নেশাক্ত_ভালোবাসা #লেখিকাঃ Tamanna Islam #পর্বঃ ৫২

0
805

#নেশাক্ত_ভালোবাসা
#লেখিকাঃ Tamanna Islam
#পর্বঃ ৫২

আইরাত আর রাশেদ কে পুলিশ অফিসার রা দ্রুত ডেকেছে। সেখানে নাকি আব্রাহামের কি কি পাওয়া গেছে। আব্রাহামের বাকি সব জিনিস পাওয়া গেলেও আব্রাহাম কে পাওয়া যায় নি। এখন বাজছে রাত ৩ঃ৪০ মিনিট। পুলিশ কল করেছিলো আইরাতকে। কল করে এটাই বলেছে যে আব্রাহাম কে পাওয়া যায় নি তবে তার কিছু জিনিস পাওয়া গেছে খাদ থেকে। এটা শুনেই তো আইরাতের মাথায় এক প্রকার বাজ ভেঙে পরেছে। এখন এতো রাতে ইলা আর রনিত কে ছেড়ে যেতেও পারছে না। কি আর করার সকাল হওয়া অব্দি সেভাবেই বসে থাকে।

নিজের কান কেই যেনো বিশ্বাস করতে পারছে না। আব্রাহামের সাথে এটা কি করে হলো। আর সব কিছু ভালোই তো ছিলো হঠাৎ করেই সব কেনো এলোমেলো হয়ে গেলো। এগুলো চিন্তায় যেনো মাথায় ভর করেছে এখন আইরাতের। বুকের ভেতর ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেছে। আইরাত অপলক হীন ভাবে তাকিয়ে ছিলো টুপ করেই এক ফোটা নোনাজল গাল বেয়ে গড়িয়ে পরে। এগুলো কে মুছে ফেলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আইরাতের নেই। আস্তে আস্তে সকাল হয়ে যায়,, সূর্য তার আলো ছড়িয়ে পূর্ব আকাশে উঠে পরেছে। সারাটা রাত এভাবে এক ভাবেই বসে কাটিয়ে দিয়েছে আইরাত। একসময় ইলা ঘুম থেকে ওঠে পরে নামাজ শেষ করে হলরুমে আসে। এসে দেখে আইরাত রনিতকে নিয়ে বসে আছে। সে এখনো ঘুম।

ইলা;; আইরাত, কি হয়েছে? মুখ টা এমন শুকিয়ে আছে কেনো?

আইরাত;; ক ক কিছু না দ দাদি। তুমি রনিতকে দেখো আমি একটু আসছি বাইরে থেকে।

ইলা;; আব্রাহাম কে পাওয়া গেছে তাই না?

আইরাত;; আমি আসি।

আইরাত দ্রুত ইলার সামনে থেকে চলে যায়। খাওয়া-ঘুম যেনো সব লাটে উঠেছে। আইরাত যেই না বাড়ির বাইরে বের হতে যাবে তখনই দেখে রাশেদ আসছে।

রাশেদ;; ম্যাম চলুন আপনাকে সাথে করে নিয়ে যাই।

আইরাত;; চলুন।

আইরাত আর রাশেদ চলে যায়। রাস্তা যতো এগোচ্ছে ভয় যেনো ততোই মন কে গ্রাস করে যাচ্ছে। যেতে যেতে প্রায় অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলো। একসময় গাড়ি থামে সেই অভিশপ্ত পাহাড়ি রাস্তাতে। আইরাত নেমে পরে দ্রুত চলে যায়। পুলিশ অফিসার এগিয়ে আসে। উনি ওভাবে চুপ করে আইরাতের সামনে দাঁড়িয়ে আছে দেখে আইরাত চিল্লিয়ে ওঠে….

অফিসার;;

আইরাত;; এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো। আমার হাসবেন্ড কোথায়?

অফিসার;; স সর, সরি ম্যাম আসলে আমরা গত ২-৩ দিন এই এলাকা আর খাদ টা তন্নতন্ন করে খুঁজেছি কিন্তু আব্রাহাম স্যার কে পাওয়া যায় নি। তবে….

আইরাত;; তবে কি?

অফিসার;; স্যারের দুটো জিনিস পাওয়া গেছে যা থেকে বুঝা যায় যে স্যারের এক্সিডেন্ট….

আইরাত;; কি কি পাওয়া গেছে?

