প্রেমের পাঁচফোড়ন💖
#সিজন_২
#পর্ব_৬৫
#Writer_Afnan_Lara
🌸
পুরোটা দিন দুজনেই ব্যস্ত ছিলো গরীব মানুষদের খাবার আয়োজনের এরেঞ্জমেন্টে
তো সন্ধ্যায় সব কাজ শেষ করে দুজনেই টায়ার্ড হয়ে কারে চুপ করে বসে আছে এখন
আহানা মাথায় হাত দিয়ে বললো”এক কাপ চা হলে ভালো হতো,আমার আর শক্তি নাই, প্রচুর কাজ হয়েছে এবার!
প্রতিজনকে নিজের হাতে খাবার দেওয়া কি ছোটখাটো কাজ?”
.
হুম সেটাই,চলো রেস্টুরেন্টে গিয়ে চা আর হালকা নাস্তা করে আসি
.
ওকে চলুন,তার আগে বলেন মায়ের অবস্থা কেমন ফোন করেছিলেন রিপাকে?
.
হুম,মা ঠিক আছে,কোনো চিন্তা নাই
♣
রেস্টুরেন্টের কাছে আসতেই শান্ত কারটা থামালো,আহানা আগে ভাগে নেমে দৌড় দিয়েছে রেস্টুরেন্টর দিকে
.
শান্ত মুচকি হেসে সিট বেল্ট খুললো সবেমাত্র,তারপর কার থেকে নামতে যেতেই বিকট একটা শব্দ হলো সাথে সাথে
মূহুর্তেই সব ওলটপালট!
.
আহানা মাত্র রেস্টুরেন্টের দরজায় হাত দিয়েছিলো দরজা খোলার জন্য
এত জোরে হওয়া শব্দ তার কানে আসতেই তার বুক কেঁপে উঠেছে সাথেসাথে,কারণ শব্দ যেদিক থেকে এসেছে সেখানেই শান্ত কার পার্ক করতেছিলো
কাঁপতে কাঁপতে আহানা পিছন ফিরে তাকালো
আশেপাশের মানুষে ভর্তি হয়ে গেছে জায়গাটায়
শান্তর কার ড্যামেজ ৫৬%,পিছনে একটা বাস দাঁড়িয়ে আছে,যাত্রীবাহী একটি বাস,ড্রাইভার পালিয়ে গেছে ততক্ষণে
আহানা কোনোদিক না তাকিয়ে দৌড় দিলো কারের কাছে
শান্ত কারের ভেতর অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে,তার হাত আর মাথার বাম সাইড থেকে রক্ত বের হচ্ছে
আহানার পুরো দুনিয়াটা যেন থেমে গেলো
তার বাবার সাথে যা ঘটেছে তা আজ আবারও??
আহানা মানুষকে সরিয়ে শান্তর কাছে এসে ওর হাত ধরে ওকে উঠানোর চেষ্টা করছে এখন
.
শান্ত?কথা বলছেন না কেন??আমার দিকে তাকান,কি হয়েছে আপনার?
.
ম্যাডাম আপনি প্লিস সাইড হন,উনাকে হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে জলদি
.
একজন পথচারীর কথা শুনে আহানা তার দিকে তাকিয়ে বললো”হ্যাঁ,আমার শান্তর কিছু হবে না,ওকে আমি বাঁচাবো”
.
আহানা কথাগুলো বলতে বলতেই সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে
এতবড় ট্রমা সে নিতে পারেনি,হাত পা হঠাৎ এত জোরেশোরে কাঁপতে লাগলো!!! না পারলো সে কিছু বলতে না পারলো চিৎকার করতে
মূহুর্তেই মানুষের জীবন কিভাবে বদলে যেতে পারে
আহানা যখন চোখ খুলেছে তখন দেখলো সে একটা সাদা চাদর বিছানো বেডে শুয়ে আছে,তারপর তার সব মনে পড়তেই সে বিছানা থেকে নেমেই দৌড় দিলো শান্তর কাছে
দুজন নার্স এসে ওকে আটকে ফেলে বললো”থামুন,আপনি যেতে পারবেন না ভেতরে”
.
আমি আমার শান্তর কাছে যেতে চাই,আমাকে বাধা দেওয়ার আপনারা কারা???,ছাড়ুন আমার হাত
.
আহানা চিৎকার করছে বারবার
নার্সরা না পেরে ওকে অজ্ঞান হওয়ার ইনজেকশান দিয়ে দিয়েছে কারব আহানা ভেতরে ডাক্তারদের কাজে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিলো রুমের দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে
.
