প্রেম_তুমি (দ্বিতীয় খণ্ড) ফাবিহা নওশীন পর্ব-৪

0
558

#প্রেম_তুমি (দ্বিতীয় খণ্ড)
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-৪

দর্শনের নিজের ঘরটা কেমন অস্বস্তিকর লাগছে। মনে হচ্ছে প্রাণ খুলে নিশ্বাস নিতে পারছে না। অপরিচিত কারো ঘরে এসে পড়েছে। চারদিকে দামি আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো তবুও ভালো লাগছে না। দর্শন দরজা জানালা সব খুলে দিল। ছোট থেকেই নতুন জায়গায় মানিয়ে নিতে বেশ সময় লাগে দর্শনের। গতকাল অবধি বেডরুম অন্য রকম ছিল আর আজ সম্পূর্ণ আলাদা। নতুন ঘর, নতুন আসবাবপত্র, নতুন ডেকোরেশন সব মিলিয়ে বেশ অস্বস্তি লাগছে। দর্শনরা যে ফ্ল্যাটে থাকত সেটা দর্শন ইউএসএ যাওয়ার পর চেঞ্জ করে ফেলেছে। বাবা-মায়ের জমানো টাকায় জমি কিনে নিজেদের দোতলা বাড়ি বানিয়েছেন। তাই এ বাড়ির সাথে দর্শনের কস্মিনকালেও সম্পর্ক ছিল না উপরন্তু ও একটু খুঁতখুঁতে স্বভাবের। ঘরের ডেকোরেশনের কিছু চেঞ্জ দরকার কিন্তু এখন এনার্জি নেই। তাই ফ্রেশ হওয়ার চিন্তা করল। বাথরুমে গিয়ে নিজের প্রয়োজনীয় সব কিছু ঠিকঠাক জায়গায় পেল। এগুলো ওর বোন দিশার কাজ। দর্শন মুচকি হেসে শাওয়ার নিতে ব্যস্ত হয়ে গেল। শাওয়ার নিয়ে পাতলা একটা টিশার্ট পরে বাগানে গেল। ছোট্ট একটা বাগান। সেখানে ফুটে আছে হরেক রকমের ফুল। বাগান থেকে দোতলা বাড়ির দিকে তাকাল। ভিডিও কল ও পিকে অনেকবার দেখেছে কিন্তু সামনাসামনি এই প্রথম বার। বাড়িটা বেশ সুন্দর। বাবা-মায়ের পছন্দ আছে। বেশ খরচা করেছেন এ বাড়িটি দাঁড় করাতে। দর্শনের সব সময় স্বপ্ন ছিল নিরিবিলিতে ওর নিজের ছোট একটা বাড়ি হবে, সামনে ছোট একটা বাগান থাকবে। বাগানে ফুলের রাজ্যের পাশাপাশি ফলের গাছ রাজত্ব করবে। পাখির কিচিরমিচির শব্দে সব সময় মুখরিত থাকবে। সেখানে ছুটির দিন বিকেলে বসে কফি খেতে খেতে গিটার বাজাবে। সেই স্বপ্নটা ঠিক পূরণ হলো। কিন্তু এখন আর গিটার বাজাতে ইচ্ছে করে না। গিটার রেখেই ইউএসএ গিয়েছিল সেখানে গিয়ে গিটার আর কেনেনি। এক সময় কত গিটার বাজাত। মুগ্ধ হয়ে অর্ষার গান শুনত। নাহ! আবারও অতীত নাড়া দিয়ে উঠে। দর্শনের অস্থির লাগতে শুরু করল।
দর্শন গাড়ির চাবি নিয়ে বের হয়ে গেল। গাড়ি চালাচ্ছে আনমনে। ওর চোখদুটো পথে-প্রান্তরে কাকে যেন খুঁজে ফিরে৷ মনে হয় এই বুঝি দেখবে। দর্শন বারবার রাস্তার এপাশ-ওপাশ দেখছে। এভাবে কাউকে পাওয়া যায় না তবুও মন মানে না যদি পেয়ে যায়। অর্ষা কোথায় আছে সেটাই জানে না, কারো কাছে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনও মনে করে না। তবুও খুঁজছে।