অফিসার গিয়ে একটা নেভি ব্লু কালারের ধুলায় মাখামাখি একটা জেকেট নিয়ে আসে। সেটা একটা পেকেটে জড়ানো রয়েছে যেনো ফিংগার প্রিন্ট না লাগে তাই। আইরাত পেকেট টা নিয়ে নিলো। কারো কোন কথা না শুনে পেকেট টা একদম ছিড়ে ফেলে। ধুলো দিয়ে জেকেট টা শেষ। আইরাত পাগলের মতো করে জেকেট টা হাতে নিয়ে দেখছে। শ্বাস ঘন হয়ে গেছে, জোরে জোরে দম নিচ্ছে আর ইতোমধ্যে চোখে পানি গুলো জড়ো হয়ে চিকচিক করছে। আইরাত জেকেট টা মেলে দিয়ে সামনে দেখে। সেখানে সুন্দর ডিজাইন করা “A” লিখা আছে। কেননা A দিয়েই আব্রাহাম আইরাতের নাম শুরু। আর আইরাত বেশ ভালোই জানে যে আব্রাহাম কেমন টাইপের কাপড় পরে। আর আব্রাহামের প্রত্যেকটা জেকেটে A মার্ক করা আছে। আইরাতের এখন চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে যে না এই আব্রাহাম না, এটা আব্রাহামের না। তখনই পুলিশ অফিসার আইরাতের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে….

অফিসার;; ম্যাম, আমরা আরো একটা জিনিস খুঁজে পেয়েছি। স্যারের গাড়ির লাইসেন্স।

আইরাত;;

অফিসার;; এখানে স্পষ্ট লিখা “আব্রাহাম আহমেদ চৌধুরী”। ইন ফ্যাক্ট স্যারের ছবি পর্যন্ত রয়েছে। আর এটা ছিলো স্যারের ৯ নাম্বার গাড়ি।

আইরাত অফিসারের কথা শুনে কয়েক কদম পিছিয়ে যায়। পা গুলো কাপছে। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি আর নিজের মাঝে নেই। আইরাত অফিসারের কাছ থেকে লাইসেন্স টা নিয়ে এসে পরে।

আইরাত;; রাশেদ?

রাশেদ;; জ্বি ম্যাম!

আইরাত;; আমাকে একটু বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবে?

রাশেদ;; জ্বি ম্যাম অবশ্যই। চলুন।

আইরাত গাড়ির দিকে পা বাড়ায়। তার পেছনে রাশেদ। গাড়ি চলছে আপন গতিতে। আইরাতের হাতে আব্রাহামের জেকেট টা। নিজের বুকের সাথে লাগিয়ে রেখেছে। আব্রাহামের সাথে যে এগুলো হবে তা রাশেদ নিজেও কখনো কল্পনা করে নি। গাড়ির সামনের গ্লাসে তাকিয়ে দেখে পেছনের সীটে আইরাত জেকেট টা নিয়ে বসে আছে। এটা দেখে রাশেদের চোখ থেকেও টুপ করে পানি গড়িয়ে পরে। সাথে সাথে সে তা মুছে ফেলে। বাড়ির সামনে এসে গেলে আইরাত কিছু না বলেই আস্তে আস্তে হেটে সোজা বাড়ির ভেতরে চলে যায়৷ রাশেদও কিছু বলে না। সিচুয়েশন বুঝতে পারছে সে তাই চলে যায়। আইরাত যখন বাড়িতে ঢুকে তখন ইলা রনিত কে খাওয়াচ্ছিলো। আইরাতের এই হাল দেখে ইলা কপাল কুচকায়। আইরাত কোন দিকে তাকায় না, একমনে সিড়ি বেয়ে ওপরের দিকে যেতে থাকে। সিড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার সময় আইরাত পরে যেতে ধরলে ইলা উঠে আসে কিন্তু তার আগেই আইরাত নিজেকে সামলিয়ে নেয়। আইরাত নিজের রুমে গিয়ে দরজা ট লাগিয়ে দেয়।

রনিত;; দাদুমনি!!

ইলা;; হ্যাঁ

রনিত;; আপুর কি হয়েছে?

