#রোদেলা
লেখা: #মাহাবুবা_মিতু
পর্ব: ৩৭
বড় মামা হঠাৎ একদিন অনেক রাতে রোদেলাদের বাসায় যায়। এত রাতে বড় ভাইকে তা বাড়িতে দেখে নাসিমা হতভম্ব। তারা বাড়ি ছেড়ে এসেছে মাস তিনেক হলো। তার ভাই এ পর্যন্ত এদিকে পা মাড়ায় নি। তাহলে এত রাতে এখানে কেন…?
কোন সমস্যা হয় নি তো….?
বড় ভাই এসেছে, তাকে তো এসব বলা যায় না, নাসিমা তাকে ঘরে এনে বসতে দিলেন। রোদেলাকে বললো চা বসা৷ এত রাতে বড় মামা কখনো চা খান না। তা রোদেলার জানা আছে। রোদেলাকে এখান থেকে সরাতেই তার এই আদেশ তা বুঝতে সময় লাগে না ওর। তাই বাইরের ঘরে চলে যায় ওরা দু বোন । ওদের তো আর আলাদা ঘর নেই সামনে হাঁটাচলার যে পথ সেখানে সিংঙ্গেল ডিভানের মতো বক্স খাট পাতা। সেখানেই বসে দুই বোন।
এরপর নাসিমার সাথে তিনি কথা বলেন। তার গাফলতির কথা, অসহায়ত্বের কথা, অপারগতার কথা। একমাত্র এই ব্যাক্তির কথা নাসিমা অখণ্ড মনোযোগ নিয়ে শুনেন। তার ভিতরে কি হচ্ছিল তা ভাষায় প্রকাশ না করলেও তার অশ্রু যেন কথা বলছিলো সেদিন। ভাইকে কিছুই বলে নি সে। প্রতিবারের মতো এবারও বলেছেন যা ভালো বুঝেন তাই করেন। যেন নাসিমার নিজের কোন বুঝ নেই, ভবিষ্যতের ভাবনা নেই।
বড় মামা পূর্বাচলে নির্মানাধীন বাড়িটা বিক্রি করে দিবে। সে বাড়িতে নাসিমার ও একটা অংশ রয়েছে। তাই যৌক্তিক দিক থেকে তাকে জানানো, তার অনুমতি নেবার একটা ব্যাপার রয়েছে। যদিও তিনি অনুমতির ধার ধারলেন না। তিনি শুধুমাত্র জানাতে এসেছেন। বলেছেন বেঁচে থাকলে তার ঋণ তিনি অবশ্যই পরিশোধ করবেন। কিভাবে করবেন তার উল্লেখ তিনি করেন নি। নাসিমা বুঝলো ব্যাপারটা। টাকাটা জোগাড় হলে বাড়িটা হাতছাড়া হবে না। পরে তার ভাই তার একটা ব্যাবস্থা ঠিক করে দিবে। তিনি জানেন নাসিমা এতে আপত্তি করবে না। তাই তাকে এ কথা জানাতে এত রাতে তার আগমন।
সে সপ্তাহের মধ্যেই পূর্বাচলের নির্মাণাধীন চারতলা বাড়িটা বিক্রি করে দিলেন। অনেক দরদাম শেষে ঠিক হলো ৬০ লাখে। কিছু টাকা অগ্রীম দিয়ে রেজিস্ট্রার করে নিলেন তারা। সে টাকাটা ছোট ভাইকে দিলেন বড় মামা। বললেন এ মাসের মধ্যেই বাকী টাকা ফেরত দিবেন তিনি। গত কয়েকদিনের ব্যাবধানে বড় মামার বয়স যেন অনেক বেড়ে গেছে। ইদানীং শরীরটাও ভালো না তার। এর আগে খেয়েছিলেন ধাক্কা এবারকার টা রীতিমতো আছার। আঘাতে মুষড়ে পরছিলেন তিনি। বড় মামী ধীর বুদ্ধির লোক। তাকে তেমন বিচলিত না লাগলেও তিনি যে মনে মনে ভঙ্গুর তা তার চলাফেরায়ই বোঝা যাচ্ছে।
কিন্তু তিনি এত শক্ত মহিলা তা এমন পরিস্থিতি না আসলে কেও জানতেই পারতো না। এদিকে নাতাশা ওর ছোট চাচার এমন ব্যাবহার জানতে পেরে ভীষণ অবাক হয়, বাড়ি এসে খুব রাগ করে ওর বাবার সাথে কেন ওকে এসব জানায়নি তাই।
মনে মনে ভীষণ কষ্ট পায় নাতাশা। যে ভাইকে বাবার মতো দায়িত্ব নিয়ে মানুষ করলো সে-ই কিনা দিন শেষে….
