প্রেম_তুমি (দ্বিতীয় খণ্ড) ফাবিহা নওশীন পর্ব-17

0
658

#প্রেম_তুমি (দ্বিতীয় খণ্ড)
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-17

“বিচ্ছেদের যন্ত্রণার চেয়ে অধিক যন্ত্রণা পাবে যখন জানবে আমি তোমাকে সন্তান সুখ দিতে ব্যর্থ। কাউকে আজীবন অসুখী করার চেয়ে সাময়িক কষ্ট দেওয়া শ্রেয়।”
দর্শনের মাথা ঘুরছে। এই কথার মানে কী? দর্শন তারিখ দেখল। এই তো মাসখানেক আগের লেখা। দর্শন পরের পাতা উল্টালো। পরের পাতায় লেখা আছে, “আমি নিয়তি মেনে নিয়েছি। তবুও মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে বুকের ভেতর প্রখর যন্ত্রণা টের পাই। আর চোখে উষ্ণ অশ্রু কণা। কেন? হয়তো আজও ভালোবাসি তাই।”

দর্শন এসির মধ্যেও দরদর করে ঘামছে। আবারও পাতা উল্টালো আর প্রথম লেখাটা পড়ল। এর মানে কী দ্বারায়? সন্তান সুখ দিতে ব্যর্থ মানে? ব্যর্থ কেন?
এরই মধ্যে খট শব্দে দরজা খুলে অর্ষা বেরিয়ে এক। হঠাৎ দর্শনকে দেখে চমকে উঠে। আতংকিত মুখে ওর দিকে তাকায়। তারপর চোখ যায় ওর হাতের ডায়েরিটার দিকে। ডায়েরির দিকে চোখ যেতেই অর্ষার পিলে চমকে উঠে। ঢোক গিলে দর্শনের থমথমে মুখের দিকে তাকায়। এতে ও আরো ভয় পেয়ে যায়। অজানা একটা আতংক মনে জেঁকে বসে।

অর্ষা ওর হাত থেকে ডায়েরিটা কেড়ে নিয়ে বলল,
“এগুলো কী ধরনের অভ্যাস? পারমিশন ছাড়া কারো পার্সোনাল জিনিসে হাত দিতে নেই জানো না?”

দর্শন ওর দু বাহু চেপে ধরে বলল,
“সন্তান সুখ দিতে ব্যর্থ এর মানে কী? কি লোকাচ্ছ তুমি আমার থেকে? আমাকে সব খুলে বলো।”

অর্ষা যা ভয় পেয়েছিল তাই হলো। দর্শন সব পড়ে ফেলেছে। এখন কি বলবে? মনে হচ্ছে বুকের ভেতর দগদগে ঘায়ে নতুন করে আঁচড় পড়েছে। ভীষণ জ্বলছে। অর্ষা ওকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য ব্যস্ততা দেখিয়ে ডায়েরিটা ড্রয়ারে রাখতে রাখতে বলল,
“এমনি। তেমন কিছু না। যা ইচ্ছে হয় তাই লিখি।”
অর্ষা অগোছালো ভাবে বলে গেল। কিন্তু দর্শন ওর কথা মানার পাত্র না।
দর্শন ওর চোখের দিকে চেয়ে বলল,
“তাহলে চোখে পানি টলমল করছে কেন? কেন উপচে পড়তে চাইছে? কেন কষ্ট পাচ্ছো? প্লিজ সত্যিটা বলো। আমার টেনশন হচ্ছে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।”

অর্ষা ধরা পড়ে গেছে। দর্শন সত্যিই কষ্ট পাচ্ছে। যে কষ্টটা ওকে দিতে চায়নি তাই হচ্ছে। এতদিন নিজেকে এই জন্য লুকিয়ে গেছে।
“দর্শন, দেখো কোন সমস্যা নেই। অল ওকে। তোমার বোনের এনগেজমেন্ট চলছে আর তুমি এখানে। তোমার যাওয়া উচিত।”

দর্শন মিনতি করে বলল,
“আমি কি এখন তোমার পায়ে পড়ব? যদি তাই চাও তবে তাতেও রাজি আছি। তবুও আর আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিও না। আমার আর ধৈর্য নেই।”

