প্রেম_তুমি ফাবিহা নওশীন পর্ব-৮

0
666

#প্রেম_তুমি
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-৮

সন্ধ্যা পাঁচটা বেয়াল্লিশ। গ্রিন ডোর রেস্টুরেন্টের দোতলায় পার্টি চলছে। ১০-১৫ জন ছেলেমেয়ে মজ-মস্তিতে মেতে আছে। স্নো সাউন্ডে গান বাজছে। অর্ষা বিষন্ন, ভারাক্রান্ত মনে বসে আছে এক কোনায়। ও যার জন্য এসেছে, যাকে দু চোখ খুঁজে ক্লান্ত সে লাপাত্তা। তাকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না। তাই বসে থাকা ছাড়া কোন কাজ নেই। প্রিয়া ওর পাশে এসে বসে বলল,
“এই অর্ষা, থম মেরে বসে আছিস কেন? এভাবে বসে থাকার জন্য এসেছিস? তুই হচ্ছিস সব পার্টির প্রাণ। সবাইকে মাতিয়ে রাখিস আর আজ তুই নির্বিকার বসে আছিস কেন?”

অর্ষা বিরক্তি নিয়ে মুখ বাকিয়ে বলল,
“তাহলে কী ধেই ধেই করে নাচব? যার জন্য এসেছি সেই তো আসেনি। আমি কী অর্পার জন্য এসেছি? আমি এসেছি দর্শনের জন্য। এমনিতেই ওর সামনে আমার ইমেজ খারাপ হয়ে আছে। তাই চেষ্টা চালাচ্ছি দর্শনকে ইম্প্রেশ করার জন্য কিন্তু দেখ ও আসেনি। এখন আমি কাকে ইমপ্রেস করব?”
অর্ষার মনটা আবারও খারাপ হয়ে গেল। মনে হচ্ছে মুখটা মেঘে ঢেকে পড়ছে।

“তুই শিওর দর্শন আসেনি?”

অর্ষা বসা থেকে দাঁড়িয়ে প্রিয়াকে প্রশ্ন করল,
“ভাই, এসেছি ৩০ মিনিট হবে। এই ৩০ মিনিটে ওকে এক পলক দেখেছিস?”

প্রিয়া ভাবছে আসলেই তো ওকে দেখেনি। এতক্ষণ একটা মানুষ পার্টির আড়ালে থাকতে পারে না। আর থাকবেই বা কেন? প্রিয়ার মুখ দেখে অর্ষা আবারও বসে পড়ল। তারপর কি একটা ভেবে বলল,
“প্রিয়া, এমন তো নয় ও ইচ্ছে করে আসেনি৷ অর্পার কাছে জেনেছে আমি আসছি তাই হয়তো আসেনি। আমাকে তো একদম পছন্দ করে না।”

প্রিয়া ওর কথা শুনে অবাক হয়ে চোখ উল্টালো। তারপর বলল,
“আরে গাধা, তুই নিজেকে এত ইম্পর্ট্যান্ট কেন দিচ্ছিস? তোর কাছে ও ইম্পর্ট্যান্ট ওর কাছে তুই না। ও তোর জন্য ফ্রেন্ডের পার্টি কেন মিস করবে? হয়তো অন্য ব্যাপার।”

অর্ষা ভেবে দেখল প্রিয়া ঠিক বলেছে। তারপর ঠোঁট উলটে অভিমান নিয়ে বলল,
“তাহলে এখানে বসে থেকে কী লাভ? চল, চলে যাই। আমরা একটা রেস্টুরেন্টে বসে খেয়েদেয়ে একটু ঘুরে বাসায় চলে যাই।”

“অর্পা কী ভাববে এভাবে চলে গেলে?”

“যা খুশি ভাবুক আমার কী?”

রুশান দূর থেকে মুচকি হেসে অর্ষার কাছে এল।
“হায়! কী অবস্থা অর্ষা? মুখটা বাংলার পাঁচ করে বসে আছো কেন? পার্টি এঞ্জয় করো। আসো আসো।”

অর্ষা ইতস্তত করে বলল,
“না ভাইয়া, আমি এখানেই ঠিক আছি।”

“বললেই হলো? এসো, এসো।”

“আপনি যান। আমি যাব না।”

এরি মধ্যে অর্পা চলে এল। রুশানের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাল। তারপর বলল,ও
“ওকে বিরক্ত করছো কেন?”