অর্ষা ছ’মাস ধরে জব করছে। মোটা অংকের স্যালারির সাথে ঝুড়িতে বেশ প্রশংসাও কুড়িয়েছে। ওর মেধা, সততা, দায়িত্বশীলতা, পরিশ্রম, একাগ্রতা দেখে কোম্পানির ডিরেক্টর ওকে আরো উচ্চপর্যায়ের সম্মান দিতে চায় কিন্তু এসবের জন্য অর্ষার সময় প্রয়োজন। তাই আগ্রহ নেই। অফিস আর বাড়িতে বসে সারাদিন কাজ এই করে কেটে যাচ্ছে সময়। আর কোনদিকে মন নেই ওর। অফিসের সময়গুলো ভালো যাচ্ছে। অনেক কিছু থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারছে। এত চাপে শপিং পার্লার কিছুই হচ্ছে না। ছুটির দিন কাজ শেষ করে হাই তুলতে তুলতে দিন চলে যায়। কিন্তু নিজের জন্য সময় বের করা জরুরি মনে করছে। তাই প্রথমে শপিংয়ে যাবে, শপিং শেষ করে পার্লারে যাবে। নিজের যত্ন নেওয়া উচিত। দর্শন রুশানকে নিয়ে শপিং করতে গিয়েছে। ইউএসএ থেকে এসেছে দশ-বারো দিন হয়ে গেছে। কিছু কেনাকাটা করা প্রয়োজন। একা যেতে ভালো লাগছে না তাই সময় বের করে রুশানকে নিয়ে গেল। অর্ষা শপিং শেষ করে কতগুলো ব্যাগ নিয়ে বের হচ্ছে। দর্শন নিজের জন্য টিশার্ট দেখছিল হ্যাংগার থেকে নেড়েচেড়ে। হঠাৎ সামনের আয়নায় পরিচিত একটা মুখ দেখে চমকে উঠে। সাথে সাথে ঘুরে যায়। সেখানে কেউ নেই। দর্শন টিশার্ট দেখা রেখে শপ থেকে বের হলো। ডান পাশে কয়েকজন মহিলা, দুটো ছেলে আর কিশোরী তিনটা মেয়ে আর যুবতি একটা মেয়ে যেতে দেখল। সম্ভবত ওই মেয়েটাকে দেখেছে৷ রুশান ওকে এভাবে আসতে দেখে ও নিজেও বের হয়ে গেল।
দর্শনের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“কিরে?”

দর্শন ওর কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে বলল,
“তুই একটু ভেতরে অপেক্ষা কর আমি আসছি।”

সবুজ ড্রেস পরা মেয়েটাকে পেছনে থেকে দেখেও পরিচিত মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে ও অর্ষা। যে অর্ষাকে চিনে সে অর্ষা। বদলায়নি একদম। লম্বা পাতলা সেই শারিরীক কাঠামো। দর্শন শিওর হওয়ার জন্য পেছনে পেছনে গেল। যদি অর্ষা হয় তবে ওকে জিজ্ঞেস করবে, অনেক প্রশ্ন করার আছে ওকে। দর্শন দ্রুত পায়ে হাঁটছে কিন্তু তাকে আর দেখতে পাচ্ছে না। এদিক সেদিক পাগলের মতো খুঁজছে। কিন্তু হারিয়ে ফেলেছে। ভীড়ের মধ্যে সেই মেয়েটাকে আর খুঁজে পেল না। দর্শন দ্রুত মার্কেট থেকে বাইরে গেল। পার্কিং লটে গিয়ে দাঁড়াল কিন্তু সেই মেয়েকে দেখতে পেল না। দর্শন আবারও মলে ঢুকল। অশান্ত মন নিয়ে আশেপাশের লেডিস্ শপগুলোয় উঁকি মারছে। কিন্তু কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না। রুশানের কল আসায় দাঁড়িয়ে গেল। কল রিসিভ করে আসছি বলে স্থির দাঁড়িয়ে রইল। আশেপাশে চোখ বুলালো। নিজের চুলগুলো সজোরে চেপে ধরে বলল,
“শিট! হারিয়ে ফেললাম।”

রুশানের কাছে বিধ্বস্ত অবস্থায় গেল। রুশান ওর এই অবস্থা দেখে বলল,
“কিরে তোকে এমন লাগছে কেন? আর কোথাও গিয়েছিলি?”