ইলা;; কিছু না সোনা। তুই খা আমি আসছি।

রনিত;; আচ্ছা।

আইরাত রুমে গিয়েই হাটু গেড়ে ধপ করে নিচে বসে পরে। আইরাত নিজের চোখ ঘুড়িয়ে রুমের চারিদিকে তাকায়। এমন কোন জায়গা নেই যাতে আব্রাহামের ছবি নেই। আব্রাহামের একার ছবি আবার তার আইরাতের সাথে। আইরাত এগুলো দেখছে আর ঘন ঘন দম ছাড়ছে। সে নিজের হাতের দিকে তাকায়। আব্রাহামের জেকেট টা দুই হাত দিয়ে নিজের বুকের সাথে আকড়ে ধরে চিল্লিয়ে ওঠে…..

আইরাত;; আব্রাহায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়াম

ইলা ততক্ষণে আইরাতের রুমের কাছে এসে পরেছে। আইরাতের চিৎকার শুনে ইলা দ্রুত রুমে যায় গিয়ে দেখে আইরাত শেষ, একদম নাজেহাল অবস্থা তার।

ইলা;; আইরাত কি হয়েছে? এমন করছিস কেনো? কি হয়েছে?

আইরাত;; দা দা দাদি আমার, আমার আব্রাহাম। ওরা বলে যে আব্রাহাম নাকি নে নেই। ওকে, ওকে আর খুঁজে পাওয়া যা যায় না। ওরা সব সব মিথ্যা বলছে তাই না। আমি আম জানি তো যে ওরা ওরা সব মিথ্যা বলছে। আমার আব্রাহামের কি কিছুই হয় নি। আব্রাহাম ওমন না, ও ওর সাথে কী করে এমন হবে বলো।

সব শুনে ইলা নিজেও নিচে বসে পরে। সর্বপ্রথম নিজের স্বামী কে হারিয়েছে মহিলাটা, তারপর নিজের মেয়ে নামক ছেলের বউ কে, তারপর নিজের ছেলেকে। আর বাচার একমাত্র আশা এই আব্রাহাম-আইরাত। এখন যদি নিজের নাতি কেও হারিয়ে ফেলে। এর থেকে মরন অনেক শ্রেয়। ইলা নিজের আচলে মুখ গুজে কেদে দেয়।

আইরাত;; আমি এখন, এখন কি করবো আমি। আমি মরে যাই হ্যাঁ। হ্যাঁ আমি মরে যাই।৷ এভাবে জীবন্ত লাশ হওয়ার থেকে মরে যাওয়া অনেক ভালো। এতো কিছু আমি সহ্য করতে পারবো না। অন্তত আমার আব্রাহামের লাশ টাকেও তারা পায় নি। আমি দেখবো না ওকে। ওইযে সেইদিন বের হয়ে গেলো আমি তো দেখিও নি ওকে। কেনো সবাই মিথ্যা বলছে আমাকে। আমি মরে যাবো আমি সত্যি মরে যাবো। এছাড়া উপায় নেই আমার কাছে। আমি শেষ, আমি বরবাদ হয়ে গেছি। আমার কাউকে লাগবে না, ওওও দাদি আমার আব্রাহাম কে এনে দাও না। আমার কাউকে লাগবে না সত্যি আমার আর কাউকে লাগবে না। একটা বার শুধু একটা বার ওকে এনে দাও। আমি চাচা-চাচি কে হারিয়েছি ওকে হারাতে পারবো না। আমি ওকে ছাড়া বাঁঁচবো না। আমি সত্যি পাগল হয়ে যাবো। (হাউমাউ করে কেদে)

আইরাত এগুলো বিলাপ পেরে বলছিলো হঠাৎ আইরাতের প্রচন্ড কাশি শুরু হয়ে যায়। ইলা আইরাতকে ধরে। কিন্তু ততক্ষনে আইরাত অজ্ঞান হয়ে পরে যায়। ইলা তড়িঘড়ি করে আইরাতকে ধরে বিছানাতে শুইয়ে দেয়। কেমন মলিন হয়ে গেছে সব। একদম পাগল পাগল হয়ে গেছে আইরাত। চুল গুলো উষ্কখুষ্ক, চোখের নিচে কালি পরে গেছে। ইলার যেনো এবার আকাশ-পাতাল ভেঙে কান্না আসছে। ইলা দ্রুত আইরাতের রুম থেকে বের হয়ে পরে।



রায়হান নিজের ঘরে বসে বসে ড্রিং করছে। মুখে ঝুলছে বাকা হাসি। তার রাস্তা এখন পরিষ্কার একদম। কোন কাটাই নেই, কোন বাধাই নেই। সে এখন আইরাতকে নিজের করে পাবে।