রুশান না বোঝার ভান করে বলল,
“আমি আবার কী করলাম?”
এটা বলেই রুশান চলে গেল। রুশান যেতেই অর্পা বলল,
“কিছু মনে করো না।”

“আচ্ছা, আপু একটা কথা বলি কিছু মনে করো না। আমি আবার কিছু চেপে রাখতে পারি না। তোমার বয়ফ্রেন্ডটা একটু ছ্যাচড়া টাইপ।”

“ও এখন আর আমার বয়ফ্রেন্ড না। ছ্যাচড়া দেখেই ব্রেক আপ করে ফেলেছি।”

অর্ষা বিস্ময়ে চোখ বড়বড় করে ফেলল। ওর কথা বিশ্বাসই হচ্ছে না। বিস্ময় নিয়ে বলল,
“সিরিয়াসলি?”

“হ্যা, সিরিয়াস। আজ তাই তো ট্রিট দিচ্ছি সবাইকে। ব্রেক আপ ট্রিট।”

“অদ্ভুত তো! ব্রেক আপ ট্রিট এক্সও পাচ্ছে। ভেরি নাইচ!”

অর্পা ইষত হেসে বলল,
“হ্যা, বাপের রেস্টুরেন্ট তো তাই ফ্রিতে দোতলায় পার্টি দিচ্ছি। এক্স-কেউ বাদ রাখিনি। ইউনিক ট্রিট আর কী। ওর কাছ থেকে দূরে দূরে থেকো। ব্রেক আপ হয়ে গেছে এখন কিন্তু ছাড়া গরু। আর ছাড়া গরু কিসে মুখ দিয়ে বসে বলা মুশকিল।”

অর্ষা চোখ বড়বড় করে তাকাল। অর্পা হেসে ফেলল। তারপর অর্ষা কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বলল,
“রুশান ভাইয়ার সাথে যে বন্ধুরা থাকে তাদের তো দেখছি না। উনারা আসেনি?”
অর্পা রুশানের দিকে চেয়ে বলল,
“কই? সবাই তো এসেছে। তুমি কার কথা বলছো রাতুলের?”
“না!”
“তাহলে তামিম? তামিমও এসেছে।”
“না, আমি উনার কথা বলছি না।”
“তাহলে কার কথা বলছো? আমি বুঝতে পারছি না।”
অর্ষা মনে মনে বিরক্ত হলো। অর্পাকে কেন এসব জিজ্ঞেস করছে এসব ভেবে নিজেরই রাগ লাগছে।
“ওসব বাদ দেও। অনেক তো হলো এখন আমি যাই।”
“কেন? এখুনি কেন? তোমাকে এখন কিছুতেই যেতে দেব না।”
অর্ষা বাড়ি চলে যাবে সেটা ভেবে বেশ খুশি হয়েছিল কিন্তু সে খুশিটা রইল না। অর্পা চুরমার করে দিল। অর্ষা মুখে চাপা হাসি ফোটাল। তবে মনে মনে বেশ বিরক্ত। এতটাই বিরক্ত যে সব লণ্ডভণ্ড করে দিতে ইচ্ছে করছে।

দর্শন দূর থেকে অর্ষাকে পর্যবেক্ষণ করছে। অর্ষাকে দেখা মাত্রই দর্শন ওর চোখের আড়ালে চলে যায়। রুশানের সাথে আড্ডা দিচ্ছিল যখন অর্ষাকে দেখে তখনই ওয়াশরুমে যাওয়ার কথা বলে সরে যায়৷ এখনো দর্শন সবার মাঝে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে৷ কেন রেখেছে জানা নেই। জানতেও চায় না। তবে অনুভূতিটা ভালো লাগছে। এটাই হয়তো একমাত্র কারণ। তাই নিজেকে আড়াল করেই রাখছে। যতক্ষণ সম্ভব রাখবে। ফর্শন ওর ফ্যাকাসে মুখের রহস্যটাও জানে। সেটা জেনে গোপনে হাসছে। অর্ষাকে আজ বেশ সুন্দর লাগছে দর্শনের কাছে। অর্ষা অন্যদের মতো সাজগোজ করেনি তবুও অন্যদের তুলনায় ওকে বেশি মোহনীয় লাগছে।

দর্শনের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে৷ একটু কোল ডিংক দরকার। দর্শন নিজেই কোল ডিংক খুঁজছে। তখন হঠাৎ শুনতে পেল মাইক্রোফোনে হ্যালো ওয়ান টু চেক।