“একজনকে খুঁজতে গিয়েছিলাম। পেয়েও হারিয়ে ফেললাম। ভাগ্যটাই খারাপ।”
দর্শন আনমনে বলে ফেলল।

রুশান বুঝতে না পেরে বলল,
“কাকে? কি বলছিস কিছুই বুঝতে পারছি না।”

দর্শনের হুশ হলো। হকচকিয়ে গিয়েও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“মামাকে। ছোট মামাকে। মনে হলো তাকে দেখলাম কিন্তু পরবর্তীতে আর খুঁজে পেলাম না। বাদ দে চল শপিং সেরে নেই।”

রুশান আর দর্শন শপিং করছে কিন্তু পুরোটা সময় দর্শন বেখেয়ালি ছিল। রুশান সবটাই খেয়াল করল কিন্তু কিছু বলল না।

অর্পা দেশে ফিরেছে। সে খবর বন্ধুমহলে ছড়িয়ে পড়ল। অর্পা গেট টুগেদারের আয়োজন করল। রুশানকে বলতেও ভুলেনি। যতই হোক রুশান ওদের ফ্রেন্ড সার্কেলের একজন। নিজের ব্যক্তিগত সমস্যা কেন সকলের সামনে আনবে? আর তাছাড়া ওর প্রতি কোন অভিযোগ নেই। দুজনের সম্মতিতেই ব্রেক আপ হয়েছে। এবং পরবর্তী সময়ে ওরা ফ্রেন্ড থাকবে এটাও বলা ছিল। তাই এটাকে পার্সোনালি নিতে চায় না। রুশানও পুরনো কথা মনে না রেখে অর্পার গেট টুগেদারে যায়৷ দর্শনও সুযোগ মিস করেনি। এতবছর পর সবার সাথে দেখা হবে, সে সুযোগ কি হাতছাড়া করা যায়? দর্শন গিয়ে গেট টুগেদারে উপস্থিত হলো। দর্শনকে দেখে অর্পার চোখে পানি চলে এল। ওদের শেষ সাক্ষাৎ খুব একটা সুন্দর ছিল না। দর্শন তখন বিধ্বস্ত ছিল। অর্পা আবিষ্কার করল যে দর্শন আগের চেয়ে চুপচাপ গম্ভীর হয়ে গেছে। হাসে খুব কম। যতটুকু কথা বলে সেটা একদম প্রয়োজনীয়। ওদের আলাপচারিতার মধ্যে রুশান চলে এল। ওর গায়ে অফিসের পোশাক। অফিস শেষ করেই চলে এসেছে। বাসায় গিয়ে ফ্রেশও হয়নি। ফর্মাল লুকে রুশানকে খুব হ্যান্ডসাম লাগছে। অর্পা ওকে এক পলক দেখে চোখ সরিয়ে নিল। রুশান সবার সাথে স্বাভাবিক ও হেসে হেসে কথা বলছে। অর্পা আড়চোখে বারবার ওকে দেখছে। সেই হাসোজ্জল মুখটা। ঠোঁটের কোনে এক ফালি হাসি লেগেই আছে। একদম বদলায়নি। অর্পা আর রুশান নিজেদের স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলেও বাকিরা কেন জানি অদ্ভুত আচরণ করছে। ওদের দিকে কিভাবে তাকাচ্ছে। এতে ওদের মধ্যে অস্বস্তি বাড়ছে।

অর্পা একটু বেশিই অস্বস্তি ফিল করছে। রুশান সব বুঝতে পেরে বলল,
“গাইস! টেক ইট ইজি। প্লিজ আমাদের আনইজি ফিল করিও না। ওই আর গুড ফ্রেন্ড। প্রথম দিকে তো তাই ছিলাম। মাঝে একটা সম্পর্ক হয়েছিল সেটা ভেঙেও গেছে কিন্তু আমাদের বন্ধুত্বটা রয়েই গেছে। অল্প বয়সের আবেগের একটা সম্পর্কের মূল্য কি বন্ধুত্বের চেয়ে বেশি? ”
রুশান যুক্তিতর্ক দাঁড় করালেও অর্পার কাছে ওর কথাগুলো অপমানজনক মনে হলো। রুশান কত সহজে বলে দিল সব। অর্পা তবুও মুখে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে রেখেছে। সবাই রুশানের কথা শুনে স্বাভাবিক হলো।
খাওয়াদাওয়া আড্ডার ফাঁকে সবাই সবার খোঁজ খবর নিল। কে কবে বিয়ে করছে, কার বফ, গফ কি করে নানান প্রশ্ন। অর্পাকে বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করায় উত্তর দিল,
“আগে তো ওদেশে ফিরি। সেখানে আগে ভালো করে স্যাটেল হই। ডাক্তারি পাশ করেছি মাত্র। কোথাও জয়েন করিনি। জয়েন করে সবকিছু গুছিয়ে তারপর ওখানের কাউকে বিয়ে করে নেব। ওখানে বলতে অবশ্যই বাঙালি মুসলিম হতে হবে।”

ওর কথা শুনে সবাই চমকে উঠে। তামিম বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করে,
“তুই ওখানে স্যাটেল হবি?”

