#প্রেম_তুমি
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-১৩
দর্শন কলেজে এসেই অর্ষাকে খুঁজছে। গতকাল রাতে ১১টা কল আর অসংখ্য মেসেজ করেছে কিন্তু রিপ্লাই পায়নি। সকালেও কল দিয়েছে রিসিভ করেনি। এর কারণ বুঝতে পারছে না দর্শন। তাই কলেজে এসে প্রথমেই অর্ষাকে খুঁজছে। অর্ষার ক্লাসরুমের দিকে যাচ্ছে। ওর বন্ধুদের দেখা যাচ্ছে কিন্তু ওদের জিজ্ঞেস করতে পারছে না। কথা বলতে অস্বস্তি লাগে ওদের সাথে। তাই সরাসরি ক্লাসেই যাচ্ছে। ওর ক্লাসে গিয়ে ওকে খুঁজতে লাগল। ক্লাসে নেই অর্ষা। ওকে না দেখে ওর বুকের ভেতর ধুক করে উঠল। অর্ষা ক্লাসে আসেনি কেন? অসুস্থ? কোন সমস্যায় পড়েনি তো? দর্শন আবারও ওর নাম্বারে কল দিতে দিতে ক্লাস থেকে বের হচ্ছে। দর্শন নিজের ক্লাসের দিকে যেতে যেতে হঠাৎ পুকুর পাড়ের দিকে চোখ আঁটকে গেল। ও ওখানেই দাঁড়িয়ে গেল। মোবাইলে কল কেটে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। হ্যা, অর্ষাই তো প্রিয়ার সাথে। ওর হাতে মোবাইল। দর্শন আবারও কল দিল। কল দিতে দিতে ওর দিকে এগিয়ে গেল। অর্ষা কল দেখেও মোবাইল রেখে দিল। এর মানে ইচ্ছে করেই কল ধরেনি। কিন্তু কেন? দর্শন কল কেটে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। অর্ষা ওকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠে৷ বসা থেকে দুম করে দাঁড়িয়ে গেল। দর্শন নাক সরু করে চোখ ছোট ছোট করে চেয়ে আছে। অর্ষার থমথমে মুখ দেখে দর্শনের রাগ লাগছে।
“প্রবলেম কী তোমার? গতকাল থেকে কল রিসিভ করছো না কেন? আর এখন কল দেখেও ইগ্নোর করছো। হোয়াই?”
অর্ষা থমথমে মুখে তোতলাতে তোতলাতে বলল,
“আমি আসলে…গতকাল রাতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকালে লেট হওয়ায় মোবাইল দেখা হয়নি।”
“এণ্ড নাও? এক্সপ্লেইন করো।”
“ওই, আসলে প্রিয়ার সাথে গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলছিলাম। তাই ভেবেছিলাম দু মিনিট পর কল দেই।”
দর্শন প্রিয়ার দিকে তাকাল। প্রিয়া ওর তাকানো দেখে ঘাবড়ে গেল।
“প্রিয়া, কী কথা হচ্ছিল?”
“ওই, ভাইয়া আসলে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছিলাম।”
“অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কী?”
প্রিয়া অর্ষার দিকে তাকাল। তারপর তাড়া দেখিয়ে বলল,
“অর্ষাকে জিজ্ঞেস করুন ও বলে দিবে। আমার ক্লাসের সময় হয়ে গেছে আমি নাহয় যাই।”
প্রিয়া চলে যেতে নিলে অর্ষা বলল,
“দাঁড়া আমিও তো যাব। আমারও তো ক্লাস আছে।”
প্রিয়া ওর কথা শুনে বলল,
“আগে এই ক্লাসটা শেষ কর। এটা গুরুত্বপূর্ণ বেশি।”
প্রিয়া এক প্রকার দৌড়ে চলে গেল। অর্ষা আঁটকে গেল। দর্শনের দিকে চেয়ে নিচুস্বরে বলল,
“আমি তোমাকে পরে কল করে নেব। ক্লাসে….
