় যাব। তাকে দেখতে চাই।
কথাটা বলেই চুপ হয়ে গেল আয়েশা। সহুরা বেগম তাকে ধরে নিয়ে রুম থেকে বের হলেন। আয়েশার বাবা আমজাদ সাহেব স্থির হয়ে তখন সোফায় বসে ছিলেন। নিজের একমাত্র মেয়ের এ অবস্থা যেন মানতে পারছেন না। কী থেকে কী হয়ে যাচ্ছে সেটা তিনি বুঝতে চেয়েও যেন বুঝতে পারছেন না। আয়েশাকে দেখে হুহু করে কেঁদে সহুরা বেগমকে বললেন
– ওকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছ?
– তাসকিনকে একটু দেখে আসুক। আর তো দেখতে পাবে না।
বলেই কেঁদে দিলেন।আয়েশা তখনও স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তাসকিনদের বাসা খুব একটা দূরে না মিনেট পাঁচেকের পথ। সহুরা বেগম নিজের মেয়েকে নিয়ে বের হলেন। চারপাশটা তখনও বিয়ে বাড়ির আমেজে ঝলমল তবে কেমন জানি ফিকে আর নির্জীব হয়ে আছে। রিকশাও নেই যে রিকশা করে যাবে। সহুরা বেগম আস্তে গলায় বলল
– হেঁটে যেতে পারবে?
আয়েশা শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। চেনা পথটায় হাঁটছে আয়েশা। চোখের সামনে কত স্মৃতি জমে উঠছে তার। কত কিছুই মনে হচ্ছে। এর মধ্যেই মনে হলো কেউ তার পাশ দিয়ে হাঁটছে। পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখল কেউ নেই। আবারও হাঁটতে শুরু করল। মনে হলো কেউ একজন তার হাত ধরেছে কিন্তু পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখল কেউ নেই। মুহূর্তেই হাতের স্পর্শটাও বিলীন হয়ে গেল। এমন কেন মনে হচ্ছে তার সেটা সে বুঝতে পারছে না। মিনেট আট পর দুজনেই উপস্থিত হলো তাসকিনদের বাসায়। সহুরা বেগম সেখানে গিয়ে আয়েশার হাতটা ছেড়ে দিল। চারপাশটায় মানুষ গিজগিজ করছে। বিয়ে বাড়ির হুলুস্থুল যেন ক্রমশেই মলিন হয়ে আহাজারিতে রুপ নিল। আয়েশা মানুষের ভীড় ঠেলে ভেতরে ঢুকল। তাসকিনের ঘরের দরজাটা খোলা। তাসকিনের লাশটা ঝুলছে। আয়েশা কাঁদতে চেয়েও পারছে না৷ তার চোখে কিছু বিষয় পরিলক্ষিত হলো। ঝুলন্ত লাশটাকে সে দেখতে লাগল। লাশটার কাছে যেতে চাইলে অনেকে বাঁধা দিল। পুলিশ আসার আগে লাশ ধরা যাবে না তাই। তবুও সে লাশটার একটু কাছে গেল। তাসকিনের পায়ের নখগুলো খেয়াল করল। প্রতিটা নখে ক্রস চিন্হ করে লাল দাগ কাটা। পায়ের গোড়ালিতে কিছু লেখা সেটা আরবি হরফও হতে পারে তবে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে না। পায়ের উপরের অংশে কালো বৃত্ত করা। হাতের দিকে তাকিয়ে দেখল প্রতিটি নখে তীরচিন্হ আঁকা। হাতের তালুতে কিছু লেখা তবে স্পষ্ট না। হাতের উল্টো পিঠে দুটো বাচ্চার ছবি অংকন করা। তবে মুখ স্পষ্ট না। এবার আয়েশা তাসকিনের মুখের দিকে তাকাল। সাধারণত ঝুলন্ত লাশের মুখ নীচের দিকে ঝুলে থাকে তবে তাসকিনের মুখটা দক্ষিণ দিক বরাবর করা। চোখ গুলো উল্টানো। মনে হচ্ছে কিছু দেখেছিল সে। আয়েশা দেয়ালের দিকটায় তাকাল। তেমন কিছুই তার চোখে পড়ল না। শুধু মনে হয়েছিল একটা বাচ্চার অবয়ব দেয়ালে আছে তবে সেটা কী তার মনের ভুল ধারণা নাকি সত্যি! কান্নার সময় সে পাচ্ছে না এসব লক্ষ্য করে। বারবার মনে হচ্ছে তার হবু বর আত্মহত্যা করেনি। এমন কিছু হয়েছে যেটা সে বা অন্যরা জানে না। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। এর মধ্যেই পুলিশ এসে পড়ল। আয়েশাকে বাইরে যেতে বলল। সে কোনো কথা না বলেই বাইরে গিয়ে পাথরের মতো বসে পড়ল। তার চোখ দিয়ে কোনো জল পড়ছে না। নেই কোনো আহাজারি শুধু এটাই মনে আসছে হাতে পায়ে এসব কী? তার মাথায় এসবেই ঘুরপাক খাচ্ছে।
লাশটা নামানো হলো। লাশটা নামাতেই আয়েশা দৌড়ে গেল। সেখানে গিয়ে শার্টের বোতমের ফাঁক দিয়ে কী যেন কালো দেখা যাচ্ছে বুকে লক্ষ্য করল। সে শত বাঁধা উপেক্ষা করে ঝাঁপটে পড়ল তাসকিনের উপর। শার্টটা একটু উপরে তুলে বুকটা দেখে নিজেই চমকে গেল। তাসকিনের বুকের বা পাশে একটা ঈগলের ট্যাটু করা। এটা কবে করাল, সে শুধু এটাই ভাবছে। রাতেই তো ভিডিও কলে কথা বলল তখন তো এমন ছিল না। তার মাথা ঘুরপাক খেতে লাগল। এতক্ষণের জামানো কান্না সব একসাথে এসে থুবরে পড়ল। জোরে চিৎকার দিয়ে তাসকিনের মাথাটা বুকে নিতেই ভয় পেয়ে গেল। মাথার পেছন দিকটায় কোনো গর্তের মতো কিছুতে যেন তার হাত আটকে গেল। সে তাড়াহুড়ো করে পেছন দিক দেখল।।লক্ষ্য করল পেছন দিকটায় একটা গর্ত। অথচ তাতে কোনো রক্ত নেই। একটা মানুষের মাথা গর্ত করল তাতে রক্ত থাকবে না এটা কেমন! আর তাসকিন আত্মহত্যা করলে অবশ্যই তার মাথার পেছন দিকটা এমন হত না। এমন সময় আয়েশা সামনের দিকে তাকাল। একটা বাচ্চা যেন হামাগুড়ি দিয়ে যেতে লাগল।
সে জোরে চিৎকার করে উঠল। জোরে জোরে বলতে লাগল এটা স্বাভাবিক মৃত্যু না। তার কথায় কেউ পাত্তা দিল না। তাকে ধরে তাসকিনের থেকে আলাদা করে বসানো হলো। ভোর ছ’টা বাজে লাশ নিয়ে থানায় গেল পুলিশ। এদিকে আয়েশা শুধু ভাবতে লাগল এটা কখনই স্বাভাবিক মৃত্যু হতে পারে না। চুপচাপ বসে রইল কতক্ষণ। পুরো বাড়ি এখন নীরব। সহুরা বেগম আয়েশার কাছে গিয়ে বলল
– বাড়ি চল।
এমন সময় সনিয়া এসে তার পাশে বসে কাঁদতে কাঁদতে বলল
– ভাবি তোমার মতো আমারও মনে এমন সন্দেহ লাগছে। ভাইয়া কখনও আত্মহত্যা করতে পারে না। জানো গতকাল একটা ঘটনা আমার সাথেও ঘটেছে। আমি জানি সেটা কেউ বিশ্বাস করবে না।
আয়েশা নিজেকে শক্ত করলো। তার মাকে দূরে বসতে বলল। সনিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল
– আমাকে বল কী হয়েছিল।
সনিয়া বলা শুরু। সনিয়ার কথা যত শুনছিল ততই আয়েশার বুক কেঁপে উঠছিল।
(কপি করা নিষেধ)
নোট-
প্রিয় পাঠক/পাঠিকা
গল্পটা ভৌতিক। এ গল্পের সাথে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। গল্পটা পড়ে বিজ্ঞান বা বাস্তবতা খুঁজবেন না। মনগড়া একটা কাহিনি। সে সূত্র ধরেই পর্ব এগুবে।