#প্রেম_তুমি (দ্বিতীয় খণ্ড)
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-৬
প্রিয়া ওকে রাজি করানোর প্রয়াস চালাচ্ছে। অর্পা এত করে বলল। অর্ষা রাজি হলে দু’জন এক সাথে অর্পার সাথে দেখা করতে যেতে পারবে। এক সাথে আড্ডা দেওয়া যাবে। একা একা যেতে ইচ্ছে করে না তাই ওকে রাজি করানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।
“অর্ষা, কী সমস্যা? সব কিছু বদলে গেছে। অর্পা আপু আবার চলে যাবে। তোকে একটু দেখতে চায়।”
“আমি বুঝতে পারছি কিন্তু কিভাবে যাব ওর সামনে? শেষ দেখা, শেষ কথা এমনকি শেষের ঘটনাগুলো কি ভুলতে পেরেছে? আমি তাদের কাছে সেখানেই আছি। আমার অস্বস্তি লাগবে। আমি পারব না সহজ হতে। কোন পক্ষই পারবে না সহজ হতে। তুই যা।”
প্রিয়া দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ধীরস্থির গলায় বলল,
“সত্যি কথা তো এটাই তুই এখনো সেখানে পড়ে আছিস। লাইফে মুভ অন করেছিস কিন্তু মানসিকভাবে সেইদিনগুলো আঁকড়ে বেঁচে আছিস।”
ওর কথা শুনে অর্ষা রেগে গেল। সত্যি সব সময় তেতো হয় অর্ষার কাছে তেতোই লাগছে।
“প্রিয়া, তুই বেশি কথা বলছিস। তোর কথা হয়ে গেলে আমি যাচ্ছি।”
“যা, এখন তো তোর আর কাউকে প্রয়োজন হয় না। নিজেই নিজের জন্য যথেষ্ট।”
অর্ষা দুম করে দাঁড়িয়ে ব্যাগ নিয়ে চলে গেল। প্রিয়া ওর যাওয়া দেখে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে নিজের উপরই রাগ হলো।
“এটা আমি কী করলাম? জানি তো অর্ষার রাগ বেশি। অর্পা আপুর সাথে দেখা করা নিয়ে শুধু শুধু ঝামেলা করলাম। ওর ইচ্ছে না হলে যাবে না এটাই তো স্বাভাবিক।”
প্রিয়াও ওর পেছনে পেছনে দৌড়ে গেল। অর্ষা ততক্ষণে গাড়ির সামনে চলে গেছে। প্রিয়া ওকে পেছনে থেকে ডাকছে।
“অর্ষা, দাঁড়া।”
অর্ষা দাঁড়িয়ে গেল। পেছনে ঘুরে ওর দিকে রাগি ফেস করে তাকাল।
“কী চাই তোর?”
“সরি সরি। আমি বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি। ঠিক আছে দরকার নেই তোর যাওয়ার তবুও রাগ করিস না।”
অর্ষা প্রতিউত্তরে কিছু বলল না। প্রিয়া ওকে চুপ দেখে বলল,
“আমাকে লিফট দিবি?”
অর্ষা আশেপাশে চেয়ে বলল,
“তুই গাড়ি আনিস নি?”