আহানা আবারও জ্ঞান হারিয়ে বেডে শুয়ে আছে
.
শান্তর পকেট থেকে ওর মানিব্যাগ নিয়ে সেখানে থাকা ওর অফিসের কার্ড থেকে অফিসে ফোন করলো নার্স তারপর ওদের খবর জানিয়ে বললো যাতে শান্তর পরিবারকে ফোন করে জানানো হয়
.
২০মিনিটের মধ্যেই রিপা আর নিতু এসে গেছে সাথে এসেছে আহানার মা আর খালা
শান্তি রহমান ঘুমাচ্ছেন,তাকে এ বিষয়ে জানানো হয়নি কিছুই,বুয়াকে বলা হয়েছে উনার খেয়াল রাখতে
.
আহানার মা আহানার কাছে এসে বললেন”ওর কি হয়েছে?”
.
নার্স জানালো আহানা শান্তর এমন হাল দেখে সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলো তারপর সেন্স আসার পর সে আরও চিৎকার চেঁচামেচি করায় ওকে অজ্ঞান হওয়ার ইনজেকশান দেওয়া হয়েছে আপাততর জন্য
.
আর শান্ত হাতে চোট পেয়েছে এবং মাথায় ও,থেমে থেমে রক্ত বমি করছে সে,চোখে সব ঝাপসা দেখছে সে
ডাক্তার নার্স ছাড়া আর কাউকেই দেখছে না চোখের সামনে
শুধু মুখ ফুটে একবার বললো”আহানা কোথায়”
.
তারপর আর কিছুই তার মনে নেই,ডাক্তার রুম থেকে বেরিয়ে এসে বললেন”আহানা কে?তাকে যেন রুমে আসতে বলা হয় আর শান্তর মাথায় চোট পেয়েছে তাকে যেন কোনো টেনসন জাতীয় কথাবার্তা না শুনানো হয়”
.
আহানার এখনও জ্ঞান ফেরেনি,শান্তর ও ফেরেনি,দুজনে দুটি রুমে শুয়ে আছে অচেতন হয়ে
মাঝখানে একটি দেয়াল
আজকের এই ঘটনার পেছনে কার হাত থাকতে পারে?
মজনু নাকি রতন??
.
মজনুর নয়,কারণ সে বলেছিলো প্রতিশোধ নেবে কিন্তু সে নেয়নি, জাস্ট হুমকি দিয়েছিলো,তিনি শুধু একবার শান্তর উপর হামলা করেছিলেন যেটা কয়েকদিনের আগের ঘটনা
আজকের বাস দিয়ে চাপা দেওয়ার আইডিয়াটা রতনের ছিল
বাস ড্রাইভার ও সেই ছিলো,চাপা দিয়ে সে বাস রেখে পালিয়েছে
.
চেয়েছিল আহানাকে আর শান্তকে একসাথে মারতে কিন্তু এই যাত্রায় আহানা বেঁচে গেছে
♣
পুরো রাত শেষ হয়ে গেলো
রিপা শান্তি রহমানের কাছে চলে গেছে যাতে উনি কোনো সন্দেহ না করেন,উনাকে শান্তর এক্সিডেন্টের কথা জানানো যাবে না কোনো মতেই
.
আহানা ভোর হতেই চোখ খুলে আবারও ছুটলো শান্তর রুমের দিকে
যতক্ষণ না সে শান্তকে সুস্থ দেখছে,শান্তকে জড়িয়ে ধরছে ততক্ষণ তার শান্তি নেই
.
শান্তর রুমে ঢুকার সময় কেউ ওকে বাধা দেইনি
করিডোরে থাকা চেয়ারের সারিতে মা,খালা আর নিতু বসে ঝিমাচ্ছেন,পুরো রাত তারা ঠিকমত ঘুমাতে পারেনি,এই মাসটা কিরকম বিচ্ছিরি ভাবে শেষ হবে তারা ভাবতেই পারেনি
একবার শান্তি রহমানের হার্ট এটাক আবার এখন এত কিছু
.
আহানা শান্তর কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছে,ওর বাম হাতে ব্যান্ডেজ করে রাখা,মাথায় ও ব্যান্ডেজ
আহানা ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে শান্তর বুকে মাথা রাখলো
.
শান্ত এসব কি হয়ে গেলো,আপনি ঠিক আছেন তো?আমার সাথে কথা বলবেন না??একটু আমার দিকে তাকান না শান্ত!