” রাখো তোমার ক্লাস। গতকাল রাত থেকে আজ কিছুক্ষণ অবধি এভাবে টেনশন দেওয়া আর হেনস্তা করার রিজন কী?”
“কোন রিজন নেই। আর তাছাড়া আমি কোন হেনস্তা করিনি।”
“হেনস্তা করোনি? ওকে ফাইন। তা গতকাল রাতে এমন অদ্ভুত টাইপ মেসেজ দিয়ে আমাকে কল ব্যাক করতে বাধ্য কে করল? আর কল দেওয়ার পর তুমি কী…..
অর্ষা তাড়া দিয়ে বলল,
” আমার ক্লাস!”
অর্ষা ওর কোন কথা না শুনেই ভো দৌড়। দর্শন ভ্যাবলাকান্তের মতো চেয়ে রইল। অতঃপর সে কারণ উউদঘাটন করতে সক্ষম হলো। অর্ষা গতকাল যা করেছে সেজন্য নিজেকে লুকিয়ে রাখছে৷ ওকে এভাবে ইগ্নোর করছে। দর্শন মজা করার জন্য ইস্যু পেয়ে গেল।
অর্ষা যেখানে যাচ্ছে সেখানেই দর্শনকে দেখতে পাচ্ছে। মনে হচ্ছে সারাদিন ফলো করে যাচ্ছে। তাই অর্ষা নিজ থেকে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর কোমড়ে দুহাত দিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,
“তুমি এভাবে আমাকে ফলো করছো কেন?”
দর্শন না বুঝার ভান করে বলল,
“ফলো? আমি! তোমাকে? হাউ ফানি? আমি না তোমার বয়ফ্রেন্ড? তাহলে ফলো কেন করব? যেভাবে বলছো মনে হচ্ছে আমি বখাটে ছেলে তোমাকে ইভটিজিং করছি।”
অর্ষা ভাবল ঠিকই তো। ওর কথায় যুক্তি আছে। বয়ফ্রেন্ড যদি গার্লফ্রেন্ডের পেছনে ঘুরে সেটা ইভটিজিং হয় না।
তখনই দর্শন বলল,
“হিসাব অনুযায়ী তোমার আমার পেছনে ঘোরার কথা।”
“কেন? কেন?”
অর্ষা ঘনঘন পলক ফেলছে।
দর্শন ভাব নিয়ে বলল,
“কারণ গতকাল একজন বলেছিল আমি দেখতে খুব কিউট। একটু বেশিই কিউট। আমাকে দেখলে মেয়েরা হুশ হারিয়ে ফেলে। প্রেমে পড়ে যায় ব্লা ব্লা। সেও নাকি আমার কিউট কিউট পিক দেখে দিনে পনেরো বার অজ্ঞান হয়ে যায়।”
“মোটেও না। আমি পনেরো বার অজ্ঞান হইনা।”
“আমি কী তোমার কথা বলেছি?”
“তাহলে কার কথা? কে পনেরো বার অজ্ঞান হয়?”
“ওহ আচ্ছা! তুমি! সে তুমি ছিলে? আমি কী সত্যিই কিউট?”
দর্শন বাকা হাসল। অর্ষা লজ্জা পেয়ে গাল ফুলিয়ে বলল,
“হয়েছে হয়েছে। তুমি নিজেকে যতটা কিউট ভাবছো তুমি ততটাও কিউট না। তোমার চেয়ে আমি বেশি কিউট।”
দর্শন ওর চেহারা দেখে হেসে ফেলল। তারপর ওর গাল টেনে বলল,
“অবশ্যই তুমি কিউট। কিউট না হলে প্রেমে পড়েছি।”
অর্ষা গালে হাত দিয়ে লাজুক হাসল। দর্শনের ওর লজ্জা মাখা মুখ দেখতে ভালো লাগে। তখন অর্ষাকে একদম অন্য রকম লাগে।
“তোমার লজ্জা মাখা মুখ আমার ভীষণ প্রিয় অর্ষা।”
অর্ষা আরো লজ্জা পেয়ে গেল। দর্শন ওর হাত ধরে বলল,
“চলো, ফুচকা খেয়ে আসি।”
….