“না।”
“আচ্ছা আয়।”
প্রিয়া আর অর্ষা দু’জনই গাড়িতে উঠে বসে। অর্ষা ড্রাইভ করছে চুপচাপ। প্রিয়াও কোন কথা বলেনি। কি বলবে আবার রেগে যাবে তাই চুপ করেই আছে।
অর্ষাই নীরবতা ভেঙে বলল,
“অতীতটাকে আমি বড্ড ভয় পাই। সে অতীতের মুখোমুখি হওয়ার সাহস আমার নেই। তাই অতীতকে এড়িয়ে চলি। সেই মানুষগুলো কিংবা ঘটনার মুখোমুখি হওয়ার অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। ভয়টা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। হয়তো পারব না।”
প্রিয়া ওর দিকে তাকাল। চোখগুলো ছলছল করছে। মুখটাও বিষন্ন। ওর অবস্থা বুঝে বলল,
“ঠিক আছে আমি আর কখনও বলব না। যা তোকে কষ্ট দেয় আমি কখনো তার সম্মুখীন হতে বলব না। অর্পা আপু অনেক করে রিকুয়েষ্ট করেছিল তাই তোকে জোর করছিলাম। এখন আমি বুঝতে পারছি।”
“আমার ইচ্ছে করে অর্পা আপুর সাথে দেখা করতে। উনি নিজ থেকে আমার সাথে দেখা করতে চাইছেন। আবার বললি চলে যাবে কিন্তু ওই যে আমি এক জায়গায় বাঁধা পড়ে আছি। তাই…..
” আরে বাদ দে…. অর্পা আপুর সাথে দেখা করা জরুরী নয়।”
“হুম। জীবনের সবচেয়ে জরুরী মানুষটাই হারিয়ে গেছে।”
অর্ষা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। প্রিয়া নীরব। মনে মনে ভাবছে যদি সেই মানুষটাকে ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব হত। এটা ভেবে প্রিয়াও দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
……
প্রিয়া রাতের বেলায় বিছানায় বসে বসে টিভি দেখছে আর চিপ্স খাচ্ছে। এমন সময় মোবাইল বেজে ওঠে। মোবাইলের স্কিনে অর্ষার নাম। প্রিয়া কল রিসিভ করল। কল রিসিভ করতেই অর্ষা বলল,
“কী করিস?”
“টিভি দেখি।”
অর্ষা চুপ। আর কিছু বলছে না। ওকে চুপ দেখে প্রিয়া নড়ে-চড়ে বসে ওর দিকে মনোযোগ দিল।
অর্ষা তখনও চুপ। প্রিয়া কান পাতল ভালো করে। অর্ষার নিশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কিছু শুনতে পাচ্ছে না। প্রিয়া তবুও প্রশ্ন করছে না। অপেক্ষা করছে অর্ষার কথা শোনার জন্য।
“প্রিয়ু তুই কবে যাবি?”
প্রিয়া না বুঝতে পেরে প্রশ্ন করল,
“কোথায়?”
অর্ষা আবারও চুপ। দীর্ঘ করে নিশ্বাস নিল।
“অর্পা আপুর সাথে দেখা করতে?”
প্রিয়া ওর কথা শুনে ভীষণ অবাক হলো। এইজন্য অর্ষা এত সময় নিচ্ছিলো। কিন্তু কেন জিজ্ঞেস করছে?
“যাব এক সময়। কিন্তু কেন?”
“না মানে আমিও যেতাম।”
প্রিয়া আরেক দফা বিস্মিত হলো। চোখেমুখে দ্বিগুণ বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করল,
“তুই যাবি?”
“হ্যা।”
প্রিয়া স্বাভাবিক হলো। সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,
“অর্ষা, মনের বিরুদ্ধে কিছু করিস না। এমন কিছু করিস না যা তোকে কষ্ট দিবে। মনের মধ্যে অশান্তি বাড়বে।”
“প্রিয়ু আমি সবকিছু থেকে বের হতে চাই। অর্পা আপুর সাথে দেখা করব। উনি যদি কোন প্রশ্ন করে নিজের মতো উত্তর দেব। ব্যস।”
“ভেবেচিন্তে বলছিস?”
“হ্যা, অনেক ভেবেছি। পুরো দিন ভেবেছি। আমি পারব।”
“আচ্ছা, আমরা পরশু শুক্রবার আপুর বাসায় যাব। তোর আমার অফিস ছুটি আছে। ওইদিন আপু আমাকে তার বাসার এড্রেস দিয়েছিল।”
“আচ্ছা।”
শুক্রবার!