রায়হান;; যেভাবে আব্রাহাম কে মেরে ফেলেছি তাতে মনে হয় না যে পাওয়া যাবে। আর এতোদিনে তো মনে হয় ওর লাশ পচেও গিয়েছে। না রইলো আব্রাহাম আর না রইলো ওই প্রীতি। এখন আইরাত আমার। আমি খুব দ্রুত ওর কাছে চলে যাবো। তবে যতদিন রাশেদ আছে ততদিন আমি আব্রাহামের সম্পত্তিতে ভাগ জমাতে পারবো না। তাহলে কি এবার রাশেদ কেও মেরে ফেলতে হবে আমার? না থাক। এতো টাও নির্দয় না হই। আমার কাছে যা আছে তাতেই আমার সারাজীবন চলে যাবে। থাক ওরা, আমি শুধু আমার আইরাতকে পেলেই হয়েছে।

এই কথা বলেই রায়হাম ঘটঘট করে এলকোহল খেয়ে ফেলে।

সেইদিনকার পর থেকে আরো কেটে যায় চারদিন। পুলিশরা এর মাঝেও কম খোজাখুজি করে নি। কিন্তু ফলাফল শুন্য। আব্রাহাম নেই। এমনকি কোন রকম কোন মৃত লাশও পাওয়া যায় নি। সব মিলিয়ে পুরো দশ দিন টানা সেই খাদে আর এলাকাতে খুঁজে গিয়েছে কিন্তু কোন কিছুই হয়নি। অবশেষে পুলিশরা আব্রাহাম কে মৃত ঘোষণা করে দেয়। যেইদিন পুলিশরা আব্রাহাম কে মৃত ঘোষণা করে দিয়েছিলো সেইদিন যেনো আইরাত আর আইরাতের মাঝে ছিলো না। একজন মরে গেছে আরেকজন জীবন-মরণের মাঝে ঝুলছে। বাড়ির এমন কোন জায়গা নেই যেখানে আব্রাহামের চিহ্ন নেই। সব জায়গায় আব্রাহাম আছে। এগুলো যেনো আইরাতকে কুড়ে কুড়ে খায়। আইরাত তো এখন পুরো পাগল। খায় না, ঘুমায় না মুখে শুধু একই কথা “” আমার আব্রাহাম কে আমার কাছে এনে দাও””। এখনো তার ব্যতিক্রম নেই। রাত গভীর হয়েছে এখন। আইরাত জানালার কাছে বসে আছে। বাইরে থেকে বাতাস এসে হালকাভাবে গায়ে লাগছে। ওইযে যেদিন পুলিশরা আইরাতকে আব্রাহামের ওই ধুলো মাখা জেকেট টা দিয়েছিলো সেটা আইরাত এখনো তার কাছেই রেখে দিয়েছে। আব্রাহাম আর নেই, আব্রাহাম মারা গেছে। এই কথা টা মানতে আইরাতের যে কি পরিমাণ কষ্ট হয় তা কেবল আর কেবল সেই জানে। আইরাতের সবচেয়ে বড়ো দুঃখ হচ্ছে এটা যে সে কিনা এতোই পোড়াকপালি যে শেষ অব্দি সে আব্রাহামের লাশ টাকেও পায় নি। আর ভাবতে পারছে না এগুলো আইরাত। নিজের দুই হাতে মাথার চুল গুলো খামছে ধরে। আর থাকতে না পেরে তার পাশে থাকা ফ্লাওয়ার ব্যাস টা তুলে ছুড়ে ফেলে। আশে পাশে যতো কাচের জিনিস ছিলো সব আইরাত ছুড়ে ফেলছে। প্রচন্ড রকমের ভাংচুর করছে এক প্রকার। নিজের দুটো হাতই কেটে শেষ করে ফেলেছে একদম। অঝোড়ে কান্না করে যাচ্ছে। পাশে থাকা আব্রাহামের ছবিটা হাতে নিয়ে নিজের ওরনা দিয়ে মুছছে আর কান্না করছে।