দর্শন আর অর্ষা এক সাথে ফুচকা খাচ্ছে। দর্শনের ইচ্ছে করছে ওকে খাইয়ে দিতে। যেমনটা বন্ধুদের দেখেছে। কিন্তু বিষয়টা হঠাৎ বেশি নেকামো মনে হচ্ছে। আর মানুষ দেখলে কী বলবে? আর অর্ষাই বা কী ভাববে? ওদের সম্পর্কের এখনো সপ্তাহ পেরোয়নি। আলিশা ফুচকা স্টলের পেছনে দাঁড়িয়ে ওদের দেখছে। ওরা এক সাথে হেসে হেসে কথা বলছে আর ফুচকা খাচ্ছে। এই দিনটা কখনো আসবে ভাবতে পারেনি। দর্শনকে একদম আলাদা ভেবেছিল। ভেবেছিল ওর কাছ থেকে কোন মেয়েই পাত্তা পাবে না। কিন্তু কয়েক দিনের মাথায় অর্ষা ওর গার্লফ্রেন্ড। আলিশা চোখ বন্ধ করে বড়বড় নিশ্বাস নিল। তারপর আবার চোখ খুলল। ওদের থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বিরবির করে কিছু বলল।
ক্লাস শেষে অর্ষাকে অর্পা ওদের আড্ডাতে ডাকল। কিন্তু সেখানে গিয়ে দর্শনের পাত্তা পাচ্ছে না। দর্শন বন্ধুদের সাথেই কথা বলছে অথবা চুপ করে আছে। তামিম মন খারাপ করে বসে আছে। ইদানীং ও কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে। রাতুল ওকে জিজ্ঞেস করল,
“কিরে তুই চুপ কেন?”
সবাই তামিমের দিকে তাকাল। ও উত্তর দিল না। শুধু আলতো হাসল।
রুশান মসকারা করে বলল,
“আরে গার্লফ্রেন্ড চলে গেছে।”
আরেকজন বলল,
“আহারে! বেচারা।”
আরেকজন বলল,
“গার্লফ্রেন্ড যা যা নিয়েছিল ফেরত দেয়নি?”
তামিম মলিন হাসল। তারপর বলল,
“হ্যা, মন নিয়েছিল সেটা আবার ফেরত দিয়ে দিয়েছে। আর কী চাই?”
সবাই ওর কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল। দর্শন সবার দিকে বিরক্ত দৃষ্টি দিল। তারপর তামিমকে জিজ্ঞেস করল,
“কি হয়েছে বল তো? কিছুই বুঝতে পারলাম না।”
“আমার ব্রেক আপ হয়েছে।”
“ব্রেক আপ? কিসের ব্রেক আপ? তোর তো কোন রিলেশনই নাই। তুই তো সিঙ্গেল।”
“না,আসলে আমার এলাকায় আমার একটা রিলেশন ছিল। তোদের কাছ থেকে লুকিয়েছিলাম। ও আসলে আমার প্রতি এতটা অবসেস ছিল যে আমি ওকে ফেরাতে পারিনি। প্রথম দিকে অনেক সময় দিতাম কিন্তু পরবর্তীতে বুঝতে পারছিলাম আমার পড়াশোনায় ঘাটতি রয়ে যাচ্ছে। আমি পিছিয়ে পড়ছিলাম। তারপর ওকে বললাম পড়াশোনায় ক্ষতি হচ্ছে। আগের মতো এত সময় দিতে পারব না। ও আমাকে সাপোর্ট দিয়েছিল। পড়ায় মনোযোগ বাড়াতে বলেছিল। একদিন সকাল বেলায় দেখি একটা ছেলের সাথে আমাদের বিল্ডিংয়ের সামনে দিয়ে রিকশা করে যাচ্ছে। আমি তখনই কল দেই। ও বলে ওর পরিচিত একজন। দোকানে যাচ্ছিল। তখন অনেক কথা কাটাকাটি হয়। রাতের বেলায় আমাকে কল