নাতাশাকে ওর বাবা বলে
: এখন এসব ভেবে লাভ নেই, আমি যা-ই করেছি ভাইবোনদের জন্য, তা আমার দায়িত্ব ছিলো। তাছাড়া টাকাটা আমি ঋণ হিসেবে নিয়েছিলাম। তাই ও চাচ্ছে, এতে তো ওর দোষ দেখছি না।
: বাবা…! দোষ জীবনে তুমি দেখেছো….
ঐ যে তোমার মা-বোন আমার মায়ের জীবনটারে কয়লা বানিয়েছেন তাই তোমার চোখে ঠেকে নাই এ জীবণে এত ভারী তোমার চোখের পর্দা। এ আর কি তার কাছে….
আর কি বললা – ঋণ….! তোমার বাবা যখন মারা গেলেন তখন তোমাদের এই বাড়িটাই ছিল একমাত্র সম্পদ। এই বাড়ি তো ভাড়াও দেও নি কোন দিন। নিজেরাই ছিলে। ঐ যে কুত্তার পাল ছিলো তাদের খাওয়া, পড়াশোনা, কাপড়চোপড় কোত্থেকে আসছে, কে জোগাড় করেছে তা কি সবাই ভুলে গেছে। একেকজনকে পড়াশোনা করিয়েছো, বিয়ে দিয়ে দিয়েছো, ইদরে-এইরে সেইরে চলে আসছে এখনো পর্যন্ত।
নাতাশার মা রান্না ঘর থেকে দৌড়ে এসে নাতাশাকে ধমক দিলো
: নাতাশা, কি সব বলছিস তুই, এগুলো আবর কেমন ভাষা…
: রাখো তোমার ভাষা, আমার বাবার জীবণ শেষ এদের দেখতে দেখতে, সেই ঋণ কে শোধ করবে…?
এদের যিনি জন্ম দিয়েছেন তিনি তো মরে খালাস হয়েছে, তিনি তো এই বাড়ি ছাড়া কিছুই রেখে যান নি। সবই লুটিয়ে গেছেন মরার আগে। আর আমার বাবা এ বাড়িটাকে, বাড়ির মানুষগুলোকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে আজীবণ। সেই ঋণ কে শোধ করবে।
নাতাশার মা নাতাশাকে একটা থাপ্পড় দিলো
নাতাশার বাবা মাথা নিচু করে চুপচাপ শুনছে সব। জীবণ নামের জটিল অংকটার হিসেব কষছেন হয়তো। উত্তর মিলছে না তাই বার বার তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। এমনটাতো হবার কথা ছিলো না।
নাতাশা কান্না জড়িত কন্ঠে বললো-
এ বাড়ি তুমি লিখে দাও ওদেরকে৷ তোমাদের দুজনকে আমি আমার কাছে নিয়ে যাবো। এ অমানুষদের কাছে রাখবো না আমি তোমাদের। যারা বাবার মতো বড় ভাইকে এমন হেনস্তা করে টাকার জন্য তারা যে তোমাদের খুন করবে না তা কে বলবে……!