আইরাত;; আমি পারবো না থাকতে আপনাকে ছাড়া। আমি মরে গেছি। আমি সত্যি মরে গেছি সেইদিনই যেদিন ওরা বলেছে আপনি আর নেই। আপনি খুব স্বার্থপর। নিজে চলে গেলেন আমাকে একা ফেলে রেখে একটা বার একটাবারও আমার কথা ভাবলেন না। আমি আপনাকে ছাড়া কীভাবে থাকবো, কি নিয়ে বেচে থাকবো ভাবলেন না।আব্রাহায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়াম। ফিরে আসুন না আমার কাছে। আমি আর জীবনেও আপনার সাথে ঝগড়া করবো না, জীবনেও রাগ করবো না। আব্রাহাম প্লিজ ফিরে আসুন একটাবার। আপনি যা বলবেন তাই করবো তাই শুনবো। কোন ছেলের সাথে কথা বলবো না। আপনার কাছ থেকে পালিয়ে যাবো না। আপনাকে আর সাইকো বলেও ডাকবো না। আপনি যেভাবে বলবেন সেভাবেই থাকবো প্লিজ একটা বার আমার কাছে ফিরে আসুন। আমি মরে যাবো আপনাকে ছাড়া। যখন চলেই যাওয়ার ছিলো তাহলে কেনো এলেন আমার জীবনে? যদি এভাবে মাঝপথে একা করে দিয়ে চলেই যাবেন তাহলে কেনো এসেছিলেন আমার জীবনে? হাত যখন ছেড়েই দেওয়ার ছিলো তাহলে হাত ধরলেন কেনো? জীবন্ত লাশ বানিয়ে রেখে চলে গেছেন আপনি। আব্রাহায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়াম। ফিরে আসুন না। একটাবার। আমার পক্ষে যে আর সম্ভব না এভাবে থাকা। আমি, আম আমি আপনাকে খ খু খুব বেশিই ভাল ভালোবাসি আব আব্রা আব্রাহাম।

এই কথা বলেই আইরাত লুটিয়ে পরে নিচে। অজ্ঞান হয়ে যায়। ঘরের চারিদিকে শুধু কাচ আর কাচ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে আছে। আর তার মাঝে আইরাত আব্রাহামের ছবিটা নিজের বুকের সাথে লাগিয়ে নিচে অজ্ঞান হয়ে পরে যায়। হাত দিয়ে গলগল করে রক্ত ঝড়ছে।

পরেরদিন সকাল হয়। বেলাও বেশ হয়ে গেছে কিন্তু আইরাতের তার রুম থেকে বের হবার নাম নেই। যেখানে আইরাত সকাল সকাল উঠে পরে। ইলার ব্যাপার টা কেমন যেন খটকা লাগে তাই সে আইরাতের রুমে চলে যায়। কিন্তু রুমের ভেতর দিকে লক করা। ইলার সন্দেহ টা যেন আরো গাঢ় হয়। চিন্তা লাগছে এবার বেশ, আইরাত ইদানীং নিজের হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে গেছে। কখন কি করে বসে বলা দায়। তাই ইলা দরজাতে জোরে জোরে ধাক্কাতে লাগলো। যখন দরজা খুলছে না তখন ইলা কয়েকজন স্টাফ কে ডাক দেয়। তারা এসে দরজা এক প্রকার ভেঙেই ফেলে। দরজা ভেঙে ভেতরে যেতেই দেখে আইরাতের রুমের চারিদিকে কাচ আর সে নিচে ফ্লোরে রক্তমাখা হাত নিয়ে পরে আছে। ইলা আইরাতের নাম ধরে চিল্লিয়ে ওঠে। খুব সাবধানে রুমের ভেতরে গিয়ে স্টাফ দের সাহায্যে আইরাতকে তুলে। দ্রুত স্টাফ দের রুম পরিষ্কার করে দিতে বলে। আর ইলা এদিকে ডাক্তার কে ফোন করে। আইরাতের কাছে ইলা এগিয়ে যায়। গিয়ে দেখে তার হাতে আব্রাহামের ছবি। নিজের চোখের পানি গুলো বিসর্জন করে আইরাতের হাত থেকে আব্রাহামের ছবি টা নিয়ে সরিয়ে রাখে। তার হাতের রক্ত গুলো শুকিয়ে গেছে। ইলা আইরাতের পাশে বসে পরে তার মাথায় হাত বুলাতে থাকে। তার কিছু সময় পরে ডাক্তার আসে। উনি এসে আগে আইরাতের হাতের ব্লাড গুলো মুছে ফেলে। হাতের ভেতরে কিছু কাচের কণা ঢুকে গিয়েছে। সেগুলো খুব সাবধানে বের করে। তারপর হাতে ব্যান্ডেজ করে দেয়।