অর্ষা চুপ করে আছে। দুজনেই নীরব। নিরবতা ভেঙে দর্শন বলল,
“তোমার কোন প্রব্লেম হয়েছে? তুমি কি মা হতে…. দর্শনের গলা আঁটকে আসছে।

অর্ষা আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারল না। চিৎকার করে বলল,
” না, আমি পারব না। আমি মা হতে পারব না। ওই এক্সিডেন্টে আমি সব হারিয়েছি। ডাক্তার বলেছে আমার মা হওয়ার চান্স খুব কম।”
অর্ষা চিৎকার করে কেঁদে উঠল। দর্শনের বুকে গিয়ে বিঁধল ওর চিৎকার। ও ধপ করে বসে পড়ল। মাথা ঝিমঝিম করছে। কি থেকে কি হয়ে গেল। অর্ষা মা হতে পারবে না এটা মানতে পারছে না। ওর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। অর্ষার মতো চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু পারছে না। অর্ষাকেও সান্তনা দিতে পারছে না। কি বলে সান্তনা দিবে? কোন মুখে দিবে?

দর্শনের মোবাইল বেজে উঠল। দিশা কল করেছে। চোখের পানি মুছে কল রিসিভ করল।
“ভাইয়া, তুমি কোথায়? আমার এনগেজমেন্ট পার্টি রেখে কোথায় চলে গেছো? আয়ান আমাকে আংটি পরাবে। যেখানে আছো দশ মিনিটের মধ্যে চলে এসো।”
দিশার কথায় রাগের বহিঃপ্রকাশ। দর্শন অর্ষার দিকে একবার তাকাল। ও তখনও কেঁদেই চলেছে।
“আসছি।”
বলে দর্শন কল কেটে দিল। ফ্লোর থেকে উঠে দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে গেল। হাঁটছে আর শার্টের হাতা দিয়ে চোখ মুছছে।
স্বপ্নটা কেন চুরমার হয়ে গেল? কেন বারবার হারাচ্ছি? আর কত হারাব? আর কত হারানো বাকি আছে?

~~~~~
অর্পা রুশানকে কল করেছে। ধরবে না ধরবে না করেও কল রিসিভ করল।
তবে আশ্চর্যের বিষয় অর্পা নিজের কথা না বলে প্রথমেই জিজ্ঞেস করল,
“দর্শনের কী হয়েছে?”

রুশান পালটা প্রশ্ন করল,
“কী হয়েছে?”

“তোমাকে কল করেনি?”

“না তো।”

“কিছুক্ষণ আগে আমাকে কল করেছিল। ও কাঁদছিল। কান্না জড়িত কন্ঠে বলল আমি রোজ রোজ আর কত সত্যের মুখোমুখি হব? আর কত যন্ত্রণা পাব? আর কতবার মরব?
ওর কণ্ঠ জড়িয়ে যাচ্ছিল বারবার। আমি জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে। উত্তর দিল না। কল কেটে দিল। তারপর আর রিসিভ করেনি।”

রুশানও বেশ চিন্তায় পড়ে গেল।
“আচ্ছা আমি দেখছি কি করা যায়। ওর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করব। যদি না পারি ওর বাসায় যাব।”

“আমাকে জানিও। আমিও যাব ওর বাসায়।”

“আচ্ছা।”

“ওকে। রাখছি।”
অর্পা কল কেটে দিল। বাড়তি একটা কথা বলল না।

~~~

অর্পা আর রুশান দর্শনের বাসায় গিয়ে বসে আছে। দর্শন এখনো হসপিটাল থেকে ফিরেনি। বাসায় ওর মা আর বোন। রুশান আর অর্পা ওর জন্য অপেক্ষা করছে। দর্শন বাড়িতে এসে ওদের দেখে চমকে গেল। অর্পা আর রুশান ওকে সরাসরি ওর রুমে নিয়ে গেল। অর্পা দরজা লক করে দিল।
“দর্শন, তোর কি হয়েছে? দিশার এনগেজমেন্ট অবধি তো সব ঠিক ছিল। হঠাৎ কী হলো?”

দর্শন ঠোঁট কামড়ে ধরে মাথা নিচু করে রাখল। রুশান ওকে চুপ দেখে বলল,
“চুপ করে থাকিস না৷ চুপ করে থাকলে কোন প্রব্লেম সলভ হবে না। শেয়ার কর সবাই মিলে একটা সল্যুশন বের করব।”

দর্শন মাথা উচু করে বলতে লাগল,
“এনগেজমেন্টের দিন আমি একটা সত্য জানতে পেরেছি।”

রুশান জিজ্ঞেস করল,
“কোন সত্য?”