“তাকে অল্প কাছে ডাকছি
আর আগলে আগলে রাখছি
তবু অল্পেই হারাচ্ছি আবার❣️

…..
বাকিটা ইউটিউবে শুনে নিয়েন।
গাইতে গাইতে অর্ষার চোখের কোনে পানি জমছে। দর্শনের মুখটা বারবার ভেসে আসছিল। দর্শনের বুকে কেমন ঝড় বইছিল। কেমন হুহু করছিল। ধীরে ধীরে সামনে এসে দাঁড়াল। অর্ষার সুর থেমে গেল দর্শনকে দেখে। দু’জন দুজনের দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। হঠাৎই দুজনের দৃষ্টিভঙ হলো। মুখরিত শ্রোতাদের কল-ধ্বনিতে।

…..

অর্ষা কাঁধের ব্যাগটা ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে হাঁটছে। মাঝেমধ্যে খোলা চুলগুলো নাড়ছে। হাঁটতে হাঁটতে জুতায় বাঁধ পড়া নুড়ি-পাথর, ইটের খোয়া লাথি মেরে উড়িয়ে দিচ্ছে। রুশান ওকে দেখিয়ে একটা ছেলেকে জোর করে ধাক্কা মেরে ওর কাছে পাঠাল।
ছেলেরা নার্ভাস কন্ঠে পেছনে থেকে ডেকে উঠল,
” অর্ষা!”
অর্ষা পেছনে ঘুরে ওকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“কী চাই?”
ওর কন্ঠ শুনে বেচারার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। আরো দ্বিগুণ নার্ভাস হয়ে গেল।
আমতা-আমতা করে এক নাগাড়ে বলল,
“অর্ষা তোমাকে আমার অনেক ভালো লাগে। আমি তোমাকে ভালোবাসি। আই লাই ইউ। প্লিজ একসেপ্ট মি।”

অর্ষা ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকাল। তারপর কড়া গলায় বলল,
“নিজের লেভেল দেখেছিস? না দেখেই প্রপোজ করতে চলে এসেছিস? প্রপোজ করার আগে অন্তত নিজের লেভেল দেখা উচিত ছিল। নাক টিপলে এখনো দুধ পড়বে সে এসেছে আমাকে প্রপোজ করতে। একটা থাপ্পড় মেরে দাঁত ফেলে দেব। এর পর যদি তোকে দেখি না তবে,, তবে কি করব সেটা তুই আমার সামনে আসলেই বুঝবি। প্রপোজ করতে এসেছে। আমি বাঁচি না আমার জ্বালায় সে এসেছে প্রপোজ করতে। ইচ্ছে করছে তোকে থিতলে ফেলি। একদল গুড়ো করে প্যাকেট করে ফেলি। বেয়াদব একটা। তুই এখনো আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছিস? অদ্ভুত তো! তুই কি চাস তোর মার্ডা*র করে ফেলি? হুহ!”
অর্ষা গর্জে উঠে ওর দিকে এক পা আগাতেই ছেলেটা দৌড় দিল। প্রিয়া হাসতে হাসতে ওর পেছনে এসে দাঁড়াল।
অর্ষার ওর হাসি দেখে গা জ্বলে যাচ্ছে।
“আরে, কওয়া নাই বলা নাই আই লাভ ইউ? এত সহজ? প্রেম ভালোবাসা এতই সহজ? পানিতে ডুবে মরে যেতে ইচ্ছে করছে। যদি ওর প্রপোজ একসেপ্ট করতাম তাহলে আমাদের দুজনকে দেখে সবাই কী বলত ছোট ভাই বড় বোন। ওয়াক! কি বিশ্রী! কমন সেন্স নাই। দৌড়ে চলে এসেছে প্রপোজ করতে।”
প্রিয়া ওর কথা শুনে আবারও হাসতে লাগল।
“বাদ দে, বাচ্চা ছেলে। বুঝেনি। হয়তো নাইন-টেনে পড়বে।”
“পেকে গেছে বেশি। অল্প বয়সে পাকলে কপালে দুঃখ আছে।”