ডক্টর;; দেখুন আমি শুনেছি যে আব্রাহাম স্যার আর বেচে নেই। মানুষ মরনশীল, এটা মেনে নিতেই হবে। আজ হোক কাল হোক মানুষ মরে যাবে। হায়াতের মালিক আল্লাহ। এখানে আপনি বা আমি কিছুই করতে পারবো না। সব মেনে নিতে হবে। জানি কষ্ট হয়, উনার তো আরো বেশি। নিজের হাসবেন্ডের লাশ টাও পায় নি উনি। কিন্তু কি আর করার বলুন। এভাবে ভেঙে পরলে হবে না। এভাবে থাকলে একেবারে পাগল হয়ে যেতে উনার বেশি একটা সময় লাগবে না। কন্ডিশন বেশি ভালো না। আপনি আছেন, উনার ছোট ভাই টা আছে। আব্রাহাম স্যারের কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি, দেখুন আজকাল যুগের মানুষ ভালো না। ঝোপ বুঝে কোপ মারতে বেশি সময় লাগবে না। তাই উনাকে একটু বুঝান। এটাই জীবনের শেষ পরিণতি না। সামনে জীবন অনেক বাকি। শুনুন উনাকে একা একা থাকতে দিবেন না। স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করুন। নয়তো সব শেষ। আমি বেশ কিছু মেডসিন দিয়ে যাচ্ছি। এগুলো সময়মতো খাওয়াবেন। আর হ্যাঁ কোন সমস্যা হলে সবার আগে আমাকে ডাক দিবেন। আর মনে রাখবেন আব্রাহাম স্যারের শেষ স্মৃতি গুলো বাচিয়ে রাখতে বা টিকিয়ে রাখতে হলে আইরাত ম্যাম কেই আবার উঠে দাড়ায়ে হবে। আমি আসি।

ডাক্তার চলে গেলে ইলা তার পেছন ঘুড়ে আইরাতের দিকে তাকায়। আইরাতের দিকে তাকিয়েই সে অবাক হয়ে যায়। কেননা আইরাত চোখ মেলে তাকিয়ে আছে। ইলা আইরাতের পাশে বসে পরে।

ইলা;; তোকে কিছু বলার নেই আমার। আমি জানি তোর ওপর দিয়ে ঝড় বইছে এখন। কিন্তু এমন তো আর হয় না। আইরাত হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। আজ নিয়ে বারো দিন আব্রাহাম নেই। জানিস আব্রাহামের সবচেয়ে বড়ো স্মৃতি কি। তা হচ্ছিস তুই নিজে। তুই নিজে ঠিক হয়ে যা সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।

ইলা এটা বলেই নিজের চোখের পানি গুলো ফেলতে ফেলতে চলে যায়। আইরাত সবই শুনেছে। সবই বুঝে সে। এক্কেবারেই যে পাগল হয়ে গেছে তা না। কিন্তু আব্রাহাম কে ছাড়া তার জীবন অচল। সে একটা মূহুর্ত আব্রাহাম কে ছাড়া ভাবতে পারে না।

এভাবেই দিন যাচ্ছে। আইরাত চুপচাপ থাকে। কথা বলে না কারো সাথে বেশি। আগের যে চঞ্চলতা নিজের মাঝে ছিলো এখন তার ছিটেফোঁটাও নেই। গম্ভীর হয়ে থাকে। একদিকেই তাকিয়ে অনেকক্ষন বসে থাকে। মাঝে মাঝে যখন ভালো না লাগে তখন আব্রাহামের ছবি রুমের সব জায়গায় রেখে নিজে তাদের মাঝখানে শুয়ে থাকে। রাতে যেনো তার এই আব্রাহাম কে না পাওয়ার ব্যার্থতা কাজ করে আরো তীব্র ভাবে। আব্রাহামের ওই হাসি, কথা, আইরাতের সাথে ঝগড়া করা, বালিশ দিয়ে মারামারি করা, আইরাতকে জ্বালানো সব যেনো আইরাতের কানে এসে বাজে। এগুলো যখন মনে পরে তখন মনে হয় এর থেকে সে নিজে শেষ হয়ে যাক। আব্রাহামের ওই “বেবিগার্ল” ডাকটা কত্তোদিন হয়ে গেলো শুনে না আইরাত। আইরাত এগুলোই ভাবছিলো রুমের জানালার কাছে বসে বসে তখনই রনিত দৌড়িয়ে আসে আইরাতের কাছে। পরনে স্কুল ড্রেস।

রনিত;; আপু, আপু, আপু!