দেয় ভেবেছিলাম সরি বলবে। কিন্তু না ও বলে ব্রেক আপ করতে চায়। আমি রিজন জানতে চাইলে জানাল আমি ওকে সময় দেইনা, একজন বয়ফ্রেন্ড হিসেবে ওর জন্য যা যা করা দরকার আমি তার কিছুই করি না। ওর লোনলি ফিল হয়। আমি শুধু আমার পড়াশোনা নিয়ে থাকি। তাই ও ব্রেক আপ করতে চায়। আর যার সাথে ওকে দেখেছিলাম সে ওর নতুন বয়ফ্রেন্ড। আমি যেন ওকে আর বিরক্ত না করি। বিশ্বাস কর এই কথাটা শোনার পর আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায়। পুরো দুনিয়া এলোমেলো হয়ে গেছে। এখন আমার কিছুই ভালো লাগে না। পড়াশোনাটাও শেষ। মোট কথা আমি পুরো দমে শেষ। কিঞ্চিৎ শ্বাস প্রশ্বাস নিয়ে বেঁচে আছি।”
সবাই ওর কথা শুনে স্তব্ধ। তামিমের চোখ ছলছল করছে। যে ছেলেটা দর্শনকে সব সময় প্রেম ভালোবাসায় জড়াতে নিষেধ করত সে যে কখনো প্রেম ভালোবাসায় জড়িয়ে এত বড় আঘাত পেয়ে এসেছে সেটা ঘূর্ণাক্ষরেও কেউ টের পায়নি।
তামিম চোখের কোন থেকে পানি মুছে বলল,
“লাস্ট এক মাস আমি মানসিক অশান্তিতে ছিলাম। একটা ট্রমার মধ্য ছিলাম। ইনফ্যাক্ট এখনো আছি। এটাই কী ভালোবাসা? এই ভালোবাসার জন্য এতটা পাগলামি করেছে? সব মিথ্যে ছিল। অভিনয় ছিল। আমি বোকা ছিলাম, বুঝতে পারিনি। তোরা কেউ প্লিজ আমার মতো ভুল করিস না৷”
দর্শন অর্ষার দিকে তাকাল। অর্ষাকে ভালোবেসে ভুল করেনি তো? অর্ষা ওকে এভাবে কষ্ট দিবে না তো? অর্ষাকেও তো এতটা সময় দেওয়া ওর পক্ষে সম্ভব না। ও এইচএসসি পরীক্ষার্থী। যা ওর স্বপ্ন পূরণের অন্যতম সোপান। এইচএসসির পর মেডিকেলের জন্য অক্লান্ত যুদ্ধ। এসবের মধ্যে অর্ষাকে পাশে পাবে? না অর্ষা দূরে ঠেলে দিবে ওকে। দর্শন ওকে শান্তনা দেবে কি ও নিজেই ভাবনায় পড়ে গেছে। অর্ষার দৃষ্টি হঠাৎ দর্শনের দিকে গেল। দর্শনের এই অসহায়, চিন্তিত দৃষ্টি কিছু একটা বলছে। তামিমের পরবর্তী কথায় সবটা ক্লিয়ার হলো অর্ষার।
তামিম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“এইজন্য তোকে নিষেধ করেছিলাম দর্শন। আমি চাইনা যে ব্যথা, যে ধোঁকা আমি পেয়েছি সেটা যেন কেউ আর না পায়। কেউ যেন আমার মতো ডেস্ট্রয় না হয়।”
সবাই অর্ষার দিকে তাকাল। অর্ষা একবার আড়চোখে দর্শনের দিকে তাকাল। তারপর কাউকে কিছু না বলে হুট করে উঠে যায় আর হনহন করে হাঁটতে লাগল। পেছনে থেকে অর্পা ডেকে উঠে। সাথে দর্শনও। কিন্তু অর্ষা থামেনি। ও চলছে ওর মতো।
আগাম একটা করে বেশি পর্ব পড়তে চাইলে আমাকে এক্ষনি ফ্লো করুন ✊🖐️
চলবে…..