রুশান দূর থেকে ওদের দেখে মুখ চেপে হেসে বলল,
“দেখছিস কত নির্দয়? ছেলেটা প্রেম নিবেদন করল আর কিভাবে রিজেক্ট করল?”
দর্শন ওর কথায় রেগে গিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,
“তো কী করবে? যে সে প্রপোজ করবে আর তার সাথে ধেই ধেই করে প্রেম করতে চলে যাবে?”
“সে ঠিক আছে। কিন্তু আমি তো আর যে সে না। আমাকেও তো পাত্তা দেয় না।”
“তোর মতো ছ্যাচড়া পোলাকে কেউ পাত্তা দিবে না। আর তাছাড়া ও আমাকে ভালোবাসে জানিস না?”
রুশান মুখ বাকিয়ে বলল,
“তুই তো আর বাসিস না। তাই আমিও হাল ছাড়ছি না। ওকে পটিয়েই ছাড়ব।”

….

দুপুর বেলায় অর্ষা ক্যানটিনে গেল। ওর আবার কিছুক্ষণ পর পর ক্ষুধা লাগে। ব্যাগে সব সময় শুকনো খাবার রাখে এই কারণে। অর্ষা ক্যানটিনে অর্পা আর রুশানকে দেখে এগিয়ে গেল। ওরা দু’জন নাকি রিলেশনে নেই কিন্তু এত গলায় গলায় ভাব কী করে। ব্রেকাপের পর এত সুন্দর বন্ধুত্ব কী করে থাকে? ও তো শুনেছে ব্রেক আপের পর এক্সকে কালসাপ বলে আখ্যায়িত করা হয়। তাই অর্ষা সবটা দেখার জন্য ওদের কাছে গেল।
“হাই, অর্পাপু। কী করো এক্সের সাথে?”
অর্পা বিষম খেল। সাথে রুশানও। ও দাঁত কেলিয়ে বলল,
“কিছু না। আসলে একটা জরুরি টপিকে কথা বলছিলাম। সামনে পরীক্ষা তো।”
অর্ষা চেয়ার টেনে বসে বলল,
“তাই?”
“হ্যা, তাই তো। তাই না রুশান?”
রুশানও থতমত খেয়ে বলল,
“হ্যা, এখন আমি পিউর সিঙ্গেল। আমার সিট একদম খালি আছে। কারো লাগলে জানিও।”
তখনই দর্শন এসে আরেকটা চেয়ার টেনে বসল। তারপর অর্ষার প্রতি রাগ,ক্ষোভ ঝেরে বলল,
“তুমি ফার্স্ট ইয়ারের মেয়ে হয়ে সেকেন্ড ইয়ারের স্টুডেন্টদের সাথে কী করো? কেন সব সময় আমাদের গ্রুপের পেছনে পেছনে ঘুরঘুর করো? বিশেষ করে ছেলেদের? কী দরকার তোমার হা?”

অর্ষা ওর কথা শুনে বাকরুদ্ধ। অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে চেয়ে আছে। অর্পা আর রুশানও ওর ব্যবহার দেখে অবাক হচ্ছে। অর্পা কিছু বলতে গেলে দর্শন হাত উঁচু করে ওকে থামিয়ে বলল,
“তুই একদম তদারকি করবি না। তোর আশকারায় এত লাই পেয়েছে। লাই দিয়ে মাথায় তুলেছিস। তুই বোন পাতিয়েছিস সেটা পার্সোনাল লাইফে রাখবি। আমাদের গ্রুপে ওকে আনবি না। এরপর যেন ওকে আর গ্রুপে আনতে না দেখি। আর তোমাকে বলছি যদি লজ্জা বলতে কিছু থাকে তবে আমাদের পেছনে ঘুরঘুর করো না। দশ হাত দূরে থেকো।”
অর্ষা লজ্জায়, অপমানে কথা বলতে ভুলে গেল। ওর চোখে পানি ছলছল করছে। গলা ধরে আসছে। অনেক কষ্টে ছোট করে ঢোক গিলল। এত অপমান সহ্য করতে পারছে না। কষ্ট হচ্ছে খুব৷ হৃদয়টা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। যাকে ভালোবাসে সে কী বলছে এসব? সে কি জানে তার এই বাক্যে কতটা অপমান জড়িয়ে আছে? এতে ও কতটা আঘাত পাবে? অর্ষা বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে এত অপমান সহ্য করতে না পেরে এক দৌড়ে ওদের দৃষ্টির অগোচরে চলে গেল।

আগাম একটা করে বেশি পর্ব পড়তে চাইলে আমাকে ফ্লো করুন 🖐️✊

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here