আইরাত;; হ্যাঁ।

রনিত আইরাতে গলা জড়িয়ে ধরে।

আইরাত;; কোথায় যাওয়া হচ্ছে?

রনিত;; একি তোমার গলা ভেঙে গেছে?

আইরাত;; না ঠিক আছি। স্কুল যাচ্ছিস?

রনিত;; হ্যাঁ, দাদুমনি নিয়ে যাচ্ছে।

আইরাত;; হুমম।

ইলা;; আইরাত, আমি রনিতকে স্কুলে নিয়ে যাই। তুই বাসায় থাক।

আইরাত;; যাও।

এই বলেই ইলা আর রনিত গাড়ি দিয়ে স্কুলে চলে যায়। আইরাত আগের মতোই জানালার কাছে বসে থাকে। সময় যাচ্ছে কিন্তু আইরাত আব্রাহামের ভাবনাতেই মগ্ন। তার প্রায় আধা ঘন্টা পর নিচে হলরুমে কোন কিছু ভাংচুরের আওয়াজ আসে। আইরাতের ভাবনাতে ছেদ ঘটে যার ফলে সে চমকে উঠে। আইরাত কপাল কুচকে তাকায়। কারো পায়ের আওয়াজ স্পষ্ট। আইরাত উঠে তার রুমের বাইরে যেতে ধরবে তার আগেই আইরাতের রুমে কেউ একজন আসে। আইরাত কপাল কুচকে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। সে কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই ব্যাক্তিটি তার মাথা থেকে কালো কাপড় সরিয়ে ফেলে। এই রায়হান। রায়হান কে দেখে আইরাত ভূত দেখার মতো চমকে যায়।

আইরাত;; আপ.. আপনি এখানে?

রায়হান;; আব্রাহাম তো নেই তাই আমাকেই আসতে হলো।

আইরাত;; মানে?

রায়হান;; মানে টা কি এখনো পরিষ্কার করে বলতে হবে তোমাকে। তুমি জানো না যে কেনো এখানে এসেছি আমি!?

আইরাত;;

রায়হান;; বলেছি না ভালোবাসি তোমাকে। এখন তুমি আমার।

আইরাত;; দেখ তুই আমার চাচা-চাচি কে মেরেছিস কিছু বলি নি কেননা তোর মা এসে তোর প্রাণ ভিক্ষা চাইছিলো আব্রাহামের কাছে। এখন তুই যদি কিছু করিস তো আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না।

রায়হান;; তুমি? তুমি আমার কি করতে পারবে কিছুই না।
আইরাত;; বের হ এখান থেকে।

রায়হান;; তোমাকে না নিয়ে বের হবোই না।

এই বলেই রায়হান আইরাতের দিকে এগোতে থাকে। আর আইরাত ছুটে দরজার দিকে চলে যায়। কিন্তু রায়হান এসে আইরাতের বাহু ধরে টান দেয়। আইরাত রায়হান কে এক ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয়। আইরাতের পাশে একটা কাচের বোতল ছিলো,, রায়হানের কাছ থেকে বাচার জন্য আইরাত পাশে থেকে তা নিয়ে অর্ধেক বারি দিয়ে ভেঙে আর অর্ধেক রায়হানের দিকে তাক করে ধরে। রায়হান তবুও আইরাতের দিকে এগোলে আইরাত রায়হানের হাত বরাবর এক ঘা দিয়ে দেয়। রায়হানের হাত কেটে যায়। সে তার এক হাত দিয়ে আরেক হাত চেপে ধরে ব্যাথায় কুকড়ে ওঠে। এই তো সুযোগ৷ আইরাত রুমের দরজা খুলে বাইরে এসে দরজা পেছন দিক দিয়ে লাগিয়ে দেয়। দৌড়ে নিচে নেমে আসে। আইরাত বাইরে এসে দেখে একটা গার্ডও নেই। তাহলে সব গেলো কোথায়। এখন আইরাত কি করবে কি করবে না কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। আর হলরুমে এসে মনে পরেছে যে সে তার ফোনটা ভুলে রুমেই রেখে এসেছে। পুলিশে ফোন দিবে কীভাবে এখন। আইরাত সারা বাড়িতে ছুটোছুটি করছে। তখনই আইরাতের মনে পরে যে আব্রাহাম তার অন্যান্য রুম গুলোতে একটা করে হলেও গান সবসময় রেখে দিতো। আইরাত দৌড়ে গিয়ে আব্রাহামের অন্য আরেক রুমে চলে যায়। এখানে আব্রাহামের সব পুরানা জিনিস গুলো রাখা। আইরাত দ্রুত রুমের সব জায়গাতে খুজতে লাগলো। কাবার্ডের সব জায়গায় তড়িঘড়ি করে রিভলবার খুজে চলেছে। কিন্তু কিছুই পাচ্ছে না। এতোক্ষনে ওপরে রায়হান এক লাথি দিয়ে দরজা ভেঙে ফেলেছে। সে আইরাতের নাম ধরে চিল্লাচ্ছে আর নিচে নামছে। কিন্তু এদিকে তো আইরাত ভয়ে শেষ। আইরাত আব্রাহামের যে পুরানা একটা রুম ছিলো সেখানেই একটা কোণাতে লুকিয়ে পরে। ভয়ে কেদে একাকার হয়ে গেছে সে।

