#প্রেম_তুমি (দ্বিতীয় খণ্ড)
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-22
“অর্ষা!”
আতংকিত, ভয়ার্ত কন্ঠস্বর শুনে অর্ষা চমকে গেল। চমকে গিয়ে ভয়ার্ত চোখেমুখে পেছনে তাকিয়ে আরেকটা ভয়ার্ত মুখ দেখতে পেল। দর্শন অজানা আশংকা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর সামনে যাচ্ছে না। সামনে গেলে যদি লাফিয়ে পড়ে।
কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,
“এই অন্ধকারে ওখানে কী করছো তুমি? তাড়াতাড়ি নেমে এসো। আমি হাত বাড়াচ্ছি। হাত ধরে আস্তে আস্তে নামো।”
দর্শন কিছুই হয়নি এমন ভাব করে হাত বাড়াল। অর্ষা আরেকবার সামনের দিকে তাকাল। দর্শন বুঝতে পারছে না অর্ষা আদোও ওর হাতটা ধরবে কি না। মনে মনে প্রার্থনা করছে ওর হাতটা যেন ধরে। ওর প্রার্থনাই কবুল হলো। তবে অর্ষা ওর হাত ধরল না। প্রথমে এক পা নিচে নামিয়ে নিজেই লাফ দিয়ে নেমে গেল। দর্শন তাতে কিছু মনে করল না। অর্ষা নেমে এসেছে এই বেশি। যে ভয় পেয়েছিল। ভয়ের চোটে হার্ট এটাক করার অবস্থা।
“তুমি ওখানে কেন উঠেছিলে?”
অর্ষা মৃদু হাসল। সে হাসিতে সুখ নেই। আছে বিষন্নতা, আছে আকাশ সমান ব্যথা।
“কি ভেবেছিলে আত্মহত্যা করব? উহু, আমি এতটা দূর্বল নই। আত্মহত্যা করার হলে অনেক বছর আগেই করতাম। তখন সামলানোর মতো কেউ ছিল না এখন তো তুমি আছো। তখন একাই নিজেকে সামলে নিতে পেরেছি, এখন পারবো না?”
“অর্ষা, আ’ম সো সরি। আমি জানি তুমি অনেক কষ্ট পাচ্ছো। আমি মায়ের সাথে কথা বলব।”
দর্শনের কন্ঠে আকুতি।
অর্ষা ছলছল চোখে বলল,
“বলেছিলাম তোমাকে। বারবার বলেছি বিয়ের আগে ম্যাটারটা সলভ করো। করোনি। যদি করতে তবে আজ সিচুয়েশন এমন হতো না। একই বাড়িতে এভাবে কি করে থাকব?”
“মা তো তোমাকে কিছু বলেনি। যা বলার আমাকে বলেছে। আর আমার উপর রেগে আছে। তোমার উপর তার কোন রাগ নেই।”
“আমার সাথে একটা কথাও বলেনি। কিছু না বলার চেয়ে মন খুলে সব বলা ব্যাটার। বাড়ির পরিবেশ দেখেছো? বাবাও কেমন অদ্ভুত ব্যবহার করল। দু’জনেই আমার উপর অসন্তুষ্ট। এখন আমি কী করব? আল্লাহ কেন আমার উপর মুখ তুলে তাকাচ্ছে না? জানি না সামনে কি হবে। তাদের কী ডিসিশন হবে সেটা ভেবেই চিন্তায় মরে যাচ্ছি। দর্শন তারা কী সিদ্ধান্ত নিবে? তুমি আমাকে ডিভোর্স করবে না তো? তাহলে আমি মরে যাব।”
দর্শনের চোখে পানি চলে এল। অর্ষাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। অর্ষাও ওর টিশার্ট খামচে ধরে কাঁদছে।
“বোকা মেয়ে। তাদের সিদ্ধান্ত যাইহোক আমার সিদ্ধান্ত কখনো পাল্টাবে না। আল্লাহর কালাম সাক্ষী করে বিয়ের মতো পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি। এই বন্ধন কখনো ছিন্ন হবে না। যত যাইহোক তুমি আমার আর আমি তোমার আছি আর থাকব৷ এতগুলো বছর পরে যখন এক হয়েছি আল্লাহর ইচ্ছে আছে আমাদের সারাজীবন এক সাথে রাখার। আল্লাহর উপর ভরসা রাখো। এত তাড়াতাড়ি কেন হার মেনে নিচ্ছো? একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন ঘরে চলো।”