আর আপনাকে ভাইয়া ডাকবো না কখনও,কখনও ঝগড়াও করবো না,প্লিস তাকান আমার দিকে
.
আহানা শান্তর কোনো উত্তর না পেয়ে উঠে দাঁড়ালো তারপর চলে যেতে নিতেই শান্ত হাত বাড়িয়ে ওর আঁচল ধরে ফেললো
.
আহানা চমকে ওর দিকে তাকিয়ে হাসিমাখা মুখে বললো”আপনি ঠিক আছেন তো?”
.
শান্ত স্বাভাবিক গলায় বললো”হুম,তোমাকে খুঁজেছিলাম অনেক,কই ছিলো?”
.
আমাকে অজ্ঞান হওয়ার ইনজেকশান দিয়েছিলো
.
কিন্তু কেন?
.
বেশি চিৎকার চোঁচামেচি করছিলাম তো,ওসব বাদ দিন,আপনার হাতে কি হয়েছে?বেশি ব্যাথা করে?
.
ব্যাথা বলতে ডাক্তার বলেছে ২০দিন বেড রেস্ট, হাতে চাপ দিয়ে কোনো কাজ করা যাবে না,আমাকে তাহলে এক হাতেই ল্যাপটপ চালাতে হবে
.
আপনাকে আমি কাজ করতে দেবো না,আমি অফিস সামলাবো
আহানা কিসব ভেবে আবারও করিডোরের দিকে যেতে নিতেই শান্ত আবারও ওর আঁচল ধরে ফেললো
আহানার চোখে মুখে, বুকের ভেতরটা আগুন জ্বলছে,প্রতিশোধের আগুন!
রতনকে সে একটা শাস্তি না দেওয়া পর্যন্ত তার শান্তি হবে না
শান্তর দিকেও তাকাচ্ছে না সে,চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে
আহানা তাকাচ্ছে না দেখে শান্ত আঁচল হালকা টেনে বললো”যা করার আমি করবো!তুমি কিছু করবা না
বাড়া ভাতে ছাই দেওয়ার প্ল্যান যেই করে থাক না কেন তার শাস্তি সে পাবে,তুমি শুধু আমার পাশে থাকো,একা কিছু করতে যেও না আহানা
.
আহানা চুপ করে থেকে আবারও চেয়ার টেনে বসলো শান্তর কাছে,শান্তর অসুখে ভরা চেহারাটা দেখে আহানা সব ভুলে গিয়ে হাত এগিয়ে এনে শান্তর মাথায় হাত রাখলো
.
শান্ত!আমি একবার আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটিকে হারিয়েছিলাম,সে কষ্টের ঘা এখনও শুকায়নি
তার মধ্যে আমি আমার আরেকজন প্রিয় মানুষকে হারানোর ঘা কি করে সহ্য করতে পারতাম?
এই ভয় ততদিন থাকবে যতদিন না শত্রুদের পতন হচ্ছে,আমার মা জানত না তার সামনে থাকা গোপনশত্রুদের কথা
কিন্তু আমি তো জানি,রতন,মজনু চাচা কিংবা সাইমন
আর তো কেউ নয়,তাহলে এদের কি করে ছাড় দেবো আমরা??
দেখলেন তো কত বড় একটা বিপদ হয়ে গেলো
মা কাল সারা রাত আপনাকে দেখেনি,রিপা কোনোরকম বুঝিয়েছে কিন্তু আজ কি হবে??আজ আপনার হাতে আর মাথায় ব্যান্ডেজ দেখলে মায়ের অবস্থা কেমন হতে পারে ভাবতে পারেন??
কি বলবেন তাকে?
আর আমার এটা ভেবে নিজেকে অসহ্য লাগছে কারণ
আজ আপনার এই এক্সিডেন্টটা যেই করিয়েছিল তার শত্রুতামি আমার সাথে কিন্তু বদলা নিয়েছে আপনার থেকে
ভবিষ্যতে ক্ষতি করার চেষ্টা করবে,আমি তখন কি করবো??
.
আহানা তুমি এত কেন ভাবতেছো??পুলিশ আছে না?উনারা উনাদের কাজ করবে
.
আহানা চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো”এই ভরসা দিয়ে দিয়ে সেই আপনার ক্ষতি তো হয়েই গেলো,এরপরেও আপনি আমাকে এমন ভরসা দেন কি করে??
ভালো হতো আমি মরে যেতাম,প্রিয় জনের কষ্ট,মৃত্যু নিজের সচোক্ষে দেখার চেয়ে মরে যাওয়া মাচ বেটার
.