রায়হান;; আইরাত, ও আইরাত। হায় হায় কতো মেয়ের সাথেই না থেকেছি কিন্তু তুমি আলাদা। কি যে করে দিলে না আমার ওপর। এখন তোমাকে ছাড়া আর কাউকে ভালোই লাগে না। আমি জানি তুমি এখানেই কোথাও লুকিয়ে আছো অযথা আমার সাথে লুকোচুরি খেলো না তো জলদি সামনে আসো। আইরাত, আইরাত।

রায়হান এগুলো বলছে আর আইরাতের দিকে এক পা এক পা করে এগোচ্ছে। আর আইরাতের ভয় ততোই বেড়ে চলেছে। রায়হান অন্যদিকে চলে যেতে ধরে কিন্তু ভাগ্য খারাপ। আইরাত যে রুমে লুকিয়ে ছিলো তখন সেই রুমের কোন একটা ভারি বস্তু আপনা আপনিই জোরে শব্দ করে নিচে পরে যায়। রায়হান শব্দের ধারা অনুসরণ করে সেদিকে তাকায়। মুখে ফুটে ওঠে শয়তানি হাসি।

রায়হান;; এইতো পেয়ে গেছি আইরাত। পালিয়ে যাবে কোথায়?

রায়হান দ্রুত পায়ে সেদিকে যেতে ধরে। রুমের ভেতরে চলে যেতেই আইরাত উঠে দাঁড়িয়ে একদম রায়হানের সামনে চলে যায়। রায়হানের দিকে আইরাত রিভলবার তাক করে ধরে। ভাগ্যিস সময় মতো রিভলবার টা পেয়ে গিয়েছিলো তখন। আইরাত রিভলবার তার দুই হাত দিয়ে চেপে ধরে রায়হানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

রায়হান;; নিজেই রুপেই তো মেরে ফেলেছো আর কতো মারবে?

আইরাত;; খবরদার সামনে এগোবি না। আমি কিন্তু শুট করে দিবো।

রায়হান;; ওহহ আচ্ছা তাই। কিন্তু আমি তো এগোবোই।

রায়হান আইরাতের দিকে এগোতে ধরে কিন্তু আইরাত এবার তার চোখ মুখ সব খিচে বন্ধ করে আঙুল দিয়ে রিভলবারের ট্রিগারে চাপ দেয়। বাতাসের বেগে একটা বুলেট বের হয়ে একদম রায়হানের বাহু বরাবর লাগে। রায়হান রাগে দাত কটমট করে আইরাতের দিকে যেতে ধরলে আইরাত তার চোখ খিচে বন্ধ করে আরো একবার ট্রিগারে চাপ দেয়। আরেকটা বুলেট গিয়ে রায়হানের বাহুতে লাগে। রক্তে সব ভিজে গেছে। রায়হান নিচে বসে পরেছে তার বাহু চেপে ধরে। আর আইরাত ভয় পেয়ে চিল্লিয়ে তার হাত থেকে রিভলবার টা নিচে ফেলে দেয়। নিজের দুই হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে। জীবনে এই প্রথম আইরাত কাউকে শুট করেছে। এখন যেনো সে কাপছে। আইরাত দৌড়ে রুম থেকে বের হয়ে আবার দরজা পেছন থেকে লাগিয়ে দেয়।




চলবে~~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here