দর্শন অর্ষার চোখের পানি মুছে দিয়ে কপালে চুমু খেল।
অর্ষা এপাশ ওপাশ করতে করতে ঘুমিয়ে গেছে কিন্তু দর্শনের ঘুম আসছে না। সকালে ডিউটি আছে ঘুমানো জরুরি কিন্তু ঘুম আসছে না। দর্শন বিছানা ছেড়ে বাগানে গেল। চারদিকে সুনসান নীরবতা। মাঝেমধ্যে বাগানের আম গাছগুলো থেকে দু একটা পাখি ডেকে উঠছে। দর্শন বাগানের আলোয় চেয়ারে বসে পড়ল। আকাশের দিকে চেয়ে অঝোরে কাঁদতে লাগল।
আর বিরবির করে বলছে,
“হে আল্লাহ, মেয়েটাকে আর কত কষ্ট দিবে? ওকে আর কষ্ট দিও না। জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছে। অনেক চেষ্টা করেছি ওকে খুশি রাখতে। কিছু সময়ের জন্য ওকে তুমি অনেক খুশি দিয়েছো। কেন আবার ওর মুখ থেকে হাসি কেড়ে নিচ্ছো? সন্তান তোমার দেওয়া নেয়ামত। সেই নেয়ামত দান করে আমাদের ধন্য করো। আমাদের একটা সন্তান দেও। শুনেছি মাঝ রাত্রিতে তুমি বান্দার কাছাকাছি চলে আসো৷ তার ডাক শুনো। আমার মোনাজাত, আমার চোখের পানি কবুল করো। আমাদের একটা সন্তান দেও। তুমি সব দিয়েছো আমাকে। এখন তোমার কাছে সুসন্তান ছাড়া আর কিছু চাওয়ার নেই। কবুল করো।”
দর্শন অঝোরে কাঁদতে লাগল।
দর্শনের কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পড়ল। দর্শন চমকে পেছনে তাকাল। ওর বাবা দাঁড়িয়ে আছে। দ্রুত চোখের পানি মুছে বলল,
“বাবা! তুমি এখানে?”
“তুমি এতরাতে এখানে কি করছো?”
দর্শন আশেপাশে তাকাল। তারপর আমতা আমতা করে বলল,
“কিছু না। ওই এমনি ঘুম আসছিল না।”
তারপর দৃষ্টি লুকাল।
দর্শনের বাবা ওর কাঁধে হাত রেখে বলল,
“বাবা হই তোমার। তোমাকে জানি আমি। এমন কাজ কেন করো যাতে একা একা কষ্ট পেতে হয়, দৃষ্টি লুকাতে হয়। তোমার মা-ও আজ অনেক কষ্ট পেয়েছে।”
“বাবা, তুমি আর মা দুজনেই চিকিৎসক। আর চিকিৎসক হয়ে রোগীর রোগ নিয়ে রাগান্বিত, রোগীর সাথে এমন ব্যবহার কি আদোও মানানসই?”
“তুমি যা ভাবছো বিষয়টা তা নয়। মানুষের রোগ-ব্যাধি থাকতেই পারে। রোগ আছে বলেই আজ আমরা ডক্তর কিন্তু তুমি পুরো ব্যাপারটা আমার আর তোমার মায়ের কাছ থেকে লুকিয়েছো। এত কষ্ট করে সন্তান মানুষ করে, তাকে বিশ্বাস ভরসা করে যদি জানতে পারি সে আমাদের থেকে দীর্ঘদিন যাবত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় লুকিয়েছে তখন মনে হয় ধোকা খেয়ে গেলাম। প্রকৃত বাবা-মা হতে পারিনি। সন্তানের কাছে বিশ্বাস আর ভরসার স্থান পাইনি। আসলে আমাদের ফিলিংসটা তোমাকে বুঝাতে পারছি না। যেদিন তোমার সন্তান হবে তখন বুঝবে। বাবামায়ের কাছে সন্তান কি জিনিস। যাইহোক, এসব নিয়ে আর ভেবো না। তোমার মায়ের সাথে আমি কথা বলব। সে আসলে হঠাৎ করে সবকিছু জানতে পেরে শকড হয়ে পড়েছে। সময়ের সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে। সব ঠিক হলে তোমার মায়ের সাথে অর্ষার ট্রিটমেন্ট নিয়ে কথা বলে নিও।”
দর্শন বিশ্বাসের সাথে বলল,
“আচ্ছা। আশা করছি শীঘ্রই সব নরমাল হয়ে যাবে।”
ওর বাবা ভরসার দৃষ্টি দিল।
চলবে…….