আহানা তুমি থামবা?নাকি ডান হাতের চড় খাবা
.
আহানা ব্রু কুঁচকে আঁচল ছাড়িয়ে বললো”চুপচাপ শুয়ে থাকেন,আমি যাই নাস্তার ব্যবস্থা করি,মা আর খালা,নিতু না খেয়ে আছে
♣
আহানা সবাইকে নাস্তা এনে দিয়ে নিজে আর খেলো না,শান্তর কাছে এসে চুপ করে বসে থাকলো
শান্ত এতক্ষণ ঘুমিয়েই ছিলো,আহানার উপস্থিতি টের পেয়ে সে চোখ খুললো
আহানা ক্লান্ত হয়ে গেছে,,তাই সে শান্তর হাতটা ধরে পাশে মাথা রেখে বসা অবস্থাতেই ঘুমিয়ে গেছে
শান্ত ওর ডান হাতটা আহানার হাত থেকে সরিয়ে সেটা দিয়ে আহানার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো,বাম হাতে ব্যান্ডেজ করা তার,নাড়ানোও যাচ্ছে না
.
শান্ত ভেবেছিল রতন মনে হয় আহানার ক্ষতি করে ফেলেছে যার কারনে সে বারবার আহানার নাম ধরে ডেকেছিলো
.
মা আর খালা মিলে শান্তকে দেখতে এসে দেখলো আহানা দিব্যি ওর পাশে মাথা রেখে শুয়ে আছে,আর শান্ত আহানার মাথায় হাত বুলাচ্ছে
.
এই আহানা?তোর এক্সিডেন্ট হয়েছে নাকি শান্তর??এরকম শুয়ে আছিস কেন?উঠ!শান্তর তো নড়তে চড়তেও কষ্ট হচ্ছে নির্ঘাত!
উঠ বলছি!
.
আহানা চোখটা খুলতেই ওর সব হুস আসলো
তখনই উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো সে
শান্ত দাঁত কেলিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে
.
আহানা মুখে হাত দিয়ে বললো”সরি!আসলে ক্লান্ত লাগছিলো,মাথা এলাতেই চোখটা লেগে এসেছে,আপনার বেশি কষ্ট লেগেছে?”
.
নাহ,এরকম বাচ্চা টাইপ মেয়ে সামলাতে আমার সমস্যা হয় না তেমন একটা
.
আহানা হেসে চলে গেলো,কিছুই বললো না
অন্য সময় হলে সে ঝগড়া করতো,তাই বিষয়টা শান্তর ভালো লাগলো না
আহানা ভেবে রেখেছে সে আর শান্তর সাথে ঝগড়া করবে না কখনও
.
বিকালের দিকে তারা সবাই বাসার দরজার সামনে এসে হাজির,শান্ত সেই হসপিটাল থেকে বাসায় আসা পর্যন্ত ভেবে যাচ্ছে মাকে কি করে সামলাবে
রিপা দরজা খুলতেই শান্ত সবার আগে দেখলো দূরে মা হুইল চেয়ারে বসে আছেন
মা শান্তকে দেখে প্রথমে মুচকি হাসলেও পরেই যখন তিনি দেখলেন শান্তর মাথায় আর হাতে ব্যান্ডেজ করা
উনি চাকা ঘুরিয়ে শান্তর কাছে এসে কাঁপা কাঁপা হাতে শান্তর শরীর ছুঁয়ে দেখলেন তারপর আহানার দিকে তাকালেন
আহানা মাথা নিচু করে আছে
.
শান্তি রহমান নিরবে কাঁদতে থাকলেন এছাড়া আর কিছু বলার শক্তি তার নেই,শান্ত মায়ের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বললো”বাবা ফিরে আসেনি,কিন্তু আমি ফিরে এসেছি মা,তোমার ছেলে তোমাকে রেখে কোথাও যাবে না
বাবা চলে যাওয়ার পর এই পরিবারের সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমি নিয়েছি আর আজীবন দায়িত্বটা আমার কাঁধেই থাকবে,তোমার আর বাকিদের দোয়ায় আমি বেঁচে ফিরে এসেছি,এটা ছোটখাটো ব্যাপার!তুমি চিন্তা করে তোমার নিজের ক্ষতি করবা না,আমার অসুখ আমি সামলে নিতে পারি কিন্তু তোমার অসুস্থতায় আমি ঠিক থাকতে পারি না মা
চলবে♥