অর্ষা মেরুন রঙের জর্জেটের ফোর পিচ পরে তৈরি হয়ে নিল। ম্যাচিং করে কানে দুল আর গলায় প্লাটিনামের চেইন পরল। চুলগুলো সাদা পাথরের ছোট হেয়ার ব্যান দিয়ে আংশিক আঁটকে বাকিটা ছেড়ে দিল। মুখে হালকা মেক আপ করে নিল। হাতে ঘড়ি। প্রথমে প্রিয়ার বাসায় গেল তারপর সেখান থেকে এক সাথে অর্পার বাসায়। অর্পার বাসার সামনে গিয়ে নার্ভাস হয়ে যাচ্ছে অর্ষা। কতদিন পর! প্রিয়া কলিং বেল বাজাল। তারপর দু’জন দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। একজন মহিলা দরজা খুলে দিল। ওরা ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করল। ভেতরের রুম থেকে অনেক মানুষের কথা শোনা যাচ্ছে। প্রিয়া মহিলার দিকে চেয়ে বলল,
“আমরা অর্পা আপুর সাথে দেখা করতে এসেছি। আপু কই?”
মহিলা মার্জিত ভাষায় বলল,
“ওই তো ওর রুম। যাও তোমরা।”
অর্ষা উনাকে প্রশ্ন করল,
“আপনি আপুর কে হোন?”
“আমি ওর মা।”
প্রিয়া আর অর্ষা দুজনেই উনাকে সালাম দিয়ে ভেতরে গেল। প্রিয়া আগে ঢুকল। অর্পার বেডরুমটা অনেক বড়। হল রুমের মতো। প্রিয়া ভেতরে গিয়ে আহাম্মক হয়ে গেল। বড় সোফার মধ্যে দু-তিন জন ছেলে আর ওর সাথে ওর বিছানায় একটা মেয়ে বসে আছে। ওরা নিজেদের মধ্যে হাসি-ঠাট্টা করছে। প্রিয়া বুঝতে পারছে না ভেতরে ঢুকে ঠিক করেছে কি-না। দরজা পুরো হাট করে খোলা ছিল তাই আর নক করেনি। নক করা কি উচিত ছিল? হঠাৎ প্রিয়ার চোখ আঁটকে গেল বড় সোফায় বসে থাকা তিনটা ছেলের মধ্যে একজনের দিকে। ওর বুক ধুক করে উঠল। প্রিয়া দ্রুত দরজার দিকে তাকাল। অর্ষা ইতস্তত মুখে ভেতরে ঢুকছে। ততক্ষনে অর্পা বিছানা থেকে নেমে অর্ষাকে জড়িয়ে ধরেছে। প্রিয়া আতংকিত চোখেমুখে নির্বাক দাঁড়িয়ে আছে। অর্ষা লাজুক হাসল। কিন্তু প্রিয়ার শুকনো আর থমথমে মুখের দিকে চেয়ে অর্ষার চোখেমুখে প্রশ্ন ফুটে উঠল। তাই চোখের ইশারায় প্রশ্ন করল কী হয়েছে। প্রিয়া উত্তর দিতে পারছে না। ঢোক গিলে পেছনে ইশারা করে মৃদুস্বরে বলল,
“দর্শন ভাইয়া!”
অর্ষার বুক ছ্যাৎ করে উঠল দর্শনের নাম শুনে। অর্পা সরে দাঁড়াতেই দর্শনের দিকে ওর চোখ পড়ল। ওর সারা শরীর কাঁপছে। বুকে হাতুড়ি পেটাচ্ছে। দর্শনসহ ওর দুই বন্ধু রাতুল আর তামিম বিস্মিত দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে আছে। দর্শনের চোখ অর্ষাতে নিবদ্ধ। ও কিছু বলতে পারছে না। ওর বুকের ভেতর ধুকপুক করছে। চাপা কষ্টগুলো নোনাজল হয়ে বের হতে চাইছে। ঝাপসা চোখে চেয়ে আছে অর্ষার দিকে। কত দিন, কত মাস, কত বছর পরে দেখছে! কত প্রশ্ন ছিল করার। এতগুলো বছর ধরে ভেবে এসেছে যদি দেখা হয় তবে জিজ্ঞেস করবে কেন ছেড়ে চলে গিয়েছিলে? অপরাধ কী এতটাই বড় ছিল? এত ভালোবাসা হঠাৎ তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল কেন?
কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করতে পারছে না। মনে হচ্ছে পায়ের নিচ থেকে জমিন সরে যাচ্ছে তাই স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। অর্ষার দম বন্ধ হয়ে আসছে। কখনো ভাবতে পারেনি এমন করে দুজনের দেখা হয়ে যাবে। ওর শরীর খারাপ লাগছে।
কোন রকমে বলল,
“আমার শরীর খারাপ লাগছে। আমাকে এখুনি বাসায় যেতে হবে।”
অর্ষা আর এক মুহুর্ত দাঁড়ালো না। অর্ষার পেছনে পেছনে প্রিয়াও চলে গেল। উপস্থিত সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে দর্শনের দিকে চেয়ে আছে। দর্শন দাঁড়ানো থেকে ধপ করে আবারও বসে পড়ল। অর্পা ওর দিকে একবার চেয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। প্রিয়া আর অর্ষার সাথে কথা বলতে চায় তাই ওদের পেছনে গেল। কিন্তু ওরা ততক্ষণে লিফটে ঢুকে গেছে। অর্পা ফিরে এল দর্শনের কাছে। ওর সামনে এক গ্লাস পানি ধরে বলল,
“তুই ঠিক আছিস?”
দর্শন গ্লাসটা নিয়ে এক নিশ্বাসে পুরোটা শেষ করে বড় করে শ্বাস নিল। তারপর অর্পার দিকে তাকাল। সে দৃষ্টিতে অর্পা নিদারুণ যন্ত্রণা দেখতে পেল।
“তোর সাথে ওর যোগাযোগ ছিল?”
অর্পা ওর প্রশ্নে থমকে গেল। দর্শন কী ভাবছে এসব?
“না, ওর সাথে আমার যোগাযোগ থাকলে তোকে জানাতাম না? আমরা সবাই ওকে নিজেদের মতো করে খুঁজেছি। আমার শুধু প্রিয়ার সাথে যোগাযোগ ছিল। ও আমার দেশে আসার খবর শুনে আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছিল আমি আমার বাসার এড্রেস দিয়েছিলাম। ওকে দেখে তুই যেমন সারপ্রাইজ হয়েছিস আমিও হয়েছি।”
অর্পা প্রিয়ার কাছ থেকে জানা অর্ষার ফেরার কথাটা এড়িয়ে গেল। দর্শন যদি ওকে ভুল বুঝে? তবে যাইহোক ভালোই হয়েছে। দু’জনেই জানে ওরা এক শহরে বসবাস করে।
“আমি সারপ্রাইজ নই, শকড হয়েছি। এতটা শকড হয়েছি যে মুখ দিয়ে একটা শব্দ বের করতে পারিনি। ওকে কত প্রশ্ন করার ছিল, কিন্তু আজ আমি নির্বিকার ছিলাম। কেন? কেন আমার সাথে হওয়া অন্যায়ের কৈফিয়ত চাইনি? কেন আবারও পালাতে দিলাম? হোয়াই?”
দর্শন চিৎকার করল।
দর্শন হাতের মুঠোয় রাখা গ্লাসটা আরো জোরে চেপে ধরল। মুহুর্তেই গ্লাসটা ভেঙে চুরমার হয়ে কাচের টুকরোগুলো নিচে পড়ল। কাচের টুকরোর উপরে গাঢ় লাল রক্তের ফোঁটা পড়ছে। কিন্তু সেদিকে দর্শন বেখেয়ালি।
চলবে…..