“হ্যা, আমি আসলে একেবারে আসিনি। ফ্রি আছি তাই জাস্ট সবার সাথে দেখা করতে এসেছি। জবে জয়েন করলে ব্যস্ত হয়ে পড়ব। তখন হয়তো আসা হত না। তাই জবে জয়েন করার আগেই এলাম।”

“কি বলছিস? আমরা এটা ভাবতে পারছি না। তুই আবার চলে যাবি? শুধুমাত্র দেখা সাক্ষাতের জন্য এসেছিস?”

অর্পা সবার মলিন মুখ দেখে উসখুস করতে করতে বলল,
“আসলে ওখানে অনেক দিন থেকেছি তাই অভস্ত্য হয়ে পড়েছি। চেনাজানাও হয়েছে খুব। ওখানে আমি একটা ব্যাটার লাইফ পাব। তাছাড়া এখানে আমার বাবা-মা ছাড়া তো আর কেউ নেই। ওখানে গিয়ে নিজে ভালোভাবে স্যাটেল হই তারপর তাদের নিয়ে যাব।”
ওর কথা শুনে সবাই ব্যথিত হলো। কিন্তু যেহেতু ওর লাইফ তাই কারো কিছু বলার অধিকার নেই। ও সেখানে কম্ফোর্ট ফিল করবে সেখানেই থাকবে।

পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে রাতুল রুশানকে প্রশ্ন করল,
“তুই কবে বিয়ে করছিস?”

রুশান মাথা চুলকে আঙুলের কড় গণনা করে বলল,
“মাত্র ২৬ বছর বয়স আমার। বিয়ের বয়স কি হয়েছে?”

“তা না হোক প্ল্যানিং….

” আমি কোনো কিছু প্ল্যানিং করে করি না। যখন যেটা হওয়ার হবে। প্ল্যান করে মাথা কেন খাব?”

রুশান খাওয়াতে মনোযোগ দিল। রাতুল পালটা প্রশ্ন করল,
“গার্লফ্রেন্ড? বিয়ের বয়স হয়নি বেশ কিন্তু প্রেম তো করছিস।”

রুশানের খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। বিষম খেয়ে বলল,
“প্রেম ভালোবাসা ছাড়া থাকা যায়? এখন জিজ্ঞেস করবি গার্লফ্রেন্ড কি করে, কই থাকে? আমার গার্লফ্রেন্ড মঙ্গল গ্রহে থাকে, সেখানে গবেষণায় ব্যস্ত।”

তামিম ওর কথা শুনে গালি দিয়ে বলল,
“শা’লা!”

রুশান মৃদু হাসল। তারপর বলল,
“প্রাইভেসি রাখছি।”

অর্পা ওর কথায় কান দিল না। ও আগের মতোই পাগল আছে। দর্শনের দিকে তাকাল। ও গম্ভীর মুখে বসে আছে। অর্পা ওর দিকে চিন্তিত ভঙ্গিতে চেয়ে বলল,”দর্শন তো দার্শনিক টাইপ কিছু হয়ে যাচ্ছিস। ঘটনা কি? রিলেশন টিলেশন কিছু চলে? আই মিন গার্লফ্রেন্ড আছে?”

দর্শন মুখে গাম্ভীর্য ভাব বজায় রেখেই বলল,
“আমি এখনো একটা মেয়েকে অসম্ভব ভালোবাসি।”

সবাই ওর কথা শুনে চমকে গেল। কারো বুঝতে বাকি নেই কার কথা বলছে। কিন্তু তার নাম উচ্চারণ করল না। অর্পা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রুশানের দিকে তাকাল। রুশান কত সহজে সব ভুলে গেছে অথচ দর্শন আজো তার পুরনো প্রেমিকাকে অসম্ভব ভালোবাসে। প্রকৃত ভালোবাসা কত সুন্দর!

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here