ঘরে থাকা সবাই চুপ, যেন জীবণ নাটকের এর পরের অংশের কথা গুলো হারিয়ে গেছে।
বড় মামার মন্দ ভাগ্যর বিড়ম্বনা এখানেই শেষ হলে পারতো। কিন্তু না, যার কপালে যতটুকু ভোগান্তি থাকে তাকে তা পোহাতেই হবে। এরিমধ্যে একদিন পাওনা টাকা আনতে গিয়ে বেশ রাত করে ফিরেন তিনি। বাড়ি ফিরে কেমন চেহারা করে যেন বসে থাকে খাটের এক কোনে। কোন কথা বলে না কারো সাথে। বড় মামী ভয় পেয়ে যায় তার এই আচরণে। হঠাৎ বুকে হাত দিয়ে পরে যান মাটিতে। হার্ট অ্যাটাকের মতো অবস্থা, তাকে দ্রুত হসপিটালে নেয়া হয়। দুদিন পর একটু সুস্থ হলে জানা যায়- কিছু টাকা নিয়ে তিনি যে জমির রেজিস্ট্রার করে দিয়েছেন তারা একসপ্তাহ সময় নিলেও টাকাটা দিতে গড়িমসি করেছিলো। শেষ যেদিন গেলো তাকে হাত-পা বেঁধে একটা ঘরে আটকে রেখেছিলো টানা সাত ঘন্টা, তারা নাকি বড় মামাকে পি*স্তল দেখিয়ে নিষেধ করেছেন আর আসতে। এর পরের বার আসলে লা*শ হয়ে ফিরতে হবে তাও বলে দিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে শরীর, মাথা কাজ করার কথা না। তাই তার এমন বেহাল অবস্থা। বড় মামী যেন কান্নাও ভুলে গেছে। বড় মামার চেহারায় দিশেহারা ভাব।
এদিকে বোনেরা এসে স্বান্তনা দেন বড় ভাইকে। আগুন লাগলে পানিতে নিভে কিন্তু সাগরেই যদি আগুন লাগে সে আগুন নিভবে কিভাবে…?
বোনেরা ছোট ভাইয়ের সাথে কথা বলে। সময় দিতে বলে বড় ভাইকে। সে চলে যাবে আগামী মাসে। সময় কম হাতে, তাই বোনদের অনুরোধে বড়জনকে সময় দেয়। কিন্তু বড় মামার সময় নিয়েই বা কি লাভ টাকা তিনি দিবেন কোত্থেকে।
শেষ ভরসার জায়গা যখন থাকে না তখন নাকি মানুষ খড়কুটো আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়। নাতাশা বললো বাবা তুমি একদমই চিন্তা করবে না। আমি কল্লোলকে টাকাটা দিতে বলবো। টাকাটা আমি ধার হিসেবে নিবো। এ ঋণ নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না বাবা, এ ঋণ আমি শোধ করবো কল্লোলকে। বড় মামী এসব পারিবারিক বিষয় জানাতে না করে কল্লোলকে। নাতাশা তখন বলে মা-
আত্মীয়রা শুধু ইদে, উৎসবে বেড়ানো, খাওয়ার জন্য আর কি দিবে তা নেওয়ার জন্য না। বিপদে পাশে থাকর জন্য ও। কথাগুলো যে বাকী দুই ফুফুকে খোঁচা দিয়ে বলেছে নাতাশা, তা তারা ঠিকই বুঝলেন। ছোট বোন হওয়ায় এটা সেটা সবসময় আবদার চলে ভাইয়ের কাছে। আর এখন যখন ভাইয়ের বিপদ তখন দুটো কথা বলার লোকও পাওয়া যায় না। তাই নাতাশার এই কথার বান তাদের প্রতি। তারা কোন প্রতিবাদ করে না। আসলে বড় মামী ভীষণ ভালো মানুষ কিনা। তাদের এসব ভুল, অন্যায় সবসময় ছোট বলে ক্ষমার চোখে দেখেছে। তার এই বড় মন তাদের অমানুষ করেছে। তাছাড়া বড় মামাও কড়া মানুষ। তিনি তার স্ত্রীকে থোড়াই কেয়ার করেছেন। অথচ এই বিপদে অনেক সুযোগ থাকা সত্ত্বেও একটা কটু কথা ও শোনায়নি স্বামীকে।
বড় মামা তাই মনে মনে অনুতপ্ত। এই ভাইবোনের জন্য নিজের স্ত্রীকে তুচ্ছজ্ঞান করেছেন দিনের পর দিন, বছরের পর। না ভালোবেসেছে স্বামী না শ্বশুড়বাড়ির কোন ননদ। তবুও কোন অভিযোগ নেই তার। এসবে মানিয়েছেন নিজেকে দিনে দিনে। আজ তাই এসব কষ্ট তাকে স্পর্শ করে না।
বড় মামী নাতাশাকে বলে দিয়েছে আমরা মরেছি মরেছি, এসবে তুই নিজেকে জড়াইস না মা। এক টাকা দুই টাকা না লাখ লাখ টাকার মামলা। জামাই জনের ঘর। আজ ভালো তো কাল এসব নিয়ে তোদের মধ্যে ঝামেলা হবে। দরকার নাইরে মা। কপাল যদি ভালো হতো তাহলে তো তোর ভাইই বুঝতো, আমাদের দুঃখ ও হতো না….
চলবে…