“অর্ষা, কখনো মা হতে পারবে না।”

রুশান আর অর্পা দুজনেই এক সাথে বিস্ময় নিয়ে বলল,
“হোয়াট? কি বলছিস তুই?”

“হ্যা, সেই এক্সিডেন্টে ও মা হওয়ার ক্ষমতা হারিয়েছে।”
অর্পা আর রুশান দুজনেই ওর কথা শুনে স্তব্ধ, বাকরুদ্ধ।
দর্শন ডুকরে কেঁদে উঠল।
“আর কত পরীক্ষা দেব আমি? যে মেয়েটা একটা এক্সিডেন্টে সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে তাকে এতগুলো বছর সবাই ঘৃণা করে এসেছে। একা একা কত কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা। ওর পাশে কেউ ছিল না। আমিও না। আমি আর কত অপরাধী হব?”

রুশান বলল,
“এতে তোর কোন দোষ নেই। নিজেকে অপরাধী ভাবিস না।”

“আমি নিজেকে নির্দোষ ভাবতে পারছি না। আমার নিজেকে অপরাধী লাগছে। আমার জন্য ও এতকিছু হারিয়েছে,এত কষ্ট পেয়েছে। আমি ওর জন্য কিচ্ছু করতে পারিনি।”

অর্পা ওর পাশে গিয়ে বসল,
“এসব জানার পরেও ওকে ভালোবাসবি?”

দর্শন অবাক দৃষ্টিতে অর্পার দিকে তাকাল। অর্পা এটা কেমন প্রশ্ন করল? তবে প্রশ্নটা কঠিন। এই প্রশ্নের সহজ একটা উত্তর আছে ওর কাছে। রুশানও ওর প্রশ্নে হতবাক।
“ভালোবাসার সাথে ওর মা না হওয়ার কী সম্পর্ক? আমি ওকে ভালোবাসি আর সব পরিস্থিতিতে বাসব।”

অর্পা মৃদু হেসে উত্তর দিল,
“তাহলে আর কি? ইউ নো, বর্তমানে কত পদ্ধতি আছে বাচ্চা নেওয়ার। ওকে গ্রহণ কর। তোর ভালোবাসা দিয়ে ওকে জয় কর। ওকে এত ভালো রাখবি যে একদিন অতীতের সমস্ত দুঃখ কষ্ট ভুলে যাবে। চোখের পানি মুছে ফেল। ওর কাছে যা, ওর এখন তোকে খুব প্রয়োজন। প্রয়োজনের সময় যদি তোকে না পায় তবে ওর জীবনে তোর যে বিশেষ জায়গা যেটা তুচ্ছ মনে হবে। তোর আর কোন মূল্য থাকবে না ওর জীবনে।”

“কিন্তু ও যে আমাকে গ্রহণ করতেই চায় না।”

“শোন, কোনদিন তো তোকে ভালোবেসেছে। সে ভালোবাসা থেকে তোর প্রতি ওর একটা দূর্বলতা রয়েই গেছে। কতবার ফেরাবে? ফেরাতে ফেরাতে ক্লান্ত হয়ে যাবে, মন গলে যাবে। তুই শুধু চেষ্টা করে যা।”

দর্শন যেন হারানো মনোবল ফিরে পেয়েছে। মৃদু হেসে বলল,
“থ্যাংকস। আমি তোদের কথায় সাহস ও শক্তি পাচ্ছি। আমি ওর ভালোবাসা পাবই।”
অর্পা মৃদু হেসে ওর কাধে চাপট দিল। রুশান ফ্যালফ্যাল করে ওদের দেখছে। ওদের নয় অর্পাকে দেখছে। দর্শন ফ্রেশ হতে যেতেই অর্পার চোখ পড়ে রুশানের দিকে। রুশান অপলক ওর দিকে চেয়ে আছে। অর্পা ঘনঘন পলক ফেলে আবার ওর দিকে তাকাল।
“কিছু বলবে?”

রুশান মাথা নাড়িয়ে সায় দিল।
“আই লাভ ইউ।”

রুশানের মুখে আই লাভ ইউ শুনে অর্পা থমকে গেল।

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here