#কহিনুর_দ্বিতীয়_খণ্ড,পর্ব:২৩
কলমে: ইয়াসমিন
মৃ*ত্যু*র মুখে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের হৃদয় আর শরীরে কেমন অনুভূতি হয়ে শুধুমাত্র সেই জানে। পৃথিবী ছেড়ে কেউ সহজে যেতে চাইনা। পাথরের বুক ধুকপুক করছে। সুউচ্চ বিল্ডিং থেকে পড়ে ভেবেছিল এই বুঝি জীবন প্রদীপ নিভে গেলো কিন্তু কথায় বলে হায়াৎয়ের মালিক ইশ্বর। কার কখন কিভাবে মৃত্যু হবে সেটা একজন ছাড়া কেউ বলতে পারে না। বাতাসে সঙ্গে কাঁপতে কাঁপতে পাথর ঝপ করে সুইমিং পুলের টলটলে নীল পানিতে গিয়ে আছড়ে পড়লো ফলে পানি চারদিকে ছড়িয়ে গেলো। কিছু বুঝে উঠার আগেই পাথর পানি থেকে ভেসে উঠলো। চোখ বন্ধ করে ঘনঘন নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করলো। হার্ট স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি বিট করছে। তবুও শান্তি কিছু হয়নি। ওর সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে হঠাৎ মেয়েলি কণ্ঠের চিৎকার শুনে ও চমকে উঠলো। এমনিতে আতঙ্কে ছিল তারপর আবার হঠাৎ গগনবিদারী চিৎকার তাই ভয়ে লাফিয়ে উঠে আশেপাশে তাঁকিয়ে চোখ গোলগোল করে ফেলল। ওর সামনে এক সুন্দরী রমনী অর্ধ নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাথর দ্রুত পেছন ফিরে ইংরেজিতে বলে উঠলো,
> সরি সরি আমি ইচ্ছে করে এমন করিনি।
মেয়েটা ভ্রু কুচকে আছে। হয়তো পাথরের উপরে বিরক্ত। পাথর কিছু বুঝতে পেরে বলল,
> উপর থেকে আমাকে ফেলে দেওয়া হয়েছে। কিছু মনে করবেন না। আমি এখুনি চলে যাচ্ছি।
কথাটা বলে পাথর ঝটপট পানিতে সাতার কেটে পুল থেকে উঠে পড়লো। দ্রুত চলে আসতে চাইলো কিন্তু পেছন থেকে আওয়াজ আসলো,
> আমি কিছু মনে করিনি। হঠাৎ ভয় পেয়েছি এই যা। কে তোমাকে ফেলে দিয়েছে?
পাথর হাসার চেষ্টা করলো কিন্তু হলো না। এই অবস্থায় হাসিটা ঠিক আসছে না তবে মেয়েটার মুখে অমায়িক হাসি ফুঁটে উঠলো। সাদা শার্ট আর কালো রঙের জিন্স পাথরের শরীরের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার। কালো কেশ পল্লব থেকে ফোটা ফোটা পানি গড়িয়ে মুখ বেয়ে থুতনিতে গিয়ে বুকের উপরে আছড়ে পড়ছে। পায়ের থেকে গোটানো জিন্সের জন্য ফর্সা পায়ের বেশ কিছু অংশ দৃশ্যমান। মেয়েটা এক দৃষ্টিতে ওকে দেখছে। পাথরের অস্বস্তি হচ্ছে। দ্রুত পা চালিয়ে সরতে চাইলো কিন্তু কপাল ওর সঙ্গ দিলো না। মেয়েটা মলায়েন কণ্ঠে আবারও বলে উঠলো,
> আমি সূচিতা তৃতীয় ফ্লোরে থাকি। আর আপনি?
পাথর কি বলবে বুঝতে পারলো না। হঠাৎ পরিচয়ে কাউকে নিজের বাসার ঠিকানা দেওয়া ঠিক হবে কি ভেবে ও মিথ্যা করে বলে দিলো,
> আমি টেন ফ্লোরের বাসিন্দা। দেখা হবে কখনও তবে আজ আসছি।
পাথর আর সময় নষ্ট করলো না। প্রস্থান করলো। পায়ে হালকা চোট পেয়েছে ব্যাথা ক্রমগত বৃদ্ধি হচ্ছে। একটু এদিক সেদিক হলেই খবর ছিল। মনে মনে শুকরিয়া করলো আল্লাহর কাছে। ভাবতে ভাবতে ও কক্ষে ফিরে আসলো। কিন্তু এখানে এসে আরেক ঝামেলা। কক্ষের চাবি নেই কাছে। ভেতর থেকে বন্ধ। বিষয়টা নিয়ে ওকে খুব ভাবাচ্ছে। কক্ষে ও ছাড়া দ্বিতীয় কোনো মানুষ ছিল না তাহলে ওকে ধাক্কা দিলো কে? কোনো মানুষ ছিল নাকি অন্যকিছু? বিষয়টা জটিল লাগলো। শেষমেশ নিচে গিয়ে অতিরিক্ত চাবিটা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে সক্ষম হলো।
*********
শামীর তালুকদারের উচিত শিক্ষা হয়েছে। লোভে পাপ আর পাপে মৃত্যু কথাটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। সুলতান পরিবারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে গিয়ে নিজের পরিবার ভাঙতে বসেছে। পাথর উনার নিজের ছেলেনা কথাটা উনি কখনও ভাবেননি। ছেলেটাকে ছোট থেকে বড় করেছেন। এই বিয়ের জন্য ছেলেটা উনার থেকে দূরে। কথা বলছে না ফোন রিসিভ করছে না। বলে দিয়েছে এই কোম্পানির উপরে ওর কোনো দাবি নেই। সবটা শামীর তালুকদারের নামে ও লিখে দিবে। বিনিময়ে ও এই পরিবারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখবে না। ওকে যেনো আর বিরক্ত না করা হয়। ছেলেটা একরোখা টাইপের। যা বলে তাই করে। এই কাজটা যে ও করবে না এমন নিশ্চয়তা নেই। ছেলেটা কোম্পানির সব কাজ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে। শামীর তালুকদার বুঝলেন কত বড় ভূল করে ফেলেছেন। কিভাবে সবটা ঠিক করবেন এটা ভেবেই শরীরের ঘাম ছুটে যাচ্ছে। সুলতানরা আবারও নিজেদের মতো রাজ করতে শুরু করেছ। সুলতান পরিবারের সম্পত্তি কহিনুরের কিন্তু সেতো এখনো বাচ্চা। উপযুক্ত না হলে টাকা পয়সা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। জুবায়ের ফারুকী বা জামসেদ ফারুকী আত্মীয় বলে কোনো আপোষ করবে না। উনি ঘরময় পাইচারী করতে করতে শেষমেশ জ্ঞান হারালেন। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নেওয়া হলো। হার্ট এটাক করেছেন অপারেশন জরুরি। উনার স্ত্রী বাধ্য হয়ে পাথরকে ফোন দিয়ে আসতে বলল। পাথর আসবে না ভেবেও আসলো। বাবা হিসেবে জানতো এতদিন মোটকথা ভালোবাসে। আসতেই হতো। হাসপাতালে পৌঁছে নিজ দায়িত্বে সব দেখাশোনা করলো। অপারেশন শেষে ও আন্টির সামনে গিয়ে বসলো। ভদ্রমহিলা কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। পাথর উনার পাশে বসে চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলল,
> কিচ্ছু হবে না তুমি কান্না থামাও। এভাবে কাঁদলে অসুস্থ হবে তখন তোমাকে নিয়ে আবার দৌড়াদৌড়ি করতে হবে। আন্টি প্লিজ।
মিসেস তালুকদার মলিন হেসে পাথরের হাতটা নিজের মুঠোয় নিয়ে চুমু দিয়ে বললেন,
> অসুস্থ হলে তুমি তো আছো ভয় কিসের আমাদের? ফোন ধরছো না উনি তোমার টেনশনে অসুস্থ হয়ে গেছেন বুঝতে পারছো? সেদিন আমি তোমাকে আটকানোর জন্য কথাগুলো বলেছিলাম। যেটা উনি জানেন না। ভেবেছেন তুমি রাগ করে উনার থেকে দূরে আছো। তোমাকে উনি নিজের ছেলে ভাবেন তাই তোমার উপরে এভাবে অধিকার দেখান। পাথর তুমি বাচ্চা না যে বুঝতে পারবে না। দেখো যে আমাদের ছেড়ে যেতে চাই বা যায় তাদের ভূলে আমাদের সঙ্গে যারা থাকে তাদেরকে নিয়ে সামনের দিকে এগোতে হয়। তোমার জন্য যদি উনি মারা যায় তুমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে তো? বাবা আমার ফিরে আসো। এই বয়সে ছেলের কাঁধে মাথা রেখে বাকীটুকু জীবন পার করতে চাই। কখন জানি পৃথিবী ছাড়ি।
ভদ্রমহিলা কথা থামাতেই পাথর উনাকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে ফেলল। সত্যিই তো যারা ছেড়ে যায় তাদের কথা ভেবে কষ্ট পাওয়ার কি মানে আছে? যারা আছে তাদের মনের মতো হয়ে সুখে থাকাই তো ভালো। পাথর সিদ্ধান্ত নিলো এখন থেকে দূরে না। কাছেই থাকবে আর শামীর তালুকদারের মনের মতো নিজেকে গড়ে তুলবে। কারো সঙ্গে পাল্লা দিয়ে না নিজের মতো কোম্পানি চালাবে। অর্থ উপার্জন করে সবাইকে চমকে দেবে। কথাটা ভেবে ও দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। মিসেস তালুকদার হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। পাথর ফোন ধরছে না দেখে উনারা গতকাল রাতেই জার্মানি ফিরে এসেছেন। টেনশন নিয়ে বাংলাদেশ থাকা সম্ভব ছিল না।
**********
কহিনুরের জ্বর কিছুটা কমেছে। সারারাত অধরা আর জুবায়ের মেয়ের সঙ্গে ছিলো। গত দুইদিন ধরে অসুস্থ। জামসেদ রাতে বেশ কয়েকবার খোঁজ নিয়ে গেছে। ভোরবেলা মেয়েটার জ্বরের প্রকোপ কমতেই অধরা জুবায়েরকে ঘুমিয়ে যেতে বলল। সারারাত জেগে থাকলে অসুস্থ হয়ে যাবে তাই। কিন্তু অজান্তে নিজেও মেয়ের পাশে ঘুমিয়ে পড়লো। জুবায়ের আর অধরার মাঝখানে কহিনুর বাচ্চাদের মতো ঘুমিয়ে আছে। কহিনুর জ্বরের ঘোরে ছোট ছোট করে বিড়বিড় করে কিছু উচ্চারণ করলো। শব্দ কানে যেতেই অধরা নড়াচড়া করে আবারও ঘুমিয়ে গেলো। একেবারে ঘুম ভাঙলো বাইরে থেকে আসা আওয়াজ শুনে। কক্ষের দরজা অর্ধেক খোলা তাই সাউন্ড আসছে।ও ধড়ফড় করে উঠে বসলো। জুবায়ের উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে আছে। অধরা ফিসফিস করে ওকে ডাকলো কিন্তু ও উঠলো না। শেষমেশ অধরা একাই বিছানা থেকে নেমে পড়লো। নিচে নামতে নামতে দেখলো জামসেদ কারো সঙ্গে চিৎকার চেচামেচি করছে। দাদুও আছে সঙ্গে। ভালো করে খেয়াল করলো একটা মেয়ে কিসের একটা পেপার দেখাচ্ছে সবাইকে। অধরা কৌতূহলী হয়ে মেয়েটার কাছে জিঞ্জাসা করলো,
> কি সমস্যা আমাকে বলুন?
মেয়েটা বিরক্তি মাখা মুখটা আরও খানিকটা কুচকে নিয়ে পেপার বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
> আমি সুলতান জামসেদ ফারুকীর বিবাহিত স্ত্রী মিসেস রুবিনা ফারুকী। উনি আমাকে বিয়ে করে এখন মানতে চাইছে না। এর বিচার চাই আমার। আমাদের একটা বাচ্চাও আছে। আমি বাচ্চার পিতার পরিচয় চাইছি আশাকরি দেওয়া হবে।
রুবিনা মেয়েটার চোখে মুখে কথা ছুটছে। প্রচণ্ডভাবে বেপরোয়া যাকে বলে। জামসেদ ফারুকীর মুখটা দেখার মতো হয়েছে। অধরার ইচ্ছে হলো শব্দ করে একটু হাঁসতে। কি শান্তি যে লাগছে কিন্তু মেয়েটা যে মিথ্যা বলছে সত্য না ভেবেই মুখটা মলিন হলো। জামসেদ বিয়ের কাবিনটা টেনে নিয়ে বলল,
> একদম মিথ্যা বলবি না। তোর মতো গণিকাকে স্ত্রী হিসেবে মানবো কিভাবে ভাবলি? সুলতান পরিবারের বউ হওয়া এতো সোজা? যোগ্যতা কি তোর যে এসব জালিয়াতি করতে এসেছিস জাল দলিল নিয়ে। মুখ ভে*ঙে দিব।
মেয়েটা ফুঁসে উঠলো। অধরা সবাইকে শান্ত হতে বলে দম নিয়ে বলল,
> একদম চুপ থাকেন। টেনশন কিসের?বাচ্চা কার সেটা ডিএনএ টেষ্ট করলেই ধরা পড়বে । আমার পরিচিত একজন ভালো ডাক্তার আছে আজকের মধ্যে রিপোর্ট করব। আসুন আপনি।
অধরা মেয়েটাকে ঘরে নিতে চাইলো কিন্তু মেয়েটা লাফিয়ে উঠে সরে গেলো। বিড়বিড় করে বলল,
> আমি কোনো টেষ্ট করাবো না। উনি আমার স্বামী কাগজপত্র ঠিক আছে এখন আমি এই বাড়ির বউ এখানেই থাকবো।
জামসেদ রাগের চোটে ট্রি টেবিলে লাথি দিয়ে বলল,
> তুই যাবি নাকি পুলিশে ফোন করবো?
অধরা ছুটে গিয়ে মেয়েটাকে আগলে নিলো। লোকটাকে বিশ্বাস নেই আঘাত করে বসবে। অবস্থা বেশ জটিল হয়ে গেলো। চিৎকার চেচামেচির মধ্যেই কলিংবেল বেজে উঠলো। কাজের মেয়েটা গিয়ে দরজা খুললো। সঙ্গে সঙ্গে এক সুদর্শন যুবক ভেতরে প্রবেশ করল। ছেলেটার মুখে ভূবন ভোলানো হাসি কিন্তু জামসেদের চোখেমুখে বিরক্তির ছায়া। মান সম্মানের প্রশ্ন তাছাড়া এই বাড়ির গেটে এতগুলো গার্ড আর দারোয়ান থাকা সত্ত্বেও কিভাবে বাইরের লোকজন ঢুকে পড়ছে ওর মাথায় আসলো না। ছেলেটা ধীরগতিতে অধরার সামনে এসে মুখ খুলল,
> ম্যাম কোনো সমস্যা? আর রুবিনা তুমি এখনে কি করছো? আবারও কোনো ঝামেলা পাকিয়েছো? দেখো এবার কিন্তু তোমাকে ছা*ড়বো না। গতবার যা করেছো? লোভেই তুমি ম*রবে দেখো একদিন।
ছেলেটার কথা অধরার মাথার উপর দিয়ে গেলো। জামসেদ যেনো আশার আলো দেখলো। ও ঝটপট বলল,
> তুমি মানে আপনি চিনেন এই মেয়েকে? দেখা নেই সাক্ষাৎ নেই হঠাৎ এসে বলছে ও নাকি আমার বউ। এই জামসেদ ফারুকীর বউ। মেজাজ খারাপ করছে।
ছেলেটা ভ্রু কুটি করে রুবিনার হাত টেনে ধরলো তাঁতেই মেয়েটা কুকড়ে গেলো ভয়ে। আর কেউ কিছু বলার আগেই ছেলেটার পায়ের কাছে বসে পড়ে হাত জোড় করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
> ক্ষমা করে দেন স্যার আমার ভুল হয়েছে। লোকজন বলে সুলতান ভিলাতে অনেক পয়সা তাই লোভে পড়ে এহেন কাজটা করে ফেলেছি আর কখনও হবে না। প্লিজ স্যার যেতে দিন।
ছেলেটার কিছু বলতে হলো না। জুবায়ের ভ্রু নাচিয়ে বলল,
> বারে এর মধ্যে বরকে ভূলে গেলি? আমার বাচ্চার মা তুই তোকে এভাবে ছাড়া যায় ! অধরা কি করা যায় বলোতো?
অধরা ঢোক গিলল। এই লোকটা কি করতে চাইছে কে জানে। মেয়েটার কপালে শনি নাচছে এটা সিউর। বাঘের খাচায় ঢুকে বাঘকে বোকা বানানোর মজা হাড়ে হাড়ে পাবে। অধরাকে চুপচাপ ভাবতে দেখে জুবায়ের আবারও বলল,
> ওই বলো? একে কি দিয়ে সেবাযত্ন করা যায়? তুমি তো বাড়ির বউ তাই এই দায়িত্বটা পালন করো। আমার বাচ্চার মায়ের জন্য ফিনাইল আর শক্তিশালী কোনো বিষ দিয়ে মজাদার চিকেন বিরানি রান্না করে আনো। আমি নিজ হাতে ওকে খাওয়াবো।
জামসেদের শীতল কণ্ঠের অদ্ভুত রেসিপির বর্ণনা শুনে রুবিনা ঘেমেঘেটে একাকার। এখান থেকে বের হওয়ার জন্য রীতিমতো শব্দ করে সুর তুলে কাঁদছে আর ক্ষমা চাইছে। জামসেদ সেসব পাত্তা দিলো না। গার্ড ডেকে মেয়েটাকে সরিয়ে নিলো। মেয়েটাকে কে এখানে পাঠিয়েছে সবটা জানতে হবে তার আগে এই অচেনা অগন্তুকের পরিচয় জানা অবশ্যক।
অধরা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ছেলেটাকে বলল;
> তোমার পরিচয়?
ছেলেটা মাথা নিচু করে বাঁকা হেসে উত্তর দিলো,
> নির্জন খান আধার। আসলে আমি একটা লকেট পেয়েছি ওটাই দিতে এসেছি।
অধরা ভ্রু কুচকে ফেলল। জামসেদ বেশ সন্তুষ্ট ছেলেটার উপরে। কিছুক্ষণ আগের ঝামেলাটা আরও বাড়তো যদি এই ছেলেটা না থাকতো। অধরা কৌতূহলী হয়ে বলল,
> কিসের লকেট? আমাদের কিছু তো খোয়া যায়নি। তোমার কোথাও ভূল হচ্ছে।
অধার বুক পকেটে যত্নে রাখা লকেটটা বের করে সামনে ধরতেই অধরা চমকে গেলো। দ্রুত ওটা নিজের হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে বলল,
> কহিনুরের লকেট তোমার কাছে? এটাতো ওর গলাতে ছিল। বাচ্চা মেয়েটা হয়তো বুঝতে পারেনি যাইহোক কোথায় পেয়েছো?
> সমুদ্রের তীরে।
অধরা আরেক দফায় অবাক হলো। কহিনুর কখনও একা কোথাও যায়না তাছাড়া সমুদ্রের তীরে নিকটবর্তী সময়ে ওদের যাওয়া হয়নি তাহলে লকেট ওখানে গেলো কিভাবে? ওকে ভাবতে দেখে জামসেদ উত্তর দিলো,
> সেদিন পার্টির দিনে হয়তো কহিনুর বোবা জেনে কেউ ওর থেকে চুরি করেছে। এতো ভাবতে হবে না। ছেলেটার নাস্তা দাও আমি আসছি।
কথাটা বলে ও বেরিয়ে গেলো। কৃতজ্ঞার খাতিরে অধরা ওকে বসতে দিলো। কাজের মেয়েটাকে নাস্তা আনতে বলে আধারের পাশে বসতে বসতে বলল,
> ধন্যবাদ, কিন্তু তুমি বুঝলে কিভাবে এটা এই বাড়ির মেয়ের? কহিনুর নামে হাজারো মানুষের বসবাস বাংলাদেশে। তাছাড়া কক্সবাজারে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন আসে।
অধরার প্রশ্ন শুনে আধার ঢোক গিলল। সামনে বসে থাকা এই অতি সাধারণ রমনীর বুদ্ধি যে বেশ তীক্ষ্ম সেটা বুঝতে বাকী নেই। তাই বিড়বিড় করে বলল,
> আসলে আমি বেশ কিছু লোকজনকে বলছি ওদের মধ্যে একজন বলল এই বাড়ির কোনো একজন মেয়ের নাম কহিনুর তাই ভাবলাম দেখে আসি। ক্ষমা করবেন বীনা অনুমতিতে এসে বিব্রত করার জন্য।
> না না বিব্রত কেনো বলছো কৃতজ্ঞ আমি তোমার কাছে। এটা আমার শাশুড়ির দেওয়া উপহার ছিল। উনি গত হয়েছেন বহুকাল আগে। তুমি নাস্তা করো আমি তোমার আঙ্কেলকে বলছি।
অধরা উঠে চলে আসতে চাইলো কিন্তু আধার পেছন থেকে করুক সুরে বলল,
> আন্টি আপনার মেয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় করাবেন না? আসলে কৌতূহল আর কি। যদি নিষেধ করেন তবে থাক।
অধরা থমকে গেলো তারপর কিছু একটা ভেবে ওকে আসতে বলল নিজের সঙ্গে। আধার উঠে ডান পা সামনে ফেলে এগিয়ে গেলো। যতই এগিয়ে গেলো ততই বুকের মধ্যে ধুকপুক বেড়ে গেলো। শরীর মন আবারও উত্তেজিত হলো। কহিনুর যার জন্য এই চারটা দিন ওকে কষ্ট পেতে হয়েছে। যার প্রতি রাত কাঁটে অচেনা অচেনা রমনীর সঙ্গে প্রেমলিলাতে অঙ্গ ভাসিয়ে সেই আধার কোনো মেয়েতো দূর কোনো ছেলেকে পযর্ন্ত এখন সহ্য করতে পারছে না। অশান্ত হয়ে আছে। হঠাৎ হঠাৎ রেগে যাচ্ছে। আধার বিড়বিড় করে বলল,
> নিজেকে শান্ত রাখতে তোমাকে আমার চাই কিউটি। যেভাবেই হোক তোমাকে আমার খুব করে চাই। একান্ত নিজের করে। তোমার জন্য আমার হৃদয়ের অনুভূতি গুলো যেমন শুকিয়ে গেছে তুমিই আবার তা ফিরিয়ে আনবে।
কথাগুলো বলতে বলতে ও একটা কক্ষের সামনে এসে উপস্থিত হলো। দরজা ধাক্কা দিয়ে এই ক্ষণিকের দূরুত্ব ঘোচাতে ওর পা অচল হয়ে গেলো। অধরা নিজে দরজা খুলতে খুলতে বলল,
> মেয়েটা দুদিন ধরে ভীষণ জ্বর। এখনো ঘুমাচ্ছে ইচ্ছে করেই ডাকছি না তুমি কিছু মনে করোনা।
আধরারে কানে কথাগুলো পৌঁছালো না। ওর দৃষ্টি কহিনুরের শুকিয়ে যাওয়া শুভ্র রক্তিম মুখটার দিকে নিমগ্ন। হৃদয়ের সকল আহাজারি যেনো থমকে গেলো ক্ষণিকের জন্য। কি সুখ যে অনুভব হলো সেটা ওই জানে। এতো এতো রমনীর সঙ্গে ওর উঠাবসা হয়েছে আজ অবধি এমন মুখ ওর চোখে পড়েনি। একেই ওর চাই যেভাবেই হোক চাই। কিভাবে পাবে এই রমনীকে মাথা ফাকা হয়ে আসলো। তারপর নিজের অভিশপ্ত জীবনের কথা ভেবে যন্ত্রণায় কুকড়ে গেলো তবুও ভাবলো দরকার নেই ওকে স্পর্শ করার। শুধু কাছে থাকলেই চলবে। এমন মুখের দিকে চেয়ে তো হাজার বছর পার করা যায়। পাথরের ধ্যান ভাঙল বাথরুমের দরজা খোলার শব্দ শুনে। জুবায়ের ফ্রেস হয়ে ছেলেটাকে দেখে বিস্মিত হলো। অধরা ওকে শর্টকাট বুঝিয়ে দিলো। জুবায়ের অধরার কাজে বিরক্ত হলো। বাইরের একটা ছেলেকে বেডরুমে কেনো এনেছে ভেবেই রাগ হলো কিন্তু প্রকাশ করলো না।আধারের মুখের দিকে তাকিয়ে ও কিছুটা অনুভব করেছে তাই বলল,
> আরে বাহ আগে আসলে আমার মেয়ের বিয়েতে নিমন্ত্রণ পেতে। যাইহোক অনুষ্ঠানের সময় নিশ্চয়ই বলবো।
আধার ভ্রু কুটি করে বলল,
> কার বিয়ে?
জুবায়ের কটিল হেসে বলল,
> কহিনুরের। চলো বাইরে গিয়ে বসি। নাস্তা করতে হবে তো?
জুবায়ের কোনোরকমে আধারের হাত ধরে টেনে বাইরে বেরিয়ে আসলো। অধরা মেয়ের কাছেই বসে আছে। জ্বরের পরিমাণ দেখছে। আধারের পা টলছে। যাকে নিজের করতে এতো প্রচেষ্টা সেই ওর নেই।। কার নামে এই মেয়েটাকে দলিল করা হয়েছে? কার আমানত ও? আধার হাতের মুঠো শক্ত করে ভাবলো, ওর জন্য আমি হাজারটা অন্যায় করতে পিছিয়ে আসবো না। যেটা আমি চাই সেটা আমি ছলবলে কৌশলে আদায় করি। যা আমার না তা আর কারো না। কথাটা ভেবে ও বেরিয়ে আসলো। পকেটের কোনে পড়ে থাকা ফোনটা অনবরত বেজে চলেছে। খান মঞ্জিল থেকে ফোন আসছে। কি এক বিশেষ দরকারে ওকে সেখানে দরকার হচ্ছে। খান মঞ্জিলের প্রতিটা ইট পাথরের পেছনে আছে রহস্য আর গোপনীয়তা। আধার হাত ঘড়িটা দেখে নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে গাড়ি ছাড়লো। নিশীতে নির্জন প্রান্তে প্রেয়সীকে দেখার সুপ্ত বাসনা বুকের মধ্যে তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে যার পিপাসা মেটাতে ওকে খান মঞ্জিলে যেতে হবে উপাই খুজতে